বাতাসে শীতের গন্ধ । প্রকৃতিতে রংয়ের উৎসব শেষ করে পাতাদের ঝরে পড়াও শেষ । বাদামী রংয়ের শুকনো পাতা মাড়িয়ে বাড়ি ফেরার পথে কোথা থেকে ভেসে এল অনেক দিন আগের এই রকম শীতের কোন ইউক্যালিপটাসের শুকনো পাতার গন্ধ...নজরুলের সমাধির পাশে লাইব্রেরীর গেইটে লাল রঙ্গা বাস থেকে নেমে কলা ভবন পর্যন্ত হেঁটে আসতে আসতে মাটি থেকে কুড়িয়ে নিতাম ইউক্যালিপটাসের শুকনো পাতা । একটু ছিড়লেই সেই পাতা থেকে বের হ’ত অদ্ভুত এক সৌরভ...কোথা হতে ভেসে এলো ফেলে আসা দিনের গায়ে লেগে থাকা সেই সৌরভ...আর তার হাত ধরে চলে এল বন্ধুর মত বন্ধুদের স্মৃতিরা...
একটি ছোট্ট কারেকশনঃ গত পর্বে লিখেছিলাম, “আমার মা ছিল আমাদের পরিবারের পালাকার ।” পাস্ট টেন্সে লেখা বাক্যটি সত্যভাষন নয় । আমার মায়ের নশ্বর দেহ আর এই পৃথিবীতে নেই । কিন্তু আমার মা যেখানে থাকার ঠিক সেখানেই আছেন, তীব্রভাবে আছেন...
এই সব অর্থহীন স্মৃতির কোন পরম্পরা নেই । তবু যদি আগ্রহ থাকে, তাহলে প্রথম পর্ব ও দ্বিতীয় পর্ব এখানে ।
৬.
স্কুল জীবনেই এক সময়ে শুরু করেছিলাম...সঙ্গোপনে ডায়রী লেখা । সেই ডায়রীতে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে “ঘোর লাগা” অংশ লিখে রাখা হ’ত । নিজেও অল্প বিস্তর কাব্যচর্চা করা হ’ত (স্কুল জীবনে ডায়রী লিখেছে, অথচ কাব্যচর্চা করেনি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না । প্রকৃতি এমন “অন্যায়” সহ্য করে না) । সেই গোপন ডায়রীর পাতায় আরও একটি জিনিষ লেখা হ’ত- স্বপ্নের কথা । সেই সব নির্ভেজাল স্বপ্নের মধ্যে আর যাই থাকুক বাস্তবতার মত “সাধারণ” কিছুর প্রবেশাধিকার ছিল না । আমার ভবিষ্যৎ আবাসস্থল সম্পর্কে লেখা স্বপ্নের কথা আবছা মনে আছে ।
উজ্জয়নীপুর গ্রামের সোহাগী নদীর ধার ঘেঁষা নিকানো উঠানের বাড়ির বাসিন্দা হওয়ার কথা ছিল আমার । পুকুর কিংবা দিঘীতে আমার ঠিক পোষাবে না, সে আমি তখনই জানতাম । আমার একটা নদী চাই, আস্ত নদী । বাড়ি ঘেঁষা সেই নদীর পাড়ে থাকবে একটি বিশাল হিজল গাছ, যার মোটা শেকড়ের ওপর বসে দিব্যি পা ডুবিয়ে দেয়া যাবে নদীর শান্ত জলে । হিজল গাছের চিরল পাতারা নুয়ে নদীর জল ছুঁয়ে থাকবে । চান্নি পসর রাতে হিজল গাছের গুড়িতে বসে অবাক বিস্ময়ে দেখা যাবে নদীর বুকে ঢেউয়ের আঘাতে জ্যোছনারা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হচ্ছে...সে বাড়ির আর কোন বাসিন্দা থাকবে কি না, আজ আর তা মনে নেই...
৭.
মাধ্যমিকের বাংলা ও ইংরেজী রচনার কথা মনে আছে ? কে কত রচনা (বিশেষত: ইংরেজী রচনা) মুখস্থ করতে পারে (অন্যথায় “কমন” করতে পারে) তার এক অঘোষিত প্রতিযোগিতা ছিল । এই পর্যায়ে গৃহশিক্ষকের ভূমিকার কথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । আমার গৃহশিক্ষক ছিল আমার সেজভাই । তার শিক্ষা পদ্ধতির মুল কথাই ছিল, “কোন কিছু মুখস্থ করা যাবে না । যে জিনিস তোমার নিজের না, তা নিজের বলে চালানো যাবে না ।” বাংলা রচনার ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা ছিল না, যে কোন বিষয়েই রচনা লিখতে বলা হোক না কেন, গুরুদেব থাকতে ঠেকায় কে ? সে কালের রচনাতে কোটেশনের একটা বিশেষ মর্যাদা ছিল । ধরা যাক, রচনা লিখতে বলা হয়েছে “তোমার প্রিয় ঋতু- বর্ষাকাল” । আমাকে আর পায় কে ? ক্লাসের সবাই মোটামুটি “বাদল দিনের প্রথম কদমফুল...” থেকে বড়জোর “আজি ঝরঝর মুখর ভাদর দিনে...”তে রচনা শেষ করে ফেলত । আমি শুরুই করতাম “মেঘের পরে মেঘ জমেছে / আমায় কেন বসিয়ে রাখো একা দ্বারের পাশে...” (আজকাল এই গানটা শুনলেই মনে হয় রবীন্দ্রনাথ লিখতে চেয়েছিলেন “কাজের পরে কাজ জমেছে / আমায় কেন তুমি ডাক অকারণে ...”) দিয়ে । তারপর দিব্যি চলে যেতাম “তোমার ঐ ঝর্ণাতলার নির্জনে/ মাটির এই কলস আমার ভরে গেল কোনক্ষণে...” । বর্ষাকাল কি করে ঝর্ণতলার নির্জনে চলে যেত সে কথা আজ আর মনে নেই । তবে কোনভাবে না কোনভাবে যেত, সে আমি নিশ্চিত । তারপর ধরা যাক, রচনা লিখতে বলা হ’ল “তোমার প্রিয় একটি ভ্রমণ কাহিনী” । অন্য সবার দৌড় “ওগো কর্ণধার, তোমারে করি নমস্কার” পর্যন্ত । আমি তখন “আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ (“চাওয়াতেই” কে “চলাতেই” করা যেতেই পারে । রবীন্দ্রনাথের মত দেবতুল্য মানুষ এই রকম ছোটখাটো বিষয়ে কিছু মনে করবেন না, এ আমি নিশ্চিত ছিলাম)” দিয়ে শুরু করে “আমার ভাঙ্গা পথের রাঙ্গা ধুলোয় পড়েছে কার পায়ের চিহ্ন”তে শেষ করতাম ।
সমস্যা দেখা দিল ইংরেজী রচনা লিখতে গিয়ে । গ্রামার সে যেই ভাষারই হোক, আমার দুই চোখের বিষ । গ্রামার মানেই হ’ল আমার সৃজনশীলতার গোঁড়ায় কুঠারাঘাত । গ্রামারের নিয়ম কানুন দেখলেই আমার গাইতে ইচ্ছে হ’ত “কারার ঐ লৌহ কপাট / ভেঙ্গে ফেল, কররে লোপাট” । ইংরেজী রচনা লিখতে হলে যে পরিমাণ গ্রামার জানা থাকা দরকার তা আমার ঝুলিতে ছিল না । বিশেষত: টেন্সের টেনশনে আমার প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত ছিল । তারমধ্যে একবার হাফিজা আপা ক্লাসে নিয়ম করলেন, ইংরেজী রচনাতে বাংলা কিছুই লেখা যাবে না । কি বিপত্তি ! “ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত/ আমরা আনিব রাঙ্গা প্রভাত” এর ইংরেজী কি হবে ? Upon kicking the door of dawn, we shall bring reddish morning?
স্কুলের শিক্ষকরা “জনৈক প্রধান শিক্ষকের” কোন বই থেকে রচনা মুখস্থ করে লিখলে কিছু মনে করতো না । কিন্তু বাসায় সেজভাই আমাকে দিয়ে ইংরেজী রচনা লিখিয়ে ছাড়তো । সেই রচনার প্রথম ড্রাফটের গুঢ় অর্থ উদ্ধার আমি ছাড়া কারুর পক্ষে সম্ভব ছিল না (গ্রামের পত্র লিখকের সেই গল্প জানা আছে নিশ্চয় ? যাকে প্রাপকের কাছে গিয়ে “পত্র” পড়ে দিয়ে আসতে হ’ত) । সেজভাই অসীম ধৈর্য্য নিয়ে সেই ড্রাফটের ওপর কাজ করে আমাকে ধরিয়ে দিত । আমার রচনা তখন এডিটের ভারে “লালে লাল হো যায়েগা” । কিন্তু সেজভাই যেহেতু নাছোড়বান্দা, কাজেই অশ্রুসিক্ত নয়নে আমাকে সেই রচনার ওপর কলম চালিয়ে যেতে হ’ত । কয়েক দফা মিটিংয়ের পরে যে জিনিস “এপ্রুভড” হ’ত, তা বড়জোর তিন থেকে চার প্যারাগ্রাফ । কাজেই ক্লাসের সবার ইংরেজী রচনা যেখানে তিন, চার পাতা আমার ইংরেজী রচনা ছিল বিশ্রী রকমের সংক্ষিপ্ত ।
৮.
মাধ্যমিকের স্কুল ফাইনালের আগে “টেস্ট পরীক্ষা” নামক একটি “পুলসিরাত” পাড়ি দিতে হ’ত । এই পুল সিরাতের মাধ্যমে ঠিক হ’ত স্কুলের সম্মানজনক “পতাকা তলে” কে কে যাবে বোর্ডের স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় । তার আগের ছোটখাটো “ওয়ার্মআপে”র জন্য ছিল প্রি টেস্ট পরীক্ষা । আমাদের সময়ে শহীদ আনোয়ার স্কুলের হেড মিস্ট্রেস প্রজ্ঞাপন জারী করলেন, প্রি টেস্টই হবে অফিসিয়াল “টেস্ট বা নির্বাচনী” পরীক্ষা । এই পরীক্ষাতেই সবার ভাগ্য নির্ধারিত হবে । কিছুদিন পরে টেস্ট পরীক্ষায় “ধারালো” ছুরিকে “শানিত” করা হবে । মরার ওপরে খাড়ার ঘা, সমগ্র বাংলাদেশের স্কুলে তেত্রিশে পাস, কিন্তু আমাদের স্কুলে চল্লিশে পাস । প্রি টেস্ট পরীক্ষার ঠিক একমাস আগে হিতাকাঙ্ক্ষী শিক্ষকরা “সারপ্রাইজ মান্থলী টেস্ট” এর ঘোষণা দিলেন...জীবন একেবারে পরীক্ষায় পরীক্ষাময়...
এক ভোরে শুদ্ধচিত্তে স্কুলে গিয়েছি । প্রথম ক্লাসেই বাতেন স্যার এসে ভগ্নদূতের মত ঘোষণা দিলেন, “আজ ট্রিগোনমেট্রির সারপ্রাইজ টেস্ট” । আমি খাতায় মনোযোগ দিয়ে নাম, সাকিন লিখছি আর মনে মনে সকালে রেডিওতে শোনা পাপিয়া সারোয়ারের “তুমি কোন কাননের ফুল, কোন গগণের তারা / তোমায় কোথায় দেখেছি...” ভাজছি । নাম, সাকিন লেখা শেষ, মাথা তুলে বোর্ডে তাকিয়েছি...বাতেন স্যার ইতিমধ্যে তিন নাম্বার প্রশ্ন লিখে চার নাম্বার শুরু করছেন । আমি তখন বিহ্বল চিত্তে তাকিয়ে আছি বোর্ডের দিকে, “হা ঈশ্বর, তুমি কোথায় ? আজকের এই দিনটিকে, এই মুহূর্তটিকে কি কোন ভাবে মহাকালের ক্যালেন্ডার থেকে মুছে ফেলা যায় না ? বাতেন স্যার এসব কী লিখছেন ? কোন ভাষায় লিখছেন ? এই ষড়যন্ত্রের মানে কি ?” মাথা থেকে কোন কাননের ফুল ক্রমশ: ম্রিয়মাণ হচ্ছে, সে জায়গায় হতাশা ও ক্ষোভ জায়গা নিচ্ছে (বিশেষ করে বেগম রোকেয়ার বিরুদ্ধে) । মুসলিম অন্তঃপুরিকাদের এই অবমাননাকর ট্রিগোনমেট্রির ফাঁদে ফেলার জন্য বেগম রোকেয়াকে কি শাস্তি দেয়া উচিত কিছুতেই যখন কিনারা করা যাচ্ছে না, তখন বাতেন স্যার শেষ প্রশ্নটি লিখে ফেলেছেন । পাঁচ নম্বর প্রশ্নটিই শুধু মাত্র পরিচিত মনে হ’ল - প্রমাণ কর যে, “সাইন স্কয়ার থিটা প্লাস কস স্কয়ার থিটা ইকুয়ালস ওয়ান” । হাতে লেগে থাকা চক ঝাড়তে ঝাড়তে স্যার ঘোষণা করলেন, “নো চয়েস । সব প্রশ্নের জবাব অপরিহার্য্য ।”
যথাসময়ে সেই পরীক্ষার খাতা দেয়া হ’ল । “ধরণী দ্বিধা হও” প্রার্থনা নিষ্ফল হ’ল । পঁচিশে আমি পাঁচ, দূরদানা বার আর শিবানী সতের । আমাকে সেই পরীক্ষার খাতা সেজভাইয়ের সমীপে সমর্পণ করতে হ’ল । সেজভাইয়ের প্রথম প্রতিক্রিয়া এই রকম, “কি পরীক্ষার খাতা এটা ?”
- আমি নির্বাক ।
- আরেব্বাস ! এতো দেখছি বিশাল ব্যাপার । সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচ টন । কীভাবে আনলা এই খাতা তুমি স্কুল থেকে ? ট্রাক ভাড়া নিছিলা ? এই খাতা তো ট্রাক ছাড়া আনা সম্ভব না ।
সেজভাই বলেই চলেছে,
- নিশ্চয়ই ক্লাসে এটাই “সর্বোচ্চ নম্বর”, উল্টো দিক দিয়ে ? ঠিক ?
- আমি বাকরুদ্ধ । তাই ওপর নীচ মাথা নেড়ে কবুল করি যে কথা সত্য ।
সেজভাই আর কি কি বলেছিল মনে নেই । তবে এক পর্যায়ে তার সাথে আমাকে একটা অলিখিত চুক্তিতে সই করতে হয়েছিল, মাধ্যমিক পরীক্ষার আগ পর্যন্ত কাব্যচর্চায় “সাময়িক মুলতবী” দিতে হবে (ইতিমধ্যে একদিন আমার ইমিডিয়েট বড় ভাইটি আমার “সিক্রেট” ডায়রীর কথা ফাঁস করে দিয়েছিল । অথচ, মাসের মধ্যে গুনে গুনে সাতাশ দিন সকালে আমি তার মশারী ভাঁজ করে দিতাম । সপ্তাহে চারদিন সে খেলার মাঠে স্যান্ডেল হারিয়ে এসে আমার স্যান্ডেল পায়ে খেলার মাঠের ধুলা “প্রক্ষালন” করত । সেই ভাই আমার ! এই পৃথিবী আসলে “মীরজাফরে” ভরা ! ) । মন দিয়ে ট্রিগনোমেট্রি ও অন্যান্য সকল মেট্রি করতে হবে । তার বিনিময়ে পরীক্ষার পরের তিন মাস আমি বিরতিহীন কাব্যচর্চা করতে পারব বাধা বন্ধনহীন । কি আর করা ? কবিতা তোমায় দিলেম আজকে ছুটি / পরীক্ষার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় / রবীন্দ্রনাথ যেন নির্মম ট্রিগনোমেট্রি...
৯.
অতঃপর আমি তৈলাক্ত বাঁশবাহী বানর, ছিদ্রযুক্ত চৌবাচ্চার নল খোলা ও লাগানো, স্রোতের অনুকূল ও প্রতিকুলে সাঁতার, মিডল টার্ম ফ্যাক্টর, উপপাদ্য, সম্পাদ্য, সাইন-কস-টেন-কটের সঙ্গে দিনাতিপাত করতে শুরু করলাম । সেজভাই আমাকে স্কুলের হোম ওয়ার্কের পাঁচগুণ “হোম” হোম ওয়ার্কে নিমজ্জিত করে রাখল । যদিও আমি সেজভাইকে অনেক সময় “ছিদ্রযুক্ত চৌবাচ্চা মেরামত কেন করা হচ্ছে না” এই প্রশ্নে ব্যস্ত রাখতে চাইতাম, কিন্তু বিশেষ লাভ হ’ত না । তাছাড়া “তৈলহীন” কোন বাঁশের কেন কোন ব্যবস্থা করা হয় নাই, সে বিষয়েও আমার বেশ ক্ষোভ ছিল । বাঁশের মাথায় ওঠার পরে যে বানরটির নামার কোন বন্দোবস্ত রাখা হয় নি, সেটাও বেশ “অনৈতিক” ছিল আমার মতে । অনেকটা গাছে তুলে মই কেড়ে নেয়ার মত ব্যাপার মনে হয়েছে । কিন্তু আমার কথায় তো আর বিশ্ব চলে না... কাজেই আমাকে সেই সব অনৈতিকতার সঙ্গে “আপোষ” করেই পরীক্ষা শেষের শুভ দিনের (“এই দিন দিন না আরও দিন আছে / এই দিনেরে নিব আমি সেই দিনের কাছে...”) অপেক্ষায় থাকতে হয়েছিল ।
এদিকে একটা সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করল । পরীক্ষার দিন যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল, আমার ঘুমের তীব্রতাও ততই ঘনীভূত হতে থাকল । যেখানে সেখানে যখন তখন সেই ভয়ঙ্কর ঘুম আমাকে দখল করে নিত (অনেকটা নাটকের বর্ণনার মত “পতন ও নিদ্রা”) । আমি যতই নিজেকে চোখ টাটাই “কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে / দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহিতে ?”, ততই আমার দুই চোখ আমাকে উপেক্ষা করে নিদ্রাদেবীর সেবায় আত্মনিয়োগ করতে লাগল । বাড়িতে তখন আমার নাম হয়ে গেল “কুম্ভকর্ণ” । সবাই মিলে ভবিষ্যৎ বানী করল, ম্যাট্রিক পরীক্ষা না দিয়ে কোন ঘুম প্রতিযোগিতায় আমার নাম লেখানো উচিত । দেশ ও দশের নাম উজ্বল করতে পারব ।
এই পরিণত বয়সে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সকল ইনসোমনিয়ার রোগিদেরকে শুধু ম্যাট্রিক পরীক্ষায় একবার রেজিস্ট্রেশন করালেই তাদের দু’চোখে বানের জলের মত ঘুম এসে বাসা বাঁধবে ।
১০.
আমাদের সময়ে ঈদ ও পুজা উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যা পত্রিকাগুলো ছিল বিশেষ আকর্ষণ । নবীন ও প্রতিষ্ঠিত লেখকদের সদ্য লেখা গল্প, কবিতা, উপন্যাসে ভরা তকতকে নতুন মোড়কের এই সব বিশেষ সংখ্যার জন্য আমরা তীর্থের কাকের মত তাকিয়ে থাকতাম । কোন এক শীতের অলস দুপুরে বিচিত্রার পাতায় পড়তে শুরু করলাম আনু মোহাম্মদের অনুবাদে ওরিয়ানা ফালাচীর উপন্যাস “হাত বাড়িয়ে দাও” । অনাগত শিশুকে উদ্দেশ্য করে কথা বলছে এক গর্ভবতী নারী । অবিবাহিত, দরিদ্র, নিঃসঙ্গ এই নারী সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে গর্ভস্থ ভ্রূণকে সে এই পৃথিবীতে আনবে । যাকে সে ভালবেসেছিল, সেই মানুষটির এত সাহস নেই, চলে গিয়েছে এই নারীকে একা রেখে ।
একবার আসেও সে, কিছু ফুল নিয়ে । সেই ফুল বিছানায় রাখতেই সাহসী সেই নারী, সংস্কার ভাঙ্গা সেই নারী অমঙ্গল হবে এই আশঙ্কায় তাড়াতাড়ি সরিয়ে রাখে বিছানা থেকে সেই ফুল । পুরুষটি যখন গর্ভস্থ ভ্রুনটিকে পৃথিবীতে না আনার পরামর্শ দেয়, তখন সেই নারী তাকে সাফ জানিয়ে দেয় এই শিশুর দায়িত্ব শুধু তার একার, ঐ পুরুষের নয় । পুরুষটি চলে যায় । আর কখনো আসে না ।
রুদ্ধশ্বাসে পড়ছি, আর এক এক করে আমার ভেতরের জগতটা ভেঙ্গে পড়ছে । আমি শেষতক আশা করছি পুরুষটি ফিরে আসবে, এই নারীর পাশে দাঁড়াবে । আমি তখনো বিশ্বাস করি ভালবাসার মানুষকে কেউ কখনও ছেড়ে যায় না...
শিশিরের শব্দের মত করে সন্ধ্যা নেমে আসছিল । আর আমি প্রানপণে পড়ছি এক ভালবাসার মৃত্যুর গল্প । সেই শীতের দিনের শেষ আলোটুকুতে বিপন্ন বিস্ময়ে প্রথম জানলাম ভালবাসার মানুষের কাছ থেকেও মানুষ চলে যায়, যেতে হয় । যাওয়ার সময় যখন আসে, তখন পবিত্র গ্রন্থের মন্ত্রপূত “চুক্তিপত্র” কিংবা কোন এক শেষ বিকেলের শুদ্ধ আলোয় করা “আজন্ম ছুঁয়ে থাকার” প্রতিশ্রুতিরা পেছনে পড়ে থাকে ...মানুষকে যেতে হয়...যেতে দিতে হয়...
হয়তোবা সব ভালবাসাকে ধারন করার শক্তি এই পৃথিবীর কখনই হবে না ।
.........
কি মাথা ধরিয়ে দিলাম ? নিন তাহলে মগন ঘুমের একটা গান শুনুন । তবে গানটা যদি তারপর মাথা থেকে বের না হয়, তাহলে আমি দায়ী নই ।
মন্তব্য
অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য । আপনাকে এক মাঠ সবুজ
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
আপনাকেও এক মাঠ
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
অসাধারণ একটা লিখা আপু।
বন্দনা, আমার এমন দূর্দশার গল্প আপনার কাছে "অসাধারন" লাগল ?!? পাঁচ টন নম্বরী খাতা বাড়ি আনতে আমার কত কষ্ট হয়েছিল, আপনি সেটা একটু প্রান দিয়ে অনুধাবন করলেন না ?
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
ইয়ে মানে, এমন কিউট একটা পাঁচ টনি ভাই থাকতে আর কি লাগে।
আমার সেজ ভাইকে আপনার “কিউট” মনে হয়েছে ? পড়তেন যদি তার পাল্লায়, তাহলে সব চৌবাচ্চার অংক আপনাকে বুঝিয়ে ছাড়তো ।
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
কোট করতে হলে পুরো লেখাই কোট করতে হবে, এতটাই ভালো লিখেছেন আপনি। আচ্ছা আপনারা এত ভাল লিখেন কিভাবে বলেনতো? টেস্ট আর প্রিটেস্টের সেই দিনগুলির কথা, বাংলা রচনা, ভাবসম্প্রসারণের কথা সব কিভাবে মিলে যায়? অফিসে বসে গান শোনা যায়না তাই "সোনায় সোহাগা" হলোনা।
আপনার এই লেখা উসাইন বোল্টের গতিতে দৌড়াক।
ফারাসাত
ফারাসাত, আপনি সেই লোক না যে আমাকে এর আগের পর্বেও চলতে বলেছিলেন ? আপনার মত "বাজে" লোকেদের কথাতেই এই সব পরীক্ষা ফেলে'র "কনফেশন" করতে বসা । আবারও বলছেন উসাইন বোল্টের গতিতে দৌড়াতে ? তারপর, এই আকালের দিনে আমার রুটি রুজির "কাজ"টা চলে গেলে আমি খাব কী ?
যাক গে, কলিম শরাফীর কন্ঠে মগন ঘুমের গানটা শুনতে ভুলবেন না যেন । একবার গানটা শুনলে, কমপক্ষে তিন দিন এই গানের হাত থেকে মুক্তি নেই
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
জ্বী আমিই সেই দুরাত্মা পাঠক!! যে কিনা সকল কাজে অকাজে, লাজে বেলাজে পুরোপুরিই "বাজে"!
ইউটিউব বাংলাদেশে বন্ধ তাই গানটা শুনতে পারিনাই। যদি পারেন গানটার নাম দিয়েন।
আরে আপনার মতো লেখিকা রুটি-রুজি নিয়ে চিন্তা করা কি মানায়, বলেন? লেখতে থাকুন আর আমরাও ক্ষণিক হাসি ক্ষণিক বিষন্নতায় আক্রান্ত হই।
ফারাসাত
বাংলাদেশে ইউ টিউবের “প্রবেশাধিকার” নিষিদ্ধ ? ও হো দেশ তাহলে ভীষন বেগে এগিয়ে যাচ্ছে ...শনৈ শনৈ... কি বলেন ?
যাকগে যে গানটা শুনতে বলেছিলাম, সেটা হ’ল “আমি তখনো ছিলেম মগন গহন ঘুমে / যখন বৃষ্টি নামল...” শুনতে হবে কলিম শরাফীর কন্ঠে । অন্য কারুর গলায় আপনি এই জিনিষ পাবেন না ...পুরো এক সপ্তাহ আপনাকে মগন থাকতে হবে
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
হয়তোবা সব ভালবাসাকে ধারন করার শক্তি এই পৃথিবীর কখনই হবে না।
এটা অনেকটা রবীন্দ্রনাথের "সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালবাসিলাম । সে কভু করে না বঞ্চনা"র মত কথা আর কি ! জানি সত্য, তবু মেনে নিতে কোথায় যে টান লাগে !
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
ধুসর, আপনাকেও
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
বাহ্ ! অতীব সুখপাঠ্য।
ধন্যবাদ আপনাকে ।
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
দুর্দান্ত !
খুব ভালো লাগলো।
আপ্বিনার কথাটা পড়ে, বাবুর একটা কবিতা মনে পড়ল-
"বুঝা যায় আধো প্রেম, আধখানা মন
সমস্ত কে বুঝেছে কখন???"
অনেক ধন্যবাদ সাফিনাজ পড়ার জন্য ও মন্তব্য করার জন্য ।
বুঝে ফেললে যে এ পৃথিবী তার সব রহস্য হারিয়ে ফেলতো । তারচেয়ে সেই ভাল, এই পৃথিবী বহাল তবিয়তে থাকুক তার রহস্য নিয়ে ।
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
আমার সচলজীবনের মেয়াদ প্রায় চার বছর ছুঁইছুঁই। নীড়পাতায় যে সিরিজ লেখাগুলো নিখাদ মুগ্দ্ধতায় পড়েছি, [স্মৃতির শহর, গানবন্দী জীবন, মন পবনের নাও, ইচ্ছে ঘুড়ি...] ---সেগুলোর সঙ্গে এটাও যোগ করা থাকবে।
যে যায়, সে তো চলেই যায়! হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে হাসি আনতে হয় তবুও....
তবে,মায়া আর ঘৃণা দুটোই বড় সাংঘাতিক জিনিস। অমোচনীয় কালির মতো। একবার বসে গেলে তুলতে কষ্ট হয় খুব।
পাঁচ তারা দাগালাম।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
তিথী বোনডি,
তোলার দরকার কী ? থাকুক না জীবনের গায়ে কিছুটা মায়া, কিছুটা ঘৃণা । তা নইলে এ জীবন যে পুরাই "ম্যাড় ম্যাড়ে" ভাতের ফ্যান ।
আর মন্তব্যের শুরুতে যে "এওয়ার্ড" দিলে তার জবাবে বলছি "এ মণিহার আমায় নাহি সাজে..." । তারপরেও তোমাকে এক আকাশ তারা । ভাল থেকো রে বোনডি, ভাল থেকো ।
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
এত সুন্দর একটা লেখার তারিফ না করে থাকা গেলনা। লগিন করতেই হল। না করলে সেটা অন্যায় হত।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
কোনটা এত "সুন্দর" লাগল আশা ? "পাঁচ টনি" নম্বর না কি "পতন ও নিদ্রা" ?
আজকাল মানুষের "দূর্দশায়" যে অন্য মানুষ এত আনন্দিত হয়
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
আপনার জীবনবোধ এবং সেটাকে প্রকাশ করবার ভঙ্গিমায় মুগ্ধ হয়েছি। দুর্দশায় আনন্দিত হইনি। এমন আমার নিজেরি ঢের আছে।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
অসাধারণ লেগেছে। মন্তব্য নিস্প্রয়োজন। তবু মন্তব্য করতে হলো।
স্বয়ম
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ । মন্তব্য কখনো "নিস্প্রয়োজন" নয় । অতীব প্রয়োজন ।
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
অসাধারণ লাগলো।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
অনেক ধন্যবাদ স্মৃতির শহর । আর বোধহয়, "হাফ এন আওয়ার" পরে হচ্ছে ডিসেম্বর চার তারিখ ইস্টার্ন টাইম জোনে । যাক গে, আরো একবার শুভ জন্মদিন স্মৃতির শহর সব শুভ হোক আপনার, কন্যাদের ও তাদের জননীর । এই শেষের মানুষটি সম্পর্কে লিখুন না একবার ?
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
১০০ পর্ব চাই।
..................................................................
#Banshibir.
আপনি কি চান ? আমি আমার জীবনের সমস্ত পরীক্ষা ফেলের "কনফেশন" করে ফেলি ? তারপর আমার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমি মুখ দেখাব কিভাবে ? তাদের কাছে তো সেই গল্পটা করতে হবে যে সকল পরীক্ষায় আমি "রেকর্ড মার্ক" পেয়ে "প্রথম" হয়েছিলাম (মায় বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতায় । উইকি, মিডিয়া ষড়যন্ত্র করে ভুল নাম ছাপিয়েছে)
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
ঠিকাছে ১০১ পর্ব।
..................................................................
#Banshibir.
আপনাকে নিয়ে দেখছি পারা গেল না । আমার শীতকালের কুম্ভকর্ণের ঘুমটা নষ্ট করার তালে আছেন আপনি ।
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
এইসব ফালতু মন-খারাপি উপন্যাস-টুপন্যাস পড়ে প্রবোধ দিবার ভালো একটা উপায় পেয়ে গেলাম।
লেখায় ।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ
তাহলে দেখা যাচ্ছে এই সব আজাইরা লেখা লেখিরও কিছু ভাল "সাইড এফেক্ট" আছে
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
এক সাথে সবগুলো পড়লাম… খুব ভালো লাগল…
অনেক অনেক ধন্যবাদ বাজে কাজে সময় নষ্ট করার জন্য
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
এক সাথে সবগুলো পড়লাম… খুব ভালো লাগল…
ঐ
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
তিনটি পর্বই একসাথে পড়লাম, না পড়ে থাকা গেল না...
আরেব্বাস আপনার দেখছি অসীম ধৈর্য্য
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
অতি স্বাদু গদ্য। অসাধারণ। ৫ তারার উপরে দেয়া গেলে তাই দিতাম।
আপনার বর্ণনা এবং এক বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে আলগোছে স্থানান্তরের ভঙ্গীটা দারুণ।
facebook
থাক ৫ তারাই ভাল । শেষে তারায় তারায় তারাময় হলে রাখার জায়গা থাকে না । এমন একটা আকাশ কই পাই, অণু ?
এক বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে স্থানান্তর ??? হেঁ হেঁ তাহলে ধোকা দিতে পেরেছি ? আমার এটেনশন স্প্যানের দৈর্ঘ্য তাহলে বুঝতে পারেন নি ?
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
স্মৃতি জিনিসটা অত্যন্ত বাজে! পুরোন কথাবার্তা কোথাও দেখলেই হল- মাথায় এসে কিলবিল করতে থাকে। হাসাহাসিটা সবার সাথে ভাগ করার পর চুপচাপ ঝিম ধরে বসে থাকাটা থাকে নিজের জন্য!
চমৎকার আপনার লেখা। চমৎকার আপনার স্মৃতিচারণ।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
নতুন মন্তব্য করুন