৩.১
অফিস থেকে বেরিয়ে প্রথামতো জালাল ভাইয়ের বাসায় যাই। প্রথাটি এইরকম, প্রতি বছর ডিসেম্বরের ষোলো তারিখটি তিনি উদ্যাপন করেন। তাঁর ব্যক্তিগত উৎসব। তারিখটি সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পড়লে সারাদিনের, নাহলে সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। বছর পাঁচেক আগে জালাল ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে আমি প্রতি বছর আমন্ত্রিত। এমন প্রথা দাঁড়িয়ে গেছে যে আগে থেকে বলা-কওয়ার ব্যাপারও নেই, তিনি আমার জন্যে অপেক্ষা করবেন।
জালাল ভাই দেশে থাকার কালেও কখনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের কুচকাওয়াজে-উৎসবে যাননি, নিজের মতো করে দিনটি উদযাপন করতেন। একদিন বলেছিলেন, ওইদিন একা একা রিকশা নিয়া দিনভর সারা ঢাকা শহর ঘোরাঘুরি করতাম। যুদ্ধের সময় যেইসব জায়গায় অপারেশন করছি, সেগুলি ঘুইরা দেখতাম, মনে মনে সেই দিনগুলিতে ফেরার চেষ্টা করতাম। সব জায়গাই কমবেশি বদলায়া গেছে, নতুন মানুষজন, নতুন দোকানপাট, বাড়িঘর। কেউ জানে না আমি কে, কি চাই। এইরকম একবার ফার্মগেটে রিকশা থামায়া সিগারেট কিনতে গেছি, তখন আমি সিগারেট খাইতাম, বুড়া দোকানদার আমার মুখের দিকে তাকায়া বলে, আপনেরে চেনা চেনা লাগে। আমি বলি, না চাচা, আমারে চিনবেন ক্যামনে? আমি এই এলাকার না। তখন দোকানদারে বলে, যুদ্ধের সময় এক রাইতে আপনে আমাগো তেজকুনিপাড়ার বাসায় আসছিলেন, আমার পোলা মাইনুল আপনেগো সাথে ইন্ডিয়া গেছিলো। ঠিক কইলাম, চাচা? আমি তখন আর কী বলি, পলায়া যাইতে পারলে বাঁচি। ক্যামনে তারে বলি মাইনুলরে আমার স্পষ্ট মনে আছে, ট্রেনিং নিয়া ফিরা আসছিলাম একই সঙ্গে। সেপ্টেম্বর মাসের দিকে আরো কয়েকজনরে নিয়া কলকাতা যাইতেছিলো কুষ্টিয়ার বর্ডার দিয়া আরো কিছু অস্ত্রপাতি আনার জন্যে। পথে তারা অ্যামবুশে পড়ে, তিনজন নিখোঁজ হয়, মাইনুল সেই তিনজনের একজন। তারা আর কোনোদিন ফিরা আসে নাই, কিছু জানাও গেলো না কি হইছিলো। তো, সেই দোকানদার চাচারে বললাম, মানুষে মানুষে চেহারার মিল তো থাকেই চাচা, আপনার হয়তো ভুল হইতেছে। রিকশায় উঠতে উঠতে বুড়া দোকানদাররে বলতে শুনলাম, আমার ভুল হয় নাই গো, চাচা! আমি ভুলি নাই!
বাংলাদেশের ইতিহাস এবং একাত্তরের যুদ্ধ নিয়ে জালাল ভাইয়ের মতো নিবেদিত ও একাগ্র মানুষ আমি আর দেখিনি। বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, স্বাধীনতার পরে কয়েক বছরে দলে ক্রমাগত ভাঙনের ফলে ক্রমশ নিরাসক্তি ও নিষ্ক্রিয়তা। বিরাশিতে এরশাদের ক্ষমতা দখলের পর তাঁর মনে হয়, বাংলাদেশ আর নিরাপদ নয়। অনেক উত্থান-পতনের পরেও কখনো সুদিন আসবে, এমন আশা তাঁর জাগ্রত ছিলো, বাংলাদেশের আরো অনেক মানুষের মতো। নতুন করে সামরিক শাসনের শুরু হলে আর আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ তিনি অবশিষ্ট দেখতে পান না।
বলেছিলেন, আপনার মনে আছে, এই লোক গদিতে বসার পরপরই খেলার মাঠের এক গোলমাল নিয়া আবাহনীর চার ফুটবলাররে জেলে ভরছিলো বিনা কারণে?
ঘটনাটি শোনা ছিলো, পত্রিকায় বিস্তারিত পড়েছিলাম। বিরাশির মার্চে নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে দিয়ে সামরিক শাসনের উপহার নিয়ে উপস্থিত এরশাদ। এর মাসকয়েক পরে ঢাকা স্টেডিয়ামে আবাহনী-মোহামেডানের ফুটবল খেলা। শ্রেষ্ঠতার প্রতিদ্বন্দ্বী এই দুই দলের খেলায় গোলযোগের ঘটনা অনেকবার ঘটেছে, প্রায়শই ঘটে। এইসব গোলমালে দর্শকে দর্শকে মারামারি, তার ফলে মৃত্যুও ঘটেছে, এমনকি একবার খেলোয়াড়দের হাতে দর্শকের মৃত্যুও ঘটেছিলো বলে মনে পড়ে। বস্তুত এই দুই দলের খেলা নির্ঝঞ্ঝাটে শেষ হওয়া একটি ঘটনাবিশেষ। বিরাশির গ্রীষ্মকালে সেই খেলায় মাঠে দুই দলের কয়েকজন খেলোয়াড়ের মধ্যে হাতাহাতি হয়, তা অচিরে গ্যালারির দর্শকদের মধ্যেও বিস্তৃতি পায়।
জালাল ভাই বলেন, সেইদিন আমি ছিলাম মাঠে, নিজের চোখে দেখা। আনোয়ার আর হেলাল ওই গোলমালে ছিলো, কিন্তু সালাউদ্দিন-চুন্নু তো আশেপাশেই নাই। খেলার মাঠের মারামারি নতুন কিছু না, তার কারণে কাউরে আগে কোনোদিন জেলে যাইতে হয় নাই। ওই চারজনরে ক্রিমিনালদের মতো হাতকড়া পরায়া ঢাকার বাইরে জেলে পাঠাইছিলো। আমার তখনই মনে হয়, এই লোক আরো অনেক সর্বনাশ করবে। আর দেশে থাকা ঠিক না। ওদের ট্রেনে তোলা হইতেছে, সেই সময় কমলাপুর স্টেশন লোকে লোকারণ্য। চুন্নুর সাথে আমার কিছু জানাশোনা ছিলো, আমারে দেইখা ফুঁপাইয়া কান্দে সে। বলে, ন্যাশনাল টীমের প্লেয়ার আমি আজ কতো বচ্ছর, জীবনে কোনোদিন মারামারি দূরে থাক তর্কও করি নাই, তা কে না জানে! ফুটবল খেলার জন্যে হাতে হাতকড়া পরতে হইবো কোনোদিন ভাবছি? বরিশালের পোলা হেলাল দাঁতে দাঁত চাপে আর কয়, একদিন ঠিক দেইখা নিমু সবগুলিরে।
স্ত্রী এবং শিশুকন্যাকে নিয়ে দেশান্তরী হন জালাল ভাই। আমেরিকায় বসতি স্থাপনের বাসনা বা চিন্তা তাঁর আগে কোনোকালে ছিলো না, সুতরাং পেশাগত প্রস্তুতিও কিছু নেওয়া হয়নি। একটি অ্যাকাউন্টিং প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, ভাবীকেও কাজ করতে হয়। এ দেশে আসার পর একটি পুত্রসন্তান হয়েছে তাঁদের। একজনের রোজগারে সংসার চলে গেলেও ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের জন্যে কিছু করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ভাবীর চাকরিটি সেই ভবিষ্যতের সঞ্চয়। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধসংক্রান্ত যে কোনো বই, সিনেমা, ফোটোগ্রাফ, গান, পোস্টার, দেশী-বিদেশী দলিলপত্র, সংবাদপত্রের কাটিং তাঁর সংগ্রহ করা চাই-ই চাই। এইসব বিনা পয়সায় হয় না, ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের সঞ্চয় ভেঙে করতে হয়। তবু এই সংগ্রহ নিয়ে তাঁর গর্বের অন্ত নেই।
এই শহরে বাঙালি সংগঠনের কোনো অনুষ্ঠান হলে জালাল ভাই অডিটরিয়ামের বাইরে তাঁর সংগ্রহের কিছু অংশ নিয়ে একটি টেবিল সাজিয়ে বসে থাকেন। কৌতূহলী কেউ কেউ এসে সেগুলো নাড়াচাড়া করে, দু’একটি প্রশ্ন করে। পরম উৎসাহে তিনি উত্তর দেন, ব্যাখ্যা করেন। তাতেই পরিতৃপ্ত তিনি, আর কিছু তাঁর চাওয়ার নেই। এইরকম একটি অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। জালাল ভাইকে ঠাট্টা করে আমি পাগল বলি, ভেতরে ভেতরে পরম মমতায় তাঁর কাছে আমার মাথা নত হয়। ভাবীও বুঝে গেছেন, জালাল ভাইয়ের পাগলামি থামানো যাবে না, সেরকম চেষ্টা মানুষটিকে জীবন্মৃত করে ফেলার শামিল।
ঘরে ঢুকে জানা গেলো, ভাবী ছেলেমেয়েদের নিয়ে গেছেন তাঁর বোনের বাসায়। রান্নাবান্না করে রেখে গেছেন। জালাল ভাই জানালেন, ভাবী বলে গেছেন, দুই পাগলের হাতে বাসা দিয়া গেলাম, ফিরা আসার পর কী দেখি কে জানে!
জালাল ভাই তাঁর নতুন কিছু সংগ্রহ দেখালেন - বাংলাদেশের যুদ্ধসংক্রান্ত সম্প্রতি ডিক্লাসিফাই করা মার্কিন সরকারের বেশ কিছু দলিলপত্র। একাত্তরে ঢাকায় আমেরিকান কনসাল জেনারেল ছিলেন আর্চার ব্লাড, তাঁর লেখা বই দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ, ঢাকা থেকে আনিয়েছেন। দু’জনে অনেকক্ষণ গান শোনা হলো। জোন বায়েজ-এর সঙ অব বাংলাদেশ -
When the sun sinks in the west
Die a million people of the Bangladesh...
যুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে বাজানো হতো, সেইসব গানের সবগুলো তাঁর সংগ্রহে। আপেল মাহমুদ, স্বপ্না রায়, মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, রথীন্দ্রনাথ রায়। একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি শুনতে শুনতে আমার চোখ ভিজে আসে।
মন্তব্য
এমএমআর জালাল
উনি যে কেন লিখছেন না
লেখা আগের মতোই চমৎকার
-------------------------------------
রামছাগলের সামনে, খচ্চরের পেছনে আর নিবোর্ধের ধারেকাছে না থাকাই শ্রেয়!
অরূপ, এমএমআর জালাল সবসময় বলেন, তিনি লিখতে পারেন না। তিনি পাঠক। এবং ইতিহাসের নিষ্ঠাবান সংগ্রাহক।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
ভালো লাগছে, গল্পচ্ছলে ইতিহাস উঠে আসছে, এটি নতুনত্ব মনে হলো। আগামী কয়েক পর্ব পড়লে বোঝতে পারবো কাহিনী কোন দিকে যাবে।
শিমুল, শুধু চলমান সময় নয় হয়তো সব সময়ের জন্যেই প্রযোজ্য।
উপন্যাসে ইতিহাস, তা-ও যদি হয় অতি সাম্প্রতিক ইতিহাস, মেশানো খুব দুরূহ। সেই কারণেই আমার এই লেখাটি এখনো "খসড়া"।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
জুবায়ের ভাই, ইতিহাস মেশানোর কাজটা বেশ এনজয় করা যাচ্ছে। বিশেষত বিরাশি-উত্তর সামরিক ইতিহাস। তবে বিরাশির আগের এবং পচাত্তরের পরের যে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ইতিহাস, তার ব্যাপারে আমার খুবই আগ্রহ। এখানকার অধিকাংশ ব্লগারের মত আমিও তখন হাঁটি হাঁটি পা পা। আপনি সেসময়টা নিবিড়ভাবে দেখেছেন, অনুমান করি। আপনার উপন্যাসে নিয়ে আসুন না সেই সময়টাকে। অবিশ্বাস, বিশ্বাসঘাতকতা, হত্যা, ক্যু পাল্টা ক্যু-র এই উত্তাল সময়টাকে। এখন পর্যন্ত ভাল কোন ইতিহাসও তো দেখিনি এই সময়ের। দুর্দান্ত একটা জিনিস হবে সেটা, আমার বিশ্বাস।
আসিতেছে। ৭১ থেকে ২০০৪। হয়তো এখনো শুধুই আঁচড় কাটা। এই খসড়াটিকে উপন্যাসে দাঁড় করাতে গেলে আপনাদের ভালোমন্দ প্রতিক্রিয়া এবং পরামর্শ কাজে আসবে। সাহায্য করবেন আশা করি।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
কোন হেলাল ?
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
এই হেলাল আবাহনীর খেলোয়াড় ছিলেন। এখনও কর্মকর্তা হিসেবে ফুটবলের সঙ্গে জড়িত জানি। বিবাহসূত্রে সন্ধানীর গাজী শাহাবুদ্দিন পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
পরের পর্বে যাই।
কি মাঝি? ডরাইলা?
নতুন মন্তব্য করুন