উপন্যাস : যদি সে ভালো না বাসে – পর্ব ০৩

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি
লিখেছেন মুহম্মদ জুবায়ের (তারিখ: রবি, ০৬/০৪/২০০৮ - ৯:৪৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.৩ নিশি

ঘড়িতে সাতটা চল্লিশ। কাঁঠালবাগান থেকে মগবাজার - মাত্র কয়েক মাইলের ব্যবধান, অথচ ইরফানের পৃথিবী কতো আলাদা। তার হয়তো এখন মাঝরাত, রাতভর কমপিউটারে বসে থাকে, রাশি রাশি ইমেল, আইএম চ্যাট। পারেও। আর আছে তার সঙ্গীত রচনা। দেশের বাইরে কোথা থেকে একটা ইলেকট্রনিক কীবোর্ড আনিয়েছে, সেটা কমপিউটারে জুড়ে দিয়ে কম্পোজ করে। এই দুই যন্ত্র মিলে গীটার, ড্রাম, সিনথেসাইজার এইসব শব্দ প্রস্তুত করে, সঙ্গীতকারের কাজ সেগুলিকে সুসংবদ্ধ করে ছাঁচে ফেলা, সুর তৈরি করা। এইসব কারিগরি সে প্রচুর উৎসাহ নিয়ে সবিস্তারে বোঝানোর চেষ্টা করে। সব আমার মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়, ধরতে পারি না। নিজের কয়েকটা কম্পোজিশন বন্ধুবান্ধব সবাইকে একদিন শুনিয়েছিলো। তার ঝিং-চাক যন্ত্রসঙ্গীত মন্দ লাগে না শুনতে।

তার মানে বান্দা রাতভর ঘুমায়নি। পাঁঠা একটা। ইরফান নাম বলে মেহরীন হঠাৎ তাকে ইরফান পাঠান ডাকতে শুরু করে। একদিন সাব্বির তাকে পাঠান থেকে পাঁঠায় রূপান্তরিত করে দেয়। অবিলম্বে তা গৃহীত ও প্রচলিত হয়ে গেলো সর্বসম্মতিক্রমে। ইরফান এইসব একদম গায়ে মাখে না। পাঠান বললে বলবি, পাঁঠা বললেও আপত্তি নেই, ইরফান তবু ইরফানই থেকে যাবে – এই তার ঘোষণা। এইরকম প্রবল আত্মবিশ্বাস তার। হওয়ার কথা অবশ্য। এতোসব নিয়ে যে দিনমান কাটায়, পড়াশোনা সে করে কখন? সুযোগ পেলে ক্লাসও ফাঁকি মারে। অথচ পরীক্ষায় বরাবর সবাইকে ছাড়িয়ে যায়।

আমার হঠাৎ রাগ হয়। এঃ, কে আমার এসে গেলেন, কোথাকার গোঁসাই। বললেন এক্ষুণি ফোন করবি। আমি তোর হুকুমে চলি? আমাকে এখন হাতমুখ ধুয়ে খাওয়ার টেবিলে যেতে হবে। বাবা বসে থাকবে, মা তাড়া লাগাবে। কাজের লোকের অভাব আজকাল, মা একহাতে সব করে। আলাদা আলাদা সময়ে খেতে বসার নিয়ম এই বাসায় নেই। নাশতা সেরে তখন ইচ্ছে হলে ফোন করবো। ততোক্ষণ তুই বসে থাকবি, ঠিক আছে?

দাঁত ব্রাশ করে চোখেমুখে পানি দিতে দিতে বুঝি, আমি আসলে অতোটা শক্ত নই। যা করবো ভাবি, তা আঁকড়ে থেকে পালন করা হয়ে ওঠে না আমার। মাঝপথে এসে আগের সিদ্ধান্ত ভুলে যাই, পাল্টে ফেলি। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ফোন তুলে নিই। মা ডাকাডাকি করলে তখন দেখা যাবে।

একবার রিং হতেই ইরফানের গলা, মহারানীর ঘুম ভাঙলো?

মহারানী হলাম আবার কবে থেকে? এতোদিন তো ঘুঁটেকুড়ানি পেত্নী বলেছিস।

বলতে হয় তাই বলা। আমার কথায় তুই পেত্নীও হবি না, মহারানীও না। মেসেজ পেয়েছিলি?

না হলে তোকে এই সাতসকালে ফোন করতে যাবো কোন দুঃখে? তুই না মাঝে মঝে সত্যিই পাঁঠা হয়ে যাস।

হাঃ হাঃ করে গলা খুলে হাসে, পাঁঠার হাসিটা দরাজ। বলে, তোর মুখে পাঁঠা শুনলে আমার সবচেয়ে বেশি মজা লাগে।

আবার প্রমাণ দিলি। আমি কী এমন আলাদা? আর সবার মতোই তো বলি।

কী জানি, অন্যরকম শোনায়।

বুঝলাম। এখন বল, কেন ফোন করতে বলেছিস? সারারাত জেগে কী উদ্ধার করলি?

প্লুটোর সর্বনাশ হয়ে গেছে।

কার সর্বনাশ হয়েছে বললি?

প্লুটোর। সৌরজগতের সেই সবচেয়ে ছোটো গ্রহটা।

তো তার কী হয়েছে?

তার জাত গেছে। এতোদিন সবাই জানে প্লুটো ন'টা গ্রহের একটা। এখন ইউরোপের বিজ্ঞানীরা বলছে, প্লুটো আসলে গ্রহ নয়। এদিকে আমেরিকার নাসা বলছে, তারা সেটা মানে না, প্লুটো এখনো গ্রহ।

আমার মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা, হাত থেকে ফোন পড়ে যায় আর কি। ইরফান একটু ছিটগ্রস্ত, আমরা সবাই জানি। এখন দেখছি সত্যি পাগল হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, তুই কি পাঁঠা থেকে পাগল হলি? সেটা প্রমোশন, না ডিমোশন?

মনে মনে ভাবা, বলা হয় না। বললেও তার কানে উঠতো, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এক নাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে, যেন ঘোরগ্রস্ত। এইরকমই সে, যে বিষয়ে উৎসাহ তার শেষ দেখা চাই।

ইরফান বলে, ১৯৩০ সাল থেকে প্লুটো গ্রহ হিসেবে স্বীকৃত। ভাবতে পারিস ইউরোপীয়দের সিদ্ধান্ত টিকে গেলে আমাদের এতোদিনের জানা সৌরজগৎ পাল্টে যাবে? পৃথিবীর যাবতীয় পাঠ্য বই সংশোধন করতে হবে?

তাতে তোর কী ক্ষতি হবে?

ছোটোবেলা থেকে প্লুটো আমার সবচেয়ে প্রিয়, তা তো তুই জানিস না।

কেন, যে পৃথিবীর বাতাস খাচ্ছিস সে প্রিয নয়? চাঁদই বা কী দোষ করলো?

তুই বুঝতে পারছিস না।

পাগলকে থামানো দরকার। বলি, ঠিক আছে। পরে বুঝিয়ে দিস। এখন মা ডাকছে, যেতে হবে।

আসলে মা ডাকেনি। প্রলাপ থামানোর জন্যে বানিয়ে না বলে উপায় ছিলো না। ফোন রেখে দিয়ে আমার খারাপ লাগতে থাকে। পাগল এই নিয়ে রাতভর ইন্টারনেট ঘেঁটেছে, আমি ঠিক জানি। সেই কথা কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চায়। প্লুটো নিয়ে ওর এই আবেগে আমার কোনো অংশ নেই। তবু কী এমন হতো আরেকটু সময় দিলে? কতো অদরকারি কথা তো শুনি, না চাইলেও শুনতে হয়। ওগুলোতেই বা আমার কী প্রয়োজন? একটু পরে ফোন করে পুষিয়ে দেবো ঠিক করি।

এতোক্ষণে আমার মাথায়ও ঘুরতে শুরু করেছে, প্লুটো আর গ্রহ নয়। ইরফানও পাঠান নয়, পাঁঠাও নয়, সে পাগল!

(ক্রমশ)


মন্তব্য

স্বপ্নাহত এর ছবি

ইরফান আসলে কি সেইটা আলোচনার বিষয়।

আমি কিন্তু এই উপন্যাসের পাঠক,সেটাতে কোন সন্দেহ নাই চোখ টিপি

---------------------------
দুঃখ সুখের স্পর্শ নীরে
সাঁতরে বেড়াই;
নিঃসংগ এক,নিঃসংগ মেঘ।

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

সন্দেহ করার মতো কিছু ঘটেনি এখনো। হাসি

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

নিঘাত তিথি এর ছবি

ঘড়িতে সাতটা চল্লিশ। ইরফানের এখন মাঝরাত হওয়ার কথা।
এই লাইন পড়ে ভেবেছিলাম ইরফান বুঝি দেশের বাইরে থাকে, কিন্তু তাহলে কেন বলা হবে যে দেশের বাইরে থেকে ইলেকট্রিক কিবোর্ড কেনা হয়েছে। অবশেষে বুঝলাম নিশির সকাল সাড়ে সাতটাই আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা সূত্রে ইরফানের মাঝরাত। হাসি
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

ভালো ধরেছেন। এটা মাথায়ই আসেনি।

একটা প্রশ্ন মাথায় উঁকি দিচ্ছে। আমরা পরবাসী বলে চট করে এই প্রতিক্রিয়াটা হয়তো স্বাভাবিক। দেশের পাঠকেরও কি একই রকম মনে হবে? হয়তো হবে, কারণ দুর্বলতাটা বাক্য রচনা ও উপস্থাপনায়।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

অনিন্দিতা এর ছবি

জমে যাচ্ছে....
বরফ হলো বলে।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আগের পর্বে বললেন মোলায়েম, এবারে বরফ-জমাট! চিন্তিত

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

গতি বাড়তে শুরু করেছে ।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আপত্তি না থাকলেই হয়! হাসি

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- নিঘাত তিথি'র ধরিয়ে দেয়া অংশটা নিয়ে বলবো ভাবছিলাম। কিন্তু আগেই আলোচিত হয়ে গেলো বলে আর এগুলাম না।

অপেক্ষায় আছি ইরফানের চেয়ে নিশিকে আরেকটু বেশি জানার জন্য।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

নিশি-ইরফান আপাতত থাক। সামনের পর্বে অন্য কারো কথা।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

নিঘাত তিথি এবং ধুসর গোধূলী বলে ফেলেছেন!! ঃ)

ঐ অংশটুকু দু'বার পড়তে হয়েছে।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

অসতর্কতার জন্যে দুঃখিত। ওই জায়গাটা মেরামত করে দিলাম।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

পুরনো প্রশ্নটা আবারও করি - 'উপন্যাস লেখা শেষ, নাকি এখনো লিখছেন?'
[গত উপন্যাসেও জিজ্ঞেস করেছিলাম;)]

যদি, লেখা শেষ হয়ে থাকে তবে - পাঠক প্রতিক্রিয়ায় এরকম মেরামতকে কেমন মনে হয়? কখনও কি বিরক্তিকর মনে হয়?

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

লেখা শেষ না করে ধারাবাহিক প্রকাশের সাহস এখনো অর্জন করে উঠতে পারিনি। চোখ টিপি

ব্লগে লেখার সুবিধা তো এটাই - কেউ ভুল ধরিয়ে দিলে ঠিক করে দেওয়া যায়। পত্রিকায় মুদ্রিত হলে ভুল মেরামতের জন্যে বই প্রকাশ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ !

অমিত আহমেদ এর ছবি

বেশ জমেছে।
এনটানে পুরোটা শেষ করব এখন।


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।