আজ আমি কাঁদতে আসিনি

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি
লিখেছেন জোহরা ফেরদৌসী (তারিখ: মঙ্গল, ৩০/০৪/২০১৩ - ৭:১৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ধ্বংস স্তুপের নীচে কাটানো প্রতিটি মুহুর্তের মৃত্যুময় অন্ধকার,
মায়ের কোল হারা প্রতিটি শিশুর কান্না,
স্বজনের আহাজারি
আর নিঃস্পন্দ প্রতিটি লাশ ছুঁয়ে
আজ আমি অভিশম্পাত দিচ্ছি- ধ্বংস হ’ নরপিশাচেরা
যারা কেড়ে নিয়েছিস আমার ভাই, আমার বোনকে-
নিশ্চিহ্ন হ’ তোরা চিরতরে ।

সাভারের গার্মেন্টস ভবন ভেঙ্গে পড়ার খবরটা পাওয়ার পর থেকেই প্রতিজ্ঞা করেছি। কিছুতেই কাঁদব না। কেঁদে কী হয়? মাত্র তো ক’মাস আগের কথা। তাজরীন গার্মেন্টসে আগুন লেগেছিল। দিনে দুপুরে জ্বলজ্যান্ত একশ বার জন অঙ্গার। দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের ভারী বাতাসেও ছিল মানুষের পোড়া গন্ধ। কী করতে পেরেছি? কী করতে পারি আমরা? কাজেই, কাঁদব না।

ফেসবুকে উৎকন্ঠিত সবাই লিখছে, ছবি দিচ্ছে, ইউ টিউবের লিঙ্ক, চেনা অচেনা লোকের কাছে হাত পেতে সাহায্য নিয়ে দেশে পাঠাচ্ছে। দেশে জান বাজী রেখে লড়ছে ছেলে-মেয়েরা। পানি, গ্লুকোজ বিস্কুট, স্যালাইন, অক্সিজেন...কোদাল, শাবল, খুন্তি নিয়ে ছুটে গিয়েছে মানুষ...মানুষের প্রাণ বাঁচাতে। তারপরেও লাশের সংখ্যা বাড়ছে...তোড়ের বেগে...ঠেকানো যাচ্ছে না...

আমি শুধু শক্ত মুখে খবর পড়ি। ভুলেও কোন ভিডিও খুলি না, টিভি খুলি না। কী লাভ? আমিতো কিছু করতে পারবো না, শুধু শুধু...

একজন বললো, “জানেন, গত দু’দিন ধরে একজন মিনতি করছিল তাকে উদ্ধার করার জন্য। তার ভিডিওটাও আছে। আজ আর সে নেই। কী করুণ করে মিনতি করছিল, ভাই, কেউ আসবে না?” বলেই তিনি চোখ লুকান আর বলেন, “ধিক্কার দিতে হয় আমাদেরকে। এইসব গরীব মানুষ মরার সময়ও মিনতি করে। দাবী নিয়ে বলে না- কেন মরছি আমরা, কেন?”

আমি তারপরেও চোখ খরখরে করে রাখি, চোয়ালের হাড় শক্ত করি। কী লাভ...কী করতে পারবো আমি?

আমারই এক ছোট বোন অনলাইনে একটা পিটিশন খুলেছে। মানুষের সাইন সহ সেই পিটিশন সে পৌঁছাবে কর্তা ব্যক্তিদের কাছে, তাতে যদি কারুর টনক নড়ে। জানি আমি, কিচ্ছু হবে না। এমন হাজার হাজার “ফকিরনীর বাচ্চা” মরলেও কিচ্ছু হবে না...আবার খোলামাত্র কারখানা ভরে যাবে পিঁপড়ার মত ফকিরনীর বাচ্চাদের ভীড়ে। তবুও অফিসে পিটিশনের উইন্ডোটা খুলে রাখি...প্রতি দু’মিনিটে একবার করে দেখি ক’টা সাইন পড়ে...

কি কুক্ষণে কে জানে, খবরের কাগজটা খুলি... আর পারি না... ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠি, “শাহিনা, কেন বাঁচতে চেয়েছিলেন, কেন? দেড় বছরের বাচ্চাটার জন্য? কী হবে এখন দুধের বাচ্চাটার?”

_________________________

ল’ব্লজ, প্রাইমার্ক ক্ষতিপুরণ দেবে। শাহিনা, ধ্বংসস্তুপের মধ্যে পাঁচদিন বেঁচে থাকতে পারলেন। আরেকটু পারলেন না? দুধের শিশুটার জন্য শেষ রক্ষা করতে পারলেন না, বোন?


মন্তব্য

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

আমি কখনো কাঁদি না, হয়তো সাধারণ মানুষের দুঃখ আমাকে বিচলিত করে না। কিন্তু আমি মনের মাঝে ঘৃণা পুষে রাখি। নিষ্ফল আক্রোশে বিড়বিড় করে প্রতিনিয়ত অভিসম্পাত দিই। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি, কখনো যদি সুযোগ হয়, মানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলার জন্য দায়ী সব কটাকে অন্ধকুপে পাঠাবো। দিনে একবেলা পাথুরে রুটি আর নোনা জল খেয়ে খেয়ে বেঁচে থাকবে। যখন ক্ষুধা তৃষ্ণার যন্ত্রনায় কাতর কন্ঠে নিজের মৃত্যু ভিক্ষে করবে, তখন তাতে কান না দিয়ে চুপচাপ নিজের কাজ করে যেতে থাকব। এখন যেমন করি।

অতিথি লেখক এর ছবি

চার দিন ধরে ধ্বংসস্তুপের নিচে দেড় বছর বয়সী কন্যাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য মৃত্যুর সাথে লড়াই করে যাওয়া শাহিনা শেষ পর্যন্ত মারা গেছে!! তার মেয়েটি মৃত্যুর মানে বোঝেনা এখনো! একদিন সে বড় হবে, তার মায়ের মৃত্যুর ইতিহাস জানবে। ধ্বংসস্তুপের নিচে ধুঁকেধুঁকে বেঁচে থাকা তার মায়ের মতোই ধুঁকেধুঁকে বেঁচে থাকা এই জাতি কি কখনো তাকে সুখী করতে পারবে???
শাহিনার বেঁচে থাকার জন্য মনে হয় বাংলাদেশের প্রত্যেকটা মানুষই কেঁদেছে। দোয়া করেছে।
এমন করে আর কোন দেশে মানুষ ভালবাসতে পারে না!

সুবোধ অবোধ

তারেক অণু এর ছবি
সাফিনাজ আরজু এর ছবি

মন খারাপ
কিছু বলার ভাষা জানা নেই আপুনি।

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।