হীরার কথার মাথামুন্ডু আমি কিছুই বুঝলাম না।
"একটু খুলে বলতো। তোর কথা ভীষণ অস্পষ্ট মনে হচ্ছে।"
তখন সে বললো। ঘটনা হচ্ছে এই যে সপ্তাহ দুয়েক আগে হীরা আর্টস ফ্যাকালটি এলাকায় গিয়েছিল একটা কাজে। সেখানে সে হঠাৎ করে খেয়াল করলো যে এম বি এ ক্লাশে ভর্তি হওয়ার জন্য দরখাস্ত গ্রহন করা হচ্ছে। কি মনে করে সে একটি দরখাস্ত ঠুকে দেয়, এবং পরে সেখানকার ভর্তি পরীক্ষাটি দেয়।
আমি যে সময়কার কথা বলছি সে সময়ে একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আই বি এ তেই এই জিনিসটি পড়ানো হোত, এবং এখানে ভর্তি হবার জন্য যে কেউই পরীক্ষা দিতে পারতো। শুধুমাত্র গ্রাজুয়েট ডিগ্রিটি থাকলেই হোল। এখানে তখন অনেক ইঞ্জিনিয়ারেরাও পড়তে আসতেন।
যেহেতু যে কেউই এখানে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারতো, সমস্যাটি ছিল যে এই বিভিন্ন শিক্ষায় শিক্ষিতদের ভিতর থেকে বাছাই করবার মতো একটি ভর্তি পরীক্ষা তৈরী করা যা দিয়ে ভালদেরকে চিহ্নিত করা যায়। হীরা এই পরীক্ষাটিতে উত্তীর্ণ হয়েছিল।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি,"তুই কি তাহলে এম বি এ পড়বি নাকি এখন?"
"তাই ভাবছি।"
"বলিস কি? এতদিন ধরে কঠিন বিজ্ঞান সাধনা করলি, এখন সেই সব বাদ দিয়ে তুই কিনা ব্যবসায়ী হবি।"
"আমিতো বুঝিনি যে চানস পেয়ে যাবো। এখন পেলামই যখন তখন একবার চেষ্টা করেই দেখি জিনিসটা কি রকম। যদি না পোষায়, ছেড়ে দেব।"
হীরা ভর্তি হয়েছিল ইভনিং প্রোগ্রামে। সন্ধ্যেবেলা আমরা যখন বাড়ী ফিরি , তখন সে এম বি এ ক্লাশে ঢোকে। আস্তে আস্তে সে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার পড়াশুনা নিয়ে। আগের মতো আর সে অতটা কার্জন হলে সময় কাটায় না।
একদিন ধরলাম তাকে।
"কিরে তোর খবর কি?"
"মহা ব্যস্ত। পড়তে পড়তে জান বেরিয়ে যাচ্ছে। এসাইনমেন্টের পর এসাইনমেন্ট। দম ফেলারও সময় পাচ্ছিনা।"
"তুই তাহলে কন্টিনিউ করছিস।"
"তাই তো মনে হচ্ছে।"
"কেমন লাগছে তোর?"
"জিনিসটা বেশ মজার কিন্তু। আমার কাছে ভালই লাগছে।"
"শালা বেইমান।"
"গালি দিচ্ছিস কেন?"
"বিজ্ঞান ছাড়লি, গালি দেবনা?"
হীরা হাসে। "অসুবিধা নেই, গালি দে। কিন্তু মনে রাখিস- তুইও পার পাবি না।"
"তার মানে?"
"মানে হচ্ছে এই যে আর কয়েক মাস পরে ওদের ভর্তি পরীক্ষা। আর তুই সেই ভর্তি পরীক্ষাটি দিবি।"
"আমি কেন এম বি এ তে ভর্তি পরীক্ষা দেব? আমি বিজ্ঞানী।"
"ওই কথায় চিড়ে ভিজবে না চান্দু। আমি দেখতে চাই যে ওই ভর্তি পরীক্ষায় তুই টিকিস কিনা। ওই পরীক্ষা দিলে বোঝা যাবে যে তুই আসলে কতটা ভাল।"
"তোকে নিয়ে তো মহা ঝামেলা। আমি তো এম বি এ পড়বোনা। তাহলে খামাখা ভর্তি পরীক্ষা কেন দেবো?"
"আগে চান্স পেয়ে নে। তারপর বলিস যে এম বি এ পড়বি না।"
"আমি পরীক্ষা দেবো না।"
"কাওয়ার্ড।"
"কি বললি তুই?"
"আমি বললাম যে তুই একটা কাওয়ার্ড। শব্দটা কি এখন বানান করে বলবো?"
মাথার ভিতরে ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। হীরা বদমায়েশটা ভালই জানে কোন সুইচে চাপ দিলে এই আগুন জ্বলে।
আমি মুখ গম্ভীর করে বললাম,"আমার জন্যে একটা অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম নিয়ে আসিস। আমি পরীক্ষা দেব।"
হীরা তারপরও একটু খোঁচায়। "কাওয়ার্ড সাহেব দেখছি একটু রেগে গেছেন। পরীক্ষার দিন আবার পালিয়ে যাবেন নাতো?"
কয়েক মাস পরে পরীক্ষাটি দিলাম। ততদিনে আমাদের মাস্টার্সের বেশীর ভাগ ঝামেলাই শেষ। আজ পরিষ্কার মনে নেই যে ভর্তি পরীক্ষাটিতে কি কি প্রশ্ন ছিল, তবে এটুকু মনে আছে তাতে মাথা খাটানোর যথেষ্ট অবকাশ ছিল। পরীক্ষার সময়েই আমি হাড়ে হাড়ে টের পাই যে হীরা কেন আমাকে জোর করে এই পরীক্ষাটি দেওয়ালো। এটাতে পাশ করতে হলে আসলেই একজনকে যথেষ্ট বুদ্ধিমান হতে হবে। পরীক্ষার হলে বসেই হীরার প্রতি আমার সম্মানবোধ বেড়ে যায়। এই পরীক্ষাতে টেকা যেনতেন ব্যাপার নয়।
পরীক্ষা দিয়ে বাইরে এসে দেখি হীরা আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। " কি রকম হোল?"
"খোদা মালুম। যা মনে এসেছে তাই লিখেছি।"
"চিন্তা করিস না। তুই পাশ করে যাবি।"
আমি হাসি। "আমি চিন্তা করছি না তো। এই পরীক্ষায় পাস ফেল করাটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় না। তুই জোরাজুরী করে আমাকে পরীক্ষা দেওয়ালি, তাই দিলাম। এখন আমি খালাস।"
সাতদিন পর হীরা কার্জন হলে এসে আমাকে পাকড়াও করলো।
"চল-আমার সাথে।"
"কোথায় যাবো?"
"আই বি এ তে। আজ রেজালট দেবে।"
"তা দিক। আমি যাবো কেন?"
"চান্স পেলি কিনা তা দেখার জন্যে। আর চান্স পেলে আমাকে বিরিয়ানী খাওয়াবি পরে।"
"তোকে নিয়েতো দেখি আমার মহা ঝামেলা। পরীক্ষা দিয়েও আমার ছাড়ান নেই?"
"না নেই। এখন ওঠ রিকশায়।"
যেতে হোল। আই বি এ র সামনে মহা ভিড়। হীরা আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ভিড় ঠেলে ভিতরে গেল। কয়েক মিনিট পর তার হাসিমুখে আগমন।
"বলেছিলাম না যে তুই চান্স পাবি। আমি বোকাদের সাথে বন্ধুত্ব করিনা। চল গুলিস্তানে গিয়ে বিরিয়ানী খাবো। আমি দাম দেবো। খুশিতে আমার জান বেরিয়ে যাচ্ছে।"
আমি হাতজোড় করি। "দোস্ত-এইবার আমাকে মাপ কর। আমাকে তোর বিরিয়ানী খাওয়াতে হবে না। ভর্তি পরীক্ষায় টিকেছি শুনে আমার কিছু যায় আসে না। ও জিনিস তো আমি পড়বোনা।"
হীরা ধমকে ওঠে। "পড়বি না মানে? আমাকে দিয়ে অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম আনালি কেন ইডিয়েট? কত লোকে এখানে চান্স পাওয়ার জন্য ঘুরে বেড়ায়, আর উনি বলছেন পড়বেন না। তুই না, তোর ঘাড় পড়বে। সাতদিনের মধ্যে ভর্তি হতে হবে কিন্তু। টাকা কি আছে, নাকি আমি ব্যবস্থা করবো?"
আমি এখন কোথায় যাই? ভর্তি না হলে তো দেখি জান নিয়ে টানাটানি।
অগত্যা ভর্তি হলাম।
প্রথম দিন ক্লাশে গিয়ে শুনলাম, ক্লাশের আগে লাইব্রেরীতে যেতে হবে। ওমা সে কি? পড়াশুনা শুরুই হোলনা, তার আগেই লাইব্রেরী? লাইব্রেরীতে আমাদের প্রত্যেককে তিনটি বই ধরিয়ে দেয়া হোল। এই বই থেকেই সবকিছু পড়ানো হবে। টেক্সটবুকের ঝামেলাটি মিটে গেল শুরুতেই।
আমি মোহিত হয়ে গেলাম। বাহ-বেশ সুন্দর ব্যবস্থা তো!
প্রথম সেমেস্টারে তিনটি কোর্স। অ্যাকাউন্টিং, অরগানাইজেশনাল বিহেভিয়র আর বিজনেস কম্যুনিকেশন। সান্ধ্যকালীন ক্লাশ বলে ক্লাশের সিংহভাগ ছাত্ররা চাকুরীজীবি। এদের মধ্যে একজন ছিলেন সে আমলের একজন টিভি পার্সোনালিটি। আর একজন পরে সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন। এদের নাম ইচ্ছে করেই উহ্য রাখলাম।
প্রথম ক্লাশে আমি আরো মোহিত হলাম। এতদিন বিজ্ঞানের ক্লাশে যা পড়েছি, তা থেকে কত পৃথক জিনিস পড়ছি। অথচ ভারী মজা লাগছে।
ক্লাশের পর হীরার সাথে দেখা। সে মিটিমিটি হাসছে।
"কিরে কেমন লাগছে?"
"ভারী ভাল লাগছে।"
"তোকে কি আমি খামাখা ইডিয়েট বলি? আমিতো জানিই যে তোর ভাল লাগবে। তোকে ঘাড় ধরে এখানে না আনলে কি তুই আসতি?"
"থ্যাংক ইউ, দোস্ত।"
"তোর থ্যাংক ইউয়ের গুষ্টি কিলাই। চল, এখানকার ক্যাফেটেরিয়ায় যাই। ওখানে ডিম-টোস্ট বলে একটা জিনিস পাওয়া যায়। একবার খেলে তুই আর কোনদিন অন্যকিছু খেতে চাইবি না।"
কৃতজ্ঞতায় আমার চোখে জল আসে। হীরার কি দরকার ছিল আমাকে এর মধ্যে টেনে আনার? জীবনে কতবার যে আমি মানুষের কত বিচিত্র রকম ভালবাসা পেয়েছি, তা বলে শেষ করা যাবে না।
এম বি এ টি শেষ পর্যন্ত আমার আর পড়া হয়ে ওঠেনি। প্রথম সেমেস্টার এর মাঝামাঝির সময়ে বিদেশ থেকে চিঠি এলো। আমেরিকার যে স্কলারশিপটির জন্য দরখাস্ত করেছিলাম, সেটি আমি পেয়েছি।
হীরাকে জানালাম,"দোস্ত-এখন কি করি?"
হীরা বললো,"কোন সমস্যা নাই। তুই প্রথম সেমেস্টারটা শেষ কর। তারপর একটা লীভ অফ এ্যাবসেন্স এর জন্য দরখাস্ত কর। বিদেশ থেকে পি এইচ ডি টা শেষ করে দেশে ফিরে আবার শুরু করিস। এখানে আট বছর পর্যন্ত তোর অ্যাডমিশন থাকবে। এই সময়ের মধ্যে শেষ করলেই হবে।"
কয়েক দিন পর দরখাস্ত হাতে করে অফিসের দিকে যাচ্ছি। আবারো হীরা এসে সামনে খাড়া হোল।
"কোথায় যাচ্ছিস? অফিসে?"
"হ্যাঁ।"
প্রবল হতাশায় হীরা মাথা নাড়ে। "তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।"
"আমি আবার এখন কি দোষ করলাম?"
একপাশে টেনে নিয়ে হীরা আমাকে সমঝালো। তখন আইবিএ অফিসে বসতেন করিম সাহেব বলে একজন। তার মেজাজ ছিল প্রচন্ড। বদ মেজাজের জন্য সবাই তাকে টাইটেল দিয়েছিল "জেনারেল করিম"। জেনারেল করিমকে নাকি তখনকার আইবিএর ডিরেক্টর মোজাফফর আহেমেদ চৌধুরীও (সংক্ষেপে ম্যাক) সমঝে চলতেন। জেনারেল করিমের সাথে কোন ব্যাপারে দেখা করতে গেলে তার জন্যে হাতে করে কিছু একটা নিয়ে যাওয়াই নাকি দস্তুর ছিল। হীরার মতে আমি যেভাবে খালি হাতে যাচ্ছিলাম, তাতে আমার কাজতো হোতই না, বরং একরাশ বকাঝকা খেয়ে আমাকে ফিরতে হোত।
হীরার উপদেশ অনুযায়ী দামী এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে পরে গিয়েছিলাম। এবং সেই ভয়াবহ করিম সাহেব আমার সাথে মাইডিয়ার ব্যবহার করলেন। তার কলমের এক খোঁচায় আমার আবেদন মঞ্জুর হয়ে গেল।
বিদেশে চলে আসবার পর হীরার সাথে যোগাযোগ কমে গেল অনেক। মাঝে তার এক বিশাল চিঠিতে জানলাম যে হীরার বিয়ে হয়েছে। চিঠির সাথে তাদের বাগদান অনুষ্ঠানের গোটাকয়েক ছবি। হীরাকে তার ভাবী স্ত্রীর পাশে বেশ হাসিখুশী লাগছে।
আমার সামনে তখন মোটা মোটা এক হালি খোলা বই। মিড-টার্ম ঘনিয়ে আসছে। হীরাকে মনেমনে কষে গাল দেই পাঁচ মিনিট ধরে। তারপর বুকজোড়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরে যাই বইয়ের পাতায়।
দু বছর পর এক সামারে দেশে বেড়াতে এলাম। হীরা হাসিমুখে সংবাদ দিলো,"দোস্ত- আমার পড়াশুনা শেষ। এম বি এ পাশ করে ফেলেছি।"
"এখন তাহলে কি করছিস তুই? কোন্ মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানীতে জয়েন করলি?"
সে এই প্রশ্নে মনে হয় একটু লজ্জা পায়। "না, ঘটনা হচ্ছে এই যে এম বি এ তে আমার রেজাল্ট বেশ ভাল হয়েছিল। তাই ওরা আমাকে ওখানে পড়াবার জন্য একটা অফার দিয়েছিল। তাইই করছি এখন। গরীব মাস্টার।"
হীরার দিকে আমি ভাল করে তাকাই। কার্জন হলে সে ভাল ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলনা। তার জন্যে হয়তো বিজ্ঞান পড়াটাই একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। ভাগ্যিস- সে এম বি এ পড়তে গিয়েছিল, তা না হলে বোধহয় সে চিরটা কাল বিজ্ঞানের কঠিন খাঁচায় আটকে থাকতো। একজন অসুখী মানুষ হয়ে।
সেই দিন আরো একটা জিনিস আমার বোধকে নাড়া দিয়ে গিয়েছিল। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা আমাদের পছন্দসই জিনিসটি পড়তে পারিনা। পছন্দসই পেশায় যেতে পারিনা। তাতে ক্ষতিটি যে শুধু ওই মানুষটিরই হয় তা নয়। যে মানুষটির হাত দিয়ে হয়তো লেখা হোত অমর কোন মহাকাব্য, সে চিরটাকাল হয়তো কম্পিউটরের কি-বোর্ড খটখটিয়ে গেল। যে মানুষটি আমাদেরকে দিতে পারতো অর্থনীতির কোন যুগান্তকারী সূত্র, তাকে হয়তো সারাজীবন কেমিস্ট্রির ইকুয়েশনের গোলকধাঁধাঁয় পথ হারাতে হোল। কি সাংঘাতিক অপচয়!
আমি খুশী যে হীরার অন্ততঃ সে পরিণতি হয়নি। তার যেটা ভাল লাগে সেখানেই সে থাকতে পেরেছে। এখনো সে মাস্টারীই করে যাচ্ছে। ভয়ানক জনপ্রিয় শিক্ষক সে। আই বি এ র বারান্দায় সে যখন হাঁটে, তখন পোলাপানদের মধ্যে তাকে সালাম দেয়ার ধুম পড়ে যায়।
এক রোদেলা দুপুরে হীরার স্ত্রীর সাথে পরিচয় হোল চায়নিজ রেস্তোরাঁয়। তার নাম সাজিয়া।
একগাল হাসি নিয়ে সে আমাকে বললো,"অ্যাল কাপোন ভাই, আপনার কথা শুনে শুনে আমার কান ব্যথা হয়ে গেল।"
হীরা হাসে। "এই গাধাটাকে নিয়ে কি আমাদের কম সমস্যা হয়েছে সারাজীবন?"
পরম কৃতজ্ঞতায় আমার চোখ ভিজে আসে।
সাজিয়া আবার বলে,"এবার একটা বিয়ে করে ফেলেন। ওর বন্ধুদের কেউই বিয়ে করেনি এখনো। আমার গল্প করার মতো লোক নেই একটাও।"
কি সাংঘাতিক যুক্তি! সাজিয়ার একাকীত্ব কাটানোর জন্য আমাকে লেজ কাটতে হবে?
আমি হেসে বলি," আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে যে আমার খেয়ে দেয়ে আর কোন কাজ নেই? বিয়ের মধ্যে নেই আমি। পরিষ্কার কথা।"
এর কয়েকদিন পর আমি খুলনা চলে গেলাম। সেখানে অখন্ড অবসর। পরীক্ষার টেনশন নেই, লম্বা লম্বা রিপোর্ট লেখা নেই। শুধু খাই-দাই-ঘুমাই। আর বই পড়ি। মায়ের ল্যাজে ল্যাজে ঘুরি।
কিন্তু কথায় বলে, কপালের লিখন, না যায় খন্ডন। সেখানে ঘটে গেল অঘটন। কি করে যেন আমার বিয়ে হয়ে গেল। নদীর নামের একটি মেয়ের সাথে। একদম হঠাৎ করেই। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোন। কিন্তু বিয়ের মধ্যেও একটি প্যাঁচ রয়ে গেল।
যেহেতু বিয়েটা খুব তড়িঘড়ি করে সারতে হোল, বিয়ের শর্ত ছিল যে প্রথমে শুধু ধর্মীয় পর্বটি সারা হবে যাতে করে আমি আমার স্ত্রীর ভিসা ইত্যাদির যোগাড়যন্তরের কাজটি শুরু করে দিতে পারি। তিন সপ্তাহ পরে সামাজিক অনুষ্ঠানটি হবে যেখানে কন্যাদান পর্বটি সম্পন্ন করা হবে। তাই যদিও বিয়ে করলাম, কিন্তু শ্বশুরবাড়ী থেকে বৌটিকে "খোদা হাফেজ" বলে একাই ফিরে এলাম নিজের বাড়ীতে।
এর কয়দিন পর ঢাকায় ফিরে এসে প্রথমেই ফোন লাগালাম হীরাকে। সে আমার গলা শুনে মহা উল্লসিত।
"কিরে- এরই মধ্যে ঢাকা ফিরে এলি আবার? তুই না বলেছিলি মায়ের আঁচলের তলায় থাকবি অনেক দিন।"
"ঘটনা খারাপ, দোস্ত। তোর সাথে কথা বলা দরকার।"
"কি হয়েছে?"
"ফোনে বলা যাবে না। সামনাসামনি বলতে হবে।"
"ঠিক আছে। সন্ধ্যায় বাসায় চলে আয়। আজ সাজিয়া নতুন একটা রান্না ট্রাই করছে। তুই তার এক্সপেরিমেন্টের গিনিপিগ হবি।"
"সম্ভব না।"
"কেন?"
"এসব আলাপ সাজিয়ার সামনে বলা যাবেনা। তোকে একাই শুনতে হবে।"
হীরা ঘাবড়ে যায় একটু। "আবার কি ঝামেলা বাঁধালি তুই?"
"আমি ঝামেলা না বাঁধালে তুই বুদ্ধি দিবি কাকে?" ফোন কেটে দেই দ্রুত।
বিকেলে একটা চায়ের দোকানের কোণায় বসি দুজনে। হীরার মুখে উৎকণ্ঠা।
"কি হয়েছে বল।"
"আমি বিয়ে করে ফেলেছি।"
হীরা দুম করে আমার পিঠে একটা দশাসই কিল বসায়। "ইয়ার্কি করার আর জায়গা পাওনা, না? এটা সমস্যা হোল কিভাবে? শালা- এদিকে টেনশনে আমার মাথা এখনো ঝিমঝিম করছে।"
"সমস্যা আছে বলেই তো তোর কাছে এলাম। সিরিয়াসলি।"
"আচ্ছা বল তোর সমস্যাটা কি? যদি আবার ইয়ার্কি করিস তাহলে তোর পিঠের হাড়গোড় আজকে একটাও আস্ত থাকবে না।"
"আমার বিয়েটা তো অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ। মেয়েটিকে চেনাতো দূরের কথা, ভাল করে কথাও হয়নি।"
"কথা হয়নি, কথা হবে। এতে সমস্যাটা কোথায় তো বুঝলাম না।"
আমি আমতা-আমতা করি। "তুই ব্যাপারটা একটু বোঝার চেষ্টা কর। আমি চিরটা কাল মেয়েদেরকে এড়িয়ে এসেছি, আর এখন কিনা আমার ঘাড়েই সওয়ার হয়েছে এক মেয়ে। কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। কি কথা বলবো তার সাথে? একসাথে ঘুমোবো কি ভাবে? যদি সে আমাকে পছন্দ না করে? যদি সে রেগে যায়? যদি সে ঝগড়া করে? মেয়েদেরকে হ্যান্ডেল করতে হয় কিভাবে সেটাই তো জানিনা। এখন আমাদের মধ্যে বিবাহিত বলতে একমাত্র হচ্ছিস তুই। তোর কাছে তাই বুদ্ধি নিতে এলাম। দুশ্চিন্তায় আমার মাথা খারাপ হতে বাকী আছে।"
হীরা আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন। তারপর বলে,"তোর মতো গাধাকে কে যে মেয়ে দিল তাই ভাবছি।"
"ওয়েল-যা হবার তা তো হয়েই গিয়েছে। দিল্লীকা লাড্ডু গিলে বসে আছি। এখন এই ঝামেলা থেকে উদ্ধার পাওয়ার রাস্তাটা বল।"
আমেরিকাতে (এবং বোধকরি অন্য দেশেও) "ফর ডামীস" সিরিজের অনেক বই পাওয়া যায়, যাতে যে কোন বিষয়কে খুব সহজ করে আমপাবলিকের জন্য লেখা থাকে। যেমন, ইনভেস্টিং ফর ডামীস, ডিজিট্যাল ফটোগ্রাফী ফর ডামীস, ডেটিং ফর ডামীস ইত্যাদি। সেদিন চায়ের দোকানের নির্জন কোণাতে বসে হীরা আমাকে ঘন্টা দুয়েক ধরে সে সব সবক দিয়েছিল, সেগুলোকে লিখে অনায়াসে "হাউ টু বী আ হাজব্যান্ড ফর ডামীস" জাতীয় শিরোনামের একটি বই ছাপানো যেতো অনায়াসেই। কি কি সে বলেছিল, সেগুলোর বিস্তারিত এখানে বলছি না।
তার শিক্ষাদান পর্ব শেষ হলে আমার মাথা আরো বেশি ঝিমঝিম করতে থাকে। এতসব তথ্যের ভার বহন তো আমার মতো আনাড়ীর জন্যে চাট্টিখানি ব্যাপার না। বিয়ে করার যে এত বায়নাক্কা তা কে জানতো?
হীরা একটা সিগারেট ধরায়। "যাক এতক্ষণ তো অনেক লেকচার দিলাম। এবার বল, তুই কি বুঝলি?"
"বুঝলাম কাজটা করা ঠিক হয়নি। দুটো কলমা আর তিনবার কবুল বলার মধ্যে যে এতসব লুকিয়ে আছে, সেটা এখন মালুম হোল।"
"তা মালুম যখন হয়েছে, তখন তাড়াতাড়ি সবাইকে জানিয়ে দে। পার্টি হোক একটা। ভাবী ঢাকায় আসবে কবে?"
"কয়েকদিনের মধ্যেই এসে পড়বে।"
"যা বলেছি সব মনে আছে তো?"
"ওকে খুব করে ভালবাসতে হবে, সেই কথা তো?"
হীরা একটু থমকায়। "না-ভালবাসা না। তাকে তুই মায়া করবি, মমতা করবি। ভালবাসা কিন্তু রিটার্ন আশা করে। মায়া-মমতা কোন রিটার্ন আশা করে না। যত রাগারাগি হোক, ঝগড়া-ঝাঁটি হোক, মারামারি হোক, তাকে তুই মায়া করা বন্ধ করবি না। তার মুখের দিকে একবার তাকালেই যেন তোর সমস্ত দুঃখ ভুলে যাবি, এমন মায়া করবি, এমন মমতা থাকবে।"
"তাকে তো আমি ভালমতো চিনিইনা।"
"কে কাকে চেনে, বল? আমি কি আমার বৌকে চিনি? তুই কি আমাকে চিনিস? আমি কি তোকে চিনি? চেনা না চেনা নিয়ে চিন্তা করিস না। তোর শুধু একটাই কাজ। সারাজীবন যেন তুই তাকে একইভাবে মায়া করে যেতে পারিস। সে মানুষ যেমনই হোক না কেন। মনে থাকবে আমার কথাগুলো?"
আমি ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ি। মনে থাকবে।
কতদিন কেটে গেল, তবুও আজও কানে হীরার গলা ভাসে। মনে হয় এইতো সেদিনের কথা।
মাঝে মাঝে গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলে অপলকে তাকিয়ে থাকি পাশে শুয়ে থাকা মানুষটির দিকে। নদীর নামে যার নাম। কতদিন হয়ে গেল, কিন্তু আজও ওই মুখখানিকে চির নতুন বলে মনে হয়। সেই যে একদিন আমার হাতটি ধরে সে এসেছিল আমার কাছে। কতদিন হোল?
স্বল্প আলোয় তার নাকফুলটি ঝিক করে ওঠে। বুকের ভিতরে উথাল-পাথাল টের পাই। এই কি তবে সেই মায়া? নাকি মমতা? কেমন যেন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে সবকিছু। শুধু জেগে থাকে একটি মাত্র মুখ। আনন্দে আমার চোখে জল আসে। কিসের সুখে তা জানিনা।
কানের পাশে ফিসফিস করে হীরা কথা বলে চলে,"অ্যাল কাপোন-এক্সপেক্ট নাথিং। তুই শুধু মায়া দিবি, মমতা দিবি। পারবি না?"
এমন সময়গুলোতে হীরার কথা বড় বেশী মনে হয়। কতকাল তার সাথে দেখা হয়নি। তার সাথে দেখা করতে বড় ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে হয় তাকে ডেকে বলি,"শালা বিহারী-আই লাভ ইউ ম্যান।"
মন্তব্য
এই হীরা কি রাহী স্যার??
একটি লেখার চরিত্রদের কে বাস্তবে খুঁজে পাওয়া যায়না সব সময়। রাহী স্যার কে?
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
চমৎকার লাগলো দুই খণ্ডই। আমিও আইবিএ থেকে পাস করেছি। হীরা স্যারের পুরো নামটা কী? এমন মানুষটা কে জানতে ইচ্ছা হচ্ছে।
-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি
আপনার লেখার হাতটি চমৎকার জাহিদ।
হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!
আপনার কাছে থেকে এমন মন্তব্য পেয়ে খুবই ভালো লাগছে। অনেক অনেক ধন্যবাদ।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
লেখাটা চমৎকার লাগলো।
আপনাদের সময় যা ছিলো ব্যতিক্রম, এখন সে'টাই বহুল প্রচলিত রীতি। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে, দেশে চাকরি করে ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে, এম বি এ এখন একমাত্র চয়েজ।
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
আগেও পড়েছিলাম কিন্তু এমন জিনিস বার বার পড়া যায়। অসাধারণ লিখেছেন!
অসাধারণ, অসাধারণ ।
"না-ভালবাসা না। তাকে তুই মায়া করবি, মমতা করবি। ভালবাসা কিন্তু রিটার্ন আশা করে। মায়া-মমতা কোন রিটার্ন আশা করে না।"
দারুণ লাগলো এই কনসেপ্ট।
আপনার এই লেখাও খুব ভাল্লাগলো, জাহিদ ভাই।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
থ্যাংক ইউ!
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
ভালবাসা, মায়া মমতা এগুলোকে কখনো এমনভাবে ভেবে দেখিনি।
এভাবে চিন্তা করতে পারলে তো জীবনের অর্ধেক ঝামেলা কমে যায়।
সত্যি অসাধারণ।
লেখা দুর্দান্ত।
আগেই পড়া ছিল। আমি ভেবে পাইনা আপনি কেমন করে এমন করে লিখেন!
---------------------------------
তাও তো ভারী লেজ উঁচিয়ে পুটুশ পাটুশ চাও!
---------------------------------
বাঁইচ্যা আছি
সবই আপনাদের কাছ থেকে শেখা।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
নতুন মন্তব্য করুন