উপন্যাস : যদি সে ভালো না বাসে – পর্ব ০৯

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি
লিখেছেন মুহম্মদ জুবায়ের (তারিখ: শনি, ১২/০৪/২০০৮ - ১০:৫১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৪.১ জামাল

আজ ছুটি নিয়েছি। পরশু সাজিদ তার আসার দিনতারিখ জানিয়েছে। আগেরবার ফোন করে তার আসার ইচ্ছে জানানোর পর কেন যেন খুব বিশ্বাস হয়নি। হতে পারে, বিশ্বাস করতে চাইনি। মনে মনে হয়তো চেয়েছিলাম, ঠিক এখনই সে না আসুক। তার জন্যে আমার টান-ভালোবাসা আছে, সব পিতার যেমন পুত্রের জন্যে থাকে। তবু ওর বোধবুদ্ধি হওয়ার বয়স থেকে তাকে আমার দেখা হয়নি। এখন এতোকাল পরে কাছাকাছি থাকার জন্যে সে বা আমি কতোটা তৈরি তা-ও ঠিক করে বলা যায় না। আর বাস্তব সমস্যা, এলে তাকে থাকতে দেবো কোথায়? ছেলে এসে আমার বাসায় উঠবে, তাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার জীবন খুব স্বাভাবিক জীবন নয়। নীলাকে এখনো বলা হয়নি।

হাতে আর দিন দশেক সময়। এর মধ্যে নীলার সঙ্গে কথা বলা দরকার। তার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, অনুমান করা খুব কঠিন নয়। বাসায় একজন বাড়তি মানুষের জায়গা করা দুষ্কর, তা-ও আবার সে যদি হয় তার ভূতপূর্ব অদেখা সতীনের ছেলে। মেয়ে বড়ো হচ্ছে, তাকে নিয়েও নীলার উদ্বেগ আছে। স্বাভাবিক। কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থাও আমার হাতে নেই। কীভাবে বলা যাবে, তা এখনো জানি না।

সকালে নাশতার টেবিলে বসে ঘোষণা দিই, আজ আমার ছুটি।

নীলা চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে এক পলক তাকায়। যেন বলতে চায়, কেন কী হলো? শরীর খারাপ নয় তো? কিছু বলে না, কেতলিতে পানি ভরছে, চা বসাবে। হয়তো প্রশ্নগুলো সে করতে চায়, হয়তো চায় না। কিন্তু আমার সেরকম ধারণা হয়।

তার হয়ে জিজ্ঞাসা করে নিশি। আশ্বস্ত করে বলি, না এমনিতেই। তুই বেরোবি কখন? আমি যাবো তোর সঙ্গে, ওদিকে আমার একটা কাজ আছে। অসুবিধা নেই তো?

অসুবিধা হবে কেন? যাবো আর আধ ঘণ্টার মধ্যে।

আসলে আমার বাইরে কাজ কিছু নেই। যেতে যেতে সাজিদ-সংকট নিয়ে নিশির সঙ্গে পরামর্শ করা। আগেও বাপ-মেয়েতে এরকম শলা-পরামর্শ হয়েছে। এইসবে নিশির মাথা খুব পরিষ্কার। সহজ কোনো একটা উপায় হয়তো আমি ভাবিইনি, সে চট করে বাতলে দিতে পারে।

মেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বার বার ঘড়ি দেখছিলো। বুঝলাম, তার দেরি হয়ে যাচ্ছে। রিকশার বদলে সিএনজি নিই। মেয়েকে আমার সংকটের বিবরণ জানাই। তাকে চিন্তিত লাগে। বলে, কতোদিনের জন্যে আসছে সাজিদ ভাইয়া?

ঠিক জানি না। বলছে তো অনেকদিন থাকবে। তেমন হলে থেকেও যেতে পারে।

নিশির মাথায় নতুন কিছু খেলে না। বলে, মা-র সঙ্গে কথা বলো। যা-ই করা হোক, তাকে ছাড়া তো হবে না।

তা আমার জানা। নিশিকে নামিয়ে দিয়ে শাহবাগ। কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি করে সিনোরিটায় চা নিয়ে বসি। কতোদিন পরে সিনোরিটায় আসা হলো। সন্ধ্যায় পুরনো দুয়েকজনকে হয়তো পাওয়া যায় এখনো। ঠিক জানি না। কারো সঙ্গেই আজকাল যোগাযোগ নেই।

চা শেষ হলে রাস্তায় নেমে হাঁটি। দিন দুয়েক আগেও বেশ ভ্যাপসা গরম গেছে, আজ একদম নেই। রোদ এখনো বেশি তেজি হয়ে ওঠেনি। হাঁটতে বেশ লাগছে। ডাক্তারের পরামর্শ, আর কিছু না হোক প্রতিদিন কিছু হাঁটাহাঁটি করা উচিত। সময় হয় কোথায়? আজ একটা সুযোগ হয়েছে, আবহাওয়াও অনুকুল, হেঁটে বাসায় যাওয়া যায়। বেশি দূরের পথ নয়, ভালো না লাগলে রিকশায় উঠে পড়া যাবে।

আচমকা মনে হয়, আচ্ছা রিনিকে ফোন করে কিছু একটা পরামর্শ চাওয়া যায়? তার বাপের বাড়িতে সাজিদের আপাতত ওঠার ব্যবস্থা করা গেলে কেমন হয়? একটু সময় পেলে একটা ব্যবস্থা করে নিতে পারবো। নাম্বার আছে, কিন্তু রিনিকে ফোন করা চলে না। সংকট আমার, তার নয়।

পঞ্চাশ বছর বয়সে পৌঁছে আমাকে জীবনের প্রথম চাকরির বাজারে নিজেকে প্রার্থী হিসেবে নামিয়ে দিতে হয়েছিলো। বছর পাঁচেক হয়ে গেলো। কঠিন কাজ। জানা ছিলো, তবে কতোটা কঠিন সে ধারণা তখনো হয়নি। চাকরির বাজারে বয়সে আটকায়। জীবনের সবকিছুতেই বয়স একটা বড়ো ভূমিকা নিয়ে থাকে তা টের পাই। কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ না করেও নির্বিঘ্নে বলে দেওয়া যায়, শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতাগুলো আগের জায়গায় আর নেই, সরে সরে যাচ্ছে। যারা চাকরি দেওয়ার অধিকারী, তারা হয়তো তা আগেভাগেই জানে, তাই বয়স নিয়ে সতর্কতা।

চাকরি করার সিদ্ধান্ত সহজ হয়নি। খুব প্রাচুর্য না হলেও এক ধরনের সচ্ছলতা ও স্বাচ্ছন্দ্য আমার জীবনে বরাবর ছিলো। কর্মজীবনে সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছিলো। সীমিত হলেও উচ্চতা আত্মবিশ্বাস দেয়। পতনের কথা কখনো ভাবা হয়নি। জীবন এইভাবেই চলবে ধরে নিয়ে নিশ্চিত হয়ে থাকা। ধস নামতে শুরু করলে গড়িয়ে পড়তে পড়তেও মনে হয়েছিলো, একটা কিছু হাতের নাগালে নিশ্চয়ই এসে যাবে। তখন আবার উঠে দাঁড়ানো সম্ভব হবে। হয়নি। নাগালে পাওয়া অবলম্বনগুলি আমার ভারের তুলনায় যথেষ্ট সমর্থ ছিলো না। গড়িয়ে নামতে নামতে কেটে যায় বছর দশেক।

একসময় বুঝি, যা খুঁজছি বা পাওয়া যাবে বলে আশা করছি তা আর আসবে না। দেরি হলে হয়েছে। উপযুক্তভাবে বাঁচার চেষ্টা ছাড়া মানুষের জীবনে আর বড়ো কোনো কাজ নেই। পঞ্চাশে পৌঁছে প্রথমবারের মতো মনে হলো, সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে।

একটা বয়সের পরে সরকারি চাকরিতে আর ঢোকা যায় না। শুনে এসেছি বৃটিশদের সময় থেকেই সরকারের চাকরির খুব কদর, স্কুলে ভর্তি করার সময় ছেলেমেয়েদের বয়স এক-দুই বছর কমিয়ে লেখা হতো। বাপ-মায়ের আশা, পাশ-টাশ করার পর ছেলে চাকরি পাওয়ার জন্যে হাতে কিছু বেশি সময় পাবে। হোক না তা কয়েক মাস বা এক বছর। কম কীসে? বৃটিশরা গেছে সেই কবে, পাকিস্তান গেলো তা-ও অনেকদিন, নিয়ম পাল্টায়নি। কিছু জিনিস হয়তো কোনোকালে বদলায় না। আমার সার্টিফিকেটে যে জন্মতারিখ লেখা তার সঙ্গে আসল জন্মদিনের পার্থক্য কয়েক মাসের। সরকারি চাকরিতে ঢোকার বয়স আমার কবে চলে গেছে। অথচ সরকারি অফিসে যা দেখেছি, তার অনেক কাজই আমার পক্ষে অনায়াসে করা সম্ভব। চেয়ারে বসা লোকগুলির চেয়ে আমার যোগ্যতা কিছু কম বলে মনে হয়নি।

তবু বয়স বড়ো ভার। জীবনে কখনো চাকরির ভাবনা ভাবতে হয়নি, এখন হচ্ছে। বেসরকারি চাকরির বিজ্ঞাপনেও সর্বোচ্চ বয়সসীমা, আমার তা-ও অতিক্রান্ত। পঞ্চাশ বা তদুর্ধ বয়সের কাউকে চাওয়া হয় বলে কোথাও দেখিনি।

আরো বিপদের কথা, আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা বলার মতো কিছু নয়। ঠেকেঠুকে বাণিজ্য বিভাগে কোনোমতে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলাম, তখন বয়স চব্বিশ। ইন্টারমিডিয়েটের পর কয়েক বছর কিছুই করিনি, তাই রে নাই রে না করে দিন কাটছিলো। বাপের তাড়া খেয়ে বি-কম দিলাম প্রাইভেটে। পাশ একটা দিতে হয়, তাই দেওয়া। কখনো সে বিদ্যা কাজে লাগেনি, দরকারও পড়েনি। আর এ দেশে পঠিত বিদ্যার সঙ্গে মিলিয়ে পেশা হয় ক'জনের? এককালের অনেক বন্ধুদের দেখি বায়োকেমিস্ট্রেতে বা বাংলা সাহিত্যে বা মাস্টার্স করে ব্যাংকের অফিসার হয়েছে, ইতিহাসের এমএ হয়েছে পল্লী বিদ্যুতায়নের চাকুরে, রসায়নের ছাত্র সংবাদপত্রের ক্রাইম রিপোর্টার।

আরেক দল আছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিলো বোধহয় এইসব মানুষের জন্যেই। ব্যাংকের কেরানি হওয়ার যোগ্যতা ছিলো না, এমন লোকও এখন ব্যাংকের মালিক। গোরুর হাটের ইজারাদার ইন্ডেন্টিং ব্যবসায় ফুলে ফেঁপে উঠলো, কয়েক বছরের ব্যবধানে।

মাঝে মাঝে ভাবি, করিৎকর্মা মানুষদের দলে আমি শামিল নই বলে অথবা টাকাপয়সা নিয়ে বিপর্যয়ের কারণে এইসব চিন্তা হয়তো আমার ঈর্ষা বা তিক্ততাপ্রসূত। অক্ষমের অভিমান হলেও হতে পারে। খুব ভেবে নিজের কাছে সর্বাংশে সৎ থেকে জানি, তা নয়। এটাই আসলে বাস্তবতা। শেষ কথা হয়তো এই, তাদের যোগ্যতা ছিলো, তারা পেরেছে। কীভাবে, ন্যায় না অন্যায় তা নিয়ে কে মাথা ঘামায়?

আমারও ভাবার দরকার নেই। কোথাও ঘাটতি ছিলো, তাই আমার হয়নি। জীবন ও বউ-বাচ্চা নিয়ে সংসার সচল রাখা এখন আমার একমাত্র কাজ। যতোটা ভালোভাবে সম্ভব। বাস্তবতা স্বীকার করে নেওয়া জীবনের খুব বড়ো শিক্ষা, অনেককিছু তখন সহজ হয়ে যায়।

(ক্রমশ)


মন্তব্য

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

হায়, জীবন!
তারপরে?

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

ক্রমশ প্রকাশ্য। হাসি

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

নিঘাত তিথি এর ছবি

সেই ব্রিটিশ আমলের বয়স কমিয়ে রেজিস্ট্রেশনের নিয়ম নিয়ে আজও আফসোস করছিলাম আমরা, যে কেন যে আমাদের বাবা-মায়েরা এটা করতেন। এক বন্ধু বলছিলো, এখানে অফিসে জন্মদিনে কেক নিয়ে যাবার নিয়ম। বেচারা তার অফিসিয়াল জন্মদিনে শুকনো মুখে কেক নিয়ে অফিসে যায়। আর নিজের জন্মদিনে কাউকে বলতেও পারে না।

এবং সেই চিরাচরিত সত্যি কথা, আমাদের দেশের শিক্ষাগত যোগ্যতার সাথে পেশাগুলো মেলে না...।
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আমার নিজের জন্মদিন নিয়েও এই গোলমাল। সার্টিফিকেট-পাসপোর্টের জন্মতারিখের সঙ্গে আসল জন্মতারিখ মেলে না। অফিসে ভুল জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়ে যখন সহকর্মীরা কেক কাটে, আমার অস্বস্তি হয়, হাসিও পায়। কী করে সত্যি কথাটা বলি, ব্যাখ্যা করি! ঘরে ছেলেমেয়েদের কাছে ভুল জন্মদিনের কারণ দর্শানোও দুরূহ।

পেশা বিষয়েও আমার একই অবস্থা। কী বিদ্যাশিক্ষা করলাম আর জীবিকা কী - মেলে না তো!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

আমারও ছয়মাসের গন্ডগোল ,,, জুনের ৩ হয়ে গেছে পরের বছরের জানুয়ারী ১ ,,, ভাগ্য ভালো জানুয়ারী ১,২,৩ এদেশে বন্ধ ,,, কলিগদের "হ্যাপিবার্থডে" শুনে চমকাতে হয়না চোখ টিপি

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আপনি তাহলে আমার রাশির মানুষ, অথবা আমি আপনার। রাশি-টাশিতে অবশ্য বিশ্বাস নেই, তবে েউ সেসব নিযে বকবক করলে শুনতে মজাই লাগে।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

এই পর্বে তেমন কিছু পেলাম না।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।