১৯৭০ সাল। আর মাসখানেক পর পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন। ৪৭-এ পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ২৩ বছরে এই দ্বিতীয়বার। আগের বছর প্রবল গণঅভ্যুত্থানে লৌহমানব বলে কথিত আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের জগদ্দল ভেসে গেছে খড়কুটোর মতো। এই বিজয়ের জন্যে মূল্য অবশ্য কম দিতে হয়নি পূর্ব বাংলাকে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর নির্দয় প্রহার, টিয়ারগ্যাস, গুলি সবই বিপুল পরিমাণে জুটেছিলো। এর প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে এই নির্বাচন। স্পষ্ট মনে আছে, আসন্ন এই নির্বাচনটিকে অনেকে বাঙালির অস্তিত্বের প্রশ্ন হিসেবে নিয়েছিলেন। তাদের দূরদর্শিতা প্রমাণিত হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। তা অন্য প্রসঙ্গ।
এই নির্বাচনকে সামনে রেখে এবং উপলক্ষ করে যখন সারা দেশ জেগে উঠেছে, তখন এসেছিলো এক মরণ ছোবল। এই ভূখণ্ডের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রায় সমগ্র সমুদ্র-উপকূলে হারিকেন ও প্রবল সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে মাত্র এক রাতে কয়েক লক্ষ মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ঘরবাড়ি, গবাদি পশু কিছুই রক্ষা পায়নি। তারিখ ১২ নভেম্বর। ঘটনার ভয়াবহতা প্রকাশিত হতেও সময় লেগেছিলো। যখন জানা গেলো যে মৃত মানুষের সংখ্যা বারো লক্ষ (মতান্তরে দশ লক্ষ), তখন পৃথিবী থমকে যাওয়ার অনুভূতি হওয়াই স্বাভাবিক।
প্রকৃতির আঘাত যখন আচমকা আসে তখন মানুষ সত্যিই অসহায়। কিছু সতর্কতা হয়তো সম্ভব, তাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কিছু কমে। কিন্তু ১২ নভেম্বরের ওই দুর্যোগের আভাস খুব সামান্যই জানা গিয়েছিলো। পরে প্রকাশিত হলো এই অবিশ্বাস্য তথ্য যে এই ঝড় সম্পর্কে তথ্য থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকার তা আমলে নেয়নি, যথাসময়ে সতর্কতাও আসেনি। ঝড়ের পূর্বাভাস ছিলো, তার ভয়াবহতা সম্পর্কে কিছুমাত্র আভাসও ছিলো না। ফলে এই অঞ্চলের মানুষ যারা এইসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে বেচে থাকে তারা এই পূর্বাভাস নিয়ে আলাদা করে মাথা ঘামায়নি। অনিবার্য ফল হিসেবে কয়েক লক্ষ মানুষ নেই হয়ে গেলো একরাত্রির ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে। এই সেদিনের হারিকেন কাটরিনার তুলনায় সে দুর্যোগ কিছুমাত্র খাটো ছিলো না।
এই বিপুল প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পরেও পাকিস্তানী শাসকদের তৎপরতা খুব বেশি দৃশ্যমান হয়নি, তা ত্রাণে, না সহানুভূতিতে। আরো একবার বোঝা গিয়েছিলো পূর্ব বাংলা ঠিক পাকিস্তান নয়।
আমাদের বাড়িতে তখন দৈনিক পূর্বদেশ রাখা হতো। এই কাগজটি এই দুর্যোগের অসাধারণ কাভারেজ করেছিলো মনে আছে। বিশাল ব্যানার হেডিং করেছিলো : ‘কাঁদো বাংলার মানুষ কাঁদো’ এবং সেদিন কাগজের প্রথম পাতার মাস্টহেড নামিয়ে দেয় একেবারে তলায়। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে এই ঘটনা আমার জানামতে ওই একবারই ঘটেছিলো।
তখন কেন্দ্রীয় সরকারে ছয়জন বাঙালি মন্ত্রী ছিলেন। একদিন প্রথম পাতায় পাশাপাশি তাঁদের ছোটো ছবি ছাপা হলো, তার নিচে জনসভায় বক্তৃতারত ভাসানীর বিশাল ছবি, তাঁর উদ্যত তর্জনী ওই ছবিগুলোকে নির্দেশ করছে। সঙ্গে হেডিং : ‘ওরা কেউ আসেনি’।
মনে পড়ে গেলো এইসব কথা। আসলে ভোলা তো হয় না। এই কাগজগুলি আমাদের বাড়িতে এখনো সযত্নে রক্ষিত আছে। হাজার হাজার মাইলের ব্যবধানে না থাকলে এগুলি স্ক্যান করে তুলে দেওয়া যেতো। তা তো আর হওয়ার নয়, পরবাস যাপনের মাশুল।
পূর্বদেশ-এ দিনের পর দিন ওই দুর্যোগে নিহত মানুষের, গবাদি পশুর পড়ে থাকা লাশের ছবি ছাপা হয়েছে। একদা কোলাহলময়, এখন বিরান সব জনপদের ছবি দেখে মন ভারি হয়ে ওঠে। একদিন এরকম কিছু ছবির সঙ্গে রফিকুল হক লিখলেন একটি অবিস্মরণীয় ছড়া :
ছেলে ঘুমলো বুড়ো ঘুমলো ভোলাদ্বীপের চরে
জেগে থাকা মানুষগুলো মাতম শুধু করে
ঘুমো বাছা ঘুমো রে
সাগর দিলো চুমো রে
খিদে ফুরোলো জ্বালা জুড়লো কান্না কেন ছি
বাংলাদেশের মানুষ বুকে পাষাণ বেঁধেছি।
মন্তব্য
অসাধারণ।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
সুন্দর সাবলীল গদ্যে হৃদয়স্পর্শী লেখা।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
আপনাদের পাঠ ও মন্তব্যের জন্যে অশেষ ধন্যবাদ সুবিনয় মুস্তফী ও শেখ জলিল। আমার স্মরণ সার্থক হলো।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
সুশান্ত, আমার পোস্ট হারিয়েছে তা কিন্তু বলিনি। পোস্টটি প্রথম পাতা থেকে কীভাবে নেই হয়ে গেলো তা-ই আমার প্রশ্ন ছিলো। আর দ্বিতীয় সমস্যা সম্পাদনা নিয়ে। ধন্যবাদ আপনার মনোযোগের জন্যে।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
তাই তো চাই। অপেক্ষায় আছি।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
১২ নভেম্বরের ঐ দুর্যোগ স্বাধীন বাংলার দাবীকে আরো সমুন্নত করেছিলো ।
-----------------------------------------
'প্রিয়তম পাতাগুলো ঝরে যাবে মনে ও রাখবেনা
আমি কে ছিলাম,কি ছিলাম--কেন আমি
সংসারী না হয়ে খুব রাগ করে হয়েছি সন্ন্যাসী
হয়েছি হিরন দাহ,হয়েছি বিজন ব্যথা,হয়েছি আগুন'
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
ধন্যবাদ হাসান মোরশেদ এবং ইমরুল হাসান।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
টেস্ট
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
অবশেষে আসল পোস্টটাও পড়লাম। তবে না পড়লেই ভাল হত মনে হয়। সবাই শুধু মন খারাপ করানো ব্যাপারগুলো নিয়ে লেখে!
মন খারাপ করানোর জন্যে আসলে লিখিনি। স্মরণ করার জন্যে। তবু আপনার মন খারাপ হলে তা-ও এক ধরনের সার্থকতা।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
পড়লাম।
ওয়ালাইকুম আসসালামের থেকেও মওলানা ভাসানীর জ্বলজ্বলে উক্তি, ওরা কেউ আসেনি.........
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ
অজ্ঞাতবাস
আমারও তাই ধারণা। এই উক্তিটি অসম্ভব তীক্ষ্ন ও লক্ষ্যভেদী।
শুধু মনে হচ্ছে, পূর্বদেশের ওই ছবিটা যদি দেখাতে পারতাম!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
ভাল লাগল। কষ্ট লাগল।
ধন্যবাদ, প্রকৃতিপ্রেমিক। এরকম কষ্ট লাগা স্বাস্থ্যকর।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
জালাল ভাই ফোনে জানালেন,
"দেরীতে পড়ার জন্য দুঃখিত। চমৎকার!"
সেই সাথে দুটো ছবি দিলেন। আমি এখানে পোস্ট করলাম। চাইলে মূল লেখায় জুড়ে দিবো।
নভেম্বর ১০, ১৯৭১ - ভাসানী (এমএমআর জালাল)
নভেম্বর ১০, ১৯৭০ (এমএমআর জালাল)
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
ছবিগুলি অবশ্যই লেখায় যুক্ত হওয়া দরকার। তবে প্রথম ছবিটার ক্যাপশনে তারিখ ভুল হয়েছে মনে হয়।
মূল ছবির ভেতরে সঠিক তারিখ আছে।
ধন্যবাদ। কৃতজ্ঞতা জালাল ভাইকে। তাঁকে জিজ্ঞেস করার কথা আমার কেন মনে পড়েনি কে জানে!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
জুড়ে দিলাম।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
আবারও ধন্যবাদ।
ভাসানীর এই সেই ছবি যেটার কথা লেখায় উল্লেখ করেছিলাম। ছবিটা চোখে ভাসছিলো, জালাল ভাইয়ের কল্যাণে চোখে দেখা হলো আরেকবার।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
নতুন মন্তব্য করুন