২.১ জামাল
টাকাপয়সা গুনে একটা পেটমোটা ব্যাগে ভরে রাখা আছে। টাকার অংকসহ ব্যাংকের ডিপোজিট স্লিপও তৈরি। টাকাগুলো ব্যাংকে জমা করে দেওয়া সকালের প্রথম কাজগুলোর মধ্যে একটা। দরকার নেই, তবু নিজে আরেকবার গুনি। আগের রাতের গোনাগুনতি সকালে মিলিয়ে নেওয়া। টাকাপয়সা জিনিসটাকে বিশ্বাস নেই, তা-ও আবার যদি একাধিক হাতে নাড়াচাড়া হয়ে থাকে।
গুলশানের এই নামী থাই রেস্টুরেন্টে ম্যানেজারের কাজ আমার। সকালে দশটার মধ্যে চলে আসি। কিচেনে শেফ ও তার সাহায্যকারীরা ন'টার মধ্যে এসে কাজ শুরু করে দেয়। দুপুরের আহারার্থীদের জন্যে প্রস্তুতি। রেস্টুরেন্ট খোলা থাকে সকাল এগারোটা থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত। বন্ধ হওয়া পর্যন্ত আমাকে থাকতে হয় না, ন'টার পরে মালিকের ছেলে আসে সারাদিনের হিসেব-নিকেশ করতে। তখন সব বুঝিয়ে দিয়ে আমার ছুটি। কোনো কোনোদিন মালিক নিজে হঠাৎ এসে হাজির হয়, ভালোমন্দ সব খবর নেয়, কর্মচারীদের সবার সঙ্গে কথা বলে। সেদিন আমার বেরোতে দেরি হয়ে যায়। রেস্টুরেস্টের দরজা বন্ধ হলে আমার তৈরি করে রাখা পরদিনের বাজারের ফর্দটা দেখে নিয়ে মালিকের ছেলে তালা ঝুলিয়ে যায়। টাকাপয়সার হিসেব সেরে ব্যাগে ভরে রেখে যায়।
টাকাপয়সা নিয়ে সতর্কতার ফল একদিন পেয়েছিলাম। চাকরিতে তখন আমার মাসখানেক হয়েছে। একদিন সকালে গুনে দেখি, টাকার অংক মেলে না। ব্যাংকের স্লিপে যা লেখা, ব্যাগে তার চেয়ে দেড় হাজার টাকা বেশি। তিনবার গুনেও একই ফল। ফোন করি মালিকের ছেলেকে। ঘুমভাঙা গলায় ফোন ধরে সে জানায়, ব্যাংকের ডিপোজিট স্লিপটা ঠিক করে নিলেই হবে। সন্ধ্যায় মালিক নিজে আসে। তখন জানা যায় ভুলটা তার নির্দেশেই করা হয়েছিলো। সততার পরীক্ষায় আমি পাশ, বেতন বাড়ার খবরও আমাকে জানানো হয়। তখন মনে পড়েছিলো, সকালে ফোনে মালিকের ছেলের গলায় কোনো বিস্ময়ের রেশ ছিলো না।
মালিককে বলা সম্ভব হয়নি যে, পরীক্ষা নেওয়ার দরকারই ছিলো না। এইসব ছোটোখাটো লোভের ফাঁদে আমাকে ফেলা যাবে না। আমি নির্লোভ মানুষ নই, সেরকম দাবি করার সাহস নেই। লোভ-টোভ আমারও ঠিকই আছে, ফেরেশতা নই। তবে এতো ছোটো অংকের টাকাপয়সায় আমার অরুচি।
টাকা গোনা তখনো শেষ হয়নি, টেবিলে রাখা মোবাইল ফোন সজাগ হয়। কোনো নম্বর দেখাচ্ছে না। কার ফোন, বোঝার উপায় নেই। তুলে হ্যালো বলি।
ওপার থেকে শোনা যায়, নিউ ইয়র্ক থেকে সাজিদ।
কী খবর রে, বাবা? তুই যে নিউ ইয়র্কে, তা কি আর জানি না?
সাজিদের হাসির শব্দ পাওয়া যায়। বলে, ঢাকা থেকেও তো করতে পারি।
তা পারিস, কিন্তু এলে তো জানতাম।
আমি কিন্তু বাবা আসছি ঢাকায়। সেই খবর দিতেই ফোন করা।
তাই? কবে?
মাসখানেকের মধ্যে চলে আসবো।
তুই একা? না তোর মায়ের সঙ্গে?
কেন, আমি একা আসতে পারি না? আমার বয়স এখন ঊনত্রিশ, বোধহয় তোমার মনেই থাকে না।
চুপ করে থাকি। মনে থাকা কঠিন বটে। কতো বছর দেখা নেই। ছেলেটা চোখের আড়ালেই বড়ো হয়ে উঠলো। চোখের দেখা না থাকলে মনের আর দোষ কি? বলি, তোর মা কেমন আছে?
বুদ্ধিমান ছেলে সে। প্রশ্নটা এড়িয়ে বলে, তুমি কেমন আছো?
আছি, চলে যাচ্ছে। তা বাপ, বললি তোর ঊনত্রিশ বছর বয়স, বিয়েশাদীর কথা ভাবতে হবে না?
ছেলের সঙ্গে বন্ধুর মতো একটা সম্পর্ক রাখা গেছে। হয়তো দূরের বলে। অথবা যে পরিবেশে সে বড়ো হয়েছে, তা-ও কারণ হতে পারে।
সাজিদ বলে, বিয়েতে আমার একটু ভয়ই লাগে।
কীরকম?
দেখছি তো তোমাদের। জিনিসটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
বুঝতে বুঝতে একদিন দেখবি বুড়ো হয়ে গেছিস।
তাতেই বা কী ক্ষতি হবে? সব বিয়ে তো তোমরাই করে ফেললে। দাদা, তুমি, মা, কস্তা।
রিনির বর রাশিয়ায় পড়াশোনা করেছে। সে দেশে বাবাকে কস্তা বলে, সে-ই শিখিয়েছে সাজিদকে। ভালোই করেছে। বাবা তো একজনই হয়।
নাজুক জায়গায় হাত দিয়ে ফেলেছে সাজিদ। প্রসঙ্গ পাল্টাতে হয়, আসার দিনতারিখ ঠিক করেছিস?
এখনো ঠিক হয়নি, তবে মাসখানেকের মধ্যেই।
কতোদিন থাকবি?
লম্বা সময়ের জন্যে আসছি। তেমন হলে থেকে যাবো।
মানে?
মানে কিছু নেই। বাংলাদেশটা কি আমার দেশ নয়? থেকে যেতেই পারি, যদি সুযোগ থাকে।
একটু অবাক হই। ছেলের জন্ম এ দেশে, তা ঠিক। এ দেশ ওর নিজের দেশ, তা-ও ভুল নয়। কিন্তু তার সত্যিকারের বেড়ে ওঠা আমেরিকায়, সেটাও তার দেশ। আমার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার সময় রিনি ছেলেকে নিয়ে তার বাপের বাড়িতে উঠে যায়। বছর তিনেক পর তার আবার বিয়ে হয় আমেরিকাবাসী একজনের সঙ্গে। সালাম সাহেবেরও দ্বিতীয় বিয়ে, আগের পক্ষের এক মেয়ে আছে, সাজিদের সমবয়সী। শুনেছি ভালো আছে রিনি। সাজিদের সঙ্গে বরাবর যোগাযোগ রেখেছি, রিনি কখনো আপত্তি করেনি।
একবার ফোনে কথা বলার সময় বলেছিলো, তোমার সঙ্গে আমার জীবনযাপন অসম্ভব হয়েছিলো তা তুমি আমি দু'জনেই স্বীকার করবো। কিন্তু ছেলেটা যে তোমারও তা-ও মানতে হবে। তুমি সাজিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে, আমি আপত্তি করবো কেন? একটাই ছোটো অনুরোধ, আমার কোনো অশান্তির কারণ যেন না ঘটে।
(ক্রমশ)
মন্তব্য
পড়ছি, আরওপড়ার অপেক্ষায়..........
ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
কোথায় পড়েছিলাম, আমাদের সবার সততার সিলিং বাঁধা আছে। কেউ লাখ টাকা পর্যন্ত সৎ, কেউ কোটিতে, আবার কারো মিলিয়ন-বিলিয়ন। সিলিং ছুঁলেই মুখোশ খুলে পড়ে।
পড়ছি জুবায়ের ভাই
=============
"আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে"
ঘুষ নেয় না এরকম মানুষদের সম্পর্কে একটা চালু মন্তব্য শুনেছিলাম : ঘুষ খায় না? কতোদূর পর্যন্ত খায় না?
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
সবার ক্ষেত্রে কথাটা সম্ভবত ঠিক নয়।
ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল
চুপচাপ পড়ছি। আর আন্দাজ করতে চেষ্টা করছি যে কাহিনিটি কোন দিকে মোড় নেয়।
কি সুন্দর লেখেন আপনি। কি দারুণ ভাবে চরিত্রগুলোকে বানাচ্ছেন! চলুক চলুক।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
এমন উদার মন্তব্যের উত্তরে ঠিক কী বলা যায় জানি না।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
- হুমম।
ঘটনার কুয়াশা সরছে ধীরে ধীরে।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
কুয়াশা সরলেই যে সূর্য দেখা দেবে তার কোনো নিশ্চয়তা কিন্তু নেই।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
মোড় নিলো।
পরের পর্বে যাই ।
নতুন মন্তব্য করুন