এই পৃথিবী এক অচিনপুর । জীবন এক অপার বিস্ময়, কখন কোন বাঁকে যে কি লুকিয়ে রাখে কেউ তা জানে না । হঠাৎ কখনো সামনে এসে যখন দাঁড়ায় সেই বিস্ময়, তখন আপ্লুত না হয়ে আর উপায় কি ? সাড়ে সাত বছরের নির্ঝর নানীমনির মৃত্যুর পরে যখন মায়ের সঙ্গে দেশে গেল তখন সেও জানতো না তার জন্য কি অপেক্ষা করেছিল । ওর মা ওকে সব সময় বলে স্বপ্নের দেশ বাংলাদেশের কথা । বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষা সবুজ ব-দ্বীপটি যে শুধু প্রকৃতির ঐশ্বর্যেই গরবিনী তাই নয় । সেই দেশের মানুষের প্রাণের সৌহার্দের, মমতার, ভালবাসার ধনেও ধনী ।
আন্তর্জালের এই যুগে নির্ঝরের মার মত সাদামাটা বাঙালী আধুনিক গণকযন্ত্রে (কম্পিউটার) বাংলা বর্ণমালায় লিখতে পেরে যে কি খুশি ! নির্ঝর অবশ্য জানে না ওর মার অভিবাসী হওয়ার ইতিবৃত্তি, কেমন করে জানবে ওতো তখনও আসেনি মায়ের কোলে । সময় নেই অসময় নেই মনের মধ্যে পদ্মা, মেঘনার উথাল পাতাল ঢেউ ওঠা । মধ্যরাতে ঘুম ভেঙ্গে তুষার সাদা শীতের (বাইরে তখন হিমাঙ্কের নীচে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা) রাতে জানালা খুলে আকাশের নক্ষত্রদের সাথে কথা বলা । আকাশে মেঘ দেখলেই বুকটা হু-হু করে ওঠা, “ওরে মেঘ তুই কি উড়ে যাবি আমার দেশের ওপর দিয়ে ? বলবি গিয়ে আমার মাকে, তার জন্য আমার মন পোড়ে ?” ফেব্রুয়ারী মাস এলেই প্রভাতফেরীর নগ্নপদ মিছিল, শহীদ মিনারের বেদী, বইমেলার ধুলোবালি, কড়কড়ে নতুন বইয়ের মলাটে তখনও লেগে থাকা না শুকানো আঠা, কখনো মা কখনো বন্ধুদের সঙ্গে বইয়ের প্যাকেট বুকে ধরে হেঁটে বেড়ানোর জন্য ভেতরটা কেমন “তেপান্তরের মাঠ” হয়ে যাওয়া...
একবার স্কুলের (এই পোড়া দেশে বিশ্ববিদ্যালয়কেও বলে “স্কুল” । যত বয়সই আপনার হোক আর যত ওপরের ক্লাসেই আপনি পড়েন, স্কুলেই পড়েন ।) ল্যাবের কম্পিউটারে বইমেলার খবর পড়তে পড়তে নির্ঝরের মা অঝোরে কেঁদে ফেলেছিল । ভাগ্য ভাল খুব বেশী কেউ ছিল না । যে দু’একজন ছিল তাদের অবাক দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে দু’চোখের বানভাসিতে ভাসা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না ... কে জানে সেই নোনা জলে কত অভিমান, বেদনা, অক্ষমতা আর অপরাধবোধ মিশে ছিল !
সে যাক আজ নির্ঝরের মা নয়, শুধুই নির্ঝরের কথা বলার দিন । দেশে যাওয়ার ঠিক দু’সপ্তাহের মাথায় ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় একটি পরিবার আসে নির্ঝরের মায়ের সাথে দেখা করতে । কাকুটা নাকি ওর মায়ের সঙ্গে একই ব্লগে লিখে, মাও তাঁকে আগে কখনও দেখেনি । কাকুর সাথে আসে খালামনি (মা ওকে শিখিয়েছে বাংলাদেশের সবাই ওর বাবা মায়ের ভাই বোন । কাজেই “কাকু” আর “খালামনি” ডাকতে হবে । “আন্টি”, “আংকেল” ডাকা মার একদম পছন্দ না), ওঁদের ছেলে সৃজন ও মেয়ে নবনী । কি আশ্চর্য, কাকু, খালামনি আর মা এমনভাবে কথা বলছে যেন কত হাজার বছরের চেনা জানা ! খালামনিটাতো এসেই মাকে জড়িয়ে ধরল, মা তাঁকে ধরে কাঁদলোও নানীমনির কথা বলে । কাকুটা কিছু না বলে চুপ করে শুধু দাঁড়িয়েছিল ।
নির্ঝরের কিন্তু সবচেয়ে ভাল লাগল সৃজনকে । সৃজন ওর চেয়ে এক বছরের ছোট, কিন্তু খুব মিশুক । এক নিমিষে ওরা বন্ধু হয়ে গেল । এই প্রথম কেউ ওকে “ভাইয়া” বলে ডাকছে শুনে নির্ঝর মোটামুটি এভারেস্টের চূড়ায় একটা “ভারচুয়াল” হাঁটাহাঁটি সেরে ফেলল মনে মনে । নবনী আপুকেও খুব মিষ্টি লাগল কিন্তু কেমন একটু বেশীই লাজুক । ও নাকি মেডিকেলে পড়ে ডাক্তার হবে । কিন্তু এত কম কথা বললে ডাক্তার কিভাবে হবে কে জানে, হয়তোবা রোগীদের কথা শুনে একটু মিষ্টি করে হেসেই ভাল করে দেবে ।
কাকু, খালামনি আর মা যখন কথা বলছিল নির্ঝর তখন সৃজনকে সব বোর্ডগেমগুলো দেখাল । বারান্দায় গিয়ে কিছুক্ষণ খেললোও । দুপুরের খাওয়ার পরে সবাই মিলে বের হওয়ার আগে মা কাকুকে নানীমনির ঘর, বইয়ের সংগ্রহ দেখাল । তারপর, কাকুরা প্রথমে নানীমনির কবরের কাছে যেতে চাইল । মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে নানীমনির কবরের পাশে গিয়ে সবাই কেমন নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল ।
এরপর সবাই মিলে মিরপুর চিড়িয়াখানায় গেল । নবনী আপূ আর সৃজন নাকি কখনো আগে আসেনি এখানে, তাই কাকু ওদেরকে এই সুযোগে দেখাতে চায় । ভেতরে ঢোকার পরে নির্ঝরের একটু খারাপই লাগল সব খাঁচায় বন্দী প্রাণীদেরকে দেখে । কানাডায় ও একবারই একটা সাফারি পার্কে গিয়েছিল, সেখানে সব প্রাণীরা খোলা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল । ওরা গাড়িতে চড়ে নিরাপদ দূরত্ব থেকে দেখেছিল, কেউ কোন প্রাণীকে বিরক্ত করছিল না । আরো একটা জিনিষ ওর খুব খারাপ লাগছিল অনেকেই এখানে সেখানে ময়লা ফেলছে (যাকে বলে “লিটার করা”), একটু কষ্ট করে দু’কদম হেঁটে ময়লা ফেলার “বীনে” ফেলছে না । সেজন্যে পুরো চিড়িয়াখানাটাই কেমন একটা ময়লার স্তূপে পরিণত হচ্ছে, কেউ খেয়াল করছে না । নির্ঝর জানে, ও যদি এখন মাকে এটা নিয়ে কিছু বলে তাহলেই মা শুরু করবে কানাডা আর বাংলাদেশের তুলনামূলক বক্তৃতাটা,......“জানো কানাডার সাইজ আর বাংলাদেশের সাইজ ? ইয়া বড় দেশ কানাডা, সেখানে বাস করে মাত্র ৩৩ মিলিয়ন মানুষ । আর বাংলাদেশে আমরা ১৫০ মিলিয়নের ওপর মানুষ থাকি । তাহলে তুমি কি আশা কর ?” নির্ঝরের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে অবশ্য কুলায় না যত মানুষই বাস করুক না কেন, তাই বলে যেখানে সেখানে কফ, থু-থু, চিপসের খালি প্যাকেট, বাদামের খোসা, ঝাল মুড়ির ঠোঙা, কলার খোসা, ডাবের খোল, আমড়ার আঁটি, আখের ছিবড়া কেন ফেলতে হবে ।
যাকগে এসব নিয়ে কথা না বলে ও মেতে ওঠে সৃজনের সঙ্গে এই খাঁচা থেকে ওই খাঁচায় প্রাণীদের দেখতে । বাঘ, সিংহ, হাতি, বানর, পাখী, ময়ূর, জেব্রা, জিরাফ, কুমির, লামা ইত্যাদি দেখতে দেখতে কখন যে সময় পার হয়ে যায় । ওরা এক সময় চিড়িয়াখানার ঝিলের ধারে চলে আসে । ঝিলের জলে উত্তরের শীতের দেশ থেকে সোনালি ডানায় ভর করে আসা পাখীদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় । ওদেরকে নাকি এখন “পরিযায়ী” পাখী বলা হয় । কারণ, ওরা অনেক দেশ ভ্রমণ করে এলেও এই সবুজ, উষ্ণ দেশের নদ-নদী, খাল-বিলই বছরের কয়েক মাসের জন্য ওদের বাসস্থান । কাজেই, ওরা আর “অতিথি” নয় এই সবুজ বাংলাদেশে । বরংচ, বছরের ওই কয়েকমাস সময় এই দেশের জলাশয়ে নিরাপদে থাকাটা ওদের অধিকার । পাখীদের কলকাকলিতে মুখর ঝিলের দিকে তাকিয়ে নির্ঝরের মনে হচ্ছিল, কানাডার লেক থেকে কোন পাখীটা এসেছে এই ঝিলে ? কেমন করে চেনা যায় তাকে ?
এক সময়ে ওদেরকে চিড়িয়াখানা থেকে বের হয়ে আসতে হয় । সবাই মিলে দু’টো সিএনজিতে করে সংসদ ভবনের সামনের চত্বরে এসে আরেকবার মিলিত হয় । সেখানে একটু ছবি তুলতে তুলতেই শীতের দিন ফুরিয়ে আসে । সৃজনরা ময়মনসিংহ ফিরে যাবে তাই কাকু তাড়া দিতে থাকে । নির্ঝর খুব চাইছিল ওরা থেকে যাক, তাহলে হয়তো সৃজনের সঙ্গে আরো গল্প করা যেত, বোর্ডগেমগুলোও খেলা যেত । কিন্তু কাকুর, খালামনির অনেক কাজ, তাই ফিরে যেতেই হবে । সৃজনদের নিয়ে সিএনজিটা যখন বাস ষ্টপেজের দিকে রওনা দিল, তখন হঠাৎ করে কোথা থেকে ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে এল । সোডিয়াম বাতির নাগরিক আলোয় ফুটপাথে হাঁটতে হাঁটতে নির্ঝরের মনে হচ্ছিল, মা ঠিকই বলে বাংলাদেশের মানুষ আসলেই অনেক অদ্ভুত । অদেখা মানুষের মায়ার টানে নিজের শত কাজ ফেলে চলে আসে কত দুরে.......
মন্তব্য
সারল্যের উপর সরলভাবে লেখাটা ভাল লাগল। আর
-এর জন্য
অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য । আসলেই খুব সাধারণ কোন অভিজ্ঞতা, সরল কিছু মানুষের উষ্ণ আন্তরিকতা কত অসাধারণ হয় এ তারই প্যাচাল ।
.......................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
ভাল্লাগছে, লিখে যান।
অনেক ধন্যবাদ । আপনার প্রফাইলের দুরন্ত কৈশোরের ছবিটিও ভাল লাগল ।
.......................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
মন ছুঁয়ে দিলেন।
আমার বাবারও না। আন্টি, আঙ্কেল শুনলেই কী যে বিরক্ত হন তিনি!
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
কেন যেন মনে হয় সবকিছুতে অনুকরণ প্রিয়তার কারণে অনেক মৌলিক সম্পদ হারিয়ে ফেলছি আমরা । প্রাণভরে মামা, খালা, চাচি, কাকু, জেঠা, জেঠীমা, ফুপু ডাকার যে আনন্দ তা বোধহয় হারিয়েই যাবে কোন একসময় ।
.......................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
দেরিতে পড়লাম। ভালো লাগলো।
পড়েছ জেনেই আনন্দ হচ্ছে । আর ভাল লেগেছে জেনে বুঝতেই পারছ... দ্বিগুণ আনন্দ!
.......................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
আরে, এতো সুন্দর লেখাটা চোখ এড়িয়ে গিয়েছিলো কেন???
--------------------------------------------------
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
তিথীডোর, শেষতক যে পড়েছেন তা দেখে কি যে ভাল লাগল । ক্যানসার রোগীদের প্রতি ভালবাসার সিরিজে আপনাকে হতাশ করেছিলাম বলে মন খারাপ ছিল ।
সে যাক, ধন্যবাদ পড়ার জন্য ।
.......................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
খুব সুন্দর লেগেচে লেখাতা, আমি মুগ্দহ।।ঃ)
ekta kotha.....-30 jokhn temperature tokhon tui janla khulsili kibhabe? r keno? ei 30 ki ashole celcius na farenheit?
নতুন মন্তব্য করুন