ক্যান্সারের জার্নাল (পর্ব -৮)

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি
লিখেছেন জোহরা ফেরদৌসী (তারিখ: রবি, ১৬/০৫/২০১০ - ১১:২৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আগের পর্বগুলোঃ

।। পর্ব -১ ।। পর্ব - ২ ।। পর্ব - ৩ ।। পর্ব -৪ ।। পর্ব -৫ ।। পর্ব -৬ ।। পর্ব -৭ ।।

১০.

এক তলার সিকিউরিটি পেরিয়ে এলিভেটরে ছয় তলায় কেমন করে নিজের কিউবিকলে এল মিতি কিছুই বলতে পারবে না । কখনো কখনো এমন হয় যে মানুষের সব বোধ কূঁয়াশায় ঢেকে যায়, আশেপাশে কি ঘটছে কিছুই তখন ছুঁয়ে যায় না । কেমন এক আচ্ছন্নতায় পেয়ে বসে । চোখ মেলে তাকালেও কিছু দেখা হয় না, কান পেতে শুনলেও কিছু মরমে গিয়ে পৌঁছায় না ।

যে কোন দিনের সকাল বেলাটাই খুব চঞ্চল একটা সময় মিতির অফিসে । তারওপর দু’দিনের উইক এন্ডের পরে সোমবার সকালে সবাই খুব ব্যস্ত পায়ে অফিসে আসে, একজন আরেকজনের খোঁজ নেয় । মাত্র ফুরিয়ে যাওয়া উইক এন্ডে কে কি করেছে, কোথায় কোন জায়গায় বেড়াতে গিয়েছে তার খবর নেয় । এলিভেটর থেকেই শুরু হয় কুশল বিনিময়ের পাশাপাশি এই সব আলাপচারিতা । তাছাড়া কাছে চলে আসা ক্রিসমাসও এখনকার আলাপের বড় অনুষজ্ঞ । এলিভেটরে সোমবার সকালের এই উৎসব মুখর আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে মিতি হেঁটে হেঁটে নিজের চেয়ারে এসে বসে থাকল কতক্ষণ কে জানে! স্তব্ধ মিতির মুখোমুখি কেউ নেই, কোন মুখরতা নেই । ওর চরাচর জুড়ে শুধু নিরবিচ্ছিন্ন নিস্তব্ধতা …

মিতি বন্ধ কম্পিউটারের কালো মনিটরের মুখোমুখি আরো কতক্ষণ বসে থাকতো কে জানে । মিতির স্তব্ধতা ভাঙ্গতেই যেন ফোনটা বেজে উঠল । রেডক্রসের মেলানির গলা ভেসে এল, “Good Morning Momota. Hope you had a nice weekend. Would you like to see me today?”

মিতি প্রথমে বুঝে উঠছিল না কেন মেলানির সঙ্গে দেখা করার কথা । একটু সময় লাগল মিতির জবাব দিতে, “Oh yes, I would like to see you sometimes this afternoon. I need to give you the funds I have collected from my co-workers for the cyclone victims. But, I am not sure when I can come. Would you mind if I call you back?”

“Not at all. Call me anytime you find out when you can come. If I am not at the desk, leave me a message. I am at the office the whole day.” কথা শেষ করে মেলানি ফোন রেখে দিল ।

মিতির কিউবিকলের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে লম্বা হলওয়ে । মার্গারেট প্রতিদিন নিজের কিউবিকলে যাওয়ার পথে একবার মিতির কিউবিকলে মুখ বাড়িয়ে “হ্যালো” বলে যায় । আজও এল । সদা ব্যস্ত মার্গারেট হাতের ব্যাগ দু’টো নামিয়ে রেখে জানতে চাইল, “How is everything Momota? How did it go? I mean the fund raising for the cyclone victims in Bangladesh.” মিতি জানাল যে খুবই ভাল হয়েছে ক্যাম্পেনটা । তাছাড়া, ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য শুধু যে ফান্ড রেইজ হয়েছে তাই না, অনেকে এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা জানতে পেরেছে । সেটাও কম কথা না । মার্গারেট বলল, “I am glad that you could do something about the cyclone victims. It must be giving you some peace in mind.” মিতিও একমত হল মার্গারেটের সাথে । তারপরেই মিতি বলল, “I have to go the civic hospital at noon, Margaret. Doctor wants to discuss the report with me. I won’t be able to go to the group meeting.” মার্গারেট তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলল, “Don’t worry about the meeting. Your health is the priority. I will have my fingers crossed.”

মার্গারেট চলে যেতেই আবার ফোন বেজে উঠল । রাফাতের গলা ভেসে এল, “মিতি, একটু নিচে আসবে?” মিতি “আসছি” বলেই ফোন ছেড়ে দিল । চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর সময় কি দুলে উঠল চোখের সামনের পৃথিবীটা? দু’চোখের সামনে আর কতটাইবা দেখা যায় এই পৃথিবীর? কী আছে দেখার সীমানার বাইরে?

মিতির অফিসের ক্যাফেটেরিয়াটা লাগোয়া একটা একতলা বিল্ডিংয়ে । মেইন বিল্ডিংয়ের সাথে একটা লম্বা প্যাসেজ দিয়ে সংযোগ করা যাতে শীতের সময়ে ঠান্ডায় বাইরে বের হতে না হয় । মিতি আর রাফাত পাশাপাশি হেঁটে ক্যাফেটেরিয়ায় যাচ্ছে । রাফাতের হাতের খামটাই বলে দিচ্ছে রাফাত এরই মধ্যে সিভিক হাসপাতাল থেকে মিতির রিপোর্ট নিয়ে এসেছে । অবশ্য সিভিক হাসপাতাল মিতির অফিসের খুব কাছে । কার্লিং ধরে আরো দু’তিন মিনিট ড্রাইভ করলেই হাসপাতালে চলে যাওয়া যায় ।

ক্যাফেটেরিয়ায় এই সময়ে শুধু সকাল বেলার কফি পিপাসুদের ভীড় । তারা সবাই ব্যস্ত হাতে কফির কাপ নিয়ে চলে যায় অফিসে, কেউ বসে না । তাই সারি সারি টেবিলগুলো খালি পড়ে আছে । উঁচু ছাদের ক্যাফেটেরিয়ার তিন দিকের দেয়ালেই কাঁচ বসানো, যে কারনে বাইরের সব কিছু দেখা যায় । চারিদিকটা খুব খোলামেলা । ক্যাফেটেরিয়ার বিশাল বিশাল কাঁচের দেয়াল গলে ঢুকে যায় প্রকৃতি । ভেতরে বসেই দেখা যায় রোদ, বৃষ্টি, মেঘলা আকাশ, তুষার ঝড়, কুঁয়াশা ।

মিতি জানালার কাছের একটা টেবিলে গিয়ে বসল । রাফাত ওকে অনুসরন করে মুখোমুখি একটা চেয়ার টেনে বসল । মিতি কোলের ওপর দু’হাত রেখে বসেছে । কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাফাত টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলল, “মিতি, তোমার টিউমারটা ম্যালিগনেন্ট ।” কথাটা বলেই রাফাতের মনে হল ঝড়ে জাহাজের মাস্তুল ভেঙ্গে গিয়েছে । ঘোর অন্ধকার রাতেও উত্তাল সমুদ্রে জাহাজের হাল ধরে রাখতে হবে । অন্ততঃ চেষ্টা করতে হবে । তাই তাড়াতাড়ি আবার বলতে শুরু করল, “তবে, ভাল খবর কি জান, এটা সবচেয়ে কমন একটা ম্যালিগন্যান্সি । আর আমারতো মনে হয় এখনো সেরকম খারাপ কিছু হয়ইনি । তুমি মনে করে দেখতো, তুমি কি আগে কখনো টের পেয়েছিলে টিউমারটা? পাওনি, তার মানে হল এটা খুব রিসেন্ট ডেভেলাপমেন্ট । এখনো ক্যান্সারে টার্ন নেয়নি । তাছাড়া, ডাক্তার হাবীবের কথা তোমার মনে আছে? সে তো তোমাকে একজামিন করেছিল । সেওতো বলেছিল ভয়ের কিছু নেই । তুমি যেন আগে থেকেই ভয় পেও না ।” রাফাতের এত কথার পরে মিতি শুধু জিজ্ঞেস করল, “রিপোর্টে কি লেখা আছে? তুমি কি কোন ডাক্তারকে রিপোর্ট দেখিয়েছ?” মিতির কণ্ঠস্বর খুব দূরাগত শোনাল । শেষ বিকেলের অপসৃয়মান আলোর মতই লাগল মিতির গলা ।

“ডাক্তার চ্যাডউইকের সঙ্গে এপয়েন্টমেন্ট বারোটায় । এখন কোন ডাক্তারকে পাইনি রিপোর্ট দেখাতে । রিপোর্টেতো শুধু ক্যালসিফিকেশনের এভিড্যান্স দেখা যাচ্ছে লেখা ।” রাফাতের কণ্ঠস্বর কি একজন পরাজিত সৈনিকের মত শোনাল?

মিতি আর কিছু জিজ্ঞাসা না করে বাইরে তাকিয়ে থাকল । রাফাত তাকিয়ে দেখল, মিতির মুখটা পাশ ফেরানো, ডানদিকটা শুধু তীর্যকভাবে দেখা যাচ্ছে । ওর চোখের পাঁপড়িতে মেঘলা দিনের ছায়া এসে ভর করেছে । বাইরে কিছুক্ষণের বিরতি দিয়ে আবার ঝিরিঝিরি তুষার বৃষ্টি শুরু হয়েছে । ক্যাফেটেরিয়ার এই জায়গাটা থেকে মেইন বিল্ডিংয়ের পেছনদিকটা শুধু দেখা যায় । এদিকটায় একদম “ঘুম না আসা” কৈশোরের দুপুরগুলোর মত নিঝুম এখন । অনেকখানি জায়গা জুড়ে লম্বা লম্বা মেপল গাছগুলো সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে । একটা গাছেও কোন পাতা নেই । নিষ্প্রান গাছগুলো দেখলে মনেই হয় না স্প্রিং আসতে না আসতেই এই গাছেদের শরীরে কচি সবুজ পাতায় কেমন প্রাণের সঞ্চার হয়ে যায় । আর সামারেতো সবুজের বন্যা বয়ে যায় প্রকৃতিতে । এই মুহূর্তে গাছের ডালে ডালে আটকে থাকা তুলার মত কোমল সাদা তুষার কণাদের কেমন অপার্থিব লাগছে । আকাশ থেকে তুষারকণারা ঝরে ঝরে পড়ছে, কিছু মাটিতে কিছু গাছের ডালে । গাছের ডালে যারা পড়ছে, তারা কেউ পিছলে পড়ছে মাটিতে, কেউ আটকে থাকছে সেখানেই । কিছুক্ষণের মধ্যেই আরেকটা তুষারকণা এসে লাগছে গাছের গায়ে লেগে থাকা কণাটির গায়ে আলতো করে । এভাবে প্রথম পড়া তুষারের গায়ে পেজা তুলার মত আরো কিছু তুষারকণা এসে লেগে লেগে একটা সাদা বলের আকৃতি নেয় । গাছেদের ডালে এই রকম মুঠো সমান বলগুলো এক সময় আর ঝুলে থাকতে পারে না । মাধ্যাকর্ষনের টানে ঝুপ করে মাটিতে জমে থাকা বরফের ওপর ঝরে পড়ে । মাটিতেই পড়েই ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে, কী অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য!

চলবে…

………………………………………………………………………
অনুগ্রহ করে আমার লেখায় বানান ও যতি চিহ্নের ভুলগুলো দেখিয়ে দিন । ধন্যবাদ ।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।