২.২ জামাল
বিয়ের আগে রিনির সঙ্গে আমার তিন বছরের সম্পর্ক। বিয়ে করতে হয়েছিলো লুকিয়ে কোর্টে গিয়ে, তাদের বাসার কারো মত ছিলো না। দেড় বছরের মাথায় সাজিদ জন্মালে নাতির মুখ দেখে রিনির বাবা-মা বিয়েটা মেনে নিয়েছিলেন। আমাদের সংসার টেকেনি, তার দায় আমার একার। বিয়ে জিনিসটা যে দুই নারী-পুরুষের মধ্যে এক ধরনের দায়বদ্ধতা এবং চাইলেই তা ভাঙা যায় না, ভাঙতে নেই, এই বোধ আমার খুব গাঢ় ছিলো না। হয়তো আমার পারিবারিক ইতিহাস এর পেছনে কাজ করে থাকবে। আমি বিশ্বস্ত থাকতে পারিনি। এই জিনিস আমার মধ্যে কোথা থেকে এলো জানি না।
বুঝেছি দেরিতে, আগে জানলে হয়তো রিনিকে আমার জীবনের অভ্যন্তরে টেনে আনতাম না। ওর জন্যে আমার ভালোবাসা ছিলো খাদহীন। প্রকাশ্যে স্বীকার করা চলে না, কিন্তু হয়তো আজও সেই ভালোবাসার কিছু অবশিষ্ট আছে আমার ভেতরে। আমার জীবনের অংশ সে আর নয়, কিন্তু সাজিদের মা হিসেবে একটা অংশীদারিত্ব জীবনভর থেকে যাবে, কোনোকিছুতেই তা পাল্টাবে না।
হঠাৎ একটা অদ্ভুত চিন্তা আসে। এতো বছর দূরে থাকা সাজিদকে কি আমি নিশি-ঋষির চেয়ে কম ভালোবাসি? নাকি সমান সমান? প্রথম সন্তানের জন্যে কিছু আলাদা দুর্বলতা সব বাবা-মায়েরই থাকে। তাহলে সাজিদের জন্যে আমার আলাদা টান থাকলে রিনিরও তাই। আমাদের জীবন আলাদা হয়ে গেলেও এখানে তাহলে আমরা এখনো যুক্ত আছি। নীলার বেলায় সে দুর্বলতা নিশির জন্যে। কে জানে এসব কি দিয়ে ওজন করা যায়, মাপা যায়।
সাজিদের কথা শুনে একটু উদ্বেগ হয়, তা অস্বীকার করতে পারি না। ওর বয়সী ছেলেমেয়েরা এখন বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে পারলে আর কিছু চায় না। অথচ সে আমেরিকায় এতো বছর বাস করার পর বাংলাদেশে ফিরতে চায়, তা খুব স্বাভাবিক লাগে না।
জিজ্ঞেস করি, কেন, মায়ের সঙ্গে কিছু হয়নি তো?
না বাবা, না। মা-র সঙ্গে কথা বলেই তোমাকে জানাচ্ছি।
সংশয় তবু যায় না। মনে হয়, সালাম সাহেবের সঙ্গে কোনো ঝামেলা হলো কি না। ভদ্রলোক খুবই ভালো শুনেছি, সাজিদকে নিজের ছেলের মতো দেখেন। তবু যুবক বয়সী সৎপুত্রের সঙ্গে খটোমটো লাগতে কতোক্ষণ? ছেলে আমার সঙ্গে থাকলেও তা হতে পারতো।
সরাসরি জিজ্ঞেস করা যায় না। পরের প্রশ্নটা এমনভাবে করি যা দিয়ে পৃথিবীর যে কোনো সম্ভাবনাকে বেড় দিয়ে ধরা যায়। বলি, অন্য কোনো ঝামেলা বাধিয়ে বসিসনি তো?
একদম না। আমি ভালো ছেলে, বাবা। ইংরেজির আই অক্ষরের মতো সোজা।
আমাদের বসতি পৃথিবীর দুই প্রান্তে হলেও সম্পর্ক সহজ রাখা গেছে। ছোটোখাটো রসিকতা চলে। তার কথায় পাল্টা জিজ্ঞেস করি, বড়ো হাতের আই তো? ছোটো হাতেরটা কিন্তু খুব সোজা লাগে না।
বাপ-ব্যাটা মিলে হাসি হয়। কিছু নিশ্চিন্ত লাগে। জিজ্ঞেস করি, তা বাপ তুই উল্টোদিকে হাঁটা দিলি কেন, বল তো?
কী রকম?
এই দেশের অর্ধেক মানুষ আমেরিকা যেতে চায়, আর তুই আসছিস বাংলাদেশে।
বাবা, যে কোনো সময় এখানে ফিরে আসার পথ আমার খোলা থাকছে। আমি আসলে তোমার সঙ্গে অন্তত কিছু সময় থাকতে চাই। তোমাকে আরেকটু বুঝতে চাই। ছোটোবেলার কথা কিছু মনে আছে, এখন দূর থেকে যতোটা বুঝি সেই বোঝাটাও যাচাই করা দরকার।
খুব ভালো কথা। কিন্তু এখানে এসে কি টিকতে পারবি?
বাংলাদেশ তো আমার অচেনা জায়গা নয়, বাবা। দেখি সেখানে নিজে কিছু করতে পারি কি না। এখন তুমি আমাকে খোলাখুলি বলো, তোমার আপত্তি নেই তো?
কী আশ্চর্য, আমার ছেলে এতোদিন পর আসছে, আপত্তি হবে কেন? পাগল নাকি?
সাজিদের হাসির শব্দ শোনা যায়। বলে, ছোটোবেলায় তুমি আমাকে পাগলা বলতে মনে আছে?
থাকবে না কেন? তোর মনে আছে দেখে অবাক হচ্ছি।
বাবা, আরেকটা কথা।
বল।
আমি কিন্তু এসে তোমার বাসায় উঠবো। তোমার অসুবিধা হবে না তো?
মায়ের সঙ্গে সাজিদ বেশ কয়েকবার এসেছে ঢাকায়। তখন থেকেছে রিনির সঙ্গেই। এই প্রথম সে একা আসছে। আমার অসুবিধা বলে সে কী জানতে চায়, বুঝতে পারি। নীলার সঙ্গে তার দেখা হলেও তেমন জানাশোনা হয়নি। নিশি-ঋষির সঙ্গেও খুব অল্প দেখা হয়েছে। নীলা কীভাবে নেবে, হয়তো তাই সাজিদ জানতে চায়। কী বলবো? সে বিষয়ে আমি নিজেও খুব নিশ্চিত হতে পারি না। সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলি, সেসব তোর ভাবার বিষয় না, আমি দেখবো। শুধু জানিয়ে দিস কবে তোকে আনতে এয়ারপোর্টে যেতে হবে।
কথা শেষ করে ভাবি, সাজিদ এলে তাকে থাকতে দেওয়া হবে কোথায়? দুটি ঘরে কোনোমতে থাকা আমাদের, তার কোথায় জায়গা হবে, কী করে? তার আসতে আরো মাসখানেক দেরি, সেসব পরে ভাবা যাবে। আপাতত কাজে মন দিই। চাকরিটা তো সবার আগে রাখতে হবে, তারপর অন্য কথা।
ঘড়িতে দেখি সাড়ে দশটা। ব্যাংক থেকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। এদিকে লাঞ্চের আয়োজন শেষ করে রেস্টুরেন্টের দরজা খুলে দিতে হবে এগারোটায়। দেরি হয়ে যাচ্ছে, আজ আর টাকা গোনার সময় নেই। ব্যাংকে তো গুনবেই, তখন দেখা যাবে। টাকা ব্যাগে ভরে কিচেনের কাজকর্ম এক নজর দেখে নিই। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে বসে আছে। ঢাকা শহরে টাকাপয়সা নিয়ে চলাফেরা নিরাপদ নয়, কোনোকালে যে ছিলো তা-ও আজকাল আর মনে পড়ে না। রোজ সকালে এইরকম সময়ে মালিকের বা তার ছেলের গাড়ি আসে, ব্যাংকের কাজ শেষ হলে আমাকে নামিয়ে দিয়ে ফিরে যায়।
কাচের দরজা দিয়ে বাইরে দেখে নিই, যতোদূর চোখ চলে। কাছাকাছি অচেনা লোকজন ঘোরাফেরা করছে দেখলে অপেক্ষা করার নিয়ম, যতোক্ষণ না নিরাপদ লাগে। আশেপাশে কাউকে না দেখে কালো পলিথিনে মোড়া টাকার ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে উঠে বসি। আকাশে মেঘ করে আসছে। বৃষ্টি হবে নাকি?
(ক্রমশ)
মন্তব্য
পড়ছি...।
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
জেনে খুশি।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
পড়তে ভাল লাগছে।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
পড়ছেন জেনেই খুশি। ভালো লাগলে তো আরো।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
ভাল লাগছে, জুবায়ের ভাই।
এখনো ধৈর্য রাখতে পারছেন? ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
- সাজিদের সাহসী পদক্ষেপে একাত্মতা ঘোষণা করছি। 'উল্টো দৌঁড়' দিতে হলে নাকি গাটস লাগে, সাজিদের সেটা আছে বলেই মনে হচ্ছে।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
দেখা যাক।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
তারপরে কী হবে?
নীলা-নিশি-ঋষি কি সাজিদকে সহজভাবে নিবে?
সাজিদ কি আসলেই আসবে?
এসব জানতেই - আমি যাচ্ছি পরের পর্বে।
হা হা হা
ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল
নতুন মন্তব্য করুন