তখনও দেশে পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে জিপিএ পদ্ধতি চালু হয়নি । মাধ্যমিক (এস.এস.সি.) ও উচ্চ মাধ্যমিক (এইচ.এস.সি.) পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলে পত্রিকার পাতায় কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের পারিবারিক ছবিসহ সাক্ষাৎকারের হিড়িক পরে যেত । চারটি শিক্ষা বোর্ডে (তখন ঢাকা, কুমিল্লা, রাজশাহী ও যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাগুলো হত) মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া ‘বিরল’ মেধাবী শিক্ষার্থীদের সাফল্যের পেছনে পরিবার, স্কুল, বন্ধু-বান্ধব তথা আত্মীয়-স্বজন সকলের অবদানের কথা গৌরবের সঙ্গে বলা হত । সেই গৌরব গাঁথার সঙ্গে যে ছবিটি থাকতো তাতে শিক্ষার্থীরা তাদের বাবা মায়ের মাঝখানে বসে দু’জনের কাঁধে হাত রেখে হাস্যোজ্বল তাকিয়ে থাকত ক্যামেরার দিকে । কখনো কখনো স্কুলের প্রধান শিক্ষকও থাকতেন সেই ছবিতে । খুবই উজ্বল সেইসব ছবি…প্রতিকী অর্থে মনে হত ভবিষ্যতের বাংলাদেশ তাকিয়ে আছে …
তখনো প্রযুক্তি এত এগোয়নি । তা নইলে সেই ছবিগুলো যদি কোনভাবে এনলার্জ করা যেত, তাহলে দেখা যেত সেই সব কৃতি শিক্ষার্থীদের সাফল্যের পেছনে আরো অন্তত ‘হাফ ডজন’ প্রাইভেট টিউটর ছিলেন, যাঁদের প্রশিক্ষনে এইসব শিক্ষার্থীরা তাদের ধারালো মেধাকে আরো শানিত করেছেন । আমি কোচিং, প্রাইভেট টিউটরিংয়ের বিরুদ্ধে কিছু বলছি না । কিংবা সেইসব মেধাবী শিক্ষার্থীদের মেধার সম্পর্কে কোন সন্দেহও প্রকাশ করছি না । এই লেখার উদ্দেশ্যও তা নয় । শুধু বলতে চাইছি সেই সব মেধাবী শিক্ষার্থীদের কথা যাদের ভাগ্যে কখনো এই রকম মেধা বিকাশের সুযোগ জুটে না । যারা এখনো বিদ্যাসাগরের মত ল্যাম্পপোস্টের আলোর নীচে দাঁড়িয়ে বই পড়ে ।
সম্প্রতি দেশে মাধ্যমিকের ফলাফল ঘোষনা হয়েছে । নামী দামী স্কুলের কৃতি শিক্ষার্থীদের সাফল্যের ভীড়ে প্রথম আলো পত্রিকার পাতায় এই খবরটিতে চোখ আটকে গেল । জিপিএ-৫ পাওয়া এইসব শিক্ষার্থীদের ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে অপরাধবোধে ভুগতে লাগলাম ।
পিরোজপুর সদর উপজেলার জুজখোলা গ্রামের মেহেদী জুজখোলা সম্মিলিত মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে সব কটি বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে । প্রাথমিকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়া মেহেদীকে ইট ভেঙ্গে পড়ার খরচ জোগাড় করতে হয়েছে । ভবিষ্যতে একজন চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখে মেহেদী । তার ভাইয়ের জবানীতে শুনুন তার আর্থিক অবস্থার কথা, “জমিজমা বলতে থাহার (থাকার) মতো একখান ভাঙা ঘর। গাছ বিক্রির সামান্য আয় থেকেই আমাদের ভরণপোষণ ও মেহেদীর লেখাপড়ার খরচ চলে ।”
ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার রোজিনা আক্তার এবার দিলালপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে । এক টুকরো জমিতে একটি ছাপরা ঘরে রোজিনার তিন বোন, দুই ভাই ও মা-বাবা থাকেন । পড়ার জন্য আলাদা কোনো ঘরের কথা চিন্তাই করা যায় না । রাতে সবাই ঘুমালে ঘরের এক কোণে কুপি জ্বালিয়ে পড়ত রোজিনা । ওই ছাপরা ঘরই রোজিনাদের একমাত্র সম্পত্তি । ঠেলা গাড়ি চালক বাবার মেয়ে রোজিনা জীবনের হিসাব নিকাশ জেনে গিয়েছে ইতিমধ্যে । তাই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে না । নার্স হয়েই মানুষের সেবা করতে চায় ।
বাবার চায়ের দোকানের আয় দিয়ে চলে রাকিবউদ্দীনদের সাত সদস্যের পরিবারটির । সংগতি নেই, তাই ষষ্ঠ শ্রেনীর পরে রাকিবকে স্কুলে যেতে নিষেধ করেছিলেন বাবা । কিন্তু বাবার কথা শোনেনি সে । বন্ধুদের কাছ থেকে পুরোনো বই ধার নিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে গিয়েছে । নিজের চেষ্টায় ও শিক্ষকদের সহযোগিতায় অষ্টম শ্রেণীতে সে বৃত্তি পায় । পড়ার পাশাপাশি বাবার সঙ্গে চায়ের দোকানে কাজ করে । নোয়াখালীর হাতিয়ার সুখচর ইউনিয়নের বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এবার সব কটি বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে ।
দিন মজুর বাবার মেয়ে খুর্শেদা মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার মহলাল উচ্চবিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে । কুপির কেরোসিনের যোগান দেয়ার সামর্থ্য নেই পরিবারটির, তাই পাশের বাড়ির বারান্দায় বিদ্যুতের আলোয় সিঁড়িতে বসে পড়েছে সে । “যেখানে যে পরিবেশেই থাকি না কেন, পড়াটা চালিয়ে যেতে” এই মন্ত্র সাধনা করে এতদূর এসেছে সে । মহলাল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খালিছুর রহমান বলেন, “খুবই গরিব পরিবারের মেয়ে খুর্শেদা । নিজের চেষ্টা ও আন্তরিকতায় এতটা পথ এসেছে । স্কুল থেকে যতটা সম্ভব তাকে সমর্থন ও সহযোগিতা করা যায়, করেছি ।” স্কুলের শিক্ষকদের আদর্শে অনুপ্রানিত খুর্শেদা শিক্ষক হতে চায় ।
দিন মজুর বাবার চার সন্তানের দ্বিতীয় আওলাদ সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার গাছতলা উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে । বাবার আয়ে ছয় জনের পরিবারটির অন্ন সংস্থান করাই দুরুহ, রাতে পড়ার জন্য কেরোসিন জোগাড় সম্ভব হয়নি । তাই দিনেমানেই পড়তে হয়েছে আওলাদকে । স্কুলের সব পরীক্ষায় প্রথম হওয়া আওলাদ স্বপ্ন দেখে চিকিৎসক হওয়ার ।
মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার রুনার প্রাইভেট টিউটর থাকার প্রশ্নই উঠে না, সে নিজেই গৃহ শিক্ষকতার কাজ করে পড়ার খরচ জুগিয়েছে । অন্যের বাড়িতে কাজ করে মা অন্ন যোগান তিন সন্তানের । কাজেই, বাঁশের বেড়ার ঘরে খড়ের ছাউনি, বিদ্যুৎ নেই, বর্ষায় ঘরের চাল দিয়ে পানি পড়ে । পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পাওয়া রুনা এবারের মাধ্যমিকে জোড়পুকুরিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে সবকটি বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে ।
লেখাটির শুরুতে অপরাধবোধের কথা বলেছিলাম । এবারে তার একটু ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে । আমার মায়ের নাম “নূরজাহান” (তিনি এখন আর বেঁচে নেই, কিন্তু আমার মধ্যে তিনি প্রতি দিন, প্রতি মুহূর্ত আছেন) । তাঁর জন্মের পর প্রথমবার শিশুকন্যাকে কোলে নিয়ে আমার নানা এই নাম রেখেছিলেন । সাথে সাথে এই প্রার্থনাও করেছিলেন, তাঁর কন্যাটি যেন নামটিকে স্বার্থক করে, সত্যিই এই “পৃথিবীর আলো” হয় । আমার মা ক্ষূরধার মেধা, অসম্ভব স্মৃতিশক্তি ও অদম্য ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র প্রতিকূল পরিবেশের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বেশীদূর করতে পারেন নি । ইংরেজ উপনিবেশিক শাসনামলে সাম্প্রদায়িক দাংগার কারনে তখনকার দিনের এন্ট্রান্স (এখনকার মাধ্যমিক সমমান) পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার সময়েই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখায় যবনিকা পড়ে । তবে, জীবনের শেষদিনটি পর্যন্ত তিনি পড়াশোনা করে গিয়েছেন । ক্ষুদ্র আর্থিক সামর্থ্য দিয়ে নিজের নয়টি সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়ায় নিয়ে গিয়েছেন । শুধু তাই না, তাঁর আশেপাশের যে কারুর লেখাপড়ায় তিনি সাধ্যের মধ্যে সবটুকু করেছেন । প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে জ্ঞানের আলো ছড়ানোই ছিল আমার অতি সাধারন মায়ের জীবনের ‘ক্রুসেড’ ।
এবারে আমার মায়ের সারাজীবনের বেদনার কথাটা বলি । স্কুল শিক্ষক বাবার প্রতি ছিল তাঁর অসীম শ্রদ্ধা । জীবনে বাবার বিরুদ্ধে তাঁর একটাই অভিযোগ ছিল, বাবা তাঁর লেখাপড়ার পথটি মসৃন করতে যথেষ্ঠ করেননি । আমার মামারা দু’জনই পি.এইচ.ডি. করেছেন । আমার মা বলতেন, সুযোগ পেলে তিনিও তাই করতেন । আমার মাকে যাঁরা দেখেছেন, তারা জানেন কথাটা ভীষন সত্য । আমার মায়ের সম্পর্কে তাঁর ভাগ্নে বলেছিলেন, “খালাম্মা যদি এই যুগে জন্মাতেন, তাহলে নির্ঘাত ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হতেন ।”
আমার মাকে নিয়ে আমার একটি পরম বিস্ময় আছে । জীবদ্দশায় কখনোই মাকে মনে হয়নি তাঁর পড়াশোনার দৌড় মাধ্যমিকও নয় । স্বশিক্ষিত এই মানুষটির ঝুলিতে কোন সার্টিফিকেট ছিল না । অথচ, জীবনের যে কোন দূর্গম সমস্যাকে দেখার আলোকিত দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর ছিল । বেঁচে থাকতে কত অজস্রবার যে ভেবেছি আমার মা যদি সত্যিই তাঁর পূর্ন সম্ভাবনায় বিকশিত হতেন, কত শত মানুষ যে এই “আলোকের ঝর্ণাধারা”র দেখা পেত!
এবারে ফিরে আসি প্রথম আলোর ওই খবরটির কথায় । বুদ্ধিদীপ্ত মেধাবী শিক্ষার্থীদের মুখগুলোতে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার আনন্দের চিহ্ন মাত্র নেই, আছে অনিশ্চয়তার বিষন্নতা (যেন এই অযাচিত ভাল ফলাফল করে তারা কোন অন্যায় করে ফেলেছে !) । সামনের দিনগুলোতে লেখাপড়া চালিয়ে নিতে পারবে কিনা সেই অনিশ্চয়তার অন্ধকার ইতিমধ্যেই দখল করেছে ওদের দু’চোখের গহবর । আমরা কি এইসব চোখ থেকে এই অনিশ্চয়তার অন্ধকার দূর করে সাহসী আলোর চাষ করতে পারি না? বিশেষতঃ যাঁরা প্রবাসে থাকি, তাঁদের প্রতিদিনের এক কাপ কফির পয়সা বাঁচালেই সারা মাসে হয়ে যাবে ($১*৭০*৩০ = ৳২১০০) অন্ততঃ একজন শিক্ষার্থীর পড়ার খরচ । আমি জানি এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক বেশ কিছু এডমিনিস্ট্রেটিভ দিকও আছে । যদি কোন প্রতিষ্ঠান এইসব শিক্ষার্থীদেরকে নিয়মিত মনিটরিং ও রিপোর্টিংয়ের কাজটি নেয়, তাহলে এই রকম একটি উদ্যোগ খুব দুঃসাধ্য কিছু নয় । খুটিনাটি অন্যান্য দিকগুলো বিশদে ভেবে দেখা যেতে পারে । দেশে ও প্রবাসে থাকা একটি “সক্ষম” পরিবার একজন শিক্ষার্থীর দায়িত্বও যদি কাঁধে তুলে নেয়, তাহলে আশা করা যেতে এমন দিন একদিন আসবে যেদিন পত্রিকার পাতায় এই রকম মেধাবী শিক্ষার্থীদের মুখগুলো শুধু আলোয় ঝলমল করবে, আমাদেরকেও কোন অপরাধবোধে আর ভুগতে হবে না…
………………………………………………………………………
এই লেখাটি তৈরি করার সময় কোন এক অদ্ভুত কারনে মৌসুমী ভৌমিকের স্বপ্ন দেখবো বলে… গানটি মাথার মধ্যে ঘুরছিল ।
মন্তব্য
জোহরা ফেরদৌসী - আপনি কি সেরকম কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত/জড়িত আছেন? নাকি, এই বিষয়ে কী করা যায় সেটা নিয়ে ব্রেইন স্টর্মিং করতে চাচ্ছেন?
অপরাধ বোধ হচ্ছে আমারও। কিন্তু, তারপর কী?
স্নিগ্ধা, অনেক দেরীতে জবাব লিখছি বলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি । ভেবেছিলাম এই ব্যপারে কোন উদ্যোগ ভাল করে জেনে নিয়ে জবাব দেব । তাছাড়া ব্যক্তিগত জীবনের কিছু টানাপোড়েনও ছিল ।
সে যাক, আমি কোন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত না । তবে প্রথম আলো ট্রাস্ট (এর অস্তিত্ব আমার আগে জানা ছিল না) এর অদম্য মেধাবী প্রকল্পটি ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও এই কাজটি করছে । প্রতি বছর ৪০টি দরিদ্র অথচ অনন্য মেধাবী শিক্ষার্থীকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয় দু’বছরের জন্য । এখানে বিস্তারিত জানতে পারেন । স্বপ্ন দেখি এমন আরো সৎ, কার্যকরী উদ্যোগ আসুক শিক্ষার আলো ছড়াতে ।
……………………………………
বলছি এক জ্যোতির্ময়ীর কথা
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
আপনার মায়ের কথা জেনে খুব ভালো লাগলো।
দেশেই থাকি, আর সামর্থ্যের সীমারেখায় থাকা আত্মীয়-স্বজনও কম না। যথাসাধ্য চেষ্টা করি তাঁদের কষ্টটা কমাতে, কারণ তাঁদের অধিকারটাই সর্বাগ্রে।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
শামীম, ভাল লাগল আপনার কথা শুনে । সবাই আমরা সাধ্যমত নিজের চারিপাশের মানুষদের কষ্ট কমাতে উদ্যোগী হলেই অনেক করা হয়ে যায় ।
……………………………………
বলছি এক জ্যোতির্ময়ীর কথা
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
নতুন মন্তব্য করুন