প্যাঁচালঃ জেমস জয়েস আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন লেখক। আধুনিক সাহিত্যের prose-এ যে তিনজনকে ভিত্তিমূল ধরা হয় - দিদেরো, প্রুস্ত, আর জয়েস, তিনি তাঁদের একজন। তার গল্পগ্রন্থ ডাবলিনার্স কে যদিও তাঁর পরবর্তী কাজের তুলনায় অনেক কম গভীরতাসম্পন্ন মনে করা হয়, এও ঠিক, ছোটগল্প বা গল্পের ভাষা, বিষয়বস্তু সর্বোপরি এপিফ্যানির যে প্রয়োগ, এসবে, তিনি একাই বিংশ শতকের সাহিত্যের ধারা বদলে দিয়েছেন। ইউলিসিস, ফিনেগান্স ওয়েক, অ্যা পোর্ট্রেইট অফ অ্যান আর্টিস্ট এ্যজ অ্যা ইয়াং ম্যান, এইসবি অসাধারণ সৃষ্টি। ফিনেগান্স ওয়েকে তিনি নিজস্ব বানানরীতি, শব্দতৈয়ারের শেক্সপিয়ারীয়ান মুন্সিয়ানা দেখিয়ে এটারে দূর্বোধ্যতমো উপন্যাসে পরিণত করসেন এবং এও বলসেন মাইনষের এইটা বুঝতে আরো শ তিনেক বছর লাগবো। আমার এই অনুবাদ ২০০৩ এ করা। কিছু বানান ঠিক করা ছাড়া আর কিছুই ধরলাম না। তখন দুঃসাহসী ছিলাম বলেই এই কাম করতে পারছিলাম। নাইলে জয়েস লোকটা হারামী। এই গল্পের আরো দুইটা অনুবাদ হইসিলো আমি করবার আগে। বাংলাদেশ থেকে একটা, পশ্চিমবঙ্গ থেকে একটা। এই তথ্য আমি অবশ্য অনেক পরে আমার শ্রদ্ধেয় জি.এইচ. হাবীবের কাছ থেকে পাই। গত শতকের সবচেয়ে প্রভাববিস্তারকারী সাহিত্যিক হিশাবে গণ্য করা হয় এঁরে। যারা তাঁরে পাঠ করেন নাই, আশা করি করবেন।
***************************************************
***************************************************
যে রাস্তাটি যেতে যেতে একজায়গায় শেষ হয়ে গেছে, ক্রিশ্চিয়ান ব্রাদার্স স্কুল হতে ছেলেরা যখন ছাড়া পেত - সে সময়টুকু ছাড়া, সেই অন্ধকার নর্থ রিচমন্ড স্ট্রিট-কে শান্ত-ই বলা যায় বাকিটা সময়। দোতলা নির্জন একটি বাড়ি, প্রতিবেশীদের হতে বিচ্ছিন্ন অবস্থায়, রাস্তার শেষ মাথার একটি বর্গাকার জমি দখল করে দাঁড়ানো। আর রাস্তার বাকি বাড়িগুলো, যাদের প্রতিবেশী বলা হচ্ছে, নিজেদের অন্তর্গত অভিজাত প্রাণগুলোর প্রতি যথাযথ সম্ভ্রমপূর্ণ সচেতনতা বজায় রেখেই একে অপরের বাদামি অচঞ্চল মুখমন্ডলে তাকিয়ে থাকতো নির্বিকার।
আমাদের বাড়ির আগের যে ভাড়াটে, একজন ধর্মযাজক, তিনি পিছনের ড্রয়িংরুমটিতে মারা গিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন দেয়ালগুলোয় সংগ্রথিত হয়ে থাকায় যে বাতাস ছেতো হয়ে গিয়েছে, তা - সবকটা কামরাতেই ঝুলে থেকে থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। রান্নাঘরের পেছনে আবর্জনা-ঘরটি অকাজের পুরনো কাগজপত্রে ভরা। এইসবের মাঝে কিছু কাগজমলাটযুক্ত বই খুঁজে পাই, সেসব বইয়ের পাতাগুলো স্যাঁতস্যাঁতে, কোঁকড়ানো: ওয়াল্টার স্কটের দি অ্যাবট, দি ডিভাউট কম্যুনিক্যান্ট ও দি মেমোইরস্ অফ ভিডক্। এই শেষ বইটি আমার সবচেয়ে ভালো লাগতো, এর পৃষ্ঠাগুলো বিবর্ণ হলুদ বলেই হয়তো। বাড়ির পেছনে বুনো বাগানটির মাঝখানে একটি আপেল গাছ, আর এর চারিদিকে বিশৃঙ্খলভাবে বেড়ে ওঠা ঝোপঝাড়, সেসবের কোনো একটির নিচে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম প্রয়াত ভাড়াটের মলিন জং-ধরা বাইসাইকেল-পাম্প। এই ধর্মযাজক লোকটি, যদ্দূর মনে হয়, বেশ দয়ালু ও দানশীল ছিলেন; উইলে যাবতীয় পয়সা-কড়ি একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে দান করে গেছেন, আর ফার্নিচারগুলো একমাত্র বোনকে।
শীতের স্বল্পায়ু দিনগুলোতে অনেক আগেই সন্ধ্যা হয়ে যেত। আমাদের যখন দেখা হতো, তখন, ইতোমধ্যেই, রাস্তার বিষণ্ণ মলিন বাড়িগুলো অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেছে। যেটুকু আকাশ আমরা দেখতে পেতাম, সবসময়ই বদলে যেতে থাকা ভায়োলেটের মতো ছিলো তার রং, আর রাস্তার দূর্বল বাতিগুলোর ক্ষীণ আলো সেই ভায়োলেটরঙা আকাশকে স্পর্শ করবার এক অসম্ভব চেষ্টা করতো, এক অসম্ভব চেষ্টা। ঠান্ডা শীতল বাতাস সূঁচের মতো আমাদের ছুঁয়ে যেত, আর আমরা সেই বাতাসেও ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে না আসা পর্যন্ত খেলে যেতাম। নির্জন রাস্তায় আমাদের চিৎকার, হৈ-চৈ কোথাও যেন ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ফিরে আসে। আমাদের খেলার বয়স কিংবা সেসময় শুধুমাত্র সামনের দিকে ছুটে চলা এক দুর্দান্ত গতি বাড়িগুলোর পেছনে কাঁদাটে সরু গলিগুলোয় আমাদের নিয়ে যেত, সেখানে অবস্থিত কুঁড়েঘরগুলো হতে প্রচন্ড ঝুকি নিয়ে আমরা দৌড়াতাম - ধীরে ধীরে অন্ধকারে ঝরে পড়া বাগানের পেছন-দরজায়, যেখানে ছাই ফেলার গর্ত থেকে ভেসে আসে অদ্ভুত গন্ধ, অথবা সুবাসিত অন্ধকার নেমে এসেছে এমন কোনো আস্তাবলে, যেখানে গাড়োয়ান ঘোড়ার গায়ে চিরুণী চালিয়ে চালিয়ে পশমগুলো মসৃণ করছে অথবা ঘোড়ার সাজ পরাতে গিয়ে অদ্ভুত সুর ছড়িয়ে দিচ্ছে সান্ধ্যবাতাসে। খেলা শেষে ফিরে আসতাম যখন, রান্নাঘরের জানালা দিয়ে ভেসে আসা আলোয় রাস্তার অনেকটা ভ'রে থাকে। মামাকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখলে চট করে রাস্তার কোনো অন্ধকার কোণে লুকিয়ে পড়তাম; যতক্ষণনা তিনি ঘরে অন্তর্হিত হতেন, ততক্ষণ সেখানেই থাকতে হতো। আর যদি কখনো ম্যাগেনের বোনটি তাদের দরজার গোড়ায় দাড়িয়ে ম্যাগেনকে চায়ের জন্যে ডাকে, রাস্তার অন্ধকার কোণা হতে তাকে উঁকি মেরে মেরে দেখতাম আমরা। সে ভেতরে চলে যাবে, নাকি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকবে - এই দুটির যেকোনো একটির জন্যে প্রতীক্ষায় অন্ধকার কোণায় আমাদের দাঁড়ানোর সময় দীর্ঘায়িত হতো, এবং যদি দেখতাম সে দাঁড়িয়েই আছে, তাহলে, ধীরে ধীরে, অনেকটা হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে, সেই অন্ধকার কোণ ছেড়ে আমরা বেরিয়ে আসতে থাকি। সে আমাদের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকতো, আধখোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসা আলোয় তার অবয়ব, চেহারা অনেক স্পষ্ট দেখা যায়। বোনের কথা মেনে নেয়ার আগ পর্যন্ত ম্যাগেন তার সাথে গোয়ার্তুমি করে যায়, আর আমি রেলিঙে ভর দিয়ে, অনেকটা নিরুত্তাপভাবে, তার দিকে তাকিয়ে থাকি। ঘুরে যাওয়ার সময় তার কাপড় দুলে উঠতো, তার নরোম চুলের গুচ্ছ ঘাড়ের একদিক হতে অন্যদিকে একেঁবেঁকে দোলে।
প্রতি সকালে তাদের দরোজায় চোখ রেখে সামনের বৈঠকখানায় আমি শুয়ে থাকতাম। বাইরে থেকে যেন আমাকে দেখা না যায়, সেজন্যে জানালার খড়খড়ি টেনে শার্সির এক ইঞ্চির মধ্যে নিয়ে আসতাম। সে যখন তাদের দরোজা পেরিয়ে সিঁড়ির ধাপে এসে পৌঁছুতো, আমার বুক ধড়াস করে লাফিয়ে উঠতো, দৌড়ে হলঘরে গিয়ে বইপত্র গুছিয়ে বের হয়ে তার পিছু পিছু হাঁটা শুরু করতাম। তার বাদামী দেহের অবয়ব প্রায় সারাক্ষণই আমার চোখের সামনে চলমান, এবং যেখানটায় আমাদের পথ ভাগ হয়ে গেছে, সেখানে হাঁটার গতি বাড়িয়ে আমি তাকে দ্রুত পার করে যেতাম। কিছু তুচ্ছ দৈনন্দিন শব্দের আদানপ্রদান ছাড়া তার সাথে আমার কখনোই তেমন করে কথা হয়নি। অথচ তারপরও তার নাম আমার নির্বোধ একগুঁয়ে শরীরের জন্যে সমনজারির মতো কিছু একটা ছিল।
এমনকি যেসব জায়গায় ‘ভালবাসা’ শব্দটি পর্যন্ত চিন্তা করা যায়না, সেখানেও তার প্রতিচ্ছায়া সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম আমি। শনিবারের সন্ধ্যাগুলোতে মামী যখন বাজার করতে বেরুতেন, কিছু পার্সেল আমায় বহন করতে হতো। মানুষে ফেটে পড়া রাস্তার মধ্য দিয়ে আমরা হেঁটে যেতাম - মাতাল পুরুষ ও সারাক্ষণ দরকষাকষি করতে থাকা মহিলাগুলোর সাথে ধাক্কাধাক্কি করে, রাস্তা-ভরে থাকতো মজুরদের অশ্রাব্য গালিগালাজ, শুয়োরের চামড়ার তৈরি পিপার কাছে দাঁড়িয়ে দোকানের তরুণ ছোকরাগুলো কর্কশ স্বরে যেন প্রার্থনা সঙ্গীত গেয়ে যেত, শুনতে পেতাম পথগায়কদের নাকি সুরে গাওয়া কোনো স্তবসঙ্গীত, তারা ও’ডোনোভ্যান রোসা’কে নিয়ে গেয়ে যেত ‘কাম-অল-ইউ’ ধরণের একটি গান, অথবা আমাদের কোনো দেশজ পল্লীর ঝুট-ঝামেলা নিয়ে বাতাসে ভাসাতো কোনো গাঁথা । এইসব শোরগোল, অতিশব্দ একত্রিত হয়ে আমার কাছে জীবনের শুধুমাত্র একটি অনুভূতিরূপে প্রকাশ পেত: আমি কল্পনা করে নিতাম - শত্রুদের প্রচন্ড ভিড়ের মধ্য দিয়ে নিরাপদে আমার পবিত্র পানপাত্র বয়ে নিচ্ছি। মাঝে মাঝেই তার নাম ধরে আমার কন্ঠস্বর এত অদ্ভুত, সন্তর্পণ প্রার্থনা, প্রশংসা করতো, যা আমি নিজেই বুঝে উঠতে পারিনি কখনো। আমার চোখদুটো প্রায়শই জলে ভরে যেত (কেন, আমি জানি না) এবং কখনো কখনো একটি প্লাবন যেন আমার ভেতর হতে দ্রুত বেরিয়ে এসে হৃদয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চল প্লাবিত করে দিত। সামনের দিনগুলো নিয়ে খুব কমই চিন্তা করতাম তখন। আমি জানতামনা কখনো তার সাথে কথা হবে কি-না, আর যদি হয়ও, তাহলে আমি কিভাবে তাকে আমার দ্বিধামিশ্রিত ভালবাসার কথা বলব? কিন্তু, আমার শরীরটা ছিল তখন অনেকটা একটি বাদ্যযন্ত্রবিশেষ, আর সে, তার কথাবার্তা, চলাফেরা এই বাদ্যযন্ত্রে সুনিপুণ বাদকের মতো কাজ করতো।
এক সন্ধ্যায়, ধর্মযাজক যে-রুমটিতে মারা গিয়েছিলেন, সেই পেছনের ড্রয়িংরুমটিতে গেলাম। সন্ধ্যেটি ছিল অন্ধকার, বৃষ্টিপাতসুদ্ধু, আর আমাদের বাড়িটি পুরোপুরি নিথর নীরব। জানালার শার্সির ভেঙ্গে যাওয়া একটি কাঁচ দিয়ে আমি শুনতে পাচ্ছিলাম - পৃথিবীর বুকে বৃষ্টির শান্ত অভিঘাত, মাটির ভেজা বিছানায় পানির নিরন্তর সূচ-পড়া। আমার ঠিক নীচে - দূরাগত কোনো বাতি বা প্রজ্জ্বলিত জানালা দিয়ে ভেসে আসা আলো ভেসে ছিল। এত কম দেখতে পাওয়ায় আমি কৃতজ্ঞ অনুভব করি। আমার সমস্ত বোধ যেন নিজেদের ঢেকে ফেলার এক দুর্দম্য ইচ্ছে পোষণ করতে থাকে এবং, তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ভয়ে আমি জোরে জোরে হাতের তালুগুলো ঘষতে লাগলাম, পরস্পরের সাথে, যতক্ষণনা তারা, শোনা যায়না এমন স্বরে, কাঁপতে কাঁপতে বহুবার বলল, ‘ভালবাসা! ভালবাসা!’
শেষ পর্যস্ত তার সাথে আমার কথা হলো। প্রথম শব্দগুলো শোনার পর আমি এত বেশি দ্বিধান্বিত ছিলাম যে উত্তরে কি বলব, তা-ই বুঝে উঠতে পারছিলামনা। এ্যারাবিতে যাচ্ছি কিনা সে জিজ্ঞেস করল। পারতপক্ষে ’হ্যা‘ বা ’না‘ বলাটা দরকার ছিল, সে কথাই আমি ভুলে গেলাম।
‘‘চমৎকার একটি মেলা হবে সেটি’’ সে বলল, যেতে পারলে তার ভালো লাগত।
‘‘তাহলে যাচ্ছ না যে?’’ আমি প্রশ্ন করলাম।
কথা বলার সময় তার কব্জিতে বাঁধা ব্রেসলেটটা সে বারবার ঘুরাচিছল, সে যেতে পারবে না, কেননা সে-সপ্তাহে তার মঠে ফিরে যাবার কথা। তার ভাই ও আরও দুটি ছেলে তাদের টুপিগুলোর জন্যে মারামারিতে ব্যস্ত, আমি একা রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সে দরোজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে, আমার দিকে সামান্য মাথা ঝুঁকিয়ে। দরজার ঠিক উল্টোদিকের বাতিটির আলো সূক্ষতম শিল্পের সাথে তুলে ধরলো তার ফর্সা বাঁকানো গ্রীবা, তারপর, সে আলোটুকুর বিস্তৃতি শান্তভাবে ধীরে ধীরে গ্রাস করল ঘাড়ের ওপর থেকে বারবার পড়ে যাওয়া চুলগুলো, আর সবশেষে রেলিঙের ওপর পড়ে থাকা হাতখানি। তার কাপড়ের একটা দিক আলোর সীমানার মধ্যেই, খুব সহজ ভঙ্গিতে দাঁড়ানোর জন্যে তার মতই তার পেটিকোটের একপ্রান্ত ছিল দৃশ্যমান।
‘‘সেখানে গেলে তোমার ভাল লাগবে’’ সে বলল।
‘‘আমি যদি যাই, তাহলে তোমার জন্যে কিছু নিয়ে আসব।’’
সেই সন্ধ্যেটির পর থেকে আমার একান্ত অনিদ্রিত, নিদ্রিত সমস্ত চিন্তা পুরোপুরি বিদ্ধস্ত হয়ে গেল অসংখ্য নির্বুদ্ধিতায়। মাঝখানের একঘেঁয়ে নীরস দিনগুলোকে উপড়ে ফেলার এক দুর্দম্য ইচ্ছে আমায় দমন করতে হতো। স্কুলের কাজগুলো অসহ্যরকমের পীড়াদায়ক হয়ে উঠল। রাতে শোবার ঘরে, দিনে ক্লাসে তার চেহারা আমার এবং বইয়ের মাঝখানে দেয়ালের মত ভেসে ওঠে, কোনো কিছু পড়তে গিয়ে আমার রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়। ‘এ্যারাবি’ শব্দটির অক্ষরগুলো নীরবতার পথ দিয়ে হেঁটে যখন আমার কাছে এসে পৌঁছুতো, তখন আমার হৃদয় আমার নিজের উপরই যেন প্রাচ্যজাদু প্রয়োগ করে বেশ উপভোগ করে। শনিবার রাতে বাজারে যাওয়ার অনুমতি চাইলাম। মামী বেশ অবাক হলেন, তিনি সাবধান করে দিলেন এটি যেন আরেকটি ফ্রিম্যাসন ঝামেলায় পরিণত না হয়। ক্লাসে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হলো, সে উত্তরগুলো শুনে আমার শিক্ষকের অমায়িক চেহারাটি খুব আশ্চর্যরকমভাবে বদলে গিয়ে কঠিন হয়ে যায়, তিনি আশঙ্কা করলেন - আমি বোধহয় অলস হয়ে যেতে শুরু করেছি। আমার বিচ্ছিন্ন, ছাড়া-ছাড়া চিন্তাগুলোকে আমি কিছুতেই একত্র করতে পারছিলাম না। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো হঠাৎ করে পানসে আর অর্থহীন মনে হতে লাগল, তাদের জন্যে আমার কোনো প্রকার সহানুভূতি বা ধৈর্য্য ছিল না। এইসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো বারবার আমার সারাদিনকার স্বপ্ন এবং আমার মধ্যে এসে দাঁড়াত, দাঁড়িয়ে হৈ-চৈ করতো শুধু। সুতরাং আমার কাছে তারা হয়ে গেল কুৎসিত রকমের বিরক্তিকর শিশুতোষ খেলনার মত।
শনিবার দিন সকালে আমি মামাকে সন্ধ্যায় আমার বাজারে যাবার ইচ্ছে জানিয়ে রাখলাম। তিনি প্রচন্ড ত্রস্তব্যস্ত হয়ে টুপি রাখার আলনায় টুপিব্রাশ খুঁজছিলেন বোধহয়, চাঁছাছোলাভাবে বললেন,
‘‘হ্যা খোকা, আমার মনে আছে।’’
সামনে বসার ঘরের জানালায় আজ দাঁড়িয়ে থাকা গেল না, মামা সে রুমটিতে ব্যস্ত হয়ে কী জানি খুঁজছেন। বেশ খারাপ মেজাজ নিয়ে আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে স্কুলের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। আস্তে আস্তে ঠান্ডা ক্ষমাহীন বাতাসে আমার মস্তিস্ক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে উঠলো।
ডিনারের জন্যে যখন বাড়ি এলাম, এখনো মামা ফেরেননি। যদিও সন্ধ্যার ঢের দেরি তখনো। কিছু সময় আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকি, যখন এর টিকটিক টিকটিক একঘেঁয়ে শব্দটি অসহ্য হয়ে উঠল, রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম। এরপর সিঁড়ি বেয়ে ওপর তলায়, এখানে এই উঁচু ঠান্ডা বিষণ্ণ ফাঁকা রুমগুলো আমাকে যেন স্বাধীনতার স্বাদ দেয়, মৃদু স্বরে গান গেয়ে গেয়ে রুম থেকে রুমে আমি ঘুরে বেড়াতে থাকি। সামনের জানালা দিয়ে দেখা যায় আমার সঙ্গীরা রাস্তায় খেলছে। তাদের চিৎকার, খেলার আওয়াজ অস্পষ্ট, দূর্বলভাবে শুনতে পেলাম। জানালার শীতল কাঁচে কপাল ঠেকিয়ে সে যেখানে থাকত সে অন্ধকার বাড়িটির দিকে তাকাই। আমি হয়তোবা সেখানে বড়জোর ঘন্টাখানেক দাঁড়িয়ে ছিলাম, এর মধ্যেই আমার স্বপ্নাচ্ছন্নতায় একটি পিঙ্গল পোশাক, সে পোশাকে একটি অস্পষ্ট অবয়ব বারবার ভেসে উঠছিল শুধু, দেখছিলাম তার বাঁকানো গ্রীবায় রাস্তার বাতির সতর্ক স্পর্শ, হাত পড়ে আছে রেলিঙের উপর, শান্ত, এবং তার কাপড়ের প্রান্তে কিনার ছুঁয়ে থাকা নকঁশাগুলো যেন স্থির নীরব, এ-ই, আমি আর কিছুই দেখছিলাম না তখন, আর কিছুই না।
নীচে নেমে আগুনের ধারে মিসেস মার্কারকে পেলাম। তিনি, সত্যি বলতে, একজন সাতিশয় বাঁচাল বৃদ্ধ মহিলা, এক বন্ধকী কারবারির বিধবা স্ত্রী, যার কাজই হলো সৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত ডাকটিকিট সংগ্রহ করা। সুতরাং চায়ের টেবিলে তার খোশ গপ্পোগুলো হজম করতে হলো। সময় ফুরানোর জন্যে পুরো একটা ঘন্টা খাওয়ার টেবিলে ব্যয় করলাম, তারপরও অপেক্ষা প্রলম্বিত হলো। মিসেস মার্কার চলে যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়ালেন, তিনি বললেন যে তার খুব খারাপ লাগছে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে না পারায়। কিন্তু ততক্ষণে রাত আটটা বেজে গেছে, আর বেশি রাত অবধি বাড়ির বাইরে থাকা তিনি পছন্দ করতেন না, কেননা তার ধারণা ছিল রাতের বাতাস তার শরীরের জন্যে ক্ষতিকর। তিনি চলে যাওয়ার পরে একহাতের মুঠো অন্য হাতে শক্তভাবে চেপে ধরে রেখে আমি রুমের ভেতর অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলাম। মামী বললেন,
‘‘খোদা জানেন তোমার যাওয়া হবে কি-না।’’
রাত প্রায় ন’টার দিকে আমি মামাকে সদরদরজার হুড়কো খুলতে শুনলাম, শুনতে পেলাম তিনি নিজের সাথে কথা বলছেন, তার ওভারকোটের ওজন আলনার শরীরে স্থানান্তরিত হওয়ার সময় আলনাটি দুলে উঠল, - এই দৃশ্যগুলো যেন আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ডিনারের প্রায় মাঝপথে আমি তার কাছে বাজারে যাওয়ার জন্য টাকা চাইলাম।
তিনি ভুলে গিয়েছিলেন।
‘‘সবাই এখন ঘুমুচ্ছে, পারলে একটা ঘুম অনেকেরই শেষ’’, হাসতে হাসতে তিনি বললেন।
আমার হাসি পেল না।
মামী তাকে উৎসাহিতভাবে বললেন,
‘‘তুমি কি টাকাটা দিয়ে ওকে যেতে দিতে পারনা? এমনিতেই ছেলেটিকে তুমি যথেষ্ঠ অপেক্ষা করিয়েছ।’’
মামা বললেন - তিনি সত্যিই ভুলে গিয়েছিলেন, আর তাছাড়া তিনি মনে করেন ‘‘খেলাধুলার আনন্দ ছাড়া শুধু কাজ, পড়াশুনা, ভাল ভাল ছেলেদেরও মাথা নষ্ট করে দেয়। ’’
এই প্রাচীন প্রবাদটিতে মামা বিশ্বাস করতেন। আমি কোথায় যাচ্ছি, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, দ্বিতীয়বারের মত আমাকে বলতে হল। তারপর তিনি শুধালেন আমি ‘দি অ্যারাবস ফেয়ারওয়েল টু হিস স্টিড’ পড়েছি কিনা। যখন আমি রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসছি মামা ওই বইয়ের প্রথম পংক্তিগুলো মামীকে আবৃত্তি করে শুনাচ্ছেন শুনলাম। হাতের মুঠোয় দু’শিলিং এর একটি মুদ্রা শক্ত করে ধরে লম্বা লম্বা পা ফেলে আমি বাকিঙহাম স্ট্রিট দিয়ে স্টেশনের দিকে হাঁটছি। রাস্তায় অজস্র গ্যাসবাতি জ্বলছে, ক্রেতাদের বাড়ি-ফেরা প্রচন্ড ভিড় - এসব দৃশ্য আমাকে আমার বাজারে যাওয়ার কারণটির কথা মনে করিয়ে দিল, যে কারণে আমি এখন হাঁটছি। একটি নিঃসঙ্গ প্রায় খালি ট্রেনের থার্ড ক্লাস বগিতে উঠে বসলাম। দুঃসহ অপেক্ষার পর ট্রেনটি ধীরে ধীরে স্টেশন ছেড়ে যেতে শুরু করল। প্রায় চুপিসারে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময ট্রেনটি তার দুপাশে ফেলে গেল ধ্বংস হয়ে যাওয়া অসংখ্য বাড়ি, নীচে টিমটিম করে যেন নদী জ্বলছে, অন্তত তা-ই মনে হয় এতদূর থেকে। ওয়েষ্টল্যান্ড স্টেশনে একদঙ্গল মানুষ বগির দরজা দিয়ে হঠাৎ হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল। এটা যে বাজারের জন্যে বিশেষভাবে ব্যবহৃত ট্রেন, তা জানিয়ে কুলি তাদেরকে ভাগিয়ে দিল অবশ্য। শূন্য বগিতে আমি একা রয়ে গেলাম। কয়েক মিনিটেই ট্রেনটি একটি তাড়াহুড়ো করে, আনাড়ীভাবে তৈরি কাঠের প্ল্যাটফর্মে এসে থামল। রাস্তায় নেমে এসে একটি উজ্জ্বল আলোকিত ঘড়িতে দেখতে পেলাম দশটা বাজতে দশ মিনিট বাকি, আর আমার সামনের উঁচু দালানটিতে জাদুমন্ত্রের মত জ্বলজ্বল করছে এ্যারাবীর নাম। ছয় পেনি দিয়ে ঢুকতে হয় এমন কোন প্রবেশদ্বার পেলাম না। বাজার বোধ হয় শেষ হয়ে গেছে, এই ভয়ে খুবই পরিশ্রান্ত দেখতে একজন মানুষকে দ্রুত একটি শিলিং ধরিয়ে দিয়ে আমি ঘূর্ণিদ্বারে ঢুকে পড়লাম, এবং সেখান থেকে বেরিয়ে একটি বিশাল হলে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। এর অর্ধেক উচ্চতা ঘিরে আছে একটি গ্যালারি, বেশির ভাগ অংশই অন্ধকারে ঢাকা। অধিকাংশ ষ্টলই বন্ধ। চার্চের প্রার্থনা শেষ হয়ে যাওয়ার পর যেটুকু নৈঃশব্দ বিরাজ করে, সেটুকু নীরবতা এখন এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভয়ে ভয়ে আমি বাজারের কেন্দ্রের দিকে এগোলাম। যে দোকানগুলো খোলা, তাদের চারপাশে ছাড়া-ছাড়া ক্ষুদ্রকায় ভীড় লেগে আছে এখনও। রঙ্গীন আলোয় ‘ক্যাফে ক্যানটেন্ট’ লেখা ছিল যে পর্দাটির সামনে, সেখানে দুজন মানুষকে দেখলাম ট্রেতে পড়ে থাকা টাকা গুণছে। পয়সা পড়তে থাকার ত্রমাগত আওয়াজ আমি শুনতে পাচ্ছিলাম।
কী জন্যে জানি এসেছিলাম, কষ্ট করে মনে করতে হল। তারপর একটি দোকানে ঢুকে মনোযোগ দিয়ে চীনামাটির ফুলদানি, ফুলদার টি-সেট দেখতে লাগলাম। দোকানের দরজায় একজন যুবতী দুজন তরুণের সাথে কথা বলতে বলতে হাসছিল। তাদের কথাকপথোনের ইংরেজী উচ্চারণটুকু আমি বুঝতে পারলাম, ভাসাভাসাভাবে কিছু কথা কানে এল।
‘‘ওহ্, আমি কখনোই তা বলিনি!’’
‘কিন্তু তুমি বলেছ!!’’
‘‘কক্ষণো না!’’
‘‘আচ্ছা, সে কি বলেনি?’’
‘‘হ্যা, আমি তো শুনলাম।’’
‘‘উহ্, একদম... মিথ্যে কথা!’’
আমাকে দেখে যুবতীটি এগিয়ে এল। জিজ্ঞেস করল আমার কিছু লাগবে কি-না। তার কন্ঠস্বর ভদ্রোচিত উৎসাহব্যাঞ্জকতা ধরে রেখেছিল শুধু, মনে হল কর্তব্যের খাতিরেই সে কথাগুলো বলল। দোকানের যে অন্ধকার প্রবেশপথ, তার দুদিক পূর্বদেশীয় প্রহরীর মতো ঘিরে রাখা বিশাল কলসগুলোর দিকে নম্রভাবে দৃষ্টিপাত করলাম একবার, আমার শরীর হতে মৃদুভাবে উচ্চারিত হলো :
‘‘না। ধন্যবাদ।’’
কলসগুলোর একটির অবস্থান সামান্য পাল্টে যুবতী তরুণদ্বয়ের কাছে ফিরে গেলেন, অসমাপ্ত পুরানো প্রসঙ্গেই তারা কথা বলতে শুরু করল। একবার কি দু’বার সে কাঁধ উঁচু করে দেখল আমাকে।
সেখানে আরো কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম, দাঁড়ানোটা নিতান্তই অর্থহীন, কিন্তু এও বুঝছিলাম - তার এই দ্রব্য-সরঞ্জামের প্রতি আমার আকর্ষণ যে সত্যিকার অর্থেই সত্যি, তা-ও তাকে বোঝানো দরকার। এরপর ঘুরে গিয়ে বাজারের মাঝখান দিয়ে মন্থরভাবে হেঁটে বেরিয়ে আসতে থাকি। পকেটের ছয় পেনির সাথে হাতের দুপেনিও অবহেলা ভ’রে রেখে দিলাম। শুনতে পেলাম কে জানি হঠাৎ চেঁচিয়ে বাতি চলে যাবার কথা বলল। হলের ওপরের অংশে এখন সম্পূর্ণতম অন্ধকার।
সেই বিস্তৃত অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ নিজেকে মনে হলো এক উপহাসপাত্র, পোড়-খাওয়া, আত্মশ্লাঘা যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে সবসময়; কেন জানি প্রচন্ড রাগ হয়ে গেল, একধরণের অপরাধবোধ, নিঃসঙ্গ অবোধ অর্থহীন ক্রোধ আমি অনুভব করলাম আমার উন্মত্ত চোখ দু’টিতে, নিঃসঙ্গ অবোধ অর্থহীন ক্রোধ।
মূলঃ জেমস জয়েস ('ডাবলিনার্স' গল্পগ্রন্থ হতে, পেঙ্গুইন, ২০০১)
মন্তব্য
বিজয় থেকে ইউনিকোডে রূপান্তরের সময় "ক্ষ" একেবারেই লোপ পায় কেন যেন। আর কিছু বানান ভুল আছে। সময় ও সুযোগ হলে শুধরে নিও।
ভালো লেগেছে গল্পটা পড়ে।
হাঁটুপানির জলদস্যু
বিজয়ে টাইপ করা। রূপান্তর করলাম। তারপর দেহি অনেক কিছুই হাপিশ। চোখ বুলায়ে যা যা চোখে পড়সে, ঠিক করসি।
এখন আরেক দফা মারলাম।
এইটা ভাল লাগার মতোই গল্প।
অর্ধেকটা পড়েছি, প্রচন্ড ব্যস্ত আছি একটা পত্রিকার কাজ নিয়ে। পড়ে বাকিটা পড়বো। গল্পটা আগে মূলে পড়েছিলাম। যতটা পড়েছি, ততটার জন্য পাঁচতারা। জেমস জয়েস অনুবাদ বলে কথা!!!
''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে, হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
পইড়া জানায়েন। আমারে তখনো সক্কলে তির্যক চোখে তাকায়া বলসিলো - তুমি জয়েস অনুবাদ করতেসো?!! মাথার তালুর সাথে চোখ ঠেকে এই অবস্থা!
আপনার পাঁচতারা কি ঐ দুঃসাহসের জন্যে দিলেন মিয়াভাই?
এ্যারাবীর চেয়ে আমার দি জেফাইয়ার সং অনুবাদের শখ ছিলো বেশি। কিন্তু, এই গল্পের বিষয়বস্তু এতই চমকপ্রদ, এড়াইতে পারি নাই।
আর হ, জয়েস বলে কথা!
ভাল থাইকেন।
ধন্যবাদ কাকে দেব,জয়েস না আপনাকে?আমি কনটেন্ট নিয়ে থাকতে চাই। দুর্বোদ্ধতার ভেতর ক্যারিকেচার করা মুন্সিয়ানায় মূল কথা হারিয়ে যায়-আমি মনে করি।জয়েস সে কারণে শক্তমাটি মনে হয়। আপনার অনুবাদ ঝরঝরে।
কথাচ্ছলে অন্যপ্রসঙ্গ: আপনি বলছিলেন 'আমাকে তো আপনার চেনার কথা '। তার মানে আপনি আমায় চেনেন। অথচ আমি কিছুতেই মেলাতে পারছিনা। অনুমান করার ব্যর্থ চেষ্টা।অত:পর জিজ্ঞাসা...........ঝেড়ে কাশবেন স্যার !
.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......
হাহাহা...
আপনার আমাকে চেনার কথা না, এইটাই কয়েছিলাম স্যার। আপনি আমার থেকেই সেরা আলোচনা/ সমালোচনা আশা করছিলেন, এই হিশাবেই আমি বলসিলাম যে আপনার তো আমাকে চেনারই কথা না, তো, এই আশাটা কিভাবে সম্ভব হলো, এই আর কি!
আর, নাহ, আপনার নামখানি চমকপ্রদ হলেও আপনার লিখার সাথে আমার এর পূর্বে দূর্ভাগ্যজনকভাবে পরিচয় হয় নাই।
ধন্যবাদ জয়েসের পাওনা।
হুমম। তারপর আমরা খাল পেরিয়ে জঙ্গলের দিকে হাঁটতে থাকলাম............
.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......
হুমম।
পুরো গল্পটা একটানা পড়ে গেলাম। কেমন জানি শিরশির করা একটা অনুভব। খুবই ভালো লেগেছে।
২০০৩ সালে অনুবাদ করেছেন। এও জানলাম তখন দু:সাহসী ছিলেন বলে করতে পেরেছিলেন, এখন কি তাহলে বন্ধ করে দিয়েছেন?
উপন্যাসিক হিসেবে সফল হওয়ার দরুন কবি সুনীলকে আমাদেরকে হারাতে হলো। অভিজ্ঞতার ঝুড়ি সমৃদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে অনুবাদক জিফরানও নিজেকে গুটিয়ে নিবেন?
যে রাতে গুঁজেছো চুলে বেগুনি রিবন বাঁধা ভাট,
সে রাতে নরকও ছিলো প্রেমের তল্লাট।
. . . . . . . . . . . . . . . . . . (আবু হাসান শাহরিয়ার)
বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।
হাহাহা... ধন্যবাদ। নাহ, গুটিয়ে নেয়ার ইচ্ছে নেই। তবে, অনেক বেশি স্বার্থ বুঝতে শিখসি তো, সেজন্যেই অত বেশি আর অনুবাদ, সমালোচনা করা হয় না। ছাড়া ছাড়া কাজ করার ইচ্ছা কমে গেসে।
আমি এখনো মার্ক স্ট্র্যান্ডের নির্বাচিত কবিতা অনুবাদ করছি। এছাড়া দালির একটা উপন্যাস অনুবাদের খসড়া করছি।
কিন্তু, এইসবের চেয়েও বেশি টের পাই - আমাদের নিজেদের লিখা অনুদিত হওয়া দরকার। একদমি হচ্ছে না। কত পিছনে পড়ে গেলাম আমরা!! আমার বর্তমান মূল প্রচেষ্টা সেদিকেই।
আপনি কেমন আছেন?
যাক আশ্বস্ত হলাম। আপনার আরো আরো অনুদিত লেখা পড়ার আশায় রইলাম। খুবই সত্যি কথা যে আমাদের লেখাও অনুদিত হওয়া দরকার। আর সেক্ষেত্রে ভাষার স্ট্রেংথটা একটা বড় ফ্যাক্টর। আপনি পারবেন।
আমি ভালোই আছি এই রঙ্গভরা বঙ্গ দেশে। আপনিও নিশ্চয় ভালো আছেন, যদিও প্রোফাইলে এখনো লেখা আছে- "ভাল্লাগে-না-কিসু টাইপের যে অসুখে আসি বহুদিন, আশা রাখি সেইটা একটু কমবে"। আশা করি কিছুটা কমেছে।
যে রাতে গুঁজেছো চুলে বেগুনি রিবন বাঁধা ভাট,
সে রাতে নরকও ছিলো প্রেমের তল্লাট।
. . . . . . . . . . . . . . . . . . (আবু হাসান শাহরিয়ার)
বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।
সেই অস্বস্তিভরা অসুখ বাড়তাসে... কমে না এইটা...
আমার সামর্থ্য সীমিত। আরো অনেকেই আসেন, যারা এই কাজে আগায়া আসতে পারেন। কিন্তু, লাভের চিন্তাটাই বিপাকে ফেলাই দেয়। আমি আমার মতো যা সম্ভব করবো। আমি সচলেই কনফু ভাইরে কথা দিসি ওনার একটা লিখা আমি অনুবাদ করবো।
অনুবাদ সহসা আর আসবে না। স্ট্র্যান্ড সাহেবের কিছু কবিতা দেয়ার চেষ্টা থাকবে।
আপনি দেশের কারবার শেষ কইরা কিসুদিন বাইরে আসেন।
সরোয়ার ভাইয়ের কি অবস্থা? বহুদিন যোগাযোগ নাই।
কবিকে নতুন করে চিনলাম(সফল অনুবাদক)।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
হাহাহা...
জলিল ভাই, আমার কিন্তু আরো দু-তিনটা অনুবাদ কবিতা আছে এইখানে। তারমানে দাঁড়াইলো অইগুলা সফল হয় নাই? সেন্টু খাইলাম।
ধন্যবাদ।
সফল অনুবাদকের তর্জমা হইলো- এই অনুবাদটা মারাত্মক হইছে।
হাহাহা... বুঝলাম এইবারে...
ভালো লাগলো অনুবাদ... কবির হাতে গদ্যানুবাদ বেশ ভালো লাগে... এখানেও তার ব্যতিক্রম হলো না...
ধন্যবাদ...
কবিতা কিন্তু অনেকদিন ছাড়ছেন না...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
কঠিন জেনারেলাইজড মন্তব্য দিলেন। আপনে বইলা ক্ষমা করলাম। নাইলে খবরই ছিলো...
আমার লেখা আপনার চোখ এড়ায় ক্যান বারবার? এইতো সপ্তাহখানেক হইলো 'সময়' নামক বিব্রতকর সামাজিক পদ্য এবং 'কল্পকবিতা' নামক একটা প্রাচীন ফিকশনাল কোবতে দিলাম। সিনেমার মানুষ, চউক্ষে ধান্দা লাইগগা থাকে সারাক্ষণ, এ্যা?
নিধি বাবুনি আসে কেমন?
অনুবাদের ব্যাপারে আমি একটু উন্নাসিক, অনুদিত লেখা সবসময়েই আমার কাছে সেকেন্ড হ্যান্ড মনে হয়; এক ভাষায় লেখা অভিব্যক্তি অন্য ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।
সবদিক মাথায় রেখে আমার কাছে অনুবাদটা দারুন লেগেছে। আমি জেমস জয়েস এর কোন লেখা আগে পড়িনি ।
পড়ে ফেলব...। আপনার কল্যাণে উনার নাম জানা হল, লেখার অনন্যসাধারণ
মানও.
এত সুন্দর একটি কষ্টসাধ্য কাজ করার জন্য ধন্যবাদ।
---------------------------------------
অর্থ নয়, কীর্তি নয় ,স্বচ্ছলতা নয়-
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে;
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
ধন্যবাদ রাফি। অনুবাদের ব্যাপারে আমি আমার উন্নাসিকতা ছেড়েছি মাসুম মাহমুদ (আমাদের প্রিয় সন্ন্যাসীদা) 'থ্রী কমরেডস', জি.এইচ.হাবীবের 'নিঃসঙ্গতার একশ বছর' আর মুনতাসীর মামুনের 'দি আউটসাইডার' পড়বার পর। মূলের চেয়ে বেশি ভাল লাগত এগুলো।
আধুনিক সাহিত্যে জয়েসকে ঈশ্বরতুল্য ধরা হয়। গোটা আইরিশ ও ইংরেজী সাহিত্যের ইতিহাসে গুরুত্বের দিক থেকে তাঁকে শেক্সপিয়ারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয় মাঝে মাঝে। প্রুস্ত সমর্থকেরা জয়েসকে একটু হেলা করেন। কিন্তু, দুজনের কাজই অনন্য বিশ্ব সাহিত্যে। পারলে ইউলিসিস টা পড়ে দেখবেন। এবং তাঁর কাব্যময় গল্পগ্রন্থ ডাবলিনার্স।
জিফরান,
একটা কাজে বেরুবো। সময় নেই। ভাবলাম এক প্যারা পড়ে চলে যাই,দ্যাখি,কেমন হয়েছে,পরে এসে পড়বো । প্রায় এক নি:শ্বাসে
শেষ করে এখন,নিজেই থাকিয়েছি নিজের দিকে;বিষ্ময়ে - অনুবাদ গল্প এতো দ্রুত পড়া যায় !? তা ও জয়েসের ?
এই কৃতিত্ব অনুবাদকেরই । এতো প্রাঞ্জল !! সিম্পলি দ্যা বেস্ট,জিফরান । তুলনা চলে না,যে কারোর কাজগুলোর মধ্যে,জানি । তবু, এটা যদি গড় মানও হয়,তাহলেও অনুবাদক জিফরান খালেদ-ই নমস্য আমার কাছে। অভিবাদন নিন ।
---------------------------------------------------------
আমার কোন ঘর নেই !
আছে শুধু ঘরের দিকে যাওয়া
---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !
আমার কবিঅংশ কঠিন মাইন্ড খাইলো।
একনিঃশ্বাসে পড়বার মতো গল্প কিনা জানিনা, তবে, ছোটগল্পের ইতিহাসে এই গল্প একটা স্থান দখল কইরা আসে এর অদ্ভুত সরল ভাষা আর বিষয়ের জন্যে। যদি না পড়ে থাকেন, তাইলে, মূলটা পইড়া লয়েন।
অভিবাদন জয়েসের পাওনারে ভাই... আমি কোন ছার?
গল্পটা অনুবাদে হাত দিয়েছিলাম। হঠাৎ করেই তোমারটা চোখে পড়লো। খুব ভালো অনুবাদ হয়েছে। আমার আর অনুবাদের প্রয়োজন নেই।
মূর্তালা রামাত
মজার ব্যাপার আমি জয়েসের নাম শুনেছিলাম বিক্রম শেঠের 'আ সুইটেবল বয়' পড়তে গিয়ে। উপন্যাসের এক চরিত্র প্রাণ ( ব্রহ্মপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজি সাহিত্যের মাস্টার) তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে জয়েসকে অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছিলেন। জয়েসের কথা তখন মগজে সান্ধাল। উনার প্রায় সব বই সংগ্রহ করলাম। ফিনেগেনস্ ওয়েক ছাড়া। ডাবলিনার্স পড়লাম। ইয়াং ম্যান এজ এন আর্টিস্ট ও। আটকালাম 'ইউলিসিস' এ গিয়ে। মাত্র চব্বিশ ঘন্টার কাহিনী জয়েস কি ভাষায় লিখলেন সেটা আজ ও আবিষ্কার করতে পারলাম না। উপন্যাসের শেষের প্রায় চল্লিশ পাতা কোন যতিচিহ্ন ব্যবহার না করে লেখা হয়েছে মলি ব্লুমের সলিলাকুই। এই চল্লিশ পাতা আমি ডায়েরিতে লিখেছিলাম এক সময়। লেখার পর বুঝলাম কিছুই বুঝি নাই।
আশা করি কেউ বাংলায় 'ইউলিসিস' অনুবাদে হাত দিবেন। জিফরান খালেদ হলে মন্দ কী।
ওনার জয়েসনামা ফুনিয়রে মজা ফাইলাম। রাজ্জাকর লই মিলাই দিওরে শংসাই গইরজুন ধরি লইর। আরো এককানা বুড়া হই লই, নিজের নাম ছড়াইওরে দিই, তারফর ধইরজুম ইউলিসিসরে...
ধইন্যবাদ। যদিও ইবা হম সময়ের লাই আসে আর।
বাংলায় কও জিফু মিয়া, পাহাড়ি ব্রাদারহুড ছইলত ন।
অনুবাদ কেমন লাগলো এখনো নিশ্চিত না, মূল গল্পটা আরেকবার পড়ে বলবো।
মূলটা পড়েন। তারপর আর অনুবাদ পইড়েন না। দরকার পড়বে না।
অনুবাদ কেমন লাগলো, এইটার চাইতে গল্প কেমন, বা ভাষা, ঐটার ব্যাপারে জবান খুললে ভাল হইতো।
ব্রাদারহুড ছইলব না মানে, ফাল মাইরা যাইবো মিয়া!
@জিফরান,
'ইউলিসিস' বাংলা গইরতো গেলে সময় লাইবু ত। আস্তে আস্তে শুরু গরি দেঅ।
নতুন মন্তব্য করুন