৩.১ নীলা
ফোন বাজছে। একটু আগে নিশি-ঋষির ঘর গোছাতে গিয়েছিলাম, তখন হাতে ছিলো। সেখানে ভুলে রেখে এসেছি। দুই ছেলেমেয়ের কেউ বিছানা গোছাতে শিখলো না। ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে খাওয়া সেরে বেরিয়ে যায়। বিছানার চাদর বালিশ এমন দোমড়ানো মোচড়ানো যে বিছানা দুটোকে ঘূর্ণিঝড়-উপদ্রুত এলাকা বলে মনে হয়। তবু দয়া করে যে সেগুলো মেঝেতে ফেলে যায় না, এই বেশি।
ছেলেমেয়েরা, তাদের বাবা বেরিয়ে গেলে দ্বিতীয় কাপ চা বানাই। একা একা বসে খাই। সকালের চা খাওয়া হয় কোনোমতে, দশটা কাজ করতে করতে। কোনো কোনোদিন ভুলে যাই, অর্ধেক খাওয়া ঠাণ্ডা চা পরে ফেলে দিতে হয়। দ্বিতীয় কাপটা খাওয়া হয় নিজের মতো করে। শেষ না হওয়া পর্যন্ত টিভির সামনে থাকি। নির্দিষ্ট কোনোকিছু দেখা নয়, রিমোট টিপে শুধু এ-চ্যানেল ও-চ্যানেল ঘোরাফেরা। দেশী-বিদেশী কতো চ্যানেল আসে এখন, চাইলে দিনভর রাতভর দেখা যায়।
বেশিক্ষণ টিভি দেখতে আমার ভালো লাগে না, কেমন যেন একটু মন খারাপ হয়। এই তো কয়েক বছর আগেও টিভি বলতে ছিলো এক বিটিভি, তা-ও সারাদিনমান চলতো না। আমাদের সময়ে এতোগুলো চ্যানেল থাকলে আমার জীবন কেমন হতো কে জানে! হয়তো অন্যরকম কিছু হতো না। টিভি চ্যানেলের সংখ্যা তো সমস্যা ছিলো না, ছিলো অন্যকিছু। টিভি দেখতে গেলে পুরনো কথা মনে পড়ে, পরিচিতদের কাউকে পর্দায় দেখলেও। দূরে থাকা, ভুলে থাকা ভালো।
চা শেষ করে রান্নাঘরে কিছু ধোয়া-মোছার কাজ সারতে হচ্ছিলো, এই সময় মোবাইল বাজলো। আজকাল বাসায় কাজের লোক পাওয়া আর দূর আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া একই রকম অসম্ভব হয়ে গেছে। সব নিজেকে করতে হয়। উঠে নিশি-ঋষির ঘরের দরজায় পৌঁছাতেই ফোন থেমে গেছে। কে হতে পারে? তুলে দেখি, নম্বর অচেনা। ইচ্ছে করলে কল ব্যাক করা যায়, করি না। যে-ই হোক, দরকার হলে আবার করবে।
আমাদের বাসায় ল্যান্ডলাইন নেই। আজকাল মোবাইল শস্তা হওয়াতে ল্যান্ডফোন না হলেও চলে। তিন মোবাইলের দুটো জামাল আর নিশির কাছে, আরেকটা আমার কাছে। ঋষির বায়না, তাকেও একটা দিতে হবে। স্কুলে তার অনেক বন্ধুর মোবাইল আছে। তাকে আরো বছর দুয়েক অপেক্ষা করতে হবে বলা হয়েছে।
চাই তো অনেককিছু। সবারই। আসবে কোত্থেকে? ছেলেমেয়ে বড়ো হয়েছে, তাদের আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করা দরকার। ঘর ও পড়ার টেবিলের মতো একটামাত্র কমপিউটার তারা ভাগাভাগি করে। তা-ও নাকি পুরনো হয়ে গেছে, বদলাতে হবে। সামনে শীত, ঋষির শীতের জামাকাপড় দরকার, আগেরগুলো ছোটো হয়ে গেছে। কোথা থেকে কীভাবে ব্যবস্থা হবে জানি না। জামালের একার উপার্জনে আর চলছে না, মাসের শেষে যা ঘরে আনে তাতে কায়ক্লেশে চলে। বাসাভাড়া, গ্যাস-ইলেকট্রিক-বাজার খরচ, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা এইসবের বাইরে সবকিছুই বাড়তি বিবেচনা করতে হচ্ছে কয়েক বছর ধরে। আরো কতোদিন এইভাবে চলবে, চালানো যাবে কে জানে!
ছেলেমেয়ে দুটোর মুখের দিকে তাকাতে কষ্ট হয়। এইরকম দিন এনে দিন খাওয়ার অবস্থা আমাদের সবসময় ছিলো না। ঋষি তখনো ছোটো, মনে থাকার কথা নয়। কিন্তু নিশি এই বদলটা নিজের চোখে দেখেছে, কোথা থেকে কোথায় নামতে হলো আমাদের। প্রথম প্রথম কী মনমরা হয়ে থাকতো। বড়ো আদরে বড়ো হয়ে উঠছিলো সে। মুখ ফুটে বলামাত্র তার বাবা জিনিসটা এনে হাজির করে দিতো। সেই মেয়ে ক্রমে একেবারে কিচ্ছু না চাইতেও শিখে গেলো।
এইসব ভাবলে নিজেকে শান্ত রাখা কঠিন হয়ে যায়। তাই মনে করতে চাই না। অথচ উপায় কী? মনে পড়ার কতো অজুহাত কীভাবে যেন তৈরি হয়ে যায়।
এইচএসসি দিয়ে আমি বিএ ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলাম। জামালের সঙ্গে বিয়ে হলে লেখাপড়া আর করা হয়নি। বিদ্যার জোর থাকলে বা তেমন কোনো কাজ জানলে আমি কিছু আয়-উপার্জনের চেষ্টা করতে পারতাম। সে উপায় নেই। জানার মধ্যে জানি এক গান, তা-ও আর আমার গাওয়া হবে না। বিশুদ্ধ গৃহবধূ হতে আমি চাইনি, হওয়ার কথা ছিলো না, অথচ তাই হয়ে বসে আছি।
আজকের যে জামাল, তাকে আমি বিয়ে করিনি। এখনকার এই জামালকে চিনি না, চিনতে কষ্ট হয়। সে নিজেও কি নিজেকে আর চিনতে পারে? ঊনিশ বছর আগে আমাদের বিয়ে হয়, তখন সে অন্য মানুষ ছিলো। হয়তো অন্য কেউ। স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ সুখী চেহারার জামাল এখন পুরনো কাঠামোর ওপরে বসানো অন্য কেউ। হাসিখুশি মুখচোখ চোয়াড়ে কর্কশ হয়ে গেছে, ফরসা মুখে পোড়া তামাটে রঙের পরত, শরীর-স্বাস্থ্য ভেঙেচুরে পড়ার দশা। সহজ আরামপ্রিয় জীবনে অভ্যস্ত মানুষটার চেহারায় খেটে খাওয়া মানুষের রুক্ষ্মতা এখন। শুধু বয়সের কারণে যে সবটা নয়, তা আমার চেয়ে বেশি আর কে জানে? ওর বন্ধুদের কারো মুখে ওরকম ধস দেখি না।
রান্নাঘরের ধোয়ামোছা শেষ করে বসার ঘরে ফ্যান চালিয়ে বসেছি। ভ্যাপসা গরম পড়েছে আজ। আবার মোবাইল বাজে। এবার ফোন হাতের কাছেই আছে। তুলে হ্যালো বলি।
ফোনের ওপারে অচেনা পুরুষের গলা। ভদ্রোচিত বিনয়ে জিজ্ঞেস করে, আমি কি নীলাঞ্জনা সুলতানার সঙ্গে কথা বলছি?
হ্যাঁ, আমি নীলাঞ্জনা।
আমি সৈকত আহমেদ কথা বলছি সাপ্তাহিক অষ্টপ্রহর পত্রিকা থেকে। আপনার একটা সাক্ষাৎকার নিতে চাই আমাদের কাগজের জন্যে।
অষ্টপ্রহর পত্রিকার নাম শুনেছি বলে মনে করতে পারি না। কতো রকমের কাগজ যে হয়েছে এখন! সে কথা মুখের ওপর বলা যায় না। বলি, আমি তো ভাই গান-বাজনা ছেড়ে দিয়েছি নয়-দশ বছর হয়ে গেলো। আর গাইবোও না কোনোদিন।
আমরা সেরকম বিষয় নিয়েই একটা বিশেষ ফিচার চালু করেছি আমাদের পত্রিকায়। এই বিভাগে শুধু তাঁদের কথা থাকবে যাঁরা একসময় গানে বা অভিনয়ে নাম করেছিলেন, কিন্তু এখন হারিয়ে গেছেন।
মনে মনে ভাবি, হারিয়ে গেছি? কোথায়? কীভাবে? আশ্চর্য তো, আমি জানলামই না?
বিনীতভাবে বলি, আমি অপারগ। আমাকে বাদ দিন।
সৈকত আহমেদ নাছোড়বান্দার মতো বলে, বেশি সময় নেবো না। আপনার সুবিধামতো আধ ঘণ্টা সময় দিন। আমি এই কাগজের সম্পাদক, আমি নিজে আসবো একজন ফোটোগ্রাফার নিয়ে, সে আপনার কয়েকটা ছবি তুলবে।
জিজ্ঞাসা করি, আমার ফোন নম্বর পেলেন কোথায়?
জামাল ভাইয়ের কাছ থেকে পেয়েছি।
ও, আচ্ছা। কিন্তু ভাই, আমাকে মাফ করতে হবে। আমি পারবো না।
আরো কিছুক্ষণ ঝুলোঝুলির পর অষ্টপ্রহর সম্পাদকের হাত থেকে নিস্তার পাই। শেষের দিকে একটু রূঢ় হয়েছিলাম। কিছু করার নেই, এরা এক কথা একবার বললে বোঝে না। বুঝলেও কানে তোলে না। পত্রিকার পাতা ভরানোর জন্যে কতো যে ফন্দি বের করে! যারা আর গান করে না, অভিনয় থেকে দূরে সরে গেছে তাদের সাক্ষাৎকার। মানুষের তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই। এরা হয়তো ভাবে, সাক্ষাৎকারের কথা বললে সবাই হামলে পড়বে। তাদের দোষ দিয়ে কী হবে। তারা এইরকমই দেখে অভ্যস্ত। কেউ কেউ যে প্রচারের আলো থেকে পালাতে চায়, তারা হয়তো তা জানেও না।
মোবাইল হাতে নিয়ে বসে থাকি। আজ বাজার করতে হবে না, রান্নাবান্নার কাজও বেশি নেই। কালকের রান্না করা মাংস ফ্রিজে তোলা আছে, জামালের জন্যে ছোটো মাছের তরকারিও। মেয়ে ডাল ছাড়া ভাত খেতে চায় না, শুধু ডালটা করবো, আর ভাত। ইচ্ছে হলে একটা সবজি করা যায়। ঘণ্টা দুয়েক পরে শুরু করলেই চলবে। সোফায় আধশোয়া হয়ে আনমনা লাগে। জামাল ফোন নম্বর দিলো কেন পত্রিকার লোককে? আরো কাউকে দিয়েছে নাকি কে জানে! সে কি চায় আমি গান করি আবার?
না জামাল, আমি আর ফিরবো না। যা বিসর্জন দিয়েছি, তাকে আর তুলে আনার দরকার নেই। কী হবে আর! বাংলা গানের পৃথিবী নীলাঞ্জনা সুলতানা বিহনে ওলট-পালট হয়ে যায়নি। আমি অসাধারণ কেউ ছিলাম না, গাইতে ভালো লাগতো। কারো ভালো লাগে জানলে অন্য এক ধরনের পরিতৃপ্তি বোধ করতাম। এই তো! আমার সেখানে না হয় কিছু ঘাটতি পড়বে, তাতে কার কী এসে গেলো!
(ক্রমশ)
মন্তব্য
ইচ্ছা করেই উপন্যাসটা পড়তে চাচ্ছিলাম না
কারণ বহুবার দৈনিকে ধারাবাহিক উপন্যাস পড়া শুরু করেও পরে খেই ঠিক রাখতে পারিনি
তাই ভাবছিলাম পুরোটা একসাথে পড়বো
কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন পড়ে ফেললাম আজ
ভাল্লাগলো
আমি বহু কষ্টে এখনো ব্রত ধরে রেখেছি। একবারে পড়বো। একবার এটায় ঢুকে গেলে আমার সিমেস্টার শেষ! "পড়ছি না" বলতে এসে দেখি আপনিও...
এই রে, এখন তো আর পড়বেন না। খেই হারিয়ে যাবে আবার। @ মাহবুব লীনেন। এই পড়াটা শেষ পর্বে যদি পড়তেন!
এতো অনিচ্ছুক পাঠক আছেন, কে জানতো! @ ইশতিয়াক রউফ।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
অদ্ভুত !
আমিও একটানাই উপন্যাসটা পড়তে চেয়েছিলাম।
কিন্তু লোভ সামলানো দায়, বিধায়...
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
লোভে পাপ ... ইত্যাদি ইত্যাদি
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
-
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
ভালো লাগছে। এই পর্বটা আরো ভালো লাগলো।
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
ভালো লাগাটা শেষ পর্যন্ত থাকলে হয়!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
পড়ছি।
eru
-------------------------------------------------
সুগন্ধ বিলোতে আপত্তি নেই আমার
বস্তুত সুগন্ধ মাত্রই ছড়াতে ভালবাসে।
পড়ছি...ভালো লাগছে......চলতে থাকুক...।
-নিরিবিলি
অনেক ধন্যবাদ ইমরুল কায়েস ও নিরিবিলি।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
ঝর ঝরা। পড়ে আরাম পাওয়া যায়। সময়ের সাথে সাথে প্রজন্ম প্রজন্মান্তরের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো উঠে আসবে আশাকরি। আগের পর্বগুলা পড়া হয় নি। এক বসায় পড়ে ফেলতে হবে।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
বোধহয় আমার ভবিষ্যতের মতো!
পড়ে ভালোমন্দ যা-ই লাগুক জানাতে ভুলবেন না।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
একদম সত্যি কথা। আজকের প্রচারের এই যুগে আমরা উল্টোটা দেখে এত অভ্যস্ত যে এটাকে ভুল ও মনে করি।
ভাল লাগছে।
নিজের ঢাক নিজে না পেটালে অন্যে পেটাবে না। এটা সেই যুগই তো! নীলা যে প্রচারের আলো চায় না, তারও নিশ্চয়ই কারণ আছে। সেই গল্প আসছে।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
এই নিয়ে তিন পর্ব পড়লাম। এমন ঝরঝরে লেখা, আসলেই পড়ার লোভ সামলানো দায়!
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
৬ পর্বের তিনটি পড়লেন। শূন্যস্থান পূরণ হবে কী করে?
তবু পড়লেন বলে অনেক ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
এ পর্ব বেশ গভীর মনে হলো।
অষ্টপ্রহর সম্পাদকের নাম 'সৈকত আহমেদ' পছন্দ হয়েছে খুব।
একটা নোট চিরকুটে রেখে যাই -
এ পর্বকে গত পর্বগুলোর সমান্তরাল সময়ে চিন্তা করলে, প্লুটোর বিলুপ্তি - মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতা'র যে সময় সেখানে -
একটু বেমানান মনে হয় কি? 'সন্ধ্যার কয়েক ঘন্টা' থেকে বিটিভি সম্ভবত: ৯৪/৯৫ সালেই বিস্তৃতি বাড়িয়েছে।
___
ভুল বললে সবিনয়ে ক্ষমাপ্রার্থী!
বিটিভি-র অনুষ্ঠানের সময়ের ব্যাপ্তি সম্পর্কে আমার অজ্ঞতা এই ভ্রান্তি ঘটিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। এই জায়গাটাও মেরামত করে দিলাম।
ভ্রান্তি নির্দেশ করার জন্যে অনেক ধন্যবাদ, শিমুল। এমন মনোযোগী পাঠক পাওয়া ভাগ্যের কথা।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
গৃহবধূর ছবিটা ভালো লেগেছে।
কালকের রান্না করা মাংস ফ্রিজে তোলা আছে, জামালের জন্যে ছোটো মাছের তরকারিও। মেয়ে ডাল ছাড়া ভাত খেতে চায় না, শুধু ডালটা করবো, আর ভাত। ইচ্ছে হলে একটা সবজি করা যায়।
দারুন
ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল
নতুন মন্তব্য করুন