৮
এই রিকশা, রোখকে!
১৯৭৫-এর অগাস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এক দুপুরে গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া এলাকায় অকস্মাৎ এই নির্দেশ শুনে যুবক কিয়ৎক্ষণের জন্যে বিচলিত হয়। ঢাকা শহরে উর্দূ ভাষায় আজ এই নির্দেশ কোথা থেকে আসে! মধ্যবয়সী রিকশাওয়ালা রিকশা থামিয়েছে। আরোহী যুবক তাকিয়ে দেখে, সামরিক পোশাকে এক সশস্ত্র সৈনিক সামনে দাঁড়ানো। মুহূর্তের জন্যে বিভ্রান্তি আসে, কোনো জাদুর শক্তিতে কি সময় পিছিয়ে গেলো! সে কি একাত্তরের পাকিস্তানী সেনাকবলিত ঢাকা শহরে এখন! ভুল ভাঙতে সময় লাগে না - পাকিস্তানী নয়, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর একজন এই সৈনিক! শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হয়েছেন কয়েকদিন আগে, উর্দিধারীরা রাষ্ট্রের মালিকানা নিয়ে বসেছে। বাংলাদেশ বেতার এরই মধ্যে রেডিও বাংলাদেশ, একদা যেমন রেডিও পাকিস্তান বলা হতো। জয় বাংলা তুলে দিয়ে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ চালু হয়ে গেছে। বাঙালি সৈনিকরাও এখন উর্দু বলতে শুরু করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকে না। উর্দির সঙ্গে উর্দুর সম্পর্ক অনেকদিনের, উর্দিধারীদের জন্যেই সম্রাট আকবরের আমলে উর্দু ভাষা তৈরি হয়েছিলো বলে জানা যায়।
তবু মাত্র কয়েক বছর আগে যুদ্ধের মাঠে থাকা যুবকের বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। ভাবে, এসব কী ঘটছে? বেড়ে ওঠার বয়সে সে দীর্ঘকাল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন প্রত্যক্ষ করেছে, ইয়াহিয়ার সৈনিকদের দেখেছে ধর্মরক্ষার নামে নিরীহ মানুষকে খুন করতে। একাত্তরের যুদ্ধ হয়েছিলো তো এসবেরই বিরুদ্ধে। তবু সামরিক শাসন এসে গেলো বাংলাদেশে। অস্বীকার করবে কে যে, শেখ মুজিব স্বাধীনতার সফল কারিগর হলেও শাসক হিসেবে ব্যর্থ হচ্ছিলেন ক্রমাগত, জনপ্রিয়তা ও সমর্থন দ্রুত হারাচ্ছিলেন! এরকম চললে তাঁকে সরে যেতেই হতো। প্রবল জনরোষের মুখে কবে কোন শাসক দীর্ঘদিন ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছে? একসময় তাদের বিদায় নিতেই হয়। কিন্তু রাতের অন্ধকারে সপরিবারে তাঁকে হত্যা করার কাপুরুষোচিত বর্বরতা মানা যায় কী করে?
শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত খোন্দকার মোশতাক সামরিক সরকারের প্রধান, মুজিব মন্ত্রিসভার বেশিরভাগই সামরিক সরকারের মন্ত্রী হিসেবে অধিষ্ঠিত তাঁর দাফন হওয়ারও আগে। তিনি নিহত হলেন, ঠিক পরদিন, স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছর পর, সৌদি আরবের সময় হয় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার, যেন তার আগে এই দেশটির অস্তিত্ব তারা জানতেও পারেনি। কাকতালীয় কি? আর এখন রাতারাতি বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানিয়ে ফেলা হচ্ছে বলে যুবকের ধারণা হয়। সবকিছুই এতো দ্রুত ও অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটে যাচ্ছে যে দুঃখিত বা বিস্মিত হওয়ারও সময় পাওয়া যাচ্ছে না।
রিকশাওয়ালা সৈনিকের সামনে রিকশা থামিয়ে নিজের সীটে বসে ছিলো। আরোহী যুবকের মতো তারও চোখে জিজ্ঞাসা, রাস্তার মাঝখানে থামতে বলা হলো কেন হঠাৎ? সৈনিকপুরুষ আচমকা তার পিতার বয়সী প্রৌঢ় রিকশাওয়ালার গালে সজোরে চড় বসিয়ে দেয়। রিকশাওয়ালা ঘুরে পড়ে যায় রাস্তায়। যুবক নিজের অজান্তে রিকশা থেকে নেমে এসে মুখোমুখি হয় সৈনিকের। চোখে চোখ ফেলে জিজ্ঞেস করে, অরে মারলেন ক্যান? কী দোষ করছিলো সে?
আপনে চুপ থাকেন তো মিয়া! নবাবের বাচ্চা রিকশা থামাইয়া সীটের উপরে বইসা থাকে!
বোঝা গেলো। প্রভুদের প্রতিনিধি সেপাইয়ের সামনে রিকশাওয়ালার সীটে বসে থাকাটা শক্ত ধরনের বেয়াদবি হয়েছিলো। যুবক এবার জিজ্ঞেস করে, কিন্তু থামতে বললেন ক্যান তা তো বুঝলাম না!
থামাইছি আপনের জন্যে। আপনের লম্বা চুলগুলি কাইটা ফেলতে হবে।
মানে?
ওঃ, আবার মানে জিগায়। আপনেরে তো বাংলায়ই বললাম, লম্বা চুলগুলি কাটতে হবে।
যুবক বোঝে, বিস্ময়ের আরো কিছু বাকি ছিলো। একাত্তরের পরে কিছুদিন কাঁধসমান লম্বা চুল রেখেছিলো সে, যতোদিন সশস্ত্র ছিলো। আনুষ্ঠানিক অস্ত্র সমর্পণের পরদিন চুলের দৈর্ঘ্য কমিয়ে ফেললেও মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল রাখে সে এখনো। একেবারে ছোটো ছোটো করে কদমছাঁট দেওয়া তার কোনোকালে পছন্দ ছিলো না। মুনিয়ার আগ্রহ ও উস্কানিতে কিছুদিন ধরে তাকে আবার কাঁধসমান লম্বা চুল রাখতে হচ্ছে। মুনিয়া বলে, লম্বা চুলে তোমাকে কী সুন্দর দেখায়!
নিজেকে সুন্দর লাগুক, কোন মানুষ তা না চায়? প্রেমিকার চোখে সুন্দর হওয়ার আলাদা মূল্য তো আছেই। কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা চুলগুলি তার ব্যক্তিত্বের অংশ, যেমন তার চোখ, মুখমণ্ডল, পোশাক, তার হাঁটাচলা এবং বাকভঙ্গি। এইসব মিলিয়ে সে অন্য সবার চেয়ে আলাদা একজন কেউ। সৈনিকদের সে সুযোগ অবশ্য নেই - কদমছাঁট চুল তাদের সবার, প্রত্যেককে একই ইউনিফর্ম ও বুট পরতে হয়, একই ছাঁচে তাদের হাঁটা বা ছোটা, বিশেষ ভঙ্গি ও স্বরে তাদের কথা বলা - সম্মিলিতভাবে তারা একটি একক ব্যক্তিত্বের ছবি। অন্যদের থেকে একটু আলাদা হতে গেলেই শৃঙ্খলাভঙ্গ, শাস্তির ভয়।
সামরিক শাসকরা ও তাদের বাধ্য-অনুগত সৈনিকরা ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতীকগুলোকে অনুমোদন দিতে প্রস্তুত নয়। প্রত্যেকটি মানুষকে এক ছাঁচে, নিজেদের সম্মিলিত একক ব্যত্তিত্বের সম্প্রসারণ হিসেবে দেখতে ইচ্ছুক তারা। ব্লাডি সিভিলিয়ানদের তারা নিচু জাতের প্রাণী, যেন মনুষ্যপদবাচ্য নয়, বলে মনে করে এবং তাদের ওপর কর্তৃত্ব করার সুযোগ হাতছাড়া করতে তারা অনীহ। তোমার চুল কতোটা লম্বা হতে পারবে তা-ও আমরা নির্দিষ্ট করে দেবো। তোমার ওপর আমাদের সর্বময় কর্তৃত্ব, আমরা তোমার আহার-বিহারসহ সবকিছুর মালিক। মনে থাকে যেন, তুমি আমাদের আজ্ঞাবহ মাত্র।
যুবক প্রতিবাদ জানানোর চেষ্টা করে, আমার চুলে কী দোষ করলো? আমি আমার নিজের মতন থাকি, কারো সাতে-পাঁচে নাই।
তীক্ষ্ণ স্বরে সৈনিক বলে, ওইসব কিছু বুঝি না, ওইদিকে গিয়া বাবরিডা কাইটা নিয়া তারপর যেখানে যাইতেছিলেন যান। বেশি প্যাচাল পাড়লে খবর আছে।
সৈনিকের নির্দেশ করা আঙুল অনুসরণ করে যুবক দেখতে পায়, রাস্তার পাশে একটি দেয়াল ঘেঁষে সারি দিয়ে অনেকগুলো উঁচু কাঠের টুল বসানো। প্রত্যেকটির ওপরে মাথা নিচু করা একেকজন মানুষ বসা এবং পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষৌরকাররা মানুষগুলোর চুল ছাঁটে একাগ্রমনে। টুলে বসা মানুষগুলোর মুখভঙ্গি এখান থেকে বোঝা যায় না, বুকের কাছে মাথা নামিয়ে রাখাও একটি কারণ বটে, কিন্তু যুবক জানে, বাধ্য হয়ে এইভাবে অন্যের কাছে নিজের মাথাটি জমা দেওয়ার অপমান তাদের সবার চোখেমুখে লেগে আছে।
শেষ চেষ্টা হিসেবে যুবক জানায়, সে একটি জরুরি কাজে যাচ্ছে, দেরিও হয়ে গেছে। তা সম্পন্ন করে চুল ছাঁটানোর কাজটি সে নিজেই সেরে নেবে।
আচমকা আরেক সৈনিকপুরুষ, একজন অফিসার, আবির্ভূত হয়। রাস্তার একপাশে অপেক্ষমাণ সাঁজোয়া গাড়ির ভেতরে সম্ভবত এতোক্ষণ বসে ছিলো। কর্কশ স্বরে সে জিজ্ঞাসা করে, প্রবলেমটা কি?
অধঃস্তন সৈনিকটি জানায় যে, বড়োই বেয়াড়া এই যুবক।
অফিসার শ্রেণীর সৈনিকপুরুষের মুখ থেকে একটিমাত্র শব্দ - তা স্বর্গনিসৃত কোনো শব্দ বলে ভ্রম হয় না - নির্গত হয়, বাঞ্চোৎ!
এই মোক্ষম শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে সে যুবকের মাথাভরা ঝাঁকড়া চুল মুঠো করে ধরে টেনে নিয়ে যায় রাস্তার পাশে। ধাক্কা দিয়ে তাকে পাঠিয়ে দেয় দেয়াল ঘেঁষে চুল ছাঁটানোর জায়গাটির দিকে। অপ্রস্তুত ছিলো যুবক এই চকিত আক্রমণের জন্যে, কোনোমতে রাস্তার ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়া থেকে সে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। কিন্তু অপমানবোধে চোখমুখ জ্বালা করে ওঠা থেকে নিজেকে কীভাবে রক্ষা করবে সে জানে না। তার কান-মাথা-মুখমণ্ডল উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, তা শুধুমাত্র এই সূর্যতপ্ত দুপুরের তীব্র উত্তাপের কারণে নয়। দুই চোখ তীব্র ঘৃণার আগুনে জ্বলতে থাকে, হাত নিশপিশ করে, কিছু একটা তাকে করতে হবে, কিন্তু কী করা যেতে পারে তা সে ভেবে স্থির করতে পারে না। রাষ্ট্রশক্তির সশস্ত্র প্রতিনিধির সামনে তার কিছুই করার ক্ষমতা নেই, এই বোধ তাকে আরো ক্রুদ্ধ করে। শিকারীর জালে আটকা পড়া বাঘের তবু গর্জন ও আস্ফালন করার ক্ষমতা থাকে, যুবকের তা-ও নেই। এই অসহায়ত্বের অনিবার্য অনুভব ক্রমশ বিস্তারলাভ করলে ক্রোধের সঙ্গে সঙ্গে নিরুপায় হতাশাবোধ তাকে আচ্ছন্ন করে দেয়।
মন্তব্য
১০-১১-১২ পড়লাম।
উর্দির শাসনে নিরুপায়, অসহায়।
____
অপ্রাসঙ্গিক: শ্যামদেশেও এখন উর্দির শাসন। এপ্রিল থেকে youtube ব্যান আছে সারা দেশে। ক'দিন আগে bloggers.com ব্যান করেছে কয়েকটা আইএসপি। কড়া শাসন চারিদিকে - - -
সব জলপাইয়ের এক চেহারা। আমার কথা ভাবলে দেখি, জীবনের অর্ধেকের বেশি কেটেছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সামরিক শাসনের মধ্যে। শিমুল গেলো পরবাসে, জলপাই পিছু ছাড়ে না!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
জুবায়ে ভাই,
আপনি দেশে এসেছিলেন শেষ কবে? এখন আমরা কেমন আছি ধারনা আছে?
আমারও ছিল লম্বা চুল। বাবরি হয়তো ছিলনা। মায়ের চিন্তিত মুখ আর বৌয়ের নিরব অনুরোধে আজ সেখানে... ওরা আমাকে রাস্তায় অপমানিত হতে দিতে চায়না জুবায়ের ভাই।
এইযে আপনি বিনা পয়সায় পড়তে দিচ্ছেন, এজন্য কৃতজ্ঞতা।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
নজমুল, দেশে না থাকলেও ধারণা কিছু আছে। আপনার অনুভব তো নিজেকে দিয়ে অনেকটাই বুঝি। আপনার মা এবং স্ত্রী আপনাকে অপদস্থ হতে দিতে চান না, আপনি নিজেও কি চান? মানতে ইচ্ছে করে না, বিদ্রোহ করতে ইচ্ছে করবে - কিন্তু বোধবুদ্ধিহীন দানবশক্তির বিরুদ্ধে আমরা অসহায়!
আমার ধারণা, এই পর্বে বিবৃত অনুভবটির প্রত্যক্ষ অংশীদার বাংলাদেশের অনেক মানুষ - অতীতের এবং বর্তমানের।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
জুবায়ের ভাই,
আমি এবারকার এক শিকার। কিযে ঝড় যাচ্ছে। আরিফ ভাই, মোরশেদ, মাশীদ শিমুলরা জানেন। চুপকথায় মন দিতে পারছিনা পুরোটা। আজ সকালে কমেন্ট করে কোর্টে গিয়েছিলাম। ফিরলাম এই একটু আগে।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
নজমুল, আগে 'ঝড়' সামলান। অসুবিধা বা আপত্তি না থাকলে অন্যসব ব্লগবান্ধবদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন ব্লগ আকারে।
চুপকথা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়। তার গুরুত্ব কিছুমাত্র থাকলেও তাকে অপেক্ষা করানো যায়।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
এই পর্ব থেকে আমি ডুবতে শুরু করেছি জুবায়ের ভাই ।
যুদ্ধ জয়ী ঐ তরুনের অপমান ও বিষাদ অনুভব করছি নিজের ভেতর । যেনো জলপাই দানো আমারই ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে-- শালা বাঞ্চোত!
-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
ভগবান তুমি যুগে যুগে জলপাই পাঠায়েছো বারে বারে দয়াহীন সংসারে।
কি মাঝি? ডরাইলা?
নতুন মন্তব্য করুন