আগের পর্বগুলোঃ
।। পর্ব -১ ।। পর্ব - ২ ।। পর্ব - ৩ ।। পর্ব -৪ ।। পর্ব -৫
++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
৭.
উইকেন্ডের দূ’টো দিন মিতি ব্যস্ত থাকলো নানান কাজে । সপ্তাহের অন্যদিনগুলোতে শুধু ছূটে চলতে হয় বলে মনের মত কিছু রান্না করা হয় না । ছূটির দিনগুলোতে তাই অয়ন আর রাফাতের পছন্দের এটা ওটা রান্না, ঘর গোছানো, ঘরদোর পরিষ্কার করা এসব করতে করতে অনেক সময় চলে যায় । তাছাড়া আগামী সপ্তাহের জন্যও কিছু রান্না করে জমিয়ে রাখতে হয় । বাড়ী বদলের জন্যেও মিতির অনেক কাজ জমে গিয়েছে । মুভিং বাক্সগুলো খুলে কিছু কিছু জিনিষ গুছিয়ে রাখা নিয়েও সে মেতে রইল । অয়ন তার ছোট ছোট হাতে যতটুকু পারে মাকে সাহায্য করলো । মিতি বই আর যা যা জিনিষ এই মুহুর্তে লাগছে না সেসব জিনিষ বেইজমেন্টে নিয়ে স্তুপ করে রাখল । অয়ন জানতে চাইছিল, “মা, আমরা কখন এসব গোছাবো ?” মিতির অনেকদিন ধরে শখ তার বাসায় একটা স্টাডিরুম থাকবে, যেখানে শুধু বই আর কিছু সবুজ গাছ থাকবে । খুব লো ভলিউমে ওর প্রিয় বাংলা গানগুলো শুনতে শুনতে ও বই পড়বে । এপার্টমেন্টের ছোট্ট বাসায় তার এই শখ কখনোই পুরন হয়নি । এই বাড়ীটা কেনার সময় নীচতলার স্টাডিরুমটা দেখে যে সে কি ভীষন খূশী ! এই রুমটা সে সময় নিয়ে সবশেষে গোছাবে এটাই তার ইচ্ছে ।
ছূটির দিনে অয়নকে নিয়ে মিতির আরেকটা খুব মজার খেলা আছে । অন্যদিন তাড়াহুড়োয় ঝপ ঝপ পানি ঢেলে ছেলেকে গোসল করিয়ে দেয় । কিন্তু, ছূটির দিনে অনেকক্ষন ধরে মা আর ছেলে বাথরুমের শাওয়ার কার্টেন দিয়ে লূকোচুরি খেলে । মা একবার কার্টেনের একধার ধরে বলবে “কোথায় আমার অয়ন সোনা ?”, অন্যধার থেকে তখন ছেলে বলবে, “তু......কি, এই যে আমি, মা । তুমি আমাকে খূঁজেও পাবে না ।” তখন আবার অন্যধারে গিয়ে মা একই প্রশ্ন করবে, ছেলে জায়গা বদলে করবে ও আরো জোরে একই কথা বলবে । মাকে হারিয়ে দেয়ার তীব্র আনন্দে অয়ন কচি কন্ঠে চিৎকার করে বাড়ি মূখর করে তুলবে । এইভাবে বেশ কিছূক্ষন খেলার পরে অয়ন গায়ে পানি ঢালতে রাজি হবে । ছূটির দিনে তাই অয়ন কিছূতেই বাবার সঙ্গে গোসল করবে না ।
শনিবারে দূপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে মিতি ছেলেকে নিয়ে বসলো কিছূক্ষন বাংলা বর্নমালা শিখাতে । ওর প্রচন্ড ইচ্ছে অয়ন বিদেশে থেকেও বাংলা লিখতে, পড়তে শিখবে । মাতৃভাষার এতো সমৃদ্ধ সাহিত্যের জগৎ থেকে তো ও বঞ্চিত থাকবে যদি ভাষাটাই না জানে । তাই দেশ থেকে শিশুতোষ বাংলা ছড়ার বই, স্কুলের পাঠ্যবই “আমার বই” নিয়ে এসেছে । রাতে শোবার সময় বাংলা ছড়ার বই পড়ে শোনানো আর ছূটির দিনে একটু একটু করে বর্ন পরিচয়ের মধ্য দিয়ে অয়নকে ভাষা শেখানোর কাজটি সে খুব গুরুত্বের সঙ্গে করে । মাঝে মাঝে এসে রাফাত হানা দেয় ওদের মা, ছেলের পাঠশালায় । মিতিকে রাগানোর জন্য বলে, “কতদূর শিখলো তোমার ছেলে ? আমাদের ছোট নদী..কি শুরু করেছো ? নাকি এখনো ঐ দেখা যায় তালগাছ চলছে?” মিতি অবশ্য খুব একটা গা করে না এইসবে, ও জানে লেগে থাকলে ঠিকই একসময় মায়ের ভাষার প্রতি আগ্রহ জন্মাবে অয়নের । যদিও স্কুলে অন্য কাউকে বাংলা শিখতে দেখে না, কিন্তু শৈশবের এই কচি মনে একবার ছন্দ আর কল্পনার প্রতি ভালবাসার বীজটি রোপন করে দিতে পারলে তা একসময় মহীরুহ হবেই ।
মা আর ছেলের এই কলকাকলীতে রাফাত একদমই যোগ দিল না । সারাটা সময় সে একা একা পরে রইলো স্টাডিরুমে কম্পিউটারে মুখ গুজে । দূ’একবার যে মিতি তাকে ডাকলো না তা নয়, কিন্তু রাফাত সাড়া দিল না একদমই । মিতিকে না বলে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ওপর যতটা সম্ভব জানার চেষ্টা করতে লাগলো সে । সবাইতো বলে চিকিৎসা বিদ্যা নাকি এগিয়েছে, কতটা এগিয়েছে আসলে ? তাছাড়া, মিতির কাছ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখাটাও এই মুহুর্তে খুব জরুরী । ওর কাছে কিছু লুকোনো যায় না । মুখ দেখলেই ঠিক বুঝে যাবে ভেতরে ভেতরে কঠিন একটা কষ্ট ও বুকে চেপে রাখছে ।
শনিবার সন্ধ্যায় ওরা গেল ফান্ড রেইজিং ডিনারে । স্থানীয় বাঙ্গালীরা সিডর আক্রান্ত মানুষদের জন্য এই ডিনারের আয়োজন করেছে । কার্লটন ও অটোয়া ইউনিভার্সিটির বাঙ্গালী ছাত্র-ছাত্রীরা সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যাবস্থা করেছে । অয়ন ওর পিগি ব্যাংকটা সঙ্গে করে এনেছে সিডর আক্রান্ত উপকুলের শিশুদের জন্য । ডিনারে মিতিদের দেখা হয়ে গেল পরিচিত কয়েকজন বাঙ্গালীর সঙ্গে । অল্প সময়ের মধ্যে অটোয়ায় ওদের জানাশোনা তেমন হয়ে উঠেনি । পরিচিত বলতে তাই মন্ট্রিয়াল থেকে আসা মঈন ভাই, তারেক ও সীমা । মিতিদেরকে দেখেই তারেক, সীমার তিন বছরের ছেলে ইমন “খালামনি” বলে দৌড়ে এসে ঝাপিয়ে পড়ল মিতির কোলে । অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে আরো কিছু বাঙ্গালীর সঙ্গে পরিচয় হ’ল । রাফাত কিছুতেই স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছিল না । ভেতরের কষ্টটা ওকে সারাক্ষন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল । মিতির কাছ থেকে উঠে রাফাত দর্শক সারির একদম পেছনে দাঁড়িয়ে থাকল । যদিও ও জানে ডাক্তারের কাছে শোনা কথাগুলো মিথ্যে কিংবা ভূল হওয়ার কোন কারন নেই, তবুও বারবার ও বিশ্বাস অবিশ্বাসের পেন্ডুলামে দুলতে থাকল । আরো একটা জিনিষ ওর মনকে অস্থির করে তুলল, মিতিকে ও কেমন করে এই রিপোর্ট বলবে ? অথচ ডাক্তার রিভে বলে দিয়েছে আগামী সপ্তাহ থেকেই আরো নানা রকম টেস্ট শুরু হবে, কাজেই মিতিকে এই উইকএন্ডেই যেন বলা হয় । তার মানেতো আর মাত্র একটা দিন সময় আছে সামনে । গভীর অসহায়ত্ববোধে আচ্ছন্য রাফাতের কেবলই মনে হচ্ছিল, সময়টাকে থামিয়ে দেয়া যায় না কোনভাবে? আর যদি কোনদিনই সোমবার না আসতো! অথবা পেছনের কিছু দিনকে যদি মুছে দেয়া যেত কোনভাবে? যেন মিতি সেদিন গোসল করতে গিয়ে বুকে কোন অচেনা মাংসপিন্ডের অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি । গত কিছুদিনের এই ভেতরে ভেতরে ক্ষয় করে দেয়া ঘটনাগুলো আসলে সত্যি নয়, কোন দুঃস্বপ্ন । জেগে উঠলেই দেখা যাবে এসব মিথ্যা । জীবন চলছে আগের মতই । ওই যে মিতি মঞ্চের দিকে চোখ মেলে বসে আছে দু’পাশে অয়ন আর ইমনকে নিয়ে । কোলে বসা দুই শিশুকে দু’হাতে এমন করে জড়িয়ে ধরে আছে যেন একটু আলগা করলেই ওরা কোন এক চৈত সংক্রান্তির মেলার ভীড়ে হারিয়ে যাবে । রাফাত জানে দেশের গানের সাথে সাথে মিতি অস্ফুটে গলা মেলাবে, এক সময় ওর দু’চোখ ভরে অশ্রু গড়াবে । মিতি তখন আশে পাশে বসে থাকা অন্যদের কাছ থেকে নিজেকে লুকানোর জন্য নিচু হয়ে মাটিতে ‘না হারানো’ কিছু খুঁজবে আর ন্যাপকিনে চোখ মুছবে ।
এক সময় অনুষ্ঠান শেষ হয় । ভাড়া করা অডিটরিয়ামটি পরিচ্ছন্য করার কাজে আয়োজকদের সঙ্গে সঙ্গে অংশগ্রহনকারী অনেকেই হাত লাগাল । ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টেবিল চেয়ারগুলো ঘরের এক কোনায় ফোল্ড করে রাখা হ’ল । মঈন ভাই, তারেকের সঙ্গে এখানে ওখানে জমে থাকা আবর্জনা ঝাড়ু দিয়ে সরাতে সরাতে রাফাত দেখল মিতি আর অয়ন কোথা থেকে গার্বেজ ব্যাগ জোগাড় করে তার মধ্যে কোকের ক্যান, কাচের বোতল ও প্লাস্টিকের প্লেট, চামচ, গ্লাস জড়ো করছে । মিতির এই এক বাতিক, রিসাইক্লিং করা যাবে এমন জিনিষ কিছুতেই গার্বেজ করতে দেবে না । নিজের গেরস্থালির আবর্জনা থেকেতো সব সময় রিসাইকেলযোগ্য জিনিষ সংরক্ষন করবেই, বাইরেও সুযোগ পেলেই এই কাজটি সে নিজের কাঁধে তুলে নেবে । নিশ্চয়ই এর মধ্যে আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে এইসব জিনিষ রিসাইকেল করার ব্যাবস্থা সে করে ফেলেছে । মহা উৎসাহী অয়নও পরিবেশ রক্ষার কাজে মায়ের একনিষ্ট ‘কমরেড’ । দূর থেকে রাফাত দেখছিল, মা আর ছেলে কি পরম যত্নে জিনিষগুলো প্লাস্টিকের বড় ব্যাগটায় ভরছে । নিজেদের মধ্যে নিচু স্বরে কি যেন বলাবলি করছে । রাফাতের মনে হ’ল, কি অপার্থিব সুন্দর এই দৃশ্যটি, কিন্তু কতদিন দেখা যাবে একে? কোনভাবে ‘ফ্রিজ’ করে দেয়া যায় না এই দৃশ্যটিকে?
চলবে….
পূনশ্চঃ অনুগ্রহ করে আমার লেখায় বানান ও যতি চিহ্নের ভুলগুলো দেখিয়ে দিন । ধন্যবাদ ।
মন্তব্য
- পড়লাম এবং পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
আচ্ছা, মিতি তো ব্যাপারটা আঁচ করে ফেলেছেই, একেবারে অজানা তো তার না। রাফাত না বললেও মিতি নিশ্চয়ই জেনে যাবে। রাফাতের কষ্টের ব্যাপারটা বোধগম্য যদিও।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ সময় করে পড়ার জন্য ও মন্তব্য করার জন্য ।
হ্যাঁ, মিতিকেতো জানতে হবেই…
.......................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
বাঃ। চলুক।
আপনার সবকটা পর্বই পড়লাম।
কৌস্তুভ
ধন্যবাদ কৌস্তভ সময় নিয়ে সবক’টি পর্ব পড়ার জন্য । আপনিতো তাহ’লে জেনেই গেছেন এটি একটি সত্যি গল্প, তাই খুব বেশি বদলানোর সুযোগ নেই । ক্যান্সার কেমন করে বদলে দেয় জীবন এ তারই গল্প । জানি না কতটা তুলে আনতে পারব । দেখা যাক ।
.......................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
নতুন মন্তব্য করুন