আমেরিকার এক বিশাল করপোরেশনের প্রধান নির্বাহীর সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম কয়েক বছর আগে। ভদ্রলোক ইমেল সংস্কৃতির ঘোর বিরোধী। বলেছিলেন, মাত্র দশ হাত দূরে বসা একজনকে ইমেল পাঠানোর কোনো মানে হয়! নিজে উঠে গিয়ে বার্তাটি দিতে অসুবিধা কোথায়, তাতে অন্তত মানবিক স্পর্শটি বজায় থাকে। আর যে কথা মুখেই বলা যায়, তা ইমেলে জানানোর দরকার কি? তাঁর মতে ইমেল অলসদের জন্যে এবং তা অপ্রয়োজনীয়, একটি অপচয়বিশেষ।
এই ক'বছরে কর্মকর্তাটি মত বদলেছেন কি না জানি না। না হলেও কিছু এসে যায় না। আজকের পৃথিবীর অনেক মানুষই তাঁর সঙ্গে একমত হবেন না, এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া চলে। কর্মক্ষেত্রের কথা মনে রেখেই তিনি কথাগুলি বলেছিলেন বলে ধারণা করি, কারণ এ দেশে এই ধরনের মানুষরা কর্মক্ষেত্র ছাড়া আর কিছু বোঝেন না, বোঝার চেষ্টাও থাকে না।
ইমেলে মানবিক স্পর্শ অনুপস্থিত, এই যুক্তি মানা যায় না। বার্তার প্রেরক এবং গ্রহীতা যন্ত্র বটে। লেখক কিন্তু একজন রক্তমাংসের জ্যান্ত মানুষ এবং প্রত্যেক মানুষই নিজস্ব ভঙ্গি ও ভাষায় বার্তাটি রচনা করেন। ফলে ব্যক্তিমানুষের আলাদা প্রতিচ্ছবি তাতে অবধারিতভাবে থাকে। দ্বিতীয়ত, কর্মক্ষেত্রে মুখের কথার চেয়ে লিখিত বার্তার প্রয়োজন ও গুরুত্ব অনেক বেশি। লিখিত হলে তা নথি হিসেবে সংরক্ষণ করা চলে, ভবিষ্যতে কোনো প্রয়োজনে তাকে উদ্ধার করে আনা যায়। মৌখিক কথোপকথনে তা কীভাবে সম্ভব?
বড়ো কোম্পানির বড়ো কর্তা পছন্দ না করলেও ইমেলের ব্যবহার কিছুমাত্র কমছে না, ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে তার সীমানা। অদূর ভবিষ্যতে এর দাপট কমার কোনো সম্ভাবনা নেই, যদি না নতুন কোনো প্রযুক্তি তার স্থলাভিষিক্ত হয়। তা অবশ্য হতেই পারে। খুব বেশিদিন আগের কথা নয় যখন ডাকবিভাগ ছাড়া চিঠিপত্র দেওয়া-নেওয়ার আর উপায় কি ছিলো? হাতে হাতে পাঠানো বা বইয়ের পাতার ভাঁজে লুকিয়ে প্রেমপত্র আদান-প্রদানের কথা অবশ্য আলাদা। এখন তার জায়গাও নিয়ে নিচ্ছে ইমেল। দুরু দুরু বুকের সেই রোমাঞ্চ ইমেলে পাওয়া যাচ্ছে কি না, তা আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। সে বয়স কবেই পেরিয়ে এসেছি। এখন ভাবি, আহা আমাদের সময়ে যদি ইমেল থাকতো! শুনতে পাই, আজকাল এসএমএস কমবয়সীদের খুবই পছন্দের, কিন্তু তা-ও ইমেলের আরেক রূপ।
চিঠি লেখায় আমার ভয়াবহ অনীহার কারণে একদা আমার পিতামাতা ও আর সব পরিচিতজনের প্রবল অনুযোগ ছিলো। তখন আমার মন খারাপের খবর দিয়ে ঢাকা থেকে বগুড়ায় লেখা একটি চিঠি ডাকবাক্সে ফেলে তার উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করতে হতো অন্তত দুই সপ্তাহ। ফলে, আমার মন খারাপে বন্ধুর প্রতিক্রিয়া যখন জানা গেলো ততোদিনে হয়তো আমার মন আর একটুও খারাপ নেই।
সাধারণ ডাকের চিঠিকে আজকাল বলা হচ্ছে স্নেইলমেল (বাংলায় শম্বুক ডাক বলা যায় কি?) বিদ্যুৎগতির বৈদ্যুতিন ডাক, ইলেকট্রনিক মেল বা ইমেল কিন্তু এই অবস্থাটি দূর করে দিয়েছে। এখন ইমেল পাঠিয়ে দিনে দিনে এমনকি তৎক্ষণাৎ উত্তর পাওয়া যাচ্ছে।
মনে আছে, আমেরিকা থেকে ৯৬ সালে আমার পিতাকে প্রথম ইমেল (তাঁর নিজের ইমেল ছিলো না, সেটি ঢাকায় আমার ছোটো ভাইয়ের) পাঠালে তিনি যুগপৎ বিস্মিত ও চমৎকৃত হয়েছিলেন। ইতিহাস বইয়ে পড়েছিলাম, সেই ষোড়শ শতাব্দীতে শেরশাহ ভারতবর্ষে ঘোড়ার ডাক (কেউ রসিকতা করে বলেছিলেন, তার আগে কি ঘোড়া ডাকতো না?) চালু করেছিলেন। দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত ওই শম্বুক ডাক ছিলো বলে 'পোস্টমাস্টার'-এর মতো গল্প রবীন্দ্রনাথের হাতে পাওয়া গিয়েছিলো। পোস্টমাস্টারবাবুটি রতনকে যেমন বলেছিলেন, আজকের ইমেলের জয়যাত্রা রুখতে গেলেও বলা সম্ভব 'তা কী করে হবে'?
ইমেল অনেক ক্ষেত্রে আসক্তির মতো হয়ে ওঠে। এ দেশে এই আসক্তদের বলা হয় ইমেল জাঙ্কি। কী সব লক্ষণ থাকলে কাউকে ইমেল জাঙ্কি বলা যাবে তার একটি তালিকা একবার পেয়েছিলাম, বলা বাহুল্য ইমেলেই। কয়েকটি এখানে তুলে দেওয়া যাক :
১. রাত দুটোর সময় ঘুম থেকে উঠে বাথরুম সেরে বিছানায় ফেরার পথে যখন তোমাকে নতুন ইমেল আছে কি না দেখতে হচ্ছে
২. যখন তুমি ছেলেমেয়েদের নাম রাখছো ইউডোরা (কী আশ্চর্য, আমার মেয়ের নাম ডোরা), মোজিলা বা ডটকম
৩. ইন্টারনেটের মোডেম বন্ধ করে দিলে যখন খুব প্রিয়জনের জীবনরক্ষাকারী অক্সিজেনের প্লাগ খুলে দেওয়ার অনুভূতি হচ্ছে
৪. যখন বিমানযাত্রার অর্ধেকটা সময় তুমি ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত থাকছো অথচ শিশুপুত্রটিকে তুলে রেখেছো ওভারহেড কম্পার্টমেন্টে
৫. বিনা পয়সায় ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা পাওয়ার আশায় যখন তুমি আরো বছর দুয়েক বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে যাওয়ার কথা ভাবছো
৬. ডায়াল-আপ ইন্টারনেট এখনো যারা ব্যবহার করছে তাদের জন্যে করুণা বোধ করছো
৭. যখন প্রতিটি ইংরেজি বাক্যের শেষে ফুলস্টপ দিয়ে নিজের অজান্তেই কম শব্দটি টাইপ করে তাকে ডটকম-এ পরিণত করে দিচ্ছো
৮. তোমার কাছে যখন বাথরুমে যাওয়া মানেই ডাউনলোড করা
৯. নতুন ইমেল নেই দেখেও তুমি পরমুহূর্তেই আবার ইমেল চেক করছো
১০. কোনো ইমেল মেসেজ পাঠ করামাত্র তা তুমি পাঠিয়ে দিচ্ছো অন্য কোনো বন্ধুকে।
ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে ইমেলের ক্ষতিকর একটি দিক আছে। কখনো কখনো এমন দিনও যায়, ইমেল বাক্সে একটিও নতুন বার্তা অপেক্ষায় থাকে না। কোনো বন্ধুকে লেখা ইমেলের জবাবটি সময়মতো আসছে না। সেইসব সময়ে নিজেকে কেন যেন খুব অপাংক্তেয়, উপেক্ষিত মনে হয়। মন খারাপ লাগে না! কে বুঝবে?
মন্তব্য
আমার মেইলবক্সে ইমেইল আসা কমে গেলে ইয়াহু আর গুগল গ্রুপের অচল মেম্বারশীপগুলোকে সচল করি, অর্থাৎ 'নো মেইল' কে ইয়েস মেইল করি, ডেইলি ডাইজেস্ট থেকে ইন্ডিভিজুয়াল মেইলে অপশন পরিবর্তন করি। হা হা .. হায়রে ইমেইল। আমার জিমেইলে প্রায় ৮ হাজার থ্রেড আছে, এর অধিকাংশতেই গড়ে অন্তত ১০টি করে মেইল আছে; আবার প্রায় সমপরিমান মেইল ডিলিট করা হয়েছে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায়। কত কীস্ট্রোক যে ইমেইলের পেছনে করেছি তার হিসার কেবল আল্লাহর ড্যাটাবেজেই আছে।
ফোরামের ইমেলে মন ভরে না একদম। ব্যক্তিগত স্পর্শ কোথায়? ওইটুকু না হলে তা তো আসলেই যান্ত্রিক!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
আমি কি ইমেইল জাঙ্কি? মোটেই না। আমি তারচেয়ে বেশি কিছু থাকলে তাই। তিনটা ইমেইল একাউন্ট ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে। ঘুমিয়ে না থাকলে ইনসট্যান্ট রিপ্লাই করা আমার চাইই।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
জাংকি এবং অ্যািডক্ট-এর মধ্যে পার্থক্য কি?
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
আমি বেশ ঘনঘন ইমেইল চেক করি।
হাঁটুপানির জলদস্যু
আমিও। কেন কে জানে!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
আঃ সেইসব জাংকমেল না থাকলে কেমন হতো এই প্রবাসজীবন?
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
ইমেইল বস্তুটা মাঝে মাঝে আরেকটা ইন্দ্রিয় মনে হয় আমার কাছে। একে ছাড়া আমি অচল।
আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
মজা তো ঐখানেই। এখন থেকে মাত্র ১২/১৪ বছর আগে ইমেল বস্তুটি আমাদের নিশ্বাসের বিকল্প হয়ে ওঠা তো দূরের কথা, জানাশোনাও হয়নি তার সঙ্গে।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
নতুন মন্তব্য করুন