উপন্যাস : যদি সে ভালো না বাসে – পর্ব ১০

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি
লিখেছেন মুহম্মদ জুবায়ের (তারিখ: রবি, ১৩/০৪/২০০৮ - ১১:৩৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৪.২ জামাল

অবস্থা বুঝে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া বিদ্যার হাতেখড়ি আমার বাল্যকালেই হয়েছিলো। নিজের ইচ্ছায়, তা বলতে পারি না। আমার বাবা ফজলুর রহমান বড়ো চাকুরে ছিলেন। একটা আন্তর্জাতিক সংস্থার হয়ে জীবনের বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরে কাজ করেছেন, দেশে-বিদেশে প্রভাব-প্রতিপত্তিশালীদের সঙ্গে বিস্তর ওঠাবসা। অথচ গ্রামের বাড়িতে গেলে তিনি সেই পুরনো ফজলা। বিদ্যা-বুদ্ধি, অর্থ, পরিচিতি সব বিষয়ে গ্রামের মুরুব্বি বা বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর কোনো তুলনা চলে না। ফজলা তখনো পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে টুয়েনটি নাইন খেলতে বসে যাচ্ছেন, খেয়াজাল নিয়ে মাছ ধরতে নামছেন। কোনো গোলমালে-সংকটে সাধ্যমতো পরামর্শ দিচ্ছেন। কারো মেয়ের বিয়েতে টাকার জোগাড় হয়নি তো ফজলা আছে কী করতে? কারো ছেলের বিয়েতে তিনি বরযাত্রী, গোরুর গাড়িতে খড়ের ওপর কাঁথা বিছিয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে নিলেন। গ্রামে এসে বন্ধুর মৃত্যুর খবর পেয়েছেন, বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে তার বউ-ছেলেমেয়ের সঙ্গে বসে কাঁদলেন।

এইসবের মধ্যে তাঁর কোনো ভাণ ছিলো বলে কখনো মনে হয়নি, হৃদয়বান মানুষ তিনি। বলতেন, একদিন বন্ধু তো চিরদিনের বন্ধু।

তবু একটা বিষয়ে তিনি নিজের তৈরি নিয়ম ভেঙে ফেললেন। বোঝা গেলো, স্ত্রী চিরদিনের না-ও হতে পারে। কে জানে বন্ধু আর বউ হয়তো এক সমতলে বসে না।

আমার মা জমিলা বেগম পুরোদস্তুর গ্রামের মেয়ে। যৎসামান্য লেখাপড়া গ্রামের পাঠশালায়। গাঁয়ের ছেলে ফজলার সঙ্গে তার বিয়ে হলো তেরো বছর বয়সে। ফজলা তখন শহরে বিএ ক্লাসের ছাত্র, বিয়ে করেই চলে গেছেন শহরে, আরো বিদ্যা অর্জন করতে। মায়ের নতুন বসত শ্বশুরবাড়িতে হলেও পশ্চিম পাড়ায় বাপের বাড়িতে নিত্যদিনের যাওয়া-আসা। বুঝতে শেখার বয়স হলে মাকে বলতে শুনেছি, কপাল ভালো হামার ভিন গাঁয়োত বিয়া হয়নি। হলে না জানি কী হলো হিনি।

বাবা ছুটিছাটার সময় গ্রামে আসতেন। এমনিতেও মাঝে মাঝে হঠাৎ দু'একদিনের জন্যে আসতেন শুনেছি, সেসব আমার জন্মের আগের কথা। কলেজ পাশ হয়ে গেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলেন বাবা, এই সময়ে মায়ের কোলে আমার অবতরণ। ভালো ছাত্র ছিলেন বাবা, যথাসময়ে ভালোভাবে পাশ করে জীবনের প্রথম চাকরি হলো সরকারের সমাজকল্যাণ দপ্তরে, তিনি ঢাকায় গেলেন। মাস কয়েকের মধ্যে বাসাবাড়ি ঠিক করে আমাদের নিতে এলেন।

মাকে বললেন, দুই ঘরের বাসা নিয়েছি, রান্নাঘর আলাদা। তোমার সংসার এখন তুমি গুছিয়ে নাও। একটা খাট ছাড়া আর তেমন কিছু কিনিনি, তোমার পছন্দমতো কিনবো।

বাবা বিস্মিত হয়ে জানলেন, মা যেতে চায় না। শহর সম্পর্কে তার এক ধরনের ভীতিই ছিলো বলা যায়। বাপ-মা বিয়ে দিয়েছে, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা সেখানে কিছু ছিলো না। তখন শহরে যাওয়ার কথা তো হয়নি। বাবা নিশ্চয়ই বলেছিলেন শহরে সংসার করার কথা, খুব একটা বিশ্বাস হয়তো হয়নি। সত্যি সত্যি সময় এসে গেলে তার বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায়। কী করে মানুষ শহরে থাকে? সেখানে আত্মীয়-পরিজন বলতে কেউ নেই, চেনাজানা রাস্তাঘাট নেই একা একা ইচ্ছেমতো ঘোরার। কোথায় পুকুরের ঘাটলা, তেঁতুলতলার ছায়া? স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসার করা দরকার ঠিকই, সকাল-বিকাল বাপের বাড়ি একবার ঘুরে আসা কম জরুরি? বাপ-মায়ের একমাত্র সন্তান জমিলা বেগম। বললো, হামি গেলে বাপ-মাওক কে দেখপে?

বাবা বললেন, তা বুঝলাম। কিন্তু আমাকে দেখে কে? আমার কী হবে? ছেলের লেখাপড়া?

প্রথম দুটো প্রশ্নের উত্তরে হয়তো কিছু বলার ছিলো না, শেষেরটার উত্তর দিতে সক্ষম হয় মা, গাঁয়োত ইসকুল আছে।

তা আছে। কিন্তু ওকে আমি শহরে নিয়ে পড়াতে চাই। শহরে আমার নিজের কেউ ছিলো না বলে গাঁয়ের স্কুলে পড়েছি। ওর বাবা শহরে আছে, ও এখানে পড়বে কেন?

মা নিরুত্তর। মুখ নিচু করে ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে মাটি খোঁটে। পারলে ওই কায়দায় বড়োসড়ো একটা গর্ত খুঁড়ে তার ভেতরে লুকিয়ে পড়ে।

বাবা বুঝিয়ে বলেন, ছুটিছাটায় আসবো আমরা। এটা আমারও গ্রাম, আসতে তো হবেই।

মা যেন ঠিক করেই রেখেছে, কোনো কথা কানে তুলবে না। উত্তরও দেবে না। পিঠে হাত বুলিয়ে বাবা বোঝায়, সে বুঝবে না। সামান্য কড়া কথা বললে কেঁদে দেয়। বাবা শেষমেশ বলেন, এবার তাহলে শহরে গিয়ে আরেকটা বিয়ে করে ছেলেকে নিয়ে যাবো। ওকে গাঁয়ে মানুষ করতে চাই না।

মা তখন কেঁদে বুক ভাসায়, ছাওয়াল তো হামার!

বাবার ছুটি শেষ হলেও মীমাংসা হয় না। নিরাশ হয়ে বাবা ফিরে চলে গেলেন। আসা-যাওয়া কমতে লাগলো। রাজশাহী তবু কাছের শহর ছিলো, ঢাকা আরো দূরের পথ। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে রোজা-পূজা-ঈদ-পরবের লম্বা ছুটি থাকে। গরমকালে আম-কাঁঠালের ছুটি। কিন্তু চাকরিতে সারা বছরে হাতে গোনা ছুটি, যখন-তখন নেওয়াও যায় না। উপায় কী?

এগুলো সব মায়ের কাছে শোনা, আমার মনে থাকার কথা নয়।

বাবা আরেকবার বিয়ের কথা হয়তো বলেছিলেন কৌশল হিসেবে। মায়ের ওপর চাপ দেওয়ার জন্যে। আমার তাই মনে হয়। তবে দ্বিতীয় বিয়ে তিনি করলেন আরো পাঁচ বছর পরে, চাকরি নিয়ে বিদেশে যাওয়ার আগে আগে। কাউকে কিছু আগে জানাননি। খবর না দিয়ে হঠাৎ একদিন গ্রামে এসে উপস্থিত। দাদা তখনো বেঁচে, নিজের মুখেই তাঁকে জানালেন বাবা। দাদা মনে হয় পছন্দ করেননি। বলেছিলেন, ব্যাটা ছাওয়াল, সাহস কর্যাখে বিয়া করবার পারলেন, বউ সাথে আনলে হলো হিনি।

মায়ের কাছে এসে বাবা বললেন, আমার আর কী করার ছিলো? গাঁয়ে বউ-ছেলে থাকবে, শহরে আমি একা পড়ে থাকবো, এইভাবে হয় না। তোমাদের জোর করে নিজের কাছে নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু জবরদস্তি করা আমার স্বভাব নয়। এতো বছর অপেক্ষা করেও তোমার সঙ্গে সংসার করা হলো না। তোমাকে দোষ দিই না, আমারই ভুল। আমি তখন রাজি না হলে বিয়েটা হতো না। অনেকদিনের জন্যে বিদেশে চলে যাচ্ছি বলে এখন বিয়ে না করে আর উপায় ছিলো না। দেশের মধ্যে ঢাকা শহরেই তোমাকে কখনো নিয়ে যেতে পারলাম না, বিদেশে যাওয়ার কথা তুমি হয়তো স্বপ্নেও ভাবো না।

(ক্রমশ)


মন্তব্য

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

এবার গতি একটু মন্থর হয়ে যাচ্ছে।
নাকি, আমি প্রতিদিনেরটা প্রতিদিন পড়ছি বলে এমন মনে হচ্ছে!

চলুক ।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

এখন উপায়? চিন্তিত

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আসাদুজ্জামান রুমন এর ছবি

কী আবার, 'চাকা'।

পড়ছিঃ ক্রমশ-

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

চাক্কা জ্যাম হৈলে? চোখ টিপি

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

নিঘাত তিথি এর ছবি

হুমম।
জামালের মায়ের মনোভাব পড়ে হাসছিলাম খুব। আহারে সরল গ্রাম্য বালিকা!
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

গ্রামের বালিকাটির সরলতায় হাসে এক শহুরে বালিকা! দেঁতো হাসি

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

জামালের মা'র মতো মানুষ কি আসলেই আছে?
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

চরিত্রটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক নয়। হাসি

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

আচ্ছা...

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অমিত আহমেদ এর ছবি

জামালের বাবার গল্প আসবে অনুমান করেছিলাম।


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।