বাতাসে শীতের গন্ধ । প্রকৃতিতে রংয়ের উৎসব শেষ করে পাতাদের ঝরে পড়াও শেষ । বাদামী রংয়ের শুকনো পাতা মাড়িয়ে বাড়ি ফেরার পথে কোথা থেকে ভেসে এল অনেক দিন আগের এই রকম শীতের কোন ইউক্যালিপটাসের শুকনো পাতার গন্ধ...নজরুলের সমাধির পাশে লাইব্রেরীর গেইটে লাল রঙ্গা বাস থেকে নেমে কলা ভবন পর্যন্ত হেঁটে আসতে আসতে মাটি থেকে কুড়িয়ে নিতাম ইউক্যালিপটাসের শুকনো পাতা । একটু ছিড়লেই সেই পাতা থেকে বের হ’ত অদ্ভুত এক সৌরভ...কোথা হতে ভেসে এলো ফেলে আসা দিনের গায়ে লেগে থাকা সেই সৌরভ...আর তার হাত ধরে চলে এল বন্ধুর মত বন্ধুদের স্মৃতিরা...
... ...
এই সব অদরকারী স্মৃতির কোন পরম্পরা নেই । তবু যদি কারুর আগ্রহ থাকে, তাহলে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম পর্ব এখানে ।
... ...
৩৮.
শাহীন কলেজ । কলেজ সম্পর্কে যা কিছু কবিতা কল্পনা জাল পেতেছিলাম, সবই ভুল প্রমাণিত হ’ল । জীবনে এই প্রথম কো- এডুকেশন ! কিন্তু “রক্তচক্ষু” শিক্ষকরা “অদৃশ্য দেয়ালে”র কাজ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করছেন । সদ্য গোঁফ ওঠা ইশতিয়াক, ফেরদৌস, তারেক, অমল, কমল, বিমল, শ্যামল, মুস্তাফিজ, ফয়সাল ওয়ান, ফয়সাল টু, ফয়সাল থ্রিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে কিন্তু তাদের সঙ্গে একটু নিরালায় কথা বলার কোন উপায় নেই । বিপরীত লিঙ্গের দু’জন শিক্ষার্থীকে কলেজের করিডোরে প্রকাশ্য দিবালোকে দেখলেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন শিক্ষকরা । কথোপকথনের “খোদা হাফেজ” পর্যন্ত কান পেতে শুনে সন্ধান করছেন কোন “ইন-এপ্রোপ্রিয়েট” বাক্যালাপ হচ্ছে কি না । অনুমোদিত বিষয়ের মধ্যে ছিল “আর্কিমিডিস”, “প্লবতা”, “মাধ্যাকর্ষণ”, “নিউটনের প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় ল”, “স্থিতিবিদ্যা”, “গতিবিদ্যা”, “প্রোজেকশন”, “ইমাজিনারী নাম্বার”, “অর্গানিক ও ইন-অর্গানিক কেমিস্ট্রি” । এর বাইরে কিছু বলার অনুমোদন নেই । এসবের পারমুটেশন-কম্বিনেশন করে তো আর হৃদয়ের আদান প্রদান করা সম্ভব না, বিশেষত: “রক্তচক্ষু” শিক্ষকের উপস্থিতিতে । কাজেই “আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, শুধাইলো না কেহ” তখন আমাদের “হৃদয়-সংগীত” হয়ে গেল ।
স্যারদের থেকে ম্যাডামরাতো কয়েক কাঠি চড়া । অরিয়েন্টেশনের পরেই একদিন অডিটোরিয়ামের বিশাল রুম থেকে ছেলেদের বের করে দিয়ে তিনজন কড়া চেহারার ম্যাডাম আমাদের টেরোরাইজ করলেন, “কলেজে এসেছো পড়ালেখা করতে । ছেলেদের সঙ্গে প্রেম করতে না । কলেজের ভেতরে বাইরে কোথাও কোন ঝোপে-ঝাড়ে, গাছের আড়ালে-আবডালে-মগডালে হৃদয়াবেগের কথা বলতে যদি দেখেছি, তাহলে পরিণতি খুব খারাপ জেনে রাখো । বাংলা, ইংরেজি, আরবি কিংবা সাংকেতিক যে কোন ভাষার চিঠি চালাচালির বিরুদ্ধে হুশিয়ার করে দিচ্ছি । এই সব কাজে মূল নায়ক-নায়িকা ও সখীদের সমান শাস্তি হবে । মুড়ি-মুড়কির এক দর । মনে রেখো, “ব্ল্যাক-শিপ”দেরকে বিনা বাক্যব্যয়ে ছাড়পত্র (টি সি) ধরিয়ে দেয়ার সুনাম আছে শাহীন কলেজের । কোন আপিলের ব্যবস্থা নেই । দরকার হলে সব ক’টাকে টিসি দিতে আমাদের হাত কাঁপবে না । দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল ।” কী আর করা, “দুষ্ট গরু” হওয়ার একান্ত বাসনা মনের কোনে চেপে রেখে “ভাল গরু” হওয়ার ভান করতে থাকলাম । কথায় আছে না, “বোবায় যদি স্বপ্ন দেখে, মনের কথা মনে রাখে” ?
প্রসংক্রমে, ঝর্ণার “ওয়ান ফর সরো, টু ফ অর লাভ, ফোর ফর লেটার” শালিক পাখির কুসংস্কারটি মনে পড়ে গেল । ঝর্ণার গভীর বিশ্বাস ছিল এক শালিক পাখি দুঃখ আনে, দুই শালিক আনে প্রেম ও চার শালিক প্রেম পত্রের উজ্জ্বল সম্ভাবনা । বুঝতেই পারছেন, চৌপহর আমরা “দুই” ও “চার” শালিকের সন্ধান করতাম । কিন্তু চরাচর জুড়ে শুধু নিঃসঙ্গ এক শালিক পাখি ঘুরে বেড়াতো । ঝর্ণার কথা মত সেই দুঃখ “সম্প্রদান” করার জন্য তখন কলা গাছের সন্ধান করতে হ’ত ।
৩৯.
শাহীন কলেজ শিশু শ্রেণী থেকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত । কলেজের ছাত্রীদের জন্য আলাদা কোন ড্রেস নেই, স্কুলের মেয়েদের মতই সাদা ওড়নাসহ নীল “ফ্রক” । শহীদ আনোয়ার স্কুলের ড্রেস তবু কামিজ ছিল । কলেজে এসে বলা চলে “ডিমোশন” হ’ল । সবচেয়ে বেদনাদায়ক হ’ল কোথায় পড়ি প্রশ্নের জবাবে যখনই কলেজের নাম বলি, তখনই শুনতে হয়, “শাহীন স্কুলে পড় ? ক্যান্ তুমি না মেট্রিক পাস করলা ? না কি পাস কর নাই ?” সুচালো সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় পাড়ার গুরুজনরা । তাদেরও দোষ নেই, সে কালে অনেকেই উচ্চ শিক্ষার্থে “গ্রামে যাত্রা” করতো । মেট্রিক, ইন্টার মিডিয়েটে ভাল ফলাফলের জন্য “মাটির টানে” গ্রাম ও মফস্বলে পাড়ি জমানো আর কি । অনেকটা বিদেশ যাত্রার মতই । তফাত একটাই, বিদেশ যাত্রা করতে পাসপোর্ট সাইজের সাদা-কালো ছবি সহকারে ইত্তেফাকে “বিদেশ যাত্রা” বিজ্ঞাপন দেয়া হ’ত । সেই বিজ্ঞাপনে সময়ের স্বল্পতার কারণে “স্ব-শরীরে” দোয়া নিতে অপারগতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা হ’ত । আর মাটির টানে যারা গ্রামে / মফস্বলে যাত্রা করতেন, তারা “নীরবতা পালন” করতেন । কিন্তু, আমিতো খোদ ঢাকা শহরের কলেজেই ভর্তি হয়েছি, যদিও সদ্যই সেটি স্কুল থেকে কলেজে উত্তীর্ণ হয়েছে ।
গোঁদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মত পিটি, ড্রিলও আমাকে অনুসরণ করে চলে এসেছে । অভাগা যেখানে যায়, হায় সাগর শুকায়ে যায়... । প্রতিদিন সকালে বিশাল আয়োজনে নানাবিধ শরীর চর্চা করা হয় । সেই প্রতিযোগিতায় ঈসা খাঁ, তিতুমীর এই রকম চার বীরের নামে চার “হাউজ” । সকল ছাত্র ছাত্রীদের জন্য কোন না কোন হাউজের সদস্য হওয়া অপরিহার্য্য । আইডেন্টিফিকেশনের সুবিধার জন্য প্রতিটি হাউজের আছে আলাদা রংয়ের ছোট্ট বর্গাকৃতির কাপড়ের চিহ্ন, যেটি স্কুল ও কলেজ ড্রেসের বাম হাতের হাতার ওপর সেলাই করে লাগানো থাকতো । আমার হাউজ ছিল সবুজ রংয়ের তিতুমীর । সবুজ রঙ্গের সেই সুদৃশ্য “তালি” লাগানো ছাড়া হাউজের কোন কর্মকাণ্ডেই আমার মত “নরাধম” (না কি “নরাধমী” হবে ? এই ব্যাকরণ আমাকে জ্বালিয়ে খেল !) অংশ নেয় নি । যখন বিশাল মাঠের চারিধার ধরে কাড়া নাকাড়া বাজিয়ে বাধ্যতা মূলক কুচ-কাওয়াজ চলছে, তখন সংয়ের মত ভুল পায়ে কুচ-কাওয়াজ বরবাদ করছি । হাউজ লিডার যখন “ভীম” গলায় বলছে, “প্যারেড ডাইনে তাকাও”, তখন বায়ে তাকাচ্ছি, আর “বায়ে” তাকাতে বললে “ডানে” তাকাচ্ছি ।
৪০.
অরিয়েন্টশনের পরে বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য বিভাগের ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে । পুর্নোদ্যমে ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রি প্র্যাক্টিকেল ক্লাসও শুরু হয়ে গিয়েছে । ইতিমধ্যে, হাইড্রোজেন সালফাইড বা “পঁচা ডিমের গন্ধযুক্ত” গ্যাসের সাথেও পরিচয় হয়েছে ( শত ভাগ সার্থক নামকরন) । কিন্তু, অপশনাল ফোর্থ পেপারের বিষয়ে কিছুই মনস্থির করতে পারি নাই । জীববিদ্যার প্রথম ক্লাসে উঁকি দিতে গিয়ে কনকের ডাকে বসে পড়েছি । কড়া চেহারার জীববিদ্যা ম্যাডাম পড়াচ্ছেন ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণুবাহী “এনোফেলিস” (খুব সম্ভবত: স্ত্রী মশাটিই আসল দুষ্কৃতিকারী) মশা । নিমেষের মধ্যে বোর্ড জুড়ে এঁকে ফেললেন বিশালাকৃতির এক স্ত্রী মশা, তার চারপাশে ডিম্বাণু থেকে লার্ভা হয়ে এডাল্ট অবস্থার মশার জীবনচক্র ! ম্যাডামের অংকন পারদর্শিতার কথা আর কী বলব, ক্লাসের সবচেয়ে পেছনের সারির বেঞ্চি থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এডাল্ট মশার দেহের দু’পাশে ছড়ানো ছয়টি চিকন পা ! আমি একাধারে বিস্ময়াভিভূত ও বেদনার্ত হয়ে তাকিয়ে থাকলাম । আমার সেই নবম শ্রেণীর বায়োলজি ক্লাসের প্রাণী জগতের সব চেয়ে সরলতম অবস্থা “কোষ” আঁকার দুঃস্বপ্নটি মনে পড়ে গেল । কথায় আছে না, মেয়েদের “লং মেমোরি” ? আমাকে কি এখন এনোফেলিস জাতীয় স্ত্রী মশা আঁকতে হবে ? যে কোষ আঁকতে পারে না, সে কী করে এডাল্ট স্ত্রী মশা আঁকবে ?
বাতাসে অক্সিজেনের অভাবে আমার শ্বাস কষ্ট শুরু হয়ে গেল । আমি প্রাণের বন্ধু কনককে বললাম, “কনক, তুমি স্ত্রী মশা আঁকো । আমি যাই । তোমার সাথে ফিজিক্স ক্লাসে দেখা হচ্ছে ।” ততক্ষণে কনকসহ সকল ভবিষ্যৎ জীববিজ্ঞানীরা মশার জীবন চক্র আঁকায় ব্রতী হয়ে গিয়েছে । আমি আলগোছে পেছনের দরজা খুলে নীরব নিথর করিডোরে এসে দাঁড়ালাম । বিভ্রান্ত, অবসন্ন ও জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ আমি কী করা উচিত কিছুই ভেবে পাচ্ছি না । কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখি ঝর্ণাও বের হয়ে এসেছে, ওরও কপালে এডাল্ট মশার কামড়ের “চিকন” ঘাম । প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠে ঝর্ণা আমাকে বলল, “জোহরা, চিকিৎসক কিংবা জীববিজ্ঞানী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তোমার কতটা প্রবল ?”
দীর্ঘ সময় প্রতিকুলে সাঁতরানোর পরে তীরের সম্ভাবনা দেখা মানুষের মত আশাবাদী আমার জবাব, “এক দম শূন্যের কোঠায় ।”
তখন ঝর্ণা আমাকে নিয়ে গেল এক তলার একটি ক্লাসরুমে । সেখানে গুটিকয় ছাত্র-ছাত্রীদেরকে পড়াচ্ছেন আ. কা. আজাদ স্যার । পরিসংখ্যান ক্লাস চলছে । স্যার বুঝাচ্ছেন অ্যারিথম্যাটিক মিন, জিওম্যাট্রিক মিন, হারমোনিক মিন, মিডিয়ান ও মোড । অংকনের মধ্যে দেখা গেল হিস্টোগ্রাম, বার ডায়াগ্রাম, লাইন ডায়াগ্রাম ও পাই চার্ট । অবস্থা খুব একটা খারাপ না । পারব বলেই মনে হচ্ছে । পাই চার্টটাই যা একটু কঠিন মনে হচ্ছে, কিন্তু “এডাল্ট” স্ত্রী মশার তুলনায় নেহাত শিশু । না কি “কোষ” ?
৪১.
বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি চলছে । মাঠ দাপিয়ে চলছে চার হাউজের বীরদের বিক্রম । একক ও রিলে দৌড়, হাই জাম্প, লং জাম্প, শট-পুট ইত্যাদির ধুলো উড়ছে । হাউজ লিডাররা মাঠের চারদিকে পতাকাবাহী শিবির নির্মাণ করেছেন । মাসব্যাপী এই কর্মযজ্ঞে এক একটি ইভেন্টের হিট হচ্ছে, এক এক জন বীর তার বীরত্বের নিদর্শন দেখাচ্ছেন । হাউজ লিডাররা দৌড়ে গিয়ে ফলাফলের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখছেন । নিজের হাউজের সফল বীরকে বুকে জড়িয়ে ধরছেন । অলস দর্শকরা নিজের হাউজের বীরদের জন্য চিয়ার করছে । দর্শক সারির একদম পেছনের দিকে বসে আছি ঝর্ণা আর আমি । শীতের দিনের নরোম রোদের দিকে পিঠ দিয়ে বসে রোদ পোহাচ্ছি আর ঝর্ণার খালি গলার গান শুনছি । ভাবখানা এমন আমরা “চিয়ার” করছি আমাদের হাউজের বীর ভগ্নি ও ভ্রাতাদের জন্য । হাই, লং জাম্পে-তো আর কাড়া নাকাড়ার শব্দ নেই, কাজেই গান শোনা যেত । ঝর্ণাই আমার দেখা একমাত্র কণ্ঠশিল্পী যার কখনো গরমে কিংবা ঠাণ্ডায় “গলা বসার” রোগ ছিল না । গাইতে ইচ্ছে না করলে সরাসরি বলে দিত, “আজ আমার মন নেই গানের” । ওর গলায়ই প্রথম শুনেছিলাম “ঐ আসন তলের মাটির পরে লুটিয়ে রব / তোমার চরণ ধুলায় ধুলায় ধুসর হব...” । ঝর্ণার খালি গলার সেই গান শুনে শীতের দিনের ইউক্যালিপটাসের গাছ থেকে শুকনো পাতারা ঝরে পড়তো টুপ টাপ । চির অচেনা কিন্তু চির আরাধ্য এক প্রেমাস্পদের প্রতি সেই আরতিতে প্রকৃতিও অংশ নিত, তাইতো পূজার নৈবদ্যের মতই সেই শুকনো পাতারা ঝরে পড়তো আর বলতো, ওগো করুন, ওগো নিঠুর,
৪২.
মাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হয়েছে । আমি ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করেছি । বিজ্ঞান বিভাগের জন্য এমন কিছু আহামরি রেজাল্ট না । কিন্তু এই প্রথম আমাদের বাড়িতে পরীক্ষা পাসের খবরে মিষ্টি কেনা হ’ল । আমার মায়ের আনন্দিত মুখ দেখে মনে হচ্ছে আমি বিশ্ব জয় করেছি । আমার গোবেচারা, নিভৃতচারী বাবার আনন্দিত মুখ দেখে মনে হচ্ছে আমি বিশ্ব জয় করেছি । আমার ভাই-বোনদের উজ্জ্বল মুখ দেখে মনে হচ্ছে আমি বিশ্ব জয় করেছি ।
আমাদের বাড়িতে সেই প্রথম পরীক্ষা পাসের খবর উদযাপনে মিষ্টি কেনা হ’ল । আমার মিয়াভাইয়ের ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পাওয়ার খবরে মিষ্টি কেনা হয়নি...তার মেট্রিক, ইন্টারমিডিয়েটে বোর্ডে স্ট্যান্ড করার খবরে মিষ্টি কেনা হয়নি...ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট থেকে অনার্স, মাস্টার্সে প্লেস করা রেজাল্টে মিষ্টি কেনা হয়নি...আমার মেধাবী মেজভাইয়ের ডিএমসি থেকে পাসের খবরে মিষ্টি কেনা হয়নি...তার পরের তিন ভাইয়ের বুয়েট থেকে পাস করার রেজাল্টে মিষ্টি কেনা হয়নি...আমাদের পরিবারের সবচেয়ে পরিশ্রমী ছোট’পার জাহাঙ্গীরনগর থেকে পাসের খবরে মিষ্টি কেনা হয়নি...সোহেলের পাসের খবরে মিষ্টি কেনা হয়নি...সবার তুলনায় আমার রেজাল্ট সবচেয়ে অনুজ্জ্বল...কিন্তু আমার মা তার কন্যার এই অনুজ্জ্বল রেজাল্ট উদযাপনে মিষ্টি কিনে ফেললেন...এ যেন লাস্ট ট্রেন ধরার জন্য প্লাটফর্ম ধরে দৌড়ানো । উজ্জ্বল পতাকা শোভিত সব এক্সপ্রেস ট্রেন চলে গিয়েছে স্টেশন ছেড়ে...দিনান্তের আলো ফুরিয়ে আসছে...আনন্দপুর যাওয়ার পড়ন্ত বেলার শেষ লোকাল ট্রেনটি ধরার জন্য আমার মা প্রাণপণে দৌড়াচ্ছেন ।
এই পর্যন্ত পড়ে নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে সেই আনন্দিত দিনে কোথাও কোন বেদনার ছায়া ছিল না । তাই না ? কিন্তু, গভীর একটি দুঃখের ছায়া ছিল । সেই ছায়াটি দেখতে হলে যেতে হবে অনেক অনেক দিন আগের এক দিনে । যেদিন তুলাতলী গ্রামের আবদুল হাই সরকারের সাথে পরিণয় হয় গজরা গ্রামের নুরজাহান বেগমের । তরুণ এই দম্পতির প্রথম সন্তানটি অকালে শৈশবে মারা যায় । শোকার্ত তরুণী মাতা নুরজাহান তিন বছর পরে একটি সন্তানের মুখ দেখেন । সেই কন্যার নাম রাখেন “রতন”...তার ঘর আলো করে আসা কন্যার জন্য এর চেয়ে যথার্থ নাম আর কী হতে পারে ? তার আঁধার ঘরের মাণিক যে এই রতন !
১৯৭৮ সাল । ক্যান্সার এসে হাত ধরে নিয়ে গেল উনত্রিশ বছরের রতনকে । যেন মায়ের চেয়ে, বাবার চেয়ে, ভাইদের চেয়ে, বোনদের চেয়ে...সবার চেয়ে ক্যান্সারই বেশী ভালবাসে রতনকে । কে বলে ভালবাসা সব জয় করতে পারে ? পারে না । পারলে কেন সেদিন মৃত্যু ফিরে গেল না ? কেন দয়াল দয়া করলো না রতনের মাকে, বাবাকে, ভাইদেরকে, বোনদেরকে ? কত চড়াই উৎরাই পার হয়ে রতন এসেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ প্রান্তে...মায়ের সেই অকালে হারিয়ে যাওয়া প্রথম সন্তানের অপূর্ণ সব সাধ সে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল...স্বপ্ন পুরণের এত কাছে এসে আলোর শেষ রেখাটি পর্যন্ত কেন মুছে গেল...ধরা ছোঁয়ার জগত ছাড়িয়ে কোন “না ফেরার” দেশে চলে গেল রতন...চলে গিয়ে দূর এক “বাতিঘর” হয়ে রইল সবার কাছে...
আমাদের পরিবারের যে কোন আনন্দের দিনে বেদনার চিহ্ন হয়ে রয়ে গেল আমার মায়ের “রতন”, আমাদের বড় আপা । হাজার আনন্দের দিনেও মা চোখ মুছতেন, একবার হলেও বলে উঠতেন, “আজ যদি আমার রতন থাকতো ! র...ত...ন” । আমার মায়ের সেই “রতন” ডাকের সাথে কেঁপে উঠতো তাঁর সমস্ত শরীর...আমরা জানতাম সন্তানের জন্য জননীর চরাচর কাঁপিয়ে বেদনার ঢেউ উঠেছে...হাহাকারের সেই ঢেউ থামায় কারুর সাধ্যি নেই...কারুর না...
আমাদের পরিবারের নতুন কোন শিশুর জন্ম, জন্মদিন, বিয়ে, পরীক্ষা পাসের আনন্দের সঙ্গে লেগে আছে “রতন” । পৃথিবীর কোন আনন্দ, কোন বেদনাই কি নিখাদ ? গভীর দুঃখের গায়েও লেগে থাকে কিছুটা আনন্দ । সবচেয়ে আনন্দ মুখর মুহূর্তের গায়েও লেগে থাকে কোন না কোন দুঃখবোধ । আনন্দ যে কোথায় গিয়ে মেশে দুঃখের সাথে, কিংবা বেদনা বিধুর দুঃখ কোথায় গিয়ে মেশে আনন্দের সাথে...কে বলতে পারে !
পাদটীকা:
রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন দুঃখ হল আগুনের পরশমণি । দহন দানের সেই আগুন ছাড়া জীবন পূর্ণ হয় না । তাঁর মত এমন করে কে বুঝেছিল নিশিদিন এই জীবনের সুখের পরে দুঃখের পরে শ্রাবণের ধারার মত ঝরে পড়া পরমেশ্বরের সুর ?
মন্তব্য
এই লেখাটা ফুসুফুস থেকে একটু দূরে, হৃদয়ের অনেকটুকু কাছে এসে ল্যান্ড করলো।
আগেই বলেছিলাম আপনি মানুষটা ভালো না, কিন্তু আপনার দেয়া গানগুলো ভালো। অতএব কাটাকাটি। এইবেলা পরেরটা ছাড়েন।
ফারাসাত
গানতো ভাল হতেই হবে, কার গান দেখতে হবে না ? এ যে বুড়োর গান । সেই কবে লিখে রেখে গেছে, কিন্তু ঘুরে ঘুরে তাঁর কাছেই যেতে হয় ।
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
ভেবেছিলাম আজ বুঝি কলেজ লাইফের কথা লিখবেন, মন ভালই ছিল। শেষে এসে খারাপ হয়ে গেল। রতন আপার আত্মার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।
অনেক ধন্যবাদ বেচারাথিয়াম । দোয়া করবেন আমার বড় আপার জন্য, যেন চির শান্তিতে থাকে ।
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
বেচারাথেরিয়াম এর মতই আমার অনুভুতি - চলুক।
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ স্যাম । ভাল থাকুন ।
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
আপনার কলেজ লাইফের কথা শুনে আমার ও অনেক-কিছু মনে পড়ে গেল আপা, তবে আমি খেলাধূলা খুব এনজয় করতাম। আমার সব পরীক্ষা পাসের মিষ্টীর পরিমানই অন্য ভাইবোন্দের চেয়ে বেশি ছিল, অনেক অনেক কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে। শেষের প্যারাটুকু পড়ে কেমন যেন লাগলো, এত ভয়ঙ্কর সত্য কয়েকটা লাইন। সবসময় তো আপনি আমাদেরকে গান এর লিঙ্ক দেন, আজকে আপনাকে আমি একটা গান দিই। গত তিনদিন ধরে টানা শুনে যাচ্ছি, তবু ও শুনতে খারাপ লাগছেনা।
আমিওতো করি তো, তবে দর্শকের ভুমিকায়
মালতীলতার গানতো এই রকমই হওয়ার কথা । কোন নিভৃত বাতায়নের বিরহিনীর কথা শুনতে বসলে আর কোন রক্ষা আছে, বলেন ?
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
আপনার চরম উদাসের মত অভ্যাস হইসে। মজাদার লেখার শেষে এসে মনটা বিষন্ন করে দেন। রতন আপা ভালো থাকুন।
ইয়ে, শেষতক "ভালো গরু" হইতে পারসিলেন?
..................................................................
#Banshibir.
পীরসাহেব, “কাউ দ্য বেস্ট, দ্য গ্রেট ডোমেস্টিক এনিম্যাল” মেডেলটা তো আমিই পাইসিলাম
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
আমি বাছুর কাটেগরিতে নমিনেশন পাইছিলাম। ওই যে জয় পরাজয় নয় অংশগ্রহনই ইত্যাদি ইত্যাদি।
তয় বাছুর কাটেগরি কইলাম ছাগু কাটেগরি থিকা ভালো...
..................................................................
#Banshibir.
সুখ এবং দুঃখ জাগানিয়া অসাধারণ এক স্মৃতিচারণ।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
অনেক ধন্যবাদ, তাসনীম । স্মৃতির সঙ্গে লেগে থাকে সুখ, লেগে থাকে দূঃখ ।
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
শেষের দিকে এসে হাসি খুশি ভাব্টা একেবারেই বদলে গেল, একরাশ বিষাদ এসে ঢেকে দিল যেন সব
অনেক ধন্যবাদ, সাবেকা । জীবনতো আসলেই সুখ আর দূঃখের দোল দোলানো এক যাত্রা । পথ চলতে চলতে কি বলা যায় বাঁকের ওইধারেই কী আছে ? সুখ না দূঃখ ?
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
আনন্দ-বেদনা ও স্মৃতিকথার এক সুন্দর পোস্ট। দারুণ এক অনুভূতি হলো।
অনেক ধন্যবাদ প্রৌঢ় ভাবনা । ভাল থাকুন ।
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
“আর্কিমিডিস”, “প্লবতা”, “মাধ্যাকর্ষণ”, রিলে দৌড়, হাই জাম্প, লং জাম্প, শট-পুট, হাইড্রোজেন সালফাইড, আবার বায়লজি না পড়েও ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণুবাহী “এনোফেলিস” এত কিছু মনে থাকে কিভাবে আপু?
শেষটায় আবার মন খারাপ হয়ে গেল, আগের মতই বলব কত রকম অনুভুতির জন্ম যে দিতে পারেন ভেবে অবাক হই।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
স্ত্রী মশার কামড় খেলে আপনারও মনে থাকতো
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
আপ্নে মানুষটা ভালো না জোহরাপা, খুব খ্রাপ
সেইই, আমিও বাউল ভাইয়ের সাথে একমত। এটা কোন কথা হল আপুনি, তোমার লেখাগুলো রাতদিন মনের আবেগ নিয়ে খেলা করে। একদম ঠিক না। তোমার লেখার অপেক্ষায় থাকি আর লেখা পড়ে মন খারাপ করে বসে থাকি।
আগেই পড়েছিলাম, পোস্ট করা মাত্র কিন্তু তখন মন্তব্য করা হয়নি। তাই এখন এসে পাঁচ তারা দিয়ে তোমাকে পচা বলে গেলাম।
যেখানেই থাকুন রতন আপা নিশ্চয় ভালো আছেন।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
সেই বিশ্বাস নিয়েই তো বাঁচি । নইলে তো বাঁচা অসম্ভব হ’ত ।
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
বাউল, এইটা আমারে এই জীবনে কম করে হলেও এক হাজার লোক বলেছে । আপনি হলেন এক হাজার এক তম ব্যক্তি । কাজেই কুন দূঃখ নাই ।
অপ্রাসঙ্গিক: আপনার নিকটি আমার খুব পছন্দ । আবার কবে বিশা আ আ আ ল আড্ডার মত লেখা দেবেন ?
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
এক হাজার এক তম ব্যক্তি হতে পেরে আমি যারপরনাই প্রীত ও আনন্দিত হয়েছি।
আপনার ক্ষেত্রে আমি এক হাজার এক তম হলেও আমার ক্ষেত্রে আপনি এক তম ব্যক্তি, যে আমার নিকটি "খুব পছন্দ" করেছেন। আপনাকে এক হাজার একটি
বাউল, সহস্র একটি ধনে পাতার জন্য অনেক ধন্যবাদ । ধনেপাতা খুব কাজের জিনিস ।
গৃহবাসী বাউল । আমারতো মনে হয়, গৃহবাসী সবাই মনে মনে বাউল হতে চায় । নানা কারনে পেরে উঠে না
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
"...কে বা কারে রাখে মনে দু:খেরও দিনে রে হায়, সুখের তরী দিলো পাড়ি বলো ক’জনায়
...............
আমি কেন পাথর হইলাম না, আমি কেন গণক হইলাম না।
আমি কেন দয়াল হইলাম না রে বন্ধু
আমি কেন বাউল হইলাম না??"
নিকের মতন বাউল ভাইসাহেবের লেখাও চমৎকার। খালি কম কম লেখেন এই আরকি।
..................................................................
#Banshibir.
বড় মায়াময় লেখা।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
"মরণ তোমার হার হলো যে মনের কাছে।
ভাবলে যারে কেড়ে নিলে সে যে দেখি মনেই আছে,
মনের মাঝেই বসে আছে।"
নতুন মন্তব্য করুন