৪. ‘ওরা যতো বেশি জানে ততো কম মানে’
সত্যজিৎ রায় ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবি বানানোর অনেক আগে থেকেই তৃতীয় বিশ্বের শাসকরা ‘ওরা যতো জানে ততো কম মানে' তত্ত্বটি সম্পর্কে ভালোরকম অবহিত। প্রয়োগের দক্ষতাও কম নয়। বৃটিশরা অবিভক্ত ভারতবর্ষে শিক্ষাদীক্ষার কিছু প্রসার ঘটিয়েছিলো, প্রধানত তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই। প্রশাসন চালানোর জন্যে ইংল্যান্ড থেকে জাহাজ বোঝাই করে মানুষ আমদানী করা সম্ভব ছিলো না। হলেও বিশেষত স্থানীয়দের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের জন্যে তা অর্থহীন। ফলে আধুনিক শিক্ষার ব্যবস্থা তাদের করতেই হয়। সেই সময়ের কিছু আলোকিত মানুষ সুযোগটির সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করলেন এবং অতঃপর বৃটিশদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার আওয়াজ তুললেন।
পাকিস্তান আমলে ৬২-তে শিক্ষার অধিকারের জন্যে আন্দোলন হয়েছিলো। কারণ, উচ্চশিক্ষার সুযোগ সীমিত রাখার জন্যে যতোরকমের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তার সবই করা হয়েছিলো। শিক্ষার অধিকার আদায়ের জন্যে আন্দোলন ছাড়া কোনো পথ ছিলো না। কিন্তু তার পরেও অবস্থা বিশেষ পাল্টায়নি। কমিশন-টমিশন গঠন করে কোনোমতে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিলো।
মাতৃজঠর থেকে কেউ বিজ্ঞানী, চিত্রকর, শিক্ষক বা কবি হয়ে জন্মায় না। প্রতিভা ও ক্ষমতা উৎসারিত ও বিকশিত হয় বহুস্তরের গঠন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এই প্রক্রিয়াগুলির একটি বড়ো উপাদান। বিশেষত সবার পক্ষে যখন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল বা লালন হওয়া সম্ভব নয়। এই মানুষগুলিকে অবশ্যই ব্যতিক্রম বিবেচনা করতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও বিকাশের জন্যে সুস্থ শিক্ষাব্যবস্থা একটি জরুরি উপাদান। অথচ আমাদের দেশে কখনো এই দিকটি যথেষ্ট মনোযোগ পায়নি। হীরক রাজার তত্ত্ব আজও খুব বেশি জীবন্ত ও কার্যকর।
পাকিস্তান আমলের গোড়ার দিকে শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান দুটি ধারা ছিলো – সাধারণ শিক্ষাক্রম ও মাদ্রাসা ব্যবস্থা। উচ্চতর শিক্ষায় ইংরেজির প্রাধান্য। ষাটের দশকে প্রধানত ঢাকা শহরকেন্দ্রিক বাঙালি ক্রমে বিত্তের স্বাদ পেতে শুরু করে। প্রাজ্ঞ সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী যেমন বলেছিলেন, তখন বাঙালি ধানক্ষেত থেকে সরাসরি ধানমণ্ডিতে উঠে এসেছে।
জাতে ওঠার জন্যে তখন প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকে তারা যখেষ্ট সম্মানজনক বিবেচনা করেনি। এই শ্রেণীর চাহিদা অনুযায়ী ইংরেজি মাধ্যম বলে একটি নতুন ব্যবস্থা স্কুল পর্যায়ে চালু হয়। কিন্ডার গার্টেন-এর সঙ্গে আমরা পরিচিত হতে শুরু করলাম। যতোদূর মনে পড়ে, ষাটের দশকের শেষদিকে আমাদের ছোটো শহর বগুড়ায়ও একটি কিন্ডার গার্টেন হয়েছিলো।
এগুলির বাইরে ছিলো ক্যাডেট কলেজের শিক্ষা, যেখানে সাধারণের প্রবেশাধিকার সীমিত অথবা রুদ্ধ। শিক্ষার ক্ষেত্রে এলিট তৈরির কারখানা হিসেবে ক্যাডেট কলেজের ধারণার জন্ম, ঠিক যেভাবে মাদ্রাসা শিক্ষা যুগের অনুপযোগী শিক্ষার্থীদের আস্তানা। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় অজ্ঞ ও সংস্কৃতি বিষয়ে উন্নাসিক এক প্রজন্ম তৈরি করছিলো। আজও করছে।
কিন্তু যেটিকে মূলধারা বলছি, যা সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থীদের কাছে লভ্য একমাত্র অবলম্বন, সে ব্যবস্থাও বরাবর রুগ্ণ ও ভঙ্গুর। পড়ো-পড়ো অবস্থায় কোনোমতে টিকে আছে। মোটা দাগে বলা যায়, পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে স্কুল-কলেজ পর্যায় পর্যন্ত এই শিক্ষা মূলত শিক্ষার্থীর মুখস্থ করার ক্ষমতা, নোটবই ও টিউটোরিয়াল নির্ভর। আমাদের স্কুলে পড়ার কালে ছাত্রবন্ধু বা ছাত্রসখা নামের ঢাউস সহায়িকা (আসলে নোটবই) বহুল প্রচলিত ছিলো। টিউটোরিয়াল তখনো বাণিজ্য আকারে বিকশিত হয়নি।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রথম ব্যাচ আমরা। যুদ্ধকালে পড়াশোনা কিছু হয়নি, ক্লাস হয়নি, বইপত্রের সরবরাহ যথেষ্ট নেই। সুতরাং পরীক্ষা হবে সংক্ষিপ্ত পাঠক্রমের ভিত্তিতে সংক্ষিপ্ত আকারে, ১০০-র বদলে ৫০ নম্বরের পরীক্ষা। হয়তো সেশনজট ঠেকানোর জন্যে এই ব্যবস্থা করা হয়েছিলো, কিন্তু তা যে সফল হয়নি বোঝা গিয়েছিলো পরবর্তী অনেক বছর ধরে। পরীক্ষা দিতে গিয়ে এক অভূতপূর্ব ঘটনা দেখা গেলো। পরীক্ষার্থীরা বইখাতাসহ হাজির। বই খুলে প্রশ্নপত্রের উত্তর লেখা হচ্ছে। আপত্তি করার কেউ নেই, কারো কোমরে ধাতব কোনো মারণাস্ত্র আছে কি না কে বলবে! পরীক্ষার হলে আদর্শবান পরিদর্শক আপত্তি করতে গিয়ে অপদস্থ হলেন, এমন ঘটনাও খুব দুর্লভ ছিলো না। ক্রমশ পিতৃদত্ত প্রাণ এবং অর্জিত মান-সম্মানের স্বার্থে তাঁরাও চুপ করে থাকতে শিখে গেলেন।
ঠিক এই পর্যায়ে না হলেও অনেককাল ধরে পরীক্ষার হলে গণহারে টোকাটুকি অব্যাহত ছিলো। শহর এলাকায় কিছু কড়াকড়ি হলেও গ্রামে-গঞ্জে প্রতিষ্ঠিত নতুন নতুন প্রাইভেট কলেজগুলি শুধুমাত্র পরীক্ষার্থী বাণিজ্য করে অবাধ টোকাটুকির ব্যবস্থা করে দেয়। শহরের শিক্ষার্থীরা তখন পরীক্ষার মৌসুমে গ্রামের কলেজের পরীক্ষার্থী হয় যায়! একজন বয়স্ক শিক্ষককে তিক্তকণ্ঠে ঠাট্টা করে বলতে শুনেছিলাম, আমার বুড়ি মাকে পরীক্ষায় বসিয়ে দিলে এখন ডিগ্রীধারী মায়ের পুত্র হওয়া যেতো!
মুক্তিযুদ্ধ না করেও বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত হওয়া যেমন সম্ভব হয়েছিলো, কোনোরকম মেধা ও পরিশ্রমের বিনিয়োগ ছাড়াই কারো কারো পক্ষে বিত্তের মালিক হওয়া যেমন কঠিন হয়নি, একইভাবে বিদ্যাশিক্ষার সঙ্গে কিছুমাত্র সংশ্রব ছাড়াই যথাকালে ডিগ্রী সংগ্রহ করাও সুলভ হয়ে গেলো। দুঃখজনক হলেও স্বীকার করতে হবে যে, একটি প্রজন্মের বিপুলসংখ্যক প্রতিনিধি শুধুমাত্র নোটবই পড়ে অথবা অনুপার্জিত ডিগ্রীর মালিক হয়ে নিজেদের শিক্ষিত বলে আত্মপ্রবঞ্চনা করে গেছে।
সঠিক তথ্য হাতের কাছে নেই, কিন্তু ৭২-এ দেশে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা শতকরা ১৫-র বেশি ছিলো বলে মনে হয় না। আজ তা অনেক বেড়েছে, কিন্তু গুণগতভাবে কতোটা?
বিদ্যাচর্চায় শিক্ষার্থীদের বিপরীতে অপর পক্ষটি হলেন শিক্ষক সম্প্রদায়। ছোটোবেলায় একটা কথা শুনেছিলাম – যার নাই কোনো গতি, সে-ই করে পণ্ডিতি। পূর্ণসত্য না হলেও এতে কিছু সত্য যে আছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে সর্বোচ্চ মেধার মানুষ স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শিক্ষকতার পেশায় আসেন না প্রধানত আর্থিক বিবেচনায়, এ কথা পৃথিবীর সব দেশেই কমবেশি সত্যি। বাংলাদেশে তার ব্যতিক্রম হওয়ার কোনো কারণ নেই, বিশেষত দারিদ্র্য ও অনটন যেখানে শিক্ষকদের ললাটলিখন, নিরীহ-নির্বিরোধ শিক্ষকরা যেখানে রাষ্ট্রের বা তার চালকদের মনোযোগ সবচেয়ে কম পেয়ে থাকেন।
অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষকরা শুধুমাত্র সম্মানজনক পেশার নামে এবং শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সালাম-সমীহ পাবেন বলে অভাবের সঙ্গে ক্রমাগত লড়াই করে যাবেন এমন আশা না করাই সঙ্গত। বস্তুত হয়েছেও তাই। বিপুলসংখ্যক শিক্ষক তাঁদের ন্যায়নীতিবোধ ও শিক্ষকোচিত আদর্শবাদ একপাশে সরিয়ে রেখে টিউটোরিয়াল বাণিজ্যের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছেন, অথবা অন্য কোনো বাড়তি উপার্জনের পথ খুঁজে নিয়েছেন। স্কুল-কলেজে নিয়মিত শিক্ষকতায় সময় তাঁরা খুব কমই দিয়ে থাকেন।
স্কুল-কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা উঠতি প্রজন্মের মানসিক গঠনের প্রকৃত ভিত্তি তৈরি করে দেয়, যার ওপরে পরবর্তীকালের উচ্চতর শিক্ষার মিনার যুক্ত হলে ইমারতের গঠনটি সম্পূর্ণতা পায়। কিন্তু আমাদের গোড়াতেই গলদ থেকে যাচ্ছে বলে ইপ্সিত উচ্চতা স্পর্শ করার আশাও অচরিতার্থ থেকে যাবে, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার ছবিও খুব আলাদা, তা বলা মুশকিল। তবু আমার ধারণা, নিচের স্তরগুলির সঙ্গে এখানে কিছু পার্থক্য আছে যা প্রধানত সাম্প্রতিককালের অর্জন। আমাদের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ছিলো বিশৃঙ্খলা ও অনিত্যতায় ভরা। তবু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আমার মনে হয় এর শিক্ষক সম্প্রদায়। সর্বোচ্চ মেধাবীদের একটি অংশ সচরাচর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে আসেন। সেটি আগে যেমন সত্য ছিলো, এখনো আছে। তবে শিক্ষার্থী নির্বাচনে আগের তুলনায় এখন মেধা ও যোগ্যতার যাচাই অনেক ভালো হয়েছে বলে অনুমান করি।
কিন্তু তারপরেও নৈরাশ্যের কথা আসে। সত্যকে স্বীকার করলে বলতে হবে, পরীক্ষার ফলের বিচারে মেধাবী হলেও এই শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ মননের বিচারে প্রকৃত অর্থে অ-সংস্কৃত। আমাদের কালেও তা সমান সত্য ছিলো। সম্পূর্ণ দোষ তাদের নয়, ত্রুটি থেকে গেছে তাদের গঠনপ্রক্রিয়ায় যার আয়োজন ও সরবরাহ তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিলো না। এ কথাও তো জানা যে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, প্রকৃত শিক্ষা ও মনন তৈরির শুরু হয় পরিবার থেকে। সামগ্রিকভাবে যে দেশে মননচর্চাকে খুব উঁচুভাবে দেখা হয় না বা উপেক্ষিত হয়, যেখানে প্রতিদিনের জীবন এতো কঠিন যে মননশীলতা ও বৃদ্ধিবৃত্তি কোনঠাসা হয়ে পড়বে তা-ও বিচিত্র নয়।
অথচ এই নৈরাজ্য, হতাশা ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে থেকেও অনেক অসাধারণ প্রতিভাবান বাঙালি আলো ছড়িয়ে উদিত হচ্ছেন। দেশে-বিদেশে তাঁরা বিজ্ঞানে, গবেষণায়, উদ্ভাবনে ও আরো বিবিধ মননচর্চায় নক্ষত্রের মতো ফুটে উঠছেন, তা বড়ো কম সাফল্য নয়। তা-ও হয়তো সম্ভব হয়েছে দেশের কিছু কৃতি শিক্ষকের অবদান ও চেষ্টায়। এতো প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁরা নিজের কাজটি করে গেছেন। নাহলে আমরা কোথায় কোন অন্ধকারে তলিয়ে যেতাম, কে জানে!
আমাদের শাসকরা, নেতা-নেত্রীরা দেশের উন্নয়নের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। অথচ শিক্ষাব্যবস্থার দিকে নজর নেই। যেন উন্নয়নে বিদ্যাশিক্ষা কোনো কাজে লাগে না। এমন ধারণা হওয়া মোটেই অমূলক নয় যে, আমাদের শাসকরা শিক্ষার বিস্তার বা বাংলাদেশের কল্যাণ আদৌ কামনা করেন না। যা বলেন তা কেবলই মুখের বুলি। তাঁদের ভেতরের অজ্ঞানতাই কেবল ছড়াতে চান। বছর দুয়েক আগের একটি ঘটনা মনে পড়লো। প্রাথমিক শিক্ষকরা তাঁদের দাবিদাওয়া সরকারকে মানাতে না পেরে অনশন ধর্মঘটে গেছেন। তাঁরা বললেন, নির্বাচনের আগেই এই দাবিদাওয়া বিষয়ে ক্ষমতাসীন দল অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলো। কয়েকদিন কেটে গেলেও অনশন বিষয়ে সরকারি তরফের কোনো তৎপরতা নেই, কোনো মন্তব্যও নয়। শেষমেষ প্রধানমন্ত্রী জানালেন, অর্থাভাব হেতু শিক্ষকদের দাবি মানা সম্ভব নয়। এই সংবাদটি যেদিন কাগজে এলো, সেদিনই আরেকটি খবরে দেখা গেলো, সামরিক বাহিনীর জন্যে একশো কোটি টাকা ব্যয় করে কয়েকটি হেলিকপ্টার কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষকরা ঠিক এই আচরণই পেয়ে এসেছেন বরাবর।
৩৬-বছর বয়সী দেশে আজ পর্যন্ত একটি সুস্থ ও গ্রহণযোগ্য শিক্ষানীতি তৈরি হলো না। অনুৎপাদনশীল ও অকেজো মাদ্রাসা শিক্ষাকে অকারণে উৎসাহিত করা হয় আজও। যত্রতত্র অনুমোদনহীন ও নামসর্বস্ব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গজিয়ে উঠতে দেওয়া হয়েছে। টিউটোরিয়াল বাণিজ্যের অবাধ প্রসারের বিষয়ে কোনো মাথাব্যথা কারো আছে বলে মনে হয় না। টিউটোরিয়ালের সুবাদে দেশে শিক্ষার্থীদের তোতা-পাখি বানিয়ে ফেলা হচ্ছে যা তাদের কোথায় নিয়ে যাবে কেউ জানে না।
অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের জন্যে আমার মাঝে মাঝে খুব মায়া হয়। একজন মেধাবী শিক্ষক হিসেবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেন তিনি, যৌক্তিক পরামর্শ দেন। কিন্তু হায়, সে কেবলই অরণ্যে রোদন। শোনার কেউ নেই।
(চলবে)
আগের পর্বগুলি:
আমাদের বাতিঘরগুলি ও আসন্ন দিন – ০১
আমাদের বাতিঘরগুলি ও আসন্ন দিন – ০২
আমাদের বাতিঘরগুলি ও আসন্ন দিন – ০৩
মন্তব্য
মাথা-ভরা হরেক রকম কথা/প্রশ্ন। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলবো বুঝছি না। সিরিজটা বাংলাদেশের ইতিহাসের মধ্যপর্বকে খুব ভাল মত তুলে ধরছে। শিক্ষানীতি নিয়ে আমার নিজের কিছু কথা/চিন্তা আছে, তবে সাহসে কুলায় না বলতে। চ্যাঙড়ার মুখে ভাঙড়ার চেয়ে বেশি কিছু বেমানান!
সবগুলিই বলবেন, তাহলে আমরাও জানলাম আপনি কী ভাবছেন। সাহসে না কুলানোর কী আছে তা বুঝলাম না। এখানে আমরা কেউ পরীক্ষার্থী তো নই, মাস্টারও নেই। বলে ফেললে আমরা সবাই তা নিয়ে কথা বলতে পারি। ঝাঁপি খুলে দিন।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
ইশতিয়াক রউফ-এর সাথে একমত।
---------------------------------
চোখের পাতায় হাত রেখে ওরা আমাকে স্বপ্ন দেখার যন্ত্রণা দেয়।
ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
অসংখ্য বিষয় নিয়ে সু-চিন্তিত আলোচনা। বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত কিছু কথা...
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নতুন এক রুজির পথ বের হয়েছে। তা হলো পার্ট-টাইম শিক্ষকতা। গলির আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংকটের কারণেই এই পথের উদ্ভব।
এখন কথা হলো, তাতে অসুবিধা কোথায়? একজন শিক্ষক একাধিক জায়গায় ক্লাস নিতেই পারেন। ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি এর ফলে শিক্ষকরা কমার্সিয়াল হয়ে যাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একজন শিক্ষকের দায়িত্ব শুধু পড়ানো নয়। তার উচিত ছাত্রদের সাথে মিলে বিভিন্ন গবেষণা মূলক কাজে সময় দেওয়া। পড়ালেখায় আগ্রহ সৃষ্টি করা। ছোট ছোট কাজ দিয়েই তা শুরু করা যেতে পারে। তাতে করে একদিন ছাত্রদের নিজেদের কিছু করার আগ্রহ জাগবে। মুখস্থ করে ভাল ফলাফল করা ছাত্রের সংখ্যা কিছুটা হলেও কমবে । কিন্তু বর্তমানের শিক্ষকের একই সাথে বেশ কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস চালাতে হয়। কাজের সুবিধার জন্য তারা বেছে নেন স্লাইড সিস্টেম। ক্লাসে যাও, প্রজেক্টরে স্লাইড দেখাও। ৫০ মিনিট পর বের হয়ে আস। নিজের বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় হলে সেমিস্টার শেষে ছাত্রদের ভাল গ্রেড দিয়ে আস। ভাল গ্রেড না দিলে কর্তৃপক্ষ পরেরবার তাকে মনোনীত নাও করতে পারে। এতে করে শিক্ষক হিসেবে তার দায়িত্ব কতোটুকু পালন হচ্ছে। শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। এক্ষেত্রে তিনি মানুষ এর পরিবর্তে তৈরি করছেন ভাল ফলাফল করা অসংখ্য অসংখ্য তোত যারা স্লাইডের বাইরে কোনদিন কিছু পড়েনি।
এই দোষ অবশ্য ঢালাও ভাবে শিক্ষকদের দেয়া ঠিক হবেনা। দোষ আমাদের সিস্টেমের। যাকে অতি দ্রুত পরিবর্তন করা আবশ্যক।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার একটা দিকে আলো ফেলার জন্যে ধন্যবাদ। পদ্ধতির পরিবর্তন অবশ্যই দরকার। তার অংশ হিসেবেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে কিছু নীতিমালা তৈরি হওয়া উচিত।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট মনে হয় এটাকে ,,, কেন আমরা পারছিনা? ,,,, সবগুলোর উত্তর আছে এখানে ,,,, শিক্ষাব্যবস্থা ,,,, এবং এটা এ্যালার্মিং!!! খুব দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া দরকার, কিন্তু কে নেবে ,,,,
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
এই অবস্থা চিরকাল থাকবে না, এই কথাটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। কীভাবে কবে জানি না, তবে এ দিন পাল্টাবেই।
ধন্যবাদ আপনার পাঠ ও মন্তব্যের জন্যে।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
- আচ্ছা, একটা উন্নয়নশীল দেশে বাজেট করার সময় সর্বোচ্চ ব্যয়খাত কোনটা হওয়ার কথা? শিক্ষা নাকি অন্য কোনো খাত!
সুসজ্জিত সামরিক বাহিনী দিয়ে কী হবে যদিনা দেশের নাগরিকেরা ক-অক্ষরজ্ঞান শূন্য রয়ে যায়! কিংবা ক'র পাছায় একটা 'র' কোনো মতে বাসাতে পারলেও তার সঠিক ভাবোদ্ধারে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়!
সামরিক বাহিনীতেও যে আহামরি খুব উন্নতি হয়েছে এমনও নয়। খাউদা মাউদা করে কোনমতে গোঁজামিল দেওয়া হচ্ছে সবকিছুতেই। আমাদের নৌবাহিনীর প্রথম সারির যে জাহাজ আলী হায়দার, শুনেছি সেটাও নাকি হস্তচালিত যেখানে পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের সবচাইতে নিচের সারির জাহাজটিও স্বয়ংক্রিয়।
কী লাভ এমন না ঘরকা না ঘাটকা পদানুসরণ করে!
ছোটবেলায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দিয়ে রিক্সা করে যাওয়ার সময় দেয়াল লিখন গুলো মনে পড়ে ছাত্র ইউনিয়ন দ্বারা। গনতন্ত্র এসে যদি সামরিকভাবে সুসজ্জার নাম করে নিজেদের পকেট ভরে রাজনীতিবিদরা তাহলে আর কলোনিয়াল শাসনের সাথে আমাদের পার্থক্য রইলো কোথায়?
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
এর সরল উত্তর হলো, এটা নির্ভর করে কোন দেশের কথা বলা হচ্ছে। আমাদের পাশের বাড়ি ভারতও উন্নয়নশীল দেশ। তাদের বাজেট জলপাই রাক্ষসরা খেয়ে ফেলে না। কারণ, সে দেশে জলপাইরা রাজনৈতিক শক্তির ঘাড়ে উঠে বসার সুযোগ কোনোকালে পায়নি।
স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিব নিহত হওয়ার আগে পর্যন্ত কিন্তু সেনাবাহিনী রাজনৈতিক শক্তির মাথায় উঠে বসার অবস্থায় যেতে পারেনি। এমনকি, বাকশাল গঠিত হলে সেখানে নাম লেখানোর জন্যে জিয়াউর রহমানসহ সেনাবাহিনীর সব কুতুবকেই ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে। শেখ মুজিব সেনাবাহিনীকে কম গুরুত্ব দিয়েছিলেন বলে একটা প্রচারণা আছে। প্রকৃত সত্য হলো, তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে সীমান্তের তিনদিকে ভারত-পরিবেষ্টিত হয়ে ভারতের সামরিক শক্তির সমকক্ষ হয়ে ওঠার চেষ্টা অর্থহীন। তবে তিনি সেনাবাহিনী বিলুপ্তির কথা কথা কখনো ভেবেছিলেন, এমন তধ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় না। অবশ্য রক্ষীবাহিনী তৈরি করে এবং ভারতে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে সেনাবাহিনীর যৌক্তিক সন্দেহ ও অসন্তোষের কারণ তিনি ঘটিয়েছিলেন, তা-ও স্বীকার করে নেওয়া দরকার।
আমার পিতার এক বন্ধু খাঁটি বগুড়ার ভাষায় রসিকতা করে বলতেন, "হামাকেরে আর্মি দিয়া কী হবি? যুদ্ধ লাগবাও লয়, লাগলে পারবারও লয়...।" অর্থাৎ ভারত ছাড়া আর কার সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হবে? সে যুদ্ধ বাধলে জেতার কোনো সম্ভাবনাও নেই।
সেনাবাহিনী আমাদের অবশ্যই থাকতে হবে। কিন্তু তা থাকবে রাজনৈতিক সরকারের অধীনস্থ, পৃথিবীর সব সভ্য দেশে যেমন থাকে। কিন্তু সেনায়নের পেছনে অর্থহীন অর্থায়নের কোনো প্রয়োজনও নেই। আমাদের দেশে এই সামরিক উত্থানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অসৎ রাজনীতিকদের সীমাহীন লোভ। কী দুর্ভাগা আমরা!
আমার এই পোস্টে একশো কোটি টাকায় সামরিক হেলিকপটার কেনার একটি ঘটনা কথা উল্লেখ করেছি। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এই কয়েকটি হেলিকপটার আমাদের বাড়তি কী নিরাপত্তা দেবে? বরং শিক্ষক অসন্তোষের কালে সেই টাকা অনায়াসেই তাঁদের দাবির কিছু পূরণ করে দেওয়া যেতো। বাজেট বরাদ্দ ইত্যাদি অনেক কথা উঠতে পারে, কিন্তু অভাবের সংসারে এক খাতের টাকা অন্য খাতে খরচ করা দোষের কিছু নয়। এমন উদাহরণ যে আমাদের দেশেই ভুরি ভুরি আছে।
৭৫-এর পর যে সেনায়নের কাল এলো, সেই দুর্ভাগ্য আজও আমাদের সঙ্গী। এর থেকে উত্তরণ কবে কীভাবে ঘটা সম্ভব হবে, কে জানে!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
আরো দুটি বিষয় মনে পড়লো। তথ্য হিসেবে এখানে উল্লেখ করে রাখি।
১. আমাদের দেশের একজন অবসরপ্রাপ্ত সমরবিশারদ একবার বলেছিলেন, বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সকল সমর-প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণের মূল উদ্দেশ্য সম্ভাব্য ভারতীয় আক্রমণের মুখে কোনোমতে চব্বিশ ঘণ্টা টিকে থাকা।
ঠিক জানা নেই চব্বিশ ঘণ্টা পরের পরিকল্পনা কী। তারপর কী হবে যদি আমরা আক্রান্ত হই?
২. আজকাল জলপাই বললে আমরা সামরিক বাহিনীকে বুঝি তাদের জলপাই রঙের চক্রাবক্রা পোশাকের কারণে। প্রকৃতপক্ষে জলপাই রঙের পোশাক (চক্রাবক্রা নয়, বিশুদ্ধ একরঙা) এদেশে প্রথম পরানো হয়েছিলো রক্ষী বাহিনীকে। তখনো সামরিক বাহিনীর পোশাক ছিলো খাকি রঙের। যতোদূর মনে পড়ে, জিয়ার আমলের শেষদিকে অথবা এরশাদের কালে খাকির বদলে এখনকার পোশাক সামরিক বাহিনীর গায়ে ওঠে।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
- হেড টু টো, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা আপাদমস্তক অথর্ব। হয় লোভী ধান্দাবাজ নাহয় মস্তিষ্কে গোবরভর্তি একেকটা অকালকুষ্মান্ড। যদি নাই হবে তাহলে কৃষক বাপের সন্তান হয়ে, কষ্টে-সৃষ্টে পড়াশুনা করে প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আসনে আসীত হয়েও কেনো বুঝতে পারেনা কোথায় দেশের টাকা যাওয়া উচিত, কেনো যাওয়া উচিৎ!
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
নতুন মন্তব্য করুন