আমাদের বাতিঘরগুলি ও আসন্ন দিন – ০৩

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি
লিখেছেন মুহম্মদ জুবায়ের (তারিখ: রবি, ১০/০২/২০০৮ - ১২:০২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৩. রাজনীতি বদলের গিনিপিগ আমরা

কয়েকদিন আগে একটি অনলাইন ফোরামে পড়লাম, আমেরিকায় বিজ্ঞানীদের শতকরা ১২ জন ভারতীয় বংশোদ্ভূত। আমেরিকার চিকিৎসাবিদদের ৩৮ শতাংশ, নাসা-র বিজ্ঞানীদের ৩৬ শতাংশ, মাইক্রোসফট ও আইবিএম কর্মীদের যথাক্রমে ৩৪ ও ২৮ শতাংশ ভারতীয়। এর বাইরে ব্যবসা-বাণিজ্য, চলচ্চিত্র উৎপাদন ও কমপিউটার-সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভারতীয়দের বিপুল সাফল্যের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি, বিগত দশ বছরে ছ’জন ভারতীয় মিস ইউনিভার্স/মিস ওয়ার্ল্ড হয়েছেন সে কথাও লেখক উল্লেখ করতে ভোলেননি।

এই রচনাটির পাকিস্তানী লেখক বলেছেন, পাকিস্তান এর ধারেকাছেও নেই। রচনার শেষে একটিমাত্র বাক্যে কারণ নির্দেশ করেছেন এই বলে যে, ভারতীয়দের নেতত্ব ও শাসকরা নির্বাচিত হয় আসেন।

হয়তো আমার দোষ, অথবা আমি যে সময়ে বেড়ে উঠেছি তা-ও কারণ হতে পারে, কিন্তু পাকিস্তানীদের সম্পর্কে আমার স্বাভাবিক বিরাগ আছে। তাদের যে কোনো কথা বা কর্মকে আমি সন্দেহের চোখে দেখি। তবে ওপরে বর্ণিত ভারতীয়দের সাফল্যের কারণটি যথার্থ বলে স্বীকার করা চলে। নির্বাচিত ও প্রতিনিধিত্বশীল ধারাবাহিক নেতৃত্ব একটি জাতির সাফল্যের জন্যে অত্যন্ত জরুরি উপাদান যা স্থিতির নির্দেশক, প্রথা-পদ্ধতি-আদর্শ বিষয়ে জাতিগত মৌলিক ঐক্যের স্মারক। এই ধারাবাহিকতা ভারতের শিক্ষা-দীক্ষা, সমাজ-সংস্কৃতি সবকিছুতেই তার ছাপ রেখে গেছে।

বলা বাহুল্য, পাকিস্তানের মতো চরম দুর্দশাগ্রস্ত না হলেও স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতির গল্পটিও যথেষ্ট কলংকিত ও অমসৃণ। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতত্ব দেয়। স্বাধীনতার পর নতুন সংবিধানের অধীনে ৭৩-এ আরেকটি সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগই সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকারে অধিষ্ঠিত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতার নিশ্চয়তা ছিলো শতকরা একশো ভাগ, তবু কয়েকটি আসনে গায়ের জোরে আওয়ামী লীগ নেতৃস্থানীয় কিছু প্রার্থীকে জিতিয়ে আনে। ফলে বিনা প্রয়োজনে একটি কু-দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো। এর কিছুকাল পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু নির্বাচনে ব্যালট বাক্স ছিনতাই হয় ক্ষমতাসীনদের প্ররোচনা ও তৎপরতায়। বাংলাদেশের পরবর্তীকালের রাজনীতির ইতিহাস দেখলে এই দুটি ঘটনাকে নিতান্ত শিশুসুলভ ও প্রায় নিরীহ বলা চলে। কিন্তু গণতন্ত্রচর্চার হিসেবে তা ছিলো বড়ো ধরনের হোঁচট। এই পদ্ধতি পরবর্তীকালে আরো পেশাদারী দক্ষতায় ও নৃশংসতায় রূপায়িত হতে আমরা দেখেছি।

৭৫-এর শুরুতে বাকশাল নামের ডামাডোল। জিনিসটি ভালো ছিলো কি মন্দ তা বিচার করে দেখা হয়নি কখনোই, তার আগেই শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়, রাষ্ট্রের পুরো প্রেক্ষাপট বদলে যায়। বিপুল প্রচারণার ফলে এটি যে অতি নিকৃষ্ট একটি শাসনব্যবস্থা তা আমরা জেনেছিলাম। আমার ধারণা, মানুষের জন্যে এই ধরনের সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতার ব্যবস্থা যুদ্ধেশেষে স্বাধীনতার পরপরই চালু করলে কারোই হয়তো তা মানতে আপত্তি হতো না। তখন আমরা সব মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু পুরো দুটি বছর অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর ততোদিনে রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা বদলে গেছে। তখন মানুষের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে শুরু করেছে, দেশ একটি দুর্ভিক্ষাবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে, জীবনের নিরাপত্তা পদ্মপাতায় জলের মতো টলোমলো, জীবনধারণ কঠিন থেকে কঠিনতর।

এরপর একের পর এক সামরিক শাসন এসেছে, নিরীহ বেসামরিক বেড়ালের ছাল গায়ে দিয়ে অতিকায় সামরিক বাঘ হুংকার দিয়েছে অনেক বছর ধরে। এখনো দিচ্ছে। ৯০ থেকে শুরু করে বছর পনেরো তারা সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে পুতুলনাচ দেখেছে, কিন্তু শিকারকে চোখের আড়াল হতে দেয়নি, তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতাও পুতুলনাচের কুশীলবদের ছিলো না।

প্রকাশ্য ও ছদ্মবেশী বাঘের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠে ধর্মান্ধ হায়েনারা। ক্রমে দুইয়ে হয় সখ্য এবং গভীর ভালোবাসাবাসি। রাজনীতি হয় আরো দুরূহ, পঙ্কিল। স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধী ও চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন প্রকল্পটি ক্রমে সম্পন্ন করা হয় তাদের রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার করে। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের ‘রাজনীতিকে দুরূহ’ করার সংকল্পটি সফল করার জন্যে ‘টাকা কোনো সমস্যা নয়’ তত্ত্ব প্রয়োগ করা শুরু হলো সত্তর দশকের দ্বিতীয়ার্ধে। গাবতলীর গরুর হাটের মতো জমজমাট উৎসাহ ও তৎপরতায় রাজনীতিকদের আত্মা বেচাকেনা শুরু হয়। অনেক অনেক বিপ্লবী ও সংগ্রামী রাজনীতিক সেই হাটে বিক্রি হয়ে গেলেন। একসময় এমন অবস্থা হলো (যা আজও বিদ্যমান) যে কে কবে কার বিছানাসঙ্গী হবেন বা হলেন তার হিসেব রাখাও অসম্ভব হয়ে যায়। ছাত্র রাজনীতিই বা বাদ থাকে কীভাবে? এরশাদের শাসনে শুরুর দিকে ছাত্রদের সংগঠিত বড়ো আন্দোলনটি দানা বেঁধে উঠছে, এইসময় ডাকসুর সাধারণ সম্পাদকের বিপ্লবী আত্মাটি বিক্রয়ের জন্যে লভ্য হয়ে ওঠে। ডাকসুর ইতিহাসে প্রথম। আন্দোলনের বারোটা বাজলো।

আশির দশকের শেষে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতন আমাদের রাজনীতিতে আরেক দফা বিভ্রান্তি ও হতাশার জন্ম দেয়। ওই আদর্শে বিশ্বাসী মানুষদের অধিকাংশই আর কোনো রাজনীতিতে কখনো সংশ্লিষ্ট হতে পারলেন না। যাঁরা কোনোমতে নিজ পরিচয়ে টিকে গেলেন অথবা অন্য কোথাও আশ্রয় খুঁজতে গেলেন, তাঁরা হয়ে গেলেন অনুল্লেখ্য ও গৌণ। আমাদের রাজনীতিচর্চা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের নিরিখে এ-ও এক বিশাল ক্ষত ও ক্ষতি হয়ে থাকলো।

৯০ সালে সর্বদলীয় আন্দোলনের ফসল হিসেবে এরশাদের বিদায় ঘটে। সফল আন্দোলনের রূপকার দুই জোটের সমঝোতা-স্মারকে নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ পাওয়ার স্বপ্ন আরেকবার দেখি আমরা। কিন্তু আরো একবার স্বপ্নভঙ্গ হতে দেরি হয়নি। প্রায় দুই দশকের পঙ্কিল রাজনীতির ধারা থেকে পালা করে ক্ষমতায় আসা দলগুলি কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারে না। চেষ্টাও খুব যে হয়েছে, তা-ও বলা মুশকিল। দেশ ও দেশের মানুষের জন্যে নয়, রাজনীতি মূলত আবর্তিত হয়েছে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীচর্চায় ও লুণ্ঠনচর্চায়। রাজনীতিতে সবচেয়ে বড়ো যে জিনিসটির দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় তা হলো দলীয় নীতি-আদর্শ ও কর্মসূচীর। অযথা হরতাল-চর্চায় মানুষ ভুগেছে নানাভাবে, দুর্ভোগের শিকার হয়েছে, বিরক্ত হয়েছে। রাজনীতিকরা ভ্রুক্ষেপ করেননি। তাঁদের একমাত্র মোক্ষ যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় আরোহণ।

ধারণা করা চলে যে, রাজনীতিকে খুব পরিকল্পিতভাবে ক্রমশ রাজনীতিকদের হাত থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র ভোটের জন্যে রাজনীতির প্রচলন হলে দুটি জিনিস প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে – বিত্ত ও পেশী। ফলে রাজনৈতিক দলগুলি নির্বিচারে অর্থবান মানুষদের নেতা বানিয়ে ফেলে রাতারাতি, বহু বছরের নিবেদিত ও ত্যাগী কর্মীদের বাদ দিয়ে নবাগত বিত্তবানদের নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়। বিত্তের উৎসটি ন্যায্য না অন্যায্য এই প্রশ্নও গৌণ হয়ে যায়। গত তিনটি সংসদে নির্বাচিতদের দিকে তাকালে দেখা যাবে সেখানে প্রকৃত রাজনীতিকদের চেয়ে ব্যবসায়ী বেশি। বাদবাকি অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আর আমলা। তাঁরা যে নিজেদের প্রয়োজনের দিকটিই দেখবেন তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ভোট দেওয়া জনগণের কথা মনে রাখার দায় প্রকৃত রাজনীতিকের থাকে, ব্যবসায়ী-আমলার নয়, প্রাক্তন সেনাকর্তারা তো জনগণকে চেনেনই না। একইভাবে রাজনীতির আশ্রয়ে দুর্বৃত্তরা সমাজের সর্বত্র প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়, পেশী ও অস্ত্র তাদের সহজ বিত্ত অর্জনের উপায় হয়ে ওঠে।

রাজনীতির এই ভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতার ফল হয়েছে মারাত্মক। মানুষ রাজনীতির ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। তারা রাজনীতিকদের দেখে সন্দেহের চোখে। এমনকি, রাজনীতির নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরাও আদর্শহীনতা ও কর্মসূচীবিহনে অথবা অর্থহীন কর্মসূচীর কারণে অকর্মণ্যতা ও নৈরাশ্যের শিকার হয়ে পড়েছেন। অথচ এই বাঙালি একদা ১৪৪ ধারা ভেঙেছে, কারফিউ-এর মধ্যে রাস্তায় নেমে এসেছে, শূন্য হাতে সশস্ত্র সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে নিশ্চিত চূড়ান্ত পরিণতি জেনেও। তারা প্রাণের মায়া করেনি। তা সম্ভব হয়েছিলো এই কারণে যে তখন তারা এটুকু জানতো লড়াইটা কী এবং কেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বে তাদের আস্থা ছিলো। আজ এইসব বড়ো সুদূর মনে হয়, রূপকথার মতো অবাস্তব।

পর্বের শুরুতে উল্লিখিত পাকিস্তানী লেখকের মতো আক্ষেপ করে বলতে হয়, আমাদেরও অনেকটা কাল কেটেছে যখন আমরা রাষ্ট্রচালনার জন্যে কাউকে নির্বাচিত করতে পারিনি। কোথা থেকে কে যেন উড়ে এসে আমাদের কাঁধে চেপে বসেছে। আর যাদের নির্বাচিত করার সুযোগ পেয়েছিলাম তারা আমাদের দিকে তাকায়নি। ভারতের রাজনীতির ছবিটি খুব পরিচ্ছন্ন, তা বলা যাবে না। সেখানেও নানা ধরনের অপকর্ম, দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম, সাম্প্রদায়িকতা এইসবই ছিলো এবং আছে। তফাৎ এখানেই যে ৬০ বছরের ইতিহাসে তারা একটি মিনিটও সামরিক বুটের তলায় যায়নি। তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে – ভালো বা মন্দ যা-ই হোক – গণতন্ত্রের চর্চাটি ধারাবাহিকভাবে হয়েছে, জবাবদিহির ব্যবস্থাটি বরাবর অটুট ছিলো, মানুষের প্রশ্ন করার অধিকার কখনো রহিত হয়নি। আজ সংসদীয়, কাল রাষ্ট্রপতিশাসিত, পরশু সামরিক শাসন এই ধরনের পদ্ধতিগত নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হয়নি। বাংলাদেশকে হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা আমাদের সমাজ-মনস্তত্ত্বে কতোটা প্রভাব ফেলেছিলো তা নিয়ে গভীর অনুসন্ধান করলে অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস।

---------------------------------------------------------

এই সিরিজের পাঠকদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে একটি নিবেদন। রাজনীতি বিষয়ে কিছু চর্বিতচর্বণ করতে হলো এই জন্যে যে এই বিষয়গুলির উল্লেখ ছাড়া মূল প্রসঙ্গে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষভাবে, স্থূল ও সূক্ষ্মভাবে রাজনীতি, সমাজ-বাস্তবতা আমাদের জীবনের বড়ো নিয়ামক। এবার মূল আলোচনায় যাওয়া যাবে। কয় কিস্তিতে শেষ হবে জানি না। পরিকল্পনা করে, ছক কেটে লিখতে শুরু করিনি, ঝোঁকের মাথায় লিখতে গিয়ে বুঝেছি কাজটা সহজ নয়। ধৈর্য ধরে সঙ্গে থাকলে খুশি হই। প্রাসঙ্গিক মন্তব্য পেলে অনেক উপকার হয়।

আমাদের বাতিঘরগুলি ও আসন্ন দিন - ০১
আমাদের বাতিঘরগুলি ও আসন্ন দিন - ০২

(চলবে)


মন্তব্য

ফারুক হাসান এর ছবি

সিরিজটি যে তালে এগুচ্ছে তাকে অসাধারণ বললেও কম বলা হবে।
চলুক
----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ পড়ছেন বলে।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

অসাধারণ একটি সিরিজ। জানি না আর কী ভাষায় বলবো।

কিছুদিন আগের একটি ঘটনা বলি। নিউ ইয়র্ক গিয়ে "ঠিকানা" খুললাম একটা। ভিতরে আপনার একটি সিরিজের লেখা ছিল। আগে-পরের কিছু পড়তে পারবো না বলে আফসোস ছিল। তবে একই সময়ে সচলায়তনের কথা মনে হল। বেশ খুশি লাগছিলো। মনে হচ্ছিল, আপনার বড় মাপের সব লেখাই আমার চোখের সামনে দিয়ে যাবে আগে। সেই আনন্দ আরো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে এই সিরিজের প্রতিটি পর্বের সাথে সাথে।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

ক্যামনে কি কথাটা নতুন শিখেছি, এতোদিনে ব্যবহার করার উপযুক্ত উপলক্ষ পাওয়া গেলো। হাসি "ঠিকানা" পত্রিকায় ইহজন্মে কোনো লেখা পাঠাইনি, ইচ্ছেও হয়নি কাগজটাকে খুব অরুচিকর লাগে বলে। তারা আমার লেখা ছাপছে? কে জানে কী উপায়ে! লেখাটার নাম মনে আছে?

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

আমি জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে গিয়েছিলাম নিউ ইয়র্কে। লেখার শিরোনাম মনে নেই। বস্তা সাইজের পত্রিকার পাতা উল্টাতে উল্টাতে এক জায়গায় "মুহম্মদ জুবায়ের" লেখা দেখে চোখ আটকে গেল। সম্ভবত 'আগের পর্বের পর' জাতীয় কিছু একটা লেখা ছিল। ঐ এলাকায় চেনা-জানা কারো আর্কাইভে থাকলে খোঁজ নিতে পারেন।

আমার অবাক হবার কারণগুলোর একটা ছিল ঠিকানায় আপনার লেখা পাওয়া। অবশ্য, এটা সত্য যে ঠিকানায় লেখা প্রকাশ করলে অনেক বড় পাঠককূল মেলে।

কপিরাইটের বালাই তো বাঙালিমহলে কোনদিনই ছিল না। সেজন্যই হয়তো ছেপে দিতে পেরেছে। থাকুক না, কিছু লোক আলোকিত হলে ক্ষতি কী?

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

ঠিকানা আর্কাইভ করার মতো কাউকে চিনি না। নাঃ, আসলেই মাথাব্যথা নেই, ছেপে আনন্দ পেলে পাক না!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

শুনেছিলাম - 'ঠিকানা' নাকি নিউইয়র্কের 'দৈনিক সংগ্রাম'।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

বলে কি? এই নামে নিউ ইয়র্কে কাগজ আছে জানতাম না। এটা কি জামাতীদের 'সংগ্রাম'? তাহলে আমি অবশ্যই আপত্তি করবো। এ বিষয়ে কারো কিছু স্পষ্ট জানা থাকলে অনুগ্রহ করে জানান।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

স্নিগ্ধা এর ছবি

আমার জানামতে নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ঠিকানা বাংলাদেশি পত্রিকাগুলোর মধ্যে সবচাইতে বেশি পঠিত/বিক্রিত/সঞ্চালিত। জামাতী দের কিনা জানি না, তবে যারই হোক খুব উচ্চমানের কিছু নয়। আপনি চাইলে ওদের জানাতে পারেন আপনার আপত্তি বা অনুমতির ব্যাপারটা।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

'ঠিকানা' আমেরিকায় বাংলা কাগজগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত কাগজ, তা ঠিক। পত্রিকার মান সম্পর্কে যা বলেছেন সে বিষয়েও আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। তবে ওটা ঠিক জামাতী কাগজ নয় বলেই জানি। শিমুল যেহেতু 'সংগ্রাম' নামে একটা কাগজের কথা বললো, সেই প্রেক্ষিতেই আপত্তির কথা উঠছে। আর যা-ই হোক, জামাতী কাগজে আমার লেখা যাক, তা কোনো অবস্থাতেই সহ্য হবে না। ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্যে।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

ভোরের কাগজে কলামিস্ট মহিউদ্দিন আহমদ (সাবেক সচিব) এর এক লেখায় পড়েছিলাম - 'ঠিকানা' মূলত: ঢাকার 'দৈনিক সংগ্রাম'এর ইউএস ভার্সন। পত্রিকা সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের আদর্শগত অবস্থান নিয়েও ঐ কলামে আলোচনা করেছিলেন।
আমার স্মৃতি বিভ্রাটও ঘটতে পারে, এবং সেটা কেবলই পত্রিকার নামটি নিয়ে। যদি 'ঠিকানা' না হয়ে থাকে তবে দু:খিত। অন্য নাম হবে। জুবায়ের ভাই একটু খবর নিলেই নি:শ্চয় জানতে পারবেন।

শ্যাজা এর ছবি

৫ দিয়ে গেলাম।


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

ধন্যবাদ, শ্যাজা।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

৫ এর চেয়ে বেশি কিছু দরকার। তাই ৫ এর সাথে ২/১ টা কথা দিয়ে যাই:

প্রথমে কিছু অংশ কোট করতে চাইলাম; হায় কপাল কোন অংশটা কোট করবো ভেবে পেলাম না। প্রতিটি লাইন বুকে গেঁথে আছে!

এতো সুন্দর বিশ্লেষণ কম পড়েছি। খুব কম।

একটা কথা। শুধু সমস্যার কথা জানতে পারছি। কারণও জানছি। সমাধান লেখার কেউ কি নেই?

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

সমাধান বোধ করি আমাদের কারোই জানা নেই। আমি চেষ্টা করছি আমাদের দুর্বলতা ও ভ্রান্তির জায়গাগুলিকে আমার মতো করে তুলে আনতে। এর বিপরীতে আমাদের কিছু কিছু অর্জনও যে আছে তা পরের পর্বগুলিতে আসবে।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

পরিবর্তনশীল এর ছবি

বরাবরের মতই সুন্দর...
---------------------------------
মহিব
ভাবসাব দেখে মনে হইল "উনি একজন মানুষ"

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

ধন্যবাদ। আশা করছি বাকি পথটুকুও সঙ্গে থাকবেন।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

অদৃশ্য ভগবান এর ছবি

একজন ভারতীয় হিসাবে বলতে পারি - বর্তমানে মিডিয়ায় ভারতের অগ্রগতিকে যেভাবে দেখানো হয় তাতে অনেকটাই জল মেশানো আছে । ভারতের গ্রামাঞ্চলে অর্থাৎ যেখানে ভারতের ৭০% মানুষ বাস করেন তার উন্নতি গত ষাট বছরে যথাযথ হয়নি । উচ্চশিক্ষায় কিছু মানুষ এগোলেও ভারত প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া তে এখনো প্রচুর পিছিয়ে রয়েছে । এগুলির বিচারে ভারত কোনো প্রতিযোগিতাতেই আসতে পারবে না ।
নাসা, আইবিএম, মাইক্রোসফটের কত শতাংশ ভারতীয় কর্মী তা বলার সাথে সাথে এটাও যদি বলা হয় যে ভারতের কত শতাংশ মানুষ এই সব বড় বড় কম্পানিতে কাজ করেন তাহলে ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হবে ।

শুধু পশ্চিমবঙ্গেই কমকরেও এক কোটির উপর বেকার । কলকাতার কাছাকাছি তবু তরুন তরুণীদের জন্য কিছু চাকরির সুযোগ রয়েছে কিন্তু কলকাতা থেকে একটু দূরে গেলেই দেখা যায় দোকান দেওয়া অথবা সরকারি চাকরি ছাড়া শিক্ষিতদের সেরকম কাজের সুযোগ আর নেই ।

তবুও ভারত যে কিছুটা অগ্রগতি করতে পেরেছে তার কারন ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরন এখানে কিছুটা হলেও হয়েছে । কিন্তু পাকিস্তান বা বাংলাদেশে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরন অতটা হয়নি । আর যেহেতু ভারতের জনসংখ্যা বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের থেকে বহুগুণ বেশি তাই বিভিন্ন জায়গায় ভারতীয়দের উপস্থিতির হারটা সহজেই চোখে পড়ে । জনসংখ্যার অনুপাতে এই বিষয়গুলিকে দেখলে তবেই বোঝা যাবে যে পাকিস্তান বা বাংলাদেশ কতটা পিছিয়ে রয়েছে ।

আরো একটা কথা বলা যেতে পারে যে ভারতের সেনাবাহিনী পাকিস্তান বা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম ক্ষমতালোভী । ভারতের মত এত বড় দেশকে সামরিক শাসনে কব্জায় রাখা অসম্ভব জেনেই তারা হয়ত কখনও ক্ষমতাদখলের চেষ্টা করেনি ।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্যে। ভারতের অনুন্নয়নের খাতগুলি বিষয়ে আপনি যা বলেছেন সেখানে দ্বিমত করার উপায় নেই। এগুলি আমাদের সবারই অল্পবিস্তর জানা আছে। আর মিডিয়ার হৈ চৈ জিনিসটিকে যে ছেঁকে নিয়ে আসল জায়গায় পৌঁছতে হয়, তা-ও ঠিক কথা।

এই আলোচনায় আসলে আমি ভারতের অর্জনের বিপরীতে আমাদের অবস্থান তুলে আনার জন্যে পরিসংখ্যানগুলি ব্যবহার করেছি। আমার মূল প্রতিপাদ্য ছিলো ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা।

দেশশাসনে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা বিষয়ে নেহেরুর একটা উক্তি কোথাও পড়েছিলাম (ঠিক মনে পড়ছে না কোথায়)। ভারত রাষ্ট্রের জন্মলগ্নেই তিনি ঘোষণা করেছিলেন, সশস্ত্র বাহিনী আমাদের সঞ্চয়ের মতো। দৈনন্দিন খরচ মেটানোর জন্যে কেউ সঞ্চয় ভাঙে না, সেখানে হাত দিতে হয় শুধুমাত্র সংকটের কালে। আমরা সঞ্চয়ে হাত দিতে চাই না, তা থাক চোখের আড়ালে।

ভারত রাষ্ট্রের বিশালত্ব সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের প্রতিবন্ধক তা মানা কঠিন। ক্ষুধার্ত প্রাণী অনেক সময়ই নিজের হাঁ-এর তুলনায় বড়ো শিকারে কামড় বসায়। ক্ষমতালিপ্সু সামরিক বাহিনী তাদের থেকে খুব আলাদা বোধহয় নয়।

নেহেরুর কথা ভারত মান্য করেছিলো, এখনো করছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে পাকিস্তানীরা ওই সঞ্চয় ভাঙিয়ে বরাবর চলছে, আর বাংলাদেশ মাঝেমধ্যেই সেদিকে হাত বাড়ায়, প্রয়োজনে ও অপ্রয়োজনে।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

নজমুল আলবাব এর ছবি

এই সিরিজটা শুরু করানোতে আমার মনে হয় হালকা একটা ভূমিকা আছে। তিন পর্ব হয়ে গেল। পড়ছি আর ভাবছি, ভাগ্যিস জুবায়ের ভাই ছিলেন আর আমাদের কথাগুলোকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। নয়ত এভাবে আর কে বিশদ বুঝিয়ে দিত। চলুক জুবায়ের ভাই।

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

সিরিজ শুরুর পেছনে আপনারও একটি ভুমিকা (হালকা নয়) প্রথম পর্বের গোড়াতেই উল্লেখ করেছি। ঐ যে একটা কথা আছে না - একে নাচুনি বুড়ি, তাতে ঢাকের বাড়ি! এই বিষয়গুলি মাথায় অনেকদিন ধরে এলোমেলো অবস্থায় ঘুরছিলো। এখন ঢাকে বাড়ি পড়াতে সেগুলি গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করছি, এই তো! ভালোমন্দ কী হচ্ছে জানি না, কারো কোনো কাজে আসবে কি না তা-ও জানা নেই। বলার একটা উপলক্ষ তৈরি হয়েছে, তাতেই আমার আনন্দ। আপনাদের ভালো লাগলে উপরি পাওনা হিসেবে তা কুড়িয়ে নিতে আমার আপত্তি নেই।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

আমাদের দেশে ১৫ বছরের গণতন্ত্রের চর্চা নিয়ে অনেক কিছুই বলা যায় - কিন্তু এই সব বললে অনেকটা অবধারিত ভাবেই জলপাই, সুশীল জাতীয় কিছু খেলো শব্দ বা গালি ঘাড়ের উপর নেমে আসে। তাই সেদিকে আর যাবো না। তবে এতোটুকু বলা যায় - যে অযোগ্য, অশিক্ষিত, অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন, দূর্নীতিবাজ, স্বার্থপর এবং নীতিহীন রাজনীতিবিদদের ভোট দিয়ে দিয়ে অনেক কিছুই সাধন হতে পারে, কিন্তু বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলা তাতে সম্ভব না, প্রকৃত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নও তাতে আসবে না। মোবাইলে দিন-রাত এসএমএস পাঠানো আর উন্নয়ন এক জিনিস না। তবে এই নেতৃত্বের সংকট কে ঘুচাবে, সেটা জানা নেই।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

অযোগ্য, অশিক্ষিত, অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন, দূর্নীতিবাজ, স্বার্থপর এবং নীতিহীন রাজনীতিবিদদের ভোট দিয়ে দিয়ে অনেক কিছুই সাধন হতে পারে, কিন্তু বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলা তাতে সম্ভব না, প্রকৃত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নও তাতে আসবে না।

আপনার পুরো মন্তব্যটি ঠিক বুঝেছি কি না নিশ্চিত নই। যদি ভুল না বুঝে থাকি, উদ্ধৃত অংশের প্রেক্ষিতে বলি, এই বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ একমত। আমি শুধু একটি পদ্ধতিগত ও রাষ্ট্র পরিচালনার সাধারণ নীতিমালার ধারাবাহিকতা আশা করি। সাধারণ নীতিমালার ধারাবাহিকতার একটি উদাহরণ হতে পারে উপজেলা পদ্ধতি। শুধুই উদাহরণ, ভালোমন্দের বিচারে যাচ্ছি না। আমরা যদি মনে করি পদ্ধতিটি আমরা গ্রহণ করবো, পরের সরকারকে তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে।

শুরুটা কোথাও হতে হবে। এই অযোগ্য নেতৃত্ব চিরকাল থাকবে না, নতুন যোগ্য একটি প্রজন্ম অচিরে উঠে আসবে, এটা কি খুব বেশি আশা করা? আমার মনে হয় না, আমি অতো হতাশ নই এখনো।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আরিফ জেবতিক এর ছবি

এই সিরিজটাকে ইবুক করার দাবী পুনর্ব্যক্ত করছি ।

এটা জরুরী হয়ে পড়েছে ।

সচল কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কাম্য ।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আরিফ, ই-বুক না হয় করা যাবে। কিন্তু আপনার মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য পেলে বোঝা যেতো আমার অক্ষম বিশ্লেষণের ফাঁকগুলি কোথায়। অনেক ক্ষেত্রে আমার ধারণা ভুল হতে পারে, অস্পষ্ট হওয়াও সম্ভব। আলোচনা হলে জিনিসগুলি পরিষ্কার হতে পারে।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আরিফ জেবতিক এর ছবি

এখন পর্যন্ত তো বস কোন দ্বিমত প্রকাশের সুযোগ দেখছি না । নিবিড় পর্যবেক্ষন ও পাঠ করে যাচ্ছি , কোন বিষয়ে দ্বিধা থাকলে তখন অবশ্যই মন্তব্যের মাধ্যমে বেরিয়ে আসবে ।

অতিথি লেখক এর ছবি

রাজনীতি নিয়ে এ ধরণের লেখাই তো চাই। আশাকরি আরও অনেক লিখবেন। ই-বই হলে খুব ভাল হয়।

মুহাম্মদ২০১৭

আরিফ জেবতিক এর ছবি

জুবায়ের ভাই ,
রাজনীতির এই বিবর্তনের মাঝে ৭১ পরবর্তী বিষয়গুলো নিয়ে
নিম্নোক্ত পয়েন্টে আপনার মূল্যায়ন ও পর্যবেক্ষন জানতে আগ্রহী ।

১. স্বাধীনতা পরবর্তীতে আমাদের দ্রুত বিপর্যয়ের কারন হিসেবে এটা কি একটা কারন হতে পারে যে আমরা স্বাধীনতার জন্য সেই সময় প্রস্তুত ছিলাম না । ৭০ এর নির্বাচনের ম্যান্ডেটটা আসলে ছিল পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র তৈরীর ম্যান্ডেট , একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য নয় । কিন্তু ঘটনাচক্রে আমরা স্বাধীনতা পেয়ে যাই , এবং দ্রুততম সময়ের মাঝেই পেয়ে যাই । এই হঠাৎ অর্জনটাকে দ্রুত সংহত করার মতো নেতা আমাদের মাঝে ছিলেন না, মুজিব আসলে স্তাবক পরিবেষ্ঠিত একজন একনায়কে রূপান্তরিত হন এই সময়ে । এই জাতিগত অপ্রস্তুত অবস্থা কি এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী ?

২. জাতিগত ভাবে স্বাধীনতা পরবর্তীতে হঠাৎ গনতন্ত্রের চর্চা আমাদের হাজার হাজার বছরের সামন্ততান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সাথে খাপ খেতে পারে নি । কারন বিবর্তনগুলো সেই ফোন ব্যবহার না করা কৃষকের মোবাইল ফোন পাওয়ার মতোই ( তুলনাটা আপনারই কাছ থেকে নেয়া ) একটা হুট করা ব্যাপার হয়ে যাওয়ায় আমরা একে এডাপ্ট করতে পারি নি । ( তবে এখানে আমি নিজেই কনফিউজড কারন একই সমাজ ব্যবস্থার মাঝে থেকেও ভারতে গনতন্ত্র তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পেরেছে , তুলনামূলক ছোট জনপদ এই বাংলাদেশে কিংবা পাকিস্তানে যেটা হয়ে উঠে নি )

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আমার বিবেচনায় আপনার উল্লিখিত বিষয় দুটি আসলে পরস্পরের সঙ্গে জড়িত, আলাদা করে দেখা মুশকিল। অল্প কথায় এর বিশ্লেষণ অসম্ভব। ভবিষ্যতে হয়তো এই বিষয়েই আলাদা আলোচনা হতে পারে। আপাতত সংক্ষেপে কিছু বলা যাক। পুনর্বার বলে রাখা ভালো, পর্যবেক্ষণগুলি একান্তই আমার নিজস্ব।

আওয়ামী লীগের যে কোনো নেতাকর্মীকে জিজ্ঞাসা করলে হয়তো শোনা যাবে, অতি বালক বয়সেই টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা ভেবেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি হিসেবে শেখ মুজিবের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলা দরকার, এই ধরনের অতিভক্তির কথা বানোয়াট, মনগড়া। শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিই সারাজীবন করেছেন। তিনি কোনো বিপ্লবী নেতা ছিলেন না। ঠিক যেমন ছিলেন না একনায়ক, ফলে একনায়ক হতে গিয়েও সফল হননি, প্রাণ দিতে হয়েছিলো বাংলাদেশের কপালে সর্বনাশের চিহ্ন ঝুলিয়ে দিয়ে। তিনি নিজে বিপ্লবী ছিলেন না, সুতরাং তাঁর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের পক্ষেও বিপ্লবী সংগঠন হওয়া সম্ভব ছিলো না। সশস্ত্র যুদ্ধ ও রাষ্ট্রীয় বিপ্লব স্বাভাবিকভাবেই শেখ মুজিব বা তাঁর সংগঠনের আদর্শ ছিলো না কখনো, কর্মসূচী বা কর্মপরিকল্পনার অংশও নয়। ৭১ সালের মার্চে পাকিস্তান বাহিনীর নৃশংস আক্রমণের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁদের কোনো ধারণাই ছিলো না ঠিক কী হতে যাচ্ছে, তার তীব্রতা কতোদূর।

অবশ্য স্বীকার করে নিতে হবে যে ওই সময়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের নির্বাচিত সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে হঠকারী কোনোকিছু করার সুযোগ ছিলো না। ভুট্টো-ইয়াহিয়া তাঁকে চাপের মুখে সেই হঠকারিতা করানোর চেষ্টায় ছিলো, যাতে তাঁকে আইনের কাঠামোতেই দেশদ্রোহী হিসেবে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্খাটিকে কবর দিয়ে ফেলা যায়। শেখ মুজিব অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে সেই ফাঁদ এড়াতে পেরেছিলেন। কিন্তু এর বিপরীতে তাঁর ছিলো আরেক বিপদ। ৭ মার্চের ভাষণে কার্যত স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে জনমানুষের প্রত্যাশাকে যে তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন সেখান থেকে ফেরার পথও আর ছিলো না তাঁর। এই দ্বিমুখী সংকটের মুখে শেখ মুজিব দোদুল্যমান ছিলেন। তিনি ব্যাপক প্রাণহানী রোধ করার উদ্দেশ্যে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা দিয়েছিলেন। এই ঘটনাটিও তাঁর গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি অনুসরণের একটি স্মারক।

কিন্তু সবচেয়ে বড়ো বিপর্যয় ঘটেছিলো সশস্ত্র প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা বা কাঠামো আদৌ না থাকায়। ২৫ মার্চের আগে গোপনে ও প্রকাশ্যে কিছু তরুণকে যুদ্ধকৌশল শেখানোর বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থা হয়েছিলো তা ঠিক। কিন্তু ২৫ মার্চ রাতের আক্রমণের ভয়াবহতার তুলনায় সেগুলি খড়কুটোর চেয়ে বেশি কিছু ছিলো না। প্রতিরোধ যা হয়েছিলো তা মূলত পুলিশ-আনসার বা দলছুট বাঙালি সৈনিকদের দিয়ে। তার সঙ্গে ছিলো প্রশিক্ষণহীন যুবকদের প্রাণ বলি দেওয়ার বেপরোয়া সাহস ও উৎসাহ। সামরিক প্রস্তুতি যে বস্তুত ছিলো না তার প্রমাণ, মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহর থেকে গোপনে বেরিয়ে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রস্তুতি সম্পর্কেও একই কথা। তাজউদ্দিন দিল্লীতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন যুদ্ধ শুরু হওয়ারও প্রায় দুই সপ্তাহ পরে। স্বাধীনতার ঘোষণাটিও এমনই দায়সারাভাবে করা হয়েছিলো যে আজ স্বাধীনতার ৩৭ বছর পরেও তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে কী পরিস্থিতি হতো বা কী হতে পারতো অথবা পারতো না - এখন আমরা তা শুধু কল্পনাই করতে পারি, যার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

জাতিগতভাবে আমরা যুদ্ধের জন্যে যতোটা অপ্রস্তুত ছিলাম, তার চেয়ে বেশি অপ্রস্তুত ছিলেন তাঁরা আমরা যাঁদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম নির্দেশনা পাবো বলে।

আপনার তোলা পরের প্রসঙ্গে বলি, ফোন ডিঙিয়ে মোবাইলে যাওয়ার উদাহরণে আমি ঠিক ওই ইঙ্গিতটিই করতে চেয়েছি। আমাদের রাজনীতি, সমাজ-বিবর্তন এবং সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাস সবকিছুতেই ধারাবাহিকতার নমুনা কম আছে। লাফিয়ে লাফিয়ে গেছি আমরা। কখনো গাড়ি ফেলে ঘোড়া চলে গেছে, আবার কখনো ঘোড়া ছাড়াই গাড়ি রওনা হয়ে গেছে।

ভারতের সঙ্গে ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-জীবনচর্যায় আমাদের অনেক মিল থাকলেও ১৯৭১ আমাদের আলাদা করে দিয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের ৭১ আছে, তাদের নেই। ৭১-এর যুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণ থাকলেও তারা নতুন রাষ্ট্র পায়নি, আমরা পেয়েছিলাম। এই দ্রত সাফল্য হয়তো আমাদের কিছু অন্যায় ঔদ্ধত্য দিয়েছিলো, বেপরোয়া করেছিলো। তার মাশুল আমাদেরই গুনতে হবে। হচ্ছে। ভারতের ধারাবাহিকতা আমাদের অর্জনে নেই, তার কারণ কিছু এই কিস্তিতেই দেওয়ার চেষ্টা বরেছি। তারপেরও আরেকটা কথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ না করলেই নয়। আমাদের মতো ভারতকে স্বাধীনতার সাড়ে তিন দশক পরে রাজাকার সামলাতে হয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের মোকাবেলা করতেও হয়নি। আমাদের হচ্ছে।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

'বাকশাল' নিয়ে আরও বিশদ জানতে চাই, জুবায়ের ভাই। মিডিয়া কিংবা রাজনৈতিক আলোচনায় বাকশালকে কেবল একনায়কী দু:শাসন বলে জেনে এসেছি। বিপরীতে একজন কলামিস্টের লেখাতেই শুধু পড়েছিলাম , যার মূল কথা এরকম - স্বাধীনতা পরবর্তী ঐ অবস্থায় বাকশাল ছাড়া সমাধান ছিল না, পৃথিবীর অনেক দেশেই এন্টিবায়েটিক হিসেবে এমন শাসন ব্যবস্থা ছিল, সফলও হয়েছে। বাংলাদেশে ফলাফলের আগেই মহানায়ককে হত্যা এবং পুরো ব্যবস্থাটির অপব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। সাথে আন্তর্জাতিক চাল তো ছিলোই।

এ ব্যাপারে জুবায়ের ভাইয়ের অভিজ্ঞতা ও বিশ্লেষণের অপেক্ষায় রইলাম।

আরিফ জেবতিক এর ছবি

বাকশাল বা বিশেষ করে বললে ৭২ -৭৫ যুগ সম্মন্ধে আমার মূল্যায়ন হলো , একেবারে শুরুতেই একটা জাতীয় সরকার করে ফেলা উচিত ছিল ।সেখানে বামপন্থীদেরকে একটা জায়গা ছেড়ে দেয়া যেত , একই সাথে ভাসানীকে একটি সম্মানজনক পদ দেয়া উচিত ছিল । এতে করে দেশের অভ্যন্তরের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে সামলে রাখা যেত কিছুদিনের জন্য ।

উল্লেখ্য যে , আওয়ামীলীগ কোন বিপ্লবী সংগঠন ছিল না ( জুবায়ের ভাইয়ের সাথে একমত ) এবং একারনেই তাদের অভ্যন্তরে চেইন অব কমান্ডের কোন শক্ত সিস্টেম ছিল না । স্বাধীনতা পরবর্তীকালে আওয়ামীলীগের লোকজন তাই বিভিন্ন স্থানে যা ইচ্ছা তা করে বেড়াতে লাগলো , তাদের ভাব ছিল দেশ আমরা স্বাধীন করেছি , তাই এই দেশ আমাদের । ঢালাও ভাবে এই মন্তব্যের জন্য আমি দূ:খিত তবে অধিকাংশ আওয়ামীলীগ কর্মীদের মাঝে এই মানসিকতা কাজ করছিল । ফলশ্রুতিতে আওয়ামীলীগ দ্রুত জনমানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে ।

শেখ মুজিব যেহেতু কোন বিপ্লবী সরকারের প্রধান ছিলেন না , তাই তিনি এই গন গন্ডগোলকে শক্ত হাতে থামাতে পারেন নি , অথবা স্পেসিফিকলি বললে বলতে হয় , থামাতে চান নি । উনার স্নেহ মায়া মমতা বেশি ছিল এবং এটাই তার জন্য কাল হয় ।
অন্যদিকে তখন যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তখন অস্ত্রের ছড়াছড়ি , তরুন সমাজ তখন অস্ত্রের শক্তি বুঝে গেছে , নয়মাসে দেশ স্বাধীন করায় তারাও আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান , এই তরুনদের সামনে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান নিয়ে এগিয়ে আসেন দাদাভাই সহ সাংগঠনিকভাবে দক্ষ অনেক তরুন নেতা । একদিকে সরকারের ব্যর্থতা অন্যদিকে বিপক্ষদলের স্লোগান , অস্ত্র,সাংগঠনিক ক্ষমতা এসব মিলিয়ে জাসদ দ্রুতই একটি উল্লেখযোগ্য শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়ে যায় ।

এই দুইয়ের সংঘাত থেকে বাচাঁর জন্যই বাকশালের জন্ম । তবে বাকশাল তৈরীতেও বাড়াবাড়ি ছিল , এ কারনেই কনসেপ্টটি জনপ্রিয় হতো বলে আমার মনে হয় না ।

দেখা যাক , জুবায়ের ভাই কী বলেন ।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

ধন্যবাদ , আরিফ ভাই।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

প্রেক্ষিত: বাকশাল বিষয়ে আনোয়ার সাদাত শিমুল ও আরিফ জেবতিকের মন্তব্য

আমার আগের একটি মন্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করা যায়: “কখনো গাড়ি ফেলে ঘোড়া চলে গেছে, আবার কখনো ঘোড়া ছাড়াই গাড়ি রওনা হয়ে গেছে।”

এখানে গাড়িকে বাংলাদেশ ও তার জনসাধারণ এবং ঘোড়াটিকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, অর্থাৎ চালিত করার শক্তি হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। ১৯৭২ সালে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, যা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দীর্ঘকালের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, চালু হলে গণমানুষ এক ধরনের মুক্তির আস্বাদ পায়। পাকিস্তানী সামরিক শাসনের জগদ্দল থেকে মুক্তির স্বাদ। সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যে আসলে কী বস্তু এই ভূখণ্ডের মানুষ পাকিস্তান আমলে তা কখনো পায়নি, পেলেও তা এতোই স্বল্পস্থায়ী ছিলো যে তা শুধু বয়স্কদের স্মৃতিতে আবছা ও অস্পষ্ট হয়ে আছে।

আশ্চর্য শোনালেও বলি, অনেকে লক্ষ্যই করেন না যে এই অভিজ্ঞতা তখন অধিকাংশের অজানা। সেই সময়ের তরুণতর প্রজন্ম গণতন্ত্র কেবল পাঠ্য বইয়ে পড়েছে, বাস্তবে দেখেনি। তারা জীবনে প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিক নির্বাচনে ভোট দিয়েছে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে। অপেক্ষাকৃত বয়স্করা শুধু স্মরণ করতে পারবেন, ৫৪-র যুক্তফ্রন্ট সরকারকে জোর করে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে শুরু করে ৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানে গণতন্ত্রের লেশমাত্র ছিলো না। আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী জিয়া-এরশাদের সামরিক থাবা লুকানো গণতন্ত্রের কোনো তফাৎ করা দুরূহ। বস্তুত আমাদের সামরিক শাসকরা তাঁদের পাকিস্তানী গুরুদের কাছ থেকে পাওয়া মডেলটি ব্যবহার করেছিলেন।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যাত্রা শুরুর কালে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে খানিকটা স্থবির দেখায়। সদ্যস্বাধীন দেশে যখন মানুষ যখন এগোতে চায়, সত্যিকারের পরিবর্তনের জন্যে সর্বস্ব পণ করতে ইচ্ছুক, শাসকরা পিছিয়ে পড়লেন। শাসকরা যে সদিচ্ছাগুলি কার্যকর করতে চান, বাস্তবে তা ঘটে ওঠে না, কোথায় যেন আটকে যায়। ফলে গাড়ি এগোতে চাইলেও ঘোড়া নড়ে না। অনেকগুলি কারণের মধ্যে একটি ছিলো বৃটিশ ও পাকিস্তানী মানসিকতার আমলাতন্ত্রের ওপর গভীর নির্ভরশীলতা। অপ্রিয় হলেও সত্য যে এই আমলা শ্রেণীর বেশিরভাগ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলো না। তাদের সরানোর কথা যে ওঠেনি তা নয়, কিছু কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিলো তা-ও ঠিক। তবু ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তি আমূল পরিবর্তনে সাহসী হয়নি। ১৯৭৩-এ আলজিয়ার্সে আন্তর্জাতিক জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাতে ফিডেল ক্যাস্ট্রো সতর্ক করে বলেছিলেন, পুরনো আমলাদের সরিয়ে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের সেখানে বসিয়ে দিন। অনভিজ্ঞতার কারণে হয়তো তারা অনেক ভুলভ্রান্তি করবে, কিন্তু দেশটাকে বিক্রি করে দেবে না। পুরনো আমলারা কিন্তু ঠিক সেই কাজটাই করবে, তাদের আনুগত্য বদল সহজ নয়।

শেখ মুজিব সম্ভবত মানেননি অথবা পরিবর্তনে সাহসী হননি বা হতে চাননি। তিনি মানুষকে বড়ো বেশি বিশ্বাস করতেন, তাদের শুভ দিকটাই দেখতে চাইতেন। আরিফ যেমন বলেছেন, এই মায়া-মমতার মূল্য তাঁকে দিতে হয়েছে। সত্যি বলতে কি, পুরো বাংলাদেশ তার মাশুল আজও দিয়ে যাচ্ছে, আরো বহুকাল হয়তো দেবে।

১৯৭৫-এর জানুয়ারিতে সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির শাসন ও ফেব্রুয়ারিতে বাকশাল প্রবর্তিত হলো যখন দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক ভারসাম্য, আইন-শৃঙ্খলা সবকিছু শাসকদের নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম। বাকশাল প্রবর্তন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সর্বশেষ মরীয়া চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু ঘোড়াটি যখন যাত্রা শুরু করে তখন গাড়ির সঙ্গে তার যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় রহিত হয়ে গেছে। তাজউদ্দিন আহমদ তখন শেখ মুজিবকে সতর্ক করে বলেছিলেন, এই ব্যবস্থার ফলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা বদলের পথ আর থাকবে না, স্বাভাবিক মৃত্যুও নয়। তাজউদ্দিনের অন্য অনেক বিজ্ঞ পরামর্শের মতো এটিও নিষ্ফল হয়।

বাকশাল ব্যবস্থাটি ভালো না মন্দ ছিলো তা বিচার করা এক অর্থে কঠিন। কারণ, এটি কখনোই সম্পূর্ণ বাস্তব হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু গোড়ায় যে পদক্ষেপগুলি নিয়ে এর যাত্রা, তার কিছু প্রত্যক্ষ প্রভাব মানুষের মধ্যে পড়ে। মোটা দাগে তার কতকগুলি উল্লেখ করা যাক।

১. ৭৪ সালে ডিসেম্বরের শেষে জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার ফলে জনসাধারণের বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতার মতো মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকারগুলি স্থগিত হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর তিনটি বছরে যতো সীমিত পরিমাণেই হোক, এই অধিকারগুলি বাংলাদেশের মানুষ ভোগ করেছিলো। সেই অভ্যস্ততা থেকে পিছু হটে আসা মানে তো সেই প্রাক-স্বাধীনতা পর্বে ফিরে যাওয়া।

২. সংসদীয় পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটিয়ে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকারের ধারণাও আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতি ও জন-আকাঙ্খার অনুরূপ ছিলো না। প্রস্তুতি ও ব্যাখ্যা ছাড়াই পদ্ধতি পরিবর্তনকে মানুষ জবরদস্তি করে চাপিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেনি।

৩. দুটি বাংলা এবং দুটি ইংরেজি পত্রিকা সরকারি নিয়ন্ত্রণে এনে বাকি সব দৈনিকের প্রকাশনা বাতিল করা হলে মানুষের উদ্বেগ অনেকটা আতংকে পরিণত হয়। যুক্তিসঙ্গতভাবেই এই ধারণা তখন বদ্ধমূল হয় যে, পত্রিকায় সরকারি ভাষ্য ছাড়া আর কোনোকিছু পাওয়া যাবে না। তিন বছরে কিন্তু এর বিপরীত অবস্থায় মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। জাসদের ‘গণকণ্ঠ’ বা ভাসানীর ‘হক কথা’ সত্যমিথ্যা মিলিয়ে যা-খুশি লেখালেখি করার প্রভূত স্বাধীনতা ভোগ করেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই স্বাধীনতাকে সুযোগের কু-ব্যবহার বলতেও কুণ্ঠিত নই। তবু নতুন ব্যবস্থাটি অপরপক্ষের মত প্রকাশের উপায় সম্পূর্ণ রুদ্ধ করে দেয়।

৪. বাকশালের কাফেলায় সামিল হওয়ার জন্যে এক অভূতপূর্ব ন্যক্কারজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়, যা কোনো বুদ্ধি-বিবেকসম্পন্ন মানুষের পক্ষে সহ্য করা মুশকিল। ‘বাবু যতো বলে পারিষদদলে বলে তার শতগুণ’ পঙক্তিটিকে সার্থক করে নেতাকর্মীরা দেখাতে চাইলেন কে কতো লোককে বাকশালের ছাতার তলায় আনতে পারেন, অনুগত করে তুলতে পারেন। ফলে জবরদস্তি ও বাড়াবাড়ি যে অনেক ঘটবে তা অনিবার্য ছিলো। জবরদস্তি ছাড়াও এক ধরনের মানুষ কোনো প্রত্যক্ষ কারণ ছাড়াই বাকশালে যোগ দেওয়ার জন্যে যেন ক্ষেপে ওঠে। হয়তো এক ধরনের প্রচারণাও এর পেছনে কাজ করেছে যে বাকশালে নাম না লেখালে বিপদ হতে পারে। অথচ খোদ আওয়ামী লীগসহ বামপন্থী দলগুলির অনেকেই প্রকাশ্যে ও প্রত্যক্ষভাবে বাকশালের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং তাতে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। কয়েকটি বিশিষ্ট নাম বলি: আওয়ামী লীগের দুই সাংসদ আতাউল গণি ওসমানী ও ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, বামপন্থীদের মধ্যে আহমদ শরীফ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বদরুদ্দীন উমর, আহমদ ছফা, নির্মল সেন। এমনকি আওয়ামীপন্থী বলে পরিচিত আবদুল গাফফার চৌধুরীও এর বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন। বাকশালে যোগ না দেওয়ার ফলে এঁদের মধ্যে কেউ কোনোরকমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন বলে জানি না।

ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে কিছুকালের জন্যে এই ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক বা জনসাধারণের সীমিত অধিকারের ব্যবস্থা মেনে নিতে কারো আপত্তি হতো না। আগেই বলেছি, ওই সময়ে দেশের জন্যে, একটি সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যে সর্বাত্মক ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলো সাত কোটি মানুষ। আর ছিলো সমাজতন্ত্রের আকাঙ্খা, যা নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে বলে। আরিফ যেমন বলেছেন, একটি জাতীয় সরকার গঠিত হতে পারতো তখন। তাহলে সবার সম্মতিক্রমেই এই ধরনের সীমাবদ্ধ স্বাধীনতার আচরণক্ষেত্র প্রস্তুত করা সম্ভব হতো।

স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবের প্রত্যাবর্তন কিছু বিলম্বিত হলে তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে এই ধরনের একটি ব্যবস্থা হয়তো অসম্ভব ছিলো না। সেই প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি, যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতা তাঁর ছিলো, তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। কিন্তু শেখ মুজিবের কারিশমা ও প্রভাব ছাড়া স্বাধীনতার মাত্র তিন মাসের মাথায় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়ে উঠতো না, এ কথা অতি বড়ো শত্রুকেও মানতে হবে। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবস্থান দীর্ঘ হলে কী হতে পারতো, তা ভাবতেও আমি ইচ্ছুক নই।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

বিস্তারিত আলোচনার জন্য জুবায়ের ভাই ও আরিফ ভাইকে অনেক ধন্যবাদ। ইতিহাস বিভ্রমের দু:সময়ে এরকম বিশ্লেষণ - প্রতিমন্তব্যে নি:শ্চয় সচল সুহৃদরা সমৃদ্ধ হবেন।

আরিফ জেবতিক এর ছবি

তৎকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতির ঘোরপ্যাচে আদৌ ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে বাংলাদেশের মাটিতে সৈন্য মোতায়েন করে রাখাটা সম্ভব হতো না বলেই আমার ধারনা । কারন ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে থাকলে ,সেটাকে আন্তর্জাতিক আগ্রাসন হিসেবে চিহ্নিত করে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে মার্কিন আর চীনা শক্তি মরিয়া চেষ্ঠা নিত , এতে করে বিশ্বে ভারত ও ইন্দিরা গান্ধীর ইমেজ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হতো ।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আপনার কথায় যুক্তি আছে। তবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও কিন্তু ভারতের বিপদগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট ছিলো আমেরিকা ও চিনের দিক থেকে। সে চেষ্টা খুব কম হয়নি। মনে রাখতে হবে, সোভিয়েত তখনো প্রবল পরাক্রমশালী এবং ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা বিষয়ে তাদের দীর্ঘমেয়াদী (বোধহয় ৫০ বছরের) চুক্তি বলবৎ ছিলো। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি সদ্য স্বাধীন দেশে নানা প্রকারের সাহায্য-সহযোগিতার অজুহাত (বিশেষ করে প্রতিবেশী এবং যুদ্ধে সহায়তাকারী) পাওয়া খুব কঠিন হতো বলেও মনে হয় না।

থাকগে, যা হয়নি তা নিয়ে হতে-পারতো গবেষণায় গিয়ে লাভ কি?

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।