বাঘ।

জাহিদ হোসেন এর ছবি
লিখেছেন জাহিদ হোসেন (তারিখ: বুধ, ০২/০৯/২০০৯ - ২:৩১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

একদম কাছে না এলে তার উপস্থিতি টেরই পাওয়া যাবে না।
এখন রাত একটা-দুটো হবে নিশ্চয়ই। এমদাদ আলী লঞ্চের একদম পিছন দিকে বসে আছে। নীচু রেলিংএ পিঠ ঠেকিয়ে দু'পা ছড়িয়ে। সর্বক্ষণের সাথী দোনলা বন্দুকটি পাশে শুইয়ে রাখা। তারপাশে একটা প্লাস্টিকের মগে কিছুটা সস্তা মদ। রাত জাগতে গেলে এর চেয়ে ভালো রসদ আর নেই।

এমদাদ আলী বনবিভাগের নাইটগার্ড। সুন্দরবন এলাকাতেই তার চাকরী। প্রায় সতেরো বছর হয়ে গেল। আগে সে বেশীরভাগ সময়ে ছোট ছোট কটেজগুলো পাহারা দিতো অথবা ডিঙ্গি নৌকায় করে দেখতে যেতো কেউ চুরি করে গাছ বা গোলপাতা কাটছে কিনা।
আজকাল সে থাকে ছোট এই লঞ্চগুলোতে। নানান জায়গা থেকে বেড়াতে আসা পর্যটকদের পাহারা দেয় সে। আগের তুলনায় আরামের চাকরী। দিনের বেলায় সে বেশ খানিকটা সময় ধরে ঘুমোয়। বিকেলের দিকে উঠে চোখেমুখে পানি দেয়। ভাত-টাত খেয়ে সে একটুক্ষণ জংগলে টহল দেয়। পুরনো অভ্যেস। দৈনিক একবার অল্প একটুক্ষণের জন্যে হলেও তাকে সুন্দরীগাছের ঘ্রাণ নিতে হবে।
লঞ্চের সারেং মমিন বলে,‘সুন্দরী গাছের সাথে এমদাদ ভাইয়ের পিরীত আছে। দৈনিক একবার দেখা না দিলে সুন্দরী ভাবী গোসা হইবো।’
সেকথা শুনে সবার সাথে এমদাদও হাসে। ‘হ-কথা সইত্য। এই জংগল হইলো কলমা পড়া বৌ আমার। অহন রোজ রোজ দেখা না দিলে কাবিননামার শর্তের খেলাফ হইবো না?’

এবারের ট্রিপে এসেছে ঢাকার একটি অফিসের জনা পনেরোর একটি দল। তারা যাইই দেখে তাতেই মুগ্ধ হয়। অফিসের বড়কর্তা জামান সাহেব হৈহৈ করা ধরণের মানুষ। সবতাতেই তার ভয়ানক উৎসাহ। হরিণ দেখে হাততালি দেন বারবার। আর এমদাদ আলীকে হরিণপ্রতি পাঁচটাকা করে বখশিস দেন যেন এমদাদ আলীই ভাড়া করে এনেছে হরিণদের।

পনেরোজনের মধ্যে মহিলা পাঁচজন। একমাত্র নায়লা ম্যাডামই অবিবাহিত, বাদবাকীরা তাদের স্বামীর সাথে এসেছে। মহিলারা যে খুব একটা খুশী তা মনে হয়না, ঠেলায় পড়ে এখানে এসেছে। বেশীর ভাগ সময়ে তারা ছায়ার নীচে থাকে, আর ভিসিআর ছেড়ে হিন্দী ছবি দেখে।
দুজন লোক এসেছে খুব দামী ক্যামেরা নিয়ে। তারা সর্বক্ষণ ছবি তোলায় ব্যস্ত। পানির ছবি, গাছের ছবি, নৌকার ছবি।

এমদাদ আলী মনে মনে হাসে। আল্লাহর সৃষ্টিকে কি আর ক্যামেরা দিয়ে ধরে রাখা যায়? ওই জিনিস রাখতে হয় মাথার ভিতর, বুকের দিলের ভিতর। তারপর বহুদিন পরে একা একা বসে সেই ছবি দেখতে হয়।

রাত নামলে চারিদিক শুনশান হয়ে আসে। মাঝে মাঝে ডেকে ওঠে বনবিড়াল, শোনা যায় ময়াল সাপের মুখে বন্দী শিয়ালটির শেষ আর্তনাদ। সুন্দরবনের বাতাস ফিসফিস করে কথা কয়।

লঞ্চের অতিথীরা অবশ্য এর কিছুই শোনেনা। তারা বাতি জ্বালিয়ে খাওয়াদাওয়া করে। তার পর কয়েকজনে মিলে ডেকের উপর চেয়ার পেতে বসে খোলে বিদেশী বোতল। গ্লাসের পর গ্লাস উড়ে যায়। লোকেদের কথা জড়িয়ে আসে, তারা কিসব রসিকতা করে হো হো হেসে ওঠে।
তাদের কথা ভালমতো বোঝেনা এমদাদ আলী। সে শুধু চুপচাপ বসে থাকে লঞ্চের পিছনদিকে। কোলে শোয়ানো থাকে গুলীভর্তি রাইফেল, পাশে প্লাস্টিকের মগে সস্তা চোলাই মদ।

সুন্দরবনে দীর্ঘকাল ঘুরে ঘুরে গায়ের রং পুড়ে কয়লা কালো হয়েছে এমদাদের। সেটা একদিকে ভালই হয়েছে। এখন সে অনায়াসেই রাতের কালো অন্ধকারে মিশে যেতে পারে। নাইট গার্ডের চাকরী করতে হলে এই সুন্দরবনের ঘন কালো রাতের অংশ হয়ে যেতে হয়। একথা তার না, বলেছিল এমদাদ আলীর ওস্তাদ পিয়ারু মুনসী। চাকরী শুরু করার পর প্রথম চার বছর সে পিয়ারু মুনশীর সাথে সাথে ঘুরে বেড়িয়েছে।
কতকিছু শিখেছে সে পিয়ারু মুনসীর কাছ থেকে। চিনেছে এই সুন্দরবনের প্রতিটি আনাচকানাচ, খালের প্রতিটি বাঁক, মিঠা পানির পুকুর। চিনেছে কোথায় হরিণেরা পানি খেতে আসে, কোন গাছের কোটরে বাস করে ময়াল সাপ, কোন ডালে মৌমাছিরা গড়েছে বিশাল মৌচাক।

‘বুঝলি এমদাদ-এই জংগলরে সব সময় সম্মান করবি। মনে রাখবি যে আমরা আইজ আছি, কাইল নাই। কিন্তু এই গাছগাছালি, এই সুন্দরবন এইখানেই থাকবো আরো বহু হাজার বছর।’
‘এইডা একটা কথা কইলা ওস্তাদ? গাছগাছালিরে আবার সম্মান করার কি আছে?’
‘ওরে এই জংগলডা হইলো গিয়া আমাগো সবার মা। এই মায়ের কোলে সবাই দ্যাখ কেমুন মিলমিশ কইরা থাকে।’
এমদাদ মুখ লুকিয়ে হাসে। ‘এই জঙ্গলে থাকে বাঘ আর হরিণ। এগো মইধ্যে তুমি আবার মিলমিশ কই দ্যাখলা ওস্তাদ?’
পিয়ারু মুনশী একথায় কেমন যেন উদাস হয়ে যায়। নোনা বাতাসে তার লম্বা সাদা চুল দাড়ি ফুরফুর করে ওড়ে।
‘বাঘে আর হরিণে মিলমিশ আছে রে পাগল, মিলমিশ আছে। হরিণ আছে বইলাই বাঘও আছে। হরিণ না থাকলে বাঘ থাকতো কেমনে?’
এমদাদ তখন ঠাট্টা করে। ‘ওস্তাদ-তোমার এই সুন্দরবনের গার্ড হওয়া উচিত হয় নাই। তোমার বাউল হওনের উচিৎ ছিল। বন্দুক থুইয়া তোমার হাতে নেওনের দরকার ছিল দোতারা। সারাদিন শুধু বইয়া বইয়া মারফতী গান বান্ধতা। তোমার গানে কুল মাখলুকাত মাতীয়ারা হইয়া যাইতো।’
‘এই কথাডা তুই ঠিকই কইছস এমদাদ।’

প্রতিদিন আসরের নামাজ পড়ে জায়নামাজেই বসে থাকতো পিয়ারু মুনশী। একেবারে মাগরিব শেষ করে তারপর উঠতো সে। এই সময়ে চলতো গুরুশিষ্যের কথাবার্তা।
আজকাল সেই দিনগুলো বড্ড মনে পড়ে এমদাদ আলীর। জায়নামাজে গুরুর পাশে বসে সে রাইফেলটি পরিষ্কার করতো রোজ। সাদা ধবধবে লুংগী আর একটা খাকী জামা পরে নামাজ পড়তো পিয়ারু মুনশী। সুন্দরবনে বেশী রংগীন কাপড় পরা নিষেধ। কে জানে কার নজর পড়ে।

‘বুঝলি এমদাদ-খোদার বানানো এই সুন্দরবন। খেয়াল কইরা দ্যাখ-সবাই কেমন কেমন নিজের নিজের কাজডা করতাছে। ওই দ্যাখ-মৌমাছি বানায় কত বড় বড় মৌচাক। তার জন্যে আল্লাহপাক কত সুন্দর ফুল দিছে। হরিণের জইন্য দিছে কেওড়া ফল। সাপের জইন্য বানাইছে ইন্দুর। আবার বাঘের জইন্য দিছে হরিণ।’
এমদাদ আলী নিঃশব্দে হাসে। পিয়ারু মুনশীর এখন বয়াতী হওনের টাইম।
‘কিন্তু আল্লাহর বাইন্ধা দেয়া নিয়ম কি সবাই শুনে? শুনে না। সেইজইন্যেই আমাগো ডাক পড়ে। আমরা কেউ নিয়ম ভাংলে তারে বাইন্ধা আনি।’
‘কি রকম, ওস্তাদ?’
‘এই দ্যাখ- মানুষেরা আইসা চুরি কইরা গোল পাতা কাটে, গাছ কাটে। ঠিক কাম না। তহন আমরা আসি। বাঘে যদি হরিণ খায়, সেডা ঠিক আছে। আল্লাহর নিয়ম। কিন্তু বাঘে যদি মানুষ খায়, তাইলে সে আল্লাহর নিয়ম ভাইংগা দিল। তখন সে শয়তানের কথা শুনলো। তহন আমরার ডাক পড়ে।’
‘এইডা অবশ্য ঠিক কথাই কইছো ওস্তাদ।’
‘বাঘে যহন মানুষ খাওয়া ধরে, তহন তার মুখে আর কিচ্ছু স্বাদ লাগে না। সে শুধু মানুষই খাইতে চায়। শয়তানের আছরে পইড়া বাঘ তহন আল্লাহর বিধানরে ভুইলা যায়। এই জীবনে মেলাবার বাঘের সামনা সামনি হইছি, কোনদিন বন্দুক তুলি নাই। মনে মনে তারে কইছি, গাজীর বেটা-তুমি হইলা এই বনের রাজা। তোমারে আমি সালাম দেই। গাজীর বেটা কি আমারে কোনদিন কিছু কইছে? না-কিচ্ছু কয় নাই, চুপচাপ তার কামে চইলা গেছে। শুধু একবার রাইতের বেলা পড়ছিলাম এক মানুষখোরের সামনে। রাইতের বেলার সব গাজীর বেটার চোখে সবুজ আলো জ্বলে। ক্যান জানোস?’
এমদাদ আলী মাথা নাড়ে।
‘এই আলো আল্লাহপাকের দেওয়া জিনিস। সবুজ রং ছিলো আমাগো রসুলের পেয়ারের রং। কিন্তু ওইদিন ওই শয়তানের চেলার চোখে আমি সবুজ আলো দেখি নাই। দেখি সেইখানে জ্বলে লাল আলো, এইডা হইলো শয়তানের দেওয়া জিনিস। ওই মানুষখোরের ভিতরে তখন আর মায়া-দয়া নাই। সে তহন আর ঠিক-বেঠিক বুঝে না। তার মাথা আউলা হইয়া গেছে।’
‘তারপর কি হইলো ওস্তাদ?’
পিয়ারু মুনশী এবারে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
‘আমার যা ডিউটি তাইই করতে হইলো। আস্তে আস্তে রাইফেল তুললাম। লাগাইলাম নিশানা। মনে মনে কইলাম-গাজীর বেটা, তুমি এই জংগলের নিয়ম ভাংছো। তুমি শয়তানের কথা শুনছো। এহন আমারে আমার কর্তব্য করতে হইবো। তুমি আমারে মাফ কইরা দিও।’
‘তারপর?’ এমদাদ আলী রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করে।
পিয়ারু মুনশী ম্লান হাসে। ‘দুইচোখের মাঝখানে গুলী করছিলাম। এক গুলীতেই শেষ। পরে শুনছিলাম যে তেরোজনরে খাইছিলো এই শয়তানের চেলা। আমি সেদিন তারে না মারলে আরো কতজনরে যে খাইতো আল্লাহ মাবুদ জানে।’

পাশে রাখা মগটি হাতে নেয় এমদাদ আলী। অল্প চুমুকে মদ খায়। নীলকমলের হরিপদর বানানো জিনিস। বড় তেজী জিনিস। এক চুমুকে সারা শরীর ঘেমে ওঠে। মদ তো না, যেন তরল আগুন নেমে যায় কণ্ঠনালী দিয়ে।

আজকাল পিয়ারু মুনশীর কথা খুব মনে পড়ে এমদাদ আলীর। লোকটা কি সব অদ্ভূত কথা বলতো। সব কথা বিশ্বাস যায় না এমদাদ আলী, তারপরেও কোথায় যেন একটা যথার্থতা আছে কথাগুলোর মধ্যে। এই সুন্দরবনের মধ্যে এলে লোকালয়ের অনেক কিছুই মিথ্যে হয়ে যায়, আমাদের জানা জিনিসগুলোকে মনে হয় অবিশ্বাস্য, আর অবিশ্বাস্য কথাগুলো সত্যি বলে ভাবতে ইচ্ছে করে।

এখন তাদের লঞ্চটি একটি খাঁড়ির মধ্যে নোঙর করা। গতকাল পাটকোষ্ঠা ফরেস্ট অফিস থেকে রওনা দিয়ে হংসরাজ নদী দিয়ে এসেছে তারা। সুন্দরবনের এইদিকটিতে অনেকগুলো নদী, খাল। তাদের নাম শুনে লঞ্চের অতিথীরা হেসে গড়িয়ে পড়ে।
‘হাউ ফানি! খালের নাম কেওড়াশুঁটি।’

এজাতীয় কথা আগে শোনা আছে এমদাদ আলীর। সে চুপচাপ জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে থাকে।

আজকে আবহাওয়া ভালো না। ছোট আকারের ঝড় ওঠার সম্ভাবনা আছে। তাই লঞ্চটিকে একটি মাঝারী ধরণের খালের ঠিক মাঝখানে নোংগর ফেলে বাঁধা হয়েছে। রাতের বেলায় এইরকম ভাবে লঞ্চ বাঁধা ঠিক না। মানুষের গন্ধ পেয়ে পাড় থেকে লাফ দিয়ে চলে আসতে পারে মানুষখেকোটি। শয়তানের আছর পড়া, নষ্ট হয়ে যাওয়া গাজীর বেটা।

এমদাদ আলী অন্ধকারে মধ্যে নড়েচড়ে বসে। কত বছর ধরে সে রাতের গায়ে হেলান দিয়ে চুপচাপ প্রতীক্ষা করে আছে। কিন্তু এই মানুষখেকোটিকে সে ওই একবারই দেখেছিল। তাও মাত্র একমুহুর্তের জন্যে।

সেদিনও আসরের নামাজ পড়ে অনেক কথাই বলেছিল পিয়ারু মুনশী। ঠিক এইরকম একটি খালের মাঝখানে বাঁধা ছিল তাদের নৌকা। সন্ধ্যে তখন নামে নামে। জায়নামাজের উপর দাঁড়িয়ে পিয়ারু মুনশী তাকবির দিলো। ‘আল্লাহু আকবার!’
এমদাদ আলী হ্যারিকেনের কাঁচ পরিষ্কার করছিল পিছন ফিরে। হঠাৎই দুলে উঠলো নৌকা। পিয়ারু মুনশীর গলা শোনা গেল একবার,‘ইয়া আল্লাহ!’

এমদাদ আলী ঝটিতে পিছনে ফিরে দেখলো কেওড়া গাছের আড়ালে চলে যাচ্ছে হলুদ-কালো ডোরা বাঘের শরীর। তার মুখে পিয়ারু মুনশীর নিস্প্রাণ দেহটি ঝুলছে।
গত সাতটি বছর ধরে এমদাদ আলী প্রতীক্ষায় আছে। সে জানে, একদিন না একদিন সে ওই নষ্ট হয়ে যাওয়া হারামজাদার মুখোমুখি হবেই। সে তখন দেখবে যে ওই গাজীর বেটার চোখে কোন রঙ্গের আলো জ্বলে। সেই আলো কি সবুজ নাকি লাল? তারপর সে নির্ভয়ে বন্দুক তুলবে। নিশানা লাগাবে ঠিক দুই চোখের মাঝখানে।

প্রতি রাতে রাইফেলটিতে হাত বুলাতে বুলাতে এমদাদ আলী ওই একই কথা ভাবে।

‘এ আপনি কি করছেন স্যার?’ অন্ধকারের মধ্যে কে যেন ফিস ফিস করে কথা কয়। এমদাদ আলী ঘাড় উঁচু করে তাকায়।
ডেকের উপর একটি নারীমূর্তি। গলার শব্দে এমদাদ আলী তাকে চিনে ফেলে। নায়লা ম্যাডাম।
পাশে এসে দাঁড়ায় আরো একজন। ‘তুমি এমন করছো কেন নায়লা? তুমি কি আমাকে পছন্দ করোনা?’
পুরুষের গলার স্বরটি ঈষৎ জড়ানো। তবু তাকে চিনে ফেলে এমদাদ আলী। সবার বস জামান সাহেব।
‘আপনি কি জানেন যে আপনি কি করছেন? সবাই দেখলে কি ভাববে? ভাবী দেখলে কি ভাববে?’
‘নায়লা-তোমার ভাবী এখন নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। লেটস হ্যাভ সাম ফান। চলো তোমার ঘরেই যাই।’
‘স্যার-প্লিজ। আপনি স্বাভাবিক নেই এখন। ঘরে যান প্লিজ।’
‘ওহ-কাম অন, নায়লা। আমি তোমার বস, আমার কথা শুনতে হয়। এতদিন চাকরি করে এই ছোট্ট জিনিসটা জানো না?’
‘স্যার-প্লিজ, আপনাকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি। আপনি এমন ভাবে কথা বলবেন না।’
‘শ্রদ্ধা করো, এটা খুব ভালো কথা। আজকে তুমি আমাকে এর সাথে ভালও বাসবে।’
নায়লা ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে।
‘স্যার- আপনি আমার এত বড় সর্বনাশ করবেন না।’
‘এতে সর্বনাশের কি হোল। ইউ আর নট দ্য ফার্স্ট ওয়ান। এর আগে যে মেয়েগুলো চাকরি করছে তাদের তো কোন সর্বনাশ হয়নি। বরং পরে প্রমোশন পেয়ে তারা আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছে। কাম অন-নায়লা, দিস ইজ টুয়েন্টিফার্স্ট সেঞ্চুরী। দিস ইজ পার্ট অফ দ্য জব।’

জামান সাহেব ঘুরে দাঁড়িয়ে নায়লার কাঁধে হাত রাখেন। অন্ধকারের মধ্যে এমদাদ আলী জামান সাহেবের মুখ দেখতে পায় না। শুধু তার নজরে আসে একজোড়া চোখ। যা লোভে চকচক করছে। সে চোখে জ্বলছে লালচে একটি আভা।

সুন্দরবনের ঘন কালো রাতের অন্ধকারে এমদাদ আলী সোজা হয়ে বসে। তারপর সে আস্তে আস্তে রাইফেলটি হাতে তুলে নেয়।

ফিসফিস করে বলে,"এহন আমারে আমার কর্তব্য করতে হইবো। তুমি আমারে মাফ কইরা দিও।’


মন্তব্য

জাহিদ হোসেন এর ছবি

সুন্দরবনের উপর নজরুল আর মুস্তাফিজ ভাইয়ের লেখা আর ছবি দেখে এই গল্পটি মাথায় এলো। কেমন হলো খোদা জানেন।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

হরেকৃষ্ন এর ছবি

ভাল লেগেছে! পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম 'নির্বাসিতের আপনজনে' তো আপনার সুন্দরবনে যাওয়া হয় নাই, এগল্প আপনি কিভাবে লিখলেন। মুস্তাফিজ ভাইয়ের লেখা আর ছবি আমিও দেখেছি, ভাল লেগেছে। এখন বুঝেছি আপনার তৃতীয় নেত্রের দৃষ্টি বেশ প্রখর। গতকাল 'অতিথি লেখকের' ঢাকার খারাপ অভিজ্ঞতাকে যাঁরা তার নিজের দোষের ফলে হতে পারে ভেবেছিলেন, আপনার গল্পটির ওপর তাদের মন্তব্য দেখার অপেক্ষায় রইলাম।

জাহিদ হোসেন এর ছবি

আপনার কথা সত্য, আমি জীবনেও কোনদিন সুন্দরবনে যাইনি। তবে আপনার মন্তব্য পড়ে একটা পুরনো গল্প মনে পড়লো। একবার সৈয়দ হককে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে গোটা মুক্তিযুদ্ধের সময়টি লন্ডনে কাটিয়ে তিনি কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের উপর গল্প-কাহিনী লেখেন। উত্তরে সৈয়দ হক পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন যে কারবালার যুদ্ধ না দেখে যদি মীর মোশাররফ হোসেন 'বিষাদ-সিন্ধু' লিখতে পারেন, তাহলে তার একই অপরাধ হবে না কেন। আসলে মূল কথাটি হোল এই যে গাঁজার নৌকাকে পাহাড় পার করতে নৌকাও লাগেনা, পাহাড়ে যাওয়াও লাগেনা। সুন্দরবনের উপরের সাম্প্রতিক লেখা-ছবি দেখেই মনে হোল বাঘ-টাঘ নিয়ে কিছু একটা লিখিনা কেন।
আপনার মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_প্রজাপতি এর ছবি

চমৎকার লাগলো জাহিদ ভাই, আপনার মনেও সুন্দরবনের হাওয়া লেগে গেছে।

------------------------------------------------------
ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা ...

ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা ...

মৃত্তিকা এর ছবি

শুরুটা সাদামাটা গল্প লাগছিলো, অর্ধেকের পর থেকে ভালো লাগছিলো আর শেষে এসে খুব ভালো লাগলো!
ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর সুন্দর গল্প উপহার দেবার জন্য।
______________________________
সামনে যদি যাবি ওরে, থাক-না পিছন পিছে পড়ে।

জাহিদ হোসেন এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ, প্রজাপতি আর মৃত্তিকা! লেখা ভালো লেগেছে জেনে খুশী লাগছে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

সাইফ তাহসিন এর ছবি

জাহিদ ভাই, এবারে দেখি নজরুল ভাই, মুস্তাফিজ ভাই এবং সাজিয়ার লেখা আপনাকে এই গল্পটা লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে। তবে পাঞ্চলাইন ছিল চরম। আপনে যে নমস্য, তা আবার টের পেলাম, আর স্যালুট ঠুকে গেলাম আপনাকে। লেখাটা বেশ বড় কিন্তু টের পাইনি, কোনদিক দিয়ে শেষ হল। গুরু গুরু

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

হরেকৃষ্ন এর ছবি

শুরু হয়ে আসলেই কখন শেষ হল টের পাই নাই।

সাইফ তাহসিন এর ছবি

তাহলে দাদা আরেকবার পড়ুন না কেন? চোখ টিপি

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

হরেকৃষ্ন এর ছবি

মিষ্টি বেশি খেলে ডায়াবেটিস হয় জানেন না?

সাইফ তাহসিন এর ছবি

মিষ্টি বেশি খেলে ডায়াবেটিস হয় জানেন না?

দাদা, এই তথ্য কই পাইলেন?

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

হরেকৃষ্ন এর ছবি

মূখ্যুসুখ্যু মানুষ! মাইনষে কয়, শুনি। ভুল হইলে মাফ কইরা দেন।

হরেকৃষ্ন এর ছবি

মাইনষে কয়, শুনি। মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, ভুল হইলে মাফ কইরা দিয়েন।

জাহিদ হোসেন এর ছবি

ভাই সাইফ-আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। স্যালুট-ট্যালুট পেলে নিজেকে কিরকম সৈনিক-সৈনিক মনে হয়। মনে হয় এক্ষুণি ডাক পড়বে যুদ্ধক্ষেত্রে। ভাল থাকুন।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

মামুন হক এর ছবি

একটু নাটকীয় জাহিদ ভাই, বিশেষ করে নায়লা আর তার বসের ডায়লগ গুলো।
তবে শক্তিশালী মেসেজের কারণে গল্পটা উতরে যাবে।

জাহিদ হোসেন এর ছবি

আপনার সাথে একমত। ঘটনা হচ্ছে এই যে আমি নিজের জালে নিজেই আটকা পড়ে গিয়েছিলাম। অনেক বছর ধরে মানুষখেকোর প্রতীক্ষায় থাকা এমদাদ আলীকে দিয়ে মানুষ মারানোর জন্যে একটু চড়া সুরের নাটক আমদানী করা ছাড়া আর কোন পথ খোলা ছিলনা আমার।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

কীর্তিনাশা এর ছবি

গল্পটা কোনদিকে যাবে বুঝে গিয়েছিলাম আগেই। হাসি

তবে ভালো লেগেছে। চালিয়ে যান জাহিদ ভাই চলুক

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

শেষটা হয়েছে চমৎকার, তবে কথোপকথন শুনে বেশ আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছিলো। সেক্ষেত্রে জাহিদ ভাই পিয়ারু এবং এমদাদের (মানে পিয়ারুর বাঘ শিকারের অংশটা) পরে বললেও পারতেন...

আপনার কাছে চাওয়া বেশি- বোঝেন তো দেঁতো হাসি
---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!

জাহিদ হোসেন এর ছবি

কীর্তিনাশা আর আপনার চোখে ধূলো দেওয়া কঠিন। চাওয়ার মাত্রা কমানো যায়না একটু? সীজনাল লেখালেখির মানুষ আমি। দেখি পরের লেখাতে আরও ট্যাক্টফুল হওয়া যায় কিনা।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

না ভাই, চাওয়ার মাত্রা কমামু না। আমি তো আসলে মূলত গল্পই পড়ি,তাই সচলের ভালো গল্পকারদের প্রতি দাবি একটু বেশীই রাখি...
---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!

স্বপ্নহারা এর ছবি

ব্যাপক ভাল লাগছে!
-------------------------------------------------------------
স্বপ্ন দিয়ে জীবন গড়া, কেড়ে নিলে যাব মারা!

-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...

অতিথি লেখক এর ছবি

শুধু বাঘ মানুষ খায় এটা ঠিক না, মানুষও মানুষ খায়, সেটাই বুঝে গেলো জাহিদ ভাইয়ের অসাধারণ লেখার মাধ্যমে।

জাহিদ হোসেন এর ছবি

বাঘ আর কয়টা মানুষ খায় বলেন? মানুষই মানুষকে বেশী খায়।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

মুস্তাফিজ এর ছবি

সচলে তো ভালোই সুন্দরবন ফোবিয়া চলতাছে।
চলেন সবাই মিলে আবার যাই। হাসি

ভালো কথা, গল্প ভালো লাগছে।

...........................
Every Picture Tells a Story

জাহিদ হোসেন এর ছবি

থ্যাংক ইউ মুস্তাফিজ ভাই!
আপনাদের লেখা আর ছবি দেখেইতো মনের ভিতর কেমন একটা সুন্দরবন সুন্দরবন ভাব এসে গেল। আশাকরি আমার বর্ণনায় তেমন ভুল নেই। ওই জায়গার নামটামগুলো আপনাদের লেখা থেকেই নেওয়া। যদিও জন্মশহর সুন্দরবনের কাছেই, কিন্তু সুন্দরবনে যাওয়া হয়নি কখনোই।
আপনার তোলা গার্ড এমদাদ হোসেনের একটি ছবির দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম যে এই লোকটিকে নিয়ে একটি গল্প লিখলে কেমন হয়। এই লেখাটির উৎপত্তি এভাবেই।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

অসাধারন!!! চলুক

ভুতুম এর ছবি

আপনার লেখায় আর কমেন্ট খুঁজে পাই না। পুরনো কমেন্টগুলো সব একটু কষ্ট করে পড়ে নিয়েন এইটার কমেন্ট হিসেবে।

-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি

-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি

জাহিদ হোসেন এর ছবি

মন্তব্যে মজা পেলাম। ধন্যবাদ।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

বইখাতা এর ছবি

ভালো লেগেছে, তবে আপনার আগের আরো কিছু লেখা ( ’চুমুক’, ’ওরা’, ’বাউল’ ইত্যাদি) আরো অনেক বেশি ভালো লেগেছিলো, সেই তুলনায় এ গল্পটা আমার এতোটা ভালো লাগেনি। বিশেষ করে শেষের অংশটা তাড়াহুড়া করে শেষ করা মনে হলো।
আপনার কাছে প্রত্যাশাটা আসলে একটু বেশি হয়ে গেছে যে ! হাসি

জাহিদ হোসেন এর ছবি

নিজের তৈরী করা প্রত্যাশার জালে মনে হয় নিজেই আটকে গেছি। বেরোনোর পথ খুঁজছি। আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

শেষে এসে খুব ভাল্লাগল হাসি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এইবার বুঝলাম
সুন্দরবনের বাঘ শুধু ঘাড়ই মটকায় না
মগজও মটকায়

জাহিদ হোসেন এর ছবি

এই বাঘ গাঁজায় দম দিয়ে আমদানী করা কাগুজে বাঘ। এ না পারে হেন জিনিস নেই।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

ফাহিম এর ছবি

অসাধারান লাগলো...

=======================
ছায়ার সাথে কুস্তি করে গাত্রে হলো ব্যাথা!

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।