১০.৩
এতোক্ষণ অমনোযোগে একটি পুরনো ম্যাগাজিনের পাতা উল্টে যাচ্ছিলাম। কথাবার্তার কিছু কানে আসছিলো, কিছু শুনিনি। এই ধরনের আলাপ কানে তোলার দরকার মনে হয় না বলে সচরাচর চুপচাপ থাকি। নেহাত অসহ্য লাগলে উঠে বাইরে যাই, সিগারেট ধরিয়ে টানতে থাকি। শেষের কথাটি মাথায় ধাক্কা দিয়ে আমাকে সচকিত করে দেয়। ইন্ডিয়ান আর্মি বাংলাদেশ স্বাধীন করে দিয়েছিলো!
অজান্তে বলে বসি, চুপ করেন তো ভাই। এইসব বাজে কথা কই পাইলেন? জানেন আপনে কী বলতেছেন?
ভদ্রলোককে চিনি না, আগে কোথাও দেখেছি বলেও মনে করতে পারি না। অচেনা কাউকে এ ধরনের কথা বলে আমি নিজেকেই অবাক করে দিয়েছি।
ভদ্রলোক গলা আরেক পর্দা তুলে বলেন, জানি বইলাই তো বলতেছি। বাংলাদেশের কেউ যুদ্ধ করে নাই, বাংলাদেশ স্বাধীন কইরা দিয়া গ্যাছে ইন্ডিয়ান আর্মি। তারা হাতে ধইরা স্বাধীন না করলে আজও আমরা পাকিস্তানীই থাকতাম। ইস্ট পাকিস্তানের কেউ বাংলাদেশ চায় নাই।
আপনি কিছুই জানেন না। জানলেও বোঝেন নাই কী বলতেছেন। ইন্ডিয়া আমদের হেল্প করছিলো, সেইটা তো অস্বীকার করার কিছু নাই। কিন্তু তারা আমাদের স্বাধীনতা হাতে তুইলা দিয়া গেছে, এইটা মনে করার কোনো কারণ নাই।
তাহলে ইন্ডিয়ান আর্মি আসছিলো কী করতে?
মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টায় আস্তে আস্তে বলি, আপনার হয়তো জানা নাই, পাকিস্তানীরা মুক্তিবাহিনীর মারের চোটে দিশা না পাইয়া ইন্ডিয়ারে অ্যাটাক করছিলো। আপনার কি জানা আছে, ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের যুদ্ধ লাগার আগে বাংলাদেশের অনেক জায়গা থিক্যা পাইক্কারা পলায়া গেছিলো? মুক্তিবাহিনীর হাতে মার খাইছি, এই কথা তো তারা তাবৎ দুনিয়ার কাছে বলতে পারে না, ইন্ডিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ লাগলে আমেরিকা-চীনের কাছে নালিশ করা যায়। তাই করছিলো তারা। তা ইন্ডিয়া কি তখন বইসা আঙুল চুষবো, না উল্টা মার দিবো?
মুক্তিবাহিনী বইলা কিছু কি আসলে ছিলো নাকি?
বলে কী! মাথায় রক্ত উঠে যায়। জিজ্ঞেস করি, কিছু মনে করবেন না, আপনার বয়স কতো? মানে যুদ্ধের সময় আপনার বয়স কতো ছিলো?
এবার ভদ্রলোকের গলা আরো চড়ে যায়। বলে, আমার বয়স দিয়া আপনি কী করবেন? ছয় বচ্ছর বয়স ছিলো তখন আমার।
আমি আসলে বুঝতে চাইতেছিলাম, যুদ্ধের সময় আপনের বোঝার বয়স হইছিলো কিনা, কিছু বুঝছিলেন কিনা। খালি শোনা কথা নিয়া চিল্লাইতেছেন। কথা শুনলে মনে হয় বোঝার বয়স আপনার এখনো হয় নাই। তা তখন না দেখলে না বুঝলে বইপত্র পড়লেও কিছু জানতে পারতেন।
মনে করেন আপনি একলাই পড়ছেন। আমিও কিছু পড়ালেখা কইরাই কথা বলতেছি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার উপরে একখান বইয়ের নাম বলতে পারবেন যেইটা আপনি পড়ছেন?
পড়ছি, নাম মনে নাই।
পেশাদার উকিলের ভঙ্গিতে বলি, তার মানে পড়েন নাই। পড়লে মনে থাকবে না ক্যান? মুখে মুখে শোনা মিছা কথাগুলি তো মনে রাখছেন ঠিকই।
তা ভাইজান, আপনি এতো কথা বলতেছেন, আপনে যুদ্ধ করছিলেন?
যদি বলি করছি?
তখন আপনার বয়স কতো আছিলো?
সতেরো।
হাসাইলেন, সতেরো বচ্ছরের পোলা পাকিস্তান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধ করছে?
আমার তো তাও সতেরো। বগুড়ায় আমার বন্ধুর ছোটো ভাই টিটু ক্লাস নাইনে পড়তো, পনেরোর বেশি বয়স হওয়ার কথা না। মার্চ মাসের শেষে যখন রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থিক্যা পাকিস্তানীরা বগুড়ার দিকে আসে, এই টিটু কয়েকজন বন্ধুরে নিয়া এক দোতলা দালানের ছাদে গাদা বন্দুক হাতে যুদ্ধ কইরা মারা পড়ে। আরো শুনতে চান? ঢাকা শহরের আরেকজন, তার নামও টিটো, বয়স চোদ্দো বছর, সাভারে যুদ্ধ করতে গিয়া মারা গেছিলো দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র কয়দিন আগে। তার কবর এখনো ইচ্ছা করলে দেখতে পারবেন জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির গেটের সামনে, সেইখানে তার বয়সও লেখা আছে।
আপনি যা বলতেছেন, তা সত্যি না-ও হইতে পারে।
সবজান্তার কথা কানে তুলি না। বলি, ফ্রেডি অ্যাডুর নাম হয়তো শোনেন নাই। সকার খেলে, বয়স চোদ্দো বছর। আফ্রিকায় জন্ম। তারে বলা হইতেছে আমেরিকান সকারে সেরা প্লেয়ারগুলির একজন। এইটারে আপনি কী বলবেন? আসলে বয়স দিয়া সব বিচার হয় না। আপনি দেখেন নাই, দশ-বারো বছরের পোলাপানও যুদ্ধ করছে। আমার দেখা আছে। আপনি দেখেন নাই, শোনেন নাই, শুনলেও কিছু বোঝেন নাই। আপনি বোঝনে নাই, তার মানে যে সব মিছা কথা তা কিন্তু না।
আপনি ক্যামনে জানেন?
আমি সেইখানে ছিলাম। আমি নিজের চোখে দিনগুলি দেখছি, আপনি দেখেন নাই। বুকের মধ্যে গুলি খাওয়া মানুষরে চিল্লায়া জয় বাংলা বলতে শুনছি, আপনি শোনেন নাই। যুদ্ধের ময়দানে পাশাপাশি ছিলাম, গোলাগুলি থামলে দেখি পাশের জন আর নাই। একদিকে লড়াই জেতার খুশি, পাশে রক্তমাখা বুক নিয়া আমার বন্ধু শোয়া, তার মাথার খুলি নাই, নড়ে না চড়ে না, কথাও কয় না। তাকায়া দেখি আর ডুকরায়া কানতে ইচ্ছা হয়, কানতে পারি না। মনে হয়, ওইটা আমিও হইতে পারতাম। আপনার জীবনে এইরকম কিছু জানা আছে? থাকলে এইসব নিয়া কথা বলবেন। যদি আন্দাজও করতে পারেন, তাহলে বলবেন। না হইলে চুপ যান, না জাইনা কিছু বলবেন না। ওই মরা মানুষগুলিরে অপমান না হয় না-ই করলেন।
ভদ্রলোক পুরনো প্রসঙ্গে যান, আপনে বলতে চান, ইন্ডিয়া আর্মি না পাঠাইলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হইতো?
আমি যদি বলি হইতো, আপনি বলবেন হইতো না। তার ফয়সালাটা হয় কীভাবে? খালি ইন্ডিয়ার কথা বললেন, সেই সময় রাশিয়া আমাদের পাশে দাঁড়ায় নাই? এইসব কথায় ফায়দা কি? বরং আপনি চাইলে কিছু বইপত্র আমি আপনারে দিতে পারি, পড়লে কিছু ইতিহাস জানতে পারবেন।
আপনাদের মতন মানুষগুলি যতোসব প্যাঁচ লাগায়। আপনারা কই পাইলেন একাত্তর সালে তিরিশ লক্ষ লোক মারা গেছিলো, দুই লক্ষ মাইয়ার ইজ্জত গেছে? গুনতিটা করলো কে?
ভদ্রলোকের পায়ে পা বাধিয়ে ঝগড়া করার স্বভাব মনে হয়। এক প্রসঙ্গ থেকে আরেক প্রসঙ্গে যান লাফিয়ে লাফিয়ে। আমি ধীর গলায় জবাব দিই, একটা সত্যিকারের ঘটনা শুনাই আপনারে। আটানব্বই সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে, ছাব্বিশে মার্চ যে স্বাধীনতা দিবস সেইটা জানেন তো নাকি তা-ও মনে করায়া দিতে হবে, দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে খবরের কাগজে যুদ্ধের সময় তিরিশ লাখ মানুষের শহীদ হওয়া আর দুই লাখ নারীর লাঞ্ছিত হওয়ার কথা বইলা লেখালেখি হইলে পাকিস্তানীদের তা পছন্দ হয় নাই। তারা ইসলামাবাদে বাংলাদেশের হাই কমিশনাররে ডাইকা নিয়া বলে, এইসব প্রোপাগান্ডা বন্ধ করেন, কারণ এগুলি ঐতিহাসিকভাবে অসত্য এবং সংখ্যাগুলি অনেক বাড়ায়া বলা হইতেছে। আপনে যেমন একটু আগে বললেন। তখন বাংলাদেশের হাই কমিশনার কিউ এ এম এ রহিম খুব বিনয়ের সাথে পাকিস্তানীগুলিরে বললেন, সঠিক সংখ্যাটা তাহলে আপনারাই জানায়া দিলে ভালো হয়!
তাতে কী হইলো?
জানতাম, ভদ্রলোকের মাথায় হয় জিনিসটা ঢুকবে না, অথবা না বোঝার জন্যে তিনি তৈরি হয়েই আছেন। ব্যাখ্যা করে বলি, পাকিস্তানীরা তো আজ পর্যন্ত স্বীকারই যায় নাই যে তারা একাত্তর সালে নিরীহ বাঙালিদের কচুকাটা করছিলো, মহিলাদের ইজ্জতহানি করছিলো। রহিম সাহেব যখন তাদের বললেন যে সঠিক সংখ্যাটা আপনারাই দিয়া দ্যান, পাকিস্তানীরা কী বিপদে পড়লো বুঝছেন? যদি বলে তারা দুইজন মানুষও মারছে, তাহলেও তো দোষ স্বীকার করা হয়। সেইটা তারা জীবনেও স্বীকার করতে চায় নাই, করে নাই, সে আশাও নাই। রহিম সাহেব খুব সুন্দরভাবে জুতাটা মারছিলেন। তিনি আরো বলছিলেন, দেশের স্বাধীনতার জন্যে ত্যাগ স্বীকার করছিলো যে মানুষগুলি তাদের সম্মান জানাইলে যদি পাকিস্তানের মন খারাপ লাগে, সম্পর্ক খারাপ হয়, তাতে বাংলাদেশের তো কিছু করার নাই। জানেন, অবাক লাগে ওই পাইক্কাদের মুখের কথা আপনার মুখে আইসা পড়লো ক্যামনে। আরো শুনতে চান? সেই সময় জামাতী-রাজাকারগুলি ক্ষমতায় ছিলো না। তখনকার সরকার ঢাকায় পাকিস্তানী হাই কমিশনার মিসেস রিফাত ইকবালরে ফরেন মিনিস্ট্রি অফিসে ডাইকা পরিষ্কার জানায়া দিছিলো, দ্যাখেন, পাকিস্তান যদি একাত্তরের ঘটনার জন্যে মাফ চায়, আমরা মাফ কইরা দিতে পারি, তাদের দোষগুলি ভুইলা যাইতেও রাজি, কিন্তু স্বাধীনতার জন্যে যে মানুষগুলি জান দিলো ইজ্জত দিলো সেই মানুষগুলিরে ভুলি ক্যামনে?
ভদ্রলোকের সঙ্গে আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করে না। এইসব নিয়ে তর্ক করার কোনো মানে নেই। সচরাচর করি না। আজ যে কেন করতে গেলাম! সিগারেট খাওয়ার অজুহাতে উঠে পড়ি। বাইরে কেউ নেই, কেউ লক্ষ্য করছে না দেখে গাড়িতে উঠে পড়ি। নিজের ঘরে ফিরি।
আমি না থাকলে আসমান কেক কাটবে না বলেছিলো, তার সঙ্গে দেখাও হলো না। কাল সকালে পুষিয়ে দিতে হবে। ঘরে ফেরার পথে মনে পড়েছিলো শ্লোগানটি, একাত্তরের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার!
মন্তব্য
এমন অভিজ্ঞতা কমবেশী সবারই আছে। তর্কা-তর্কীর মাঝে এমন একটা সময় আসে যখন মনে হয় বেজন্মা গুলোকে পুঁতে ফেলি। না মানে যুক্তি, না মানে আবেগ, খালি বেহুদা চিল্লায়।
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে
এমন তর্কে আমি সাধারনত যাইনা। এই হারামিগুলা যা বুকে ধারন করছে তা বাদ দিতে রাজিনা। বরং সেইটা অপনারে জোর করে গেলানোর চেস্টা শুরু করবে। আমি খালি মনে মনে হাসি। হালার ছাগলের গোস্টি...
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
তর্ক করে কেউ কারো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিশ্বাস বদলাতে পেরেছে কোনোকালে? খসড়া উপন্যাসের চরিত্রটিও এই ধরনের তর্কে যায় না। তবে কখনো কখনো না গিয়ে উপায়ও থাকে না। কোনো কোনো কথা যে মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয়!
ধন্যবাদ অমিত আহমেদ ও নজমুল আলবাব।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
হা...হা... মাথায় আগুন ধরলে আমি আবার ডাইরেক্ট একশন...
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
একেকজনের ধরণ একেক রকমের। সেটাই স্বভাবিক।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
খুব সেয়ানা ।
-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
এইরকম বিশ্বাস নিয়ে কত মানুষকে বেঁচে দেখলাম এই সামান্য জীবনে।
কি মাঝি? ডরাইলা?
এইসব শুনলে মেজাজ গরম হয়ে যায়। মন চায়, ওগুলারে ধরে ইচ্ছামতো পিটাই।
_________________________
'আজকে না হয় ভালোবাসো, আর কোন দিন নয়'
নতুন মন্তব্য করুন