উপন্যাস : যদি সে ভালো না বাসে – পর্ব ১৪

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি
লিখেছেন মুহম্মদ জুবায়ের (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৭/০৪/২০০৮ - ৯:৩৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৪.৫ জামাল

বাবা আমার বন্ধুদের সঙ্গে নিজে কথা বলে সন্তুষ্ট হয়ে অনুমোদন দিলেন। প্রতিশ্রুতিমতো পুঁজির টাকাও। একই সঙ্গে অপ্রত্যাশিতভাবে জানালেন, মগবাজারের বাড়িটি আমাকে লিখে দেওয়া হয়েছে। তাঁর ইচ্ছে রিনি এবং আমি আলাদা সংসার শুরু করি অবিলম্বে।

ভাড়াটেদের নোটিস দেওয়া হয়েছে, বাড়ি খালি হয়ে যাবে এ মাসের মধ্যেই। কারণ জানা গেলো, বাবাকে আগামী মাসে আবার দেশের বাইরে যেতে হচ্ছে কয়েক বছরের জন্যে। ধানমণ্ডির বাড়িটি দু'জন মাত্র মানুষের জন্যে বেশি রকমের বড়ো, তা আমাদের স্বস্তির চেয়ে অসুবিধার কারণই বেশি হবে। এই বাড়ি ভাড়া দিয়ে রাখা হবে। বাবা দেশে ফিরলে তখন ভাড়াটে তুলে দিয়ে নিজেরা বসবাস করবেন।

পর পর কয়েকটা বড়ো ঘটনা ঘটে। প্রেসের জন্যে ব্যাংকঋণের অনুমোদন পাওয়া গেলে আমার সম্ভাব্য পেশা ও পরিচয়ের ব্যবস্থা মোটামুটি একটা চেহারা নিতে শুরু করে। বাবা সপরিবারে নতুন কর্মস্থলে চলে গেলেন।

যাওয়ার আগে অতিরিক্ত কিছু টাকার চেক ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ব্যবসার রোজগার ঘরে আসতে অন্তত বছরখানেক তো লাগবেই, ততোদিন তোদের সংসার খরচের জন্যে।

বাবা সবদিকে এতো খেয়াল রাখেন কী করে কে জানে! মানুষটাকে আমার ঠিক বোঝা হলো না। কখনো এতো কাছের লাগে, আবার কখনো খুব দূরবর্তী ও আপাত-উদাসীন।

ধানমণ্ডির বাড়ির আসবাব তুলে এনে মগবাজারের বাড়ি সাজানো হয়। দরকারের অতিরিক্ত অনেক জিনিসে আমাদের ঘর ঠাসাঠাসি। দোতলা হলেও এই বাড়ি অতো বিশাল ও প্রশস্ত নয়। ওপরে দুই বাথরুম ও আলাদা আলাদা ব্যালকনিসহ দুটি বেডরুম, নিচে একটি বেড ও বাথ, কিচেন, ড্রইংরুম। কোণে ছোটো স্টাডিরুম।

রিনির সঙ্গে সত্যিকারের যৌথজীবন শুরু হতে না হতেই বাড়িতে আরেকজন আসছে জানা যায়। পারুল শুধাইল কে তুমি গো, অজানা কাননের মায়ামৃগ।

আমি জিজ্ঞেস করি, কবে জানলে?

বাবারা যাওয়ার আগে আগে। ইচ্ছে করে তখন বলিনি।

কেন? বললে কী হতো?

রিনি বলে, কেমন করে বলতে হয় তাই তো জানি না। লজ্জাও করছিলো।

লজ্জার করবে কেন? কী করতে কী হয়ে গেলো তাই?

নষ্টের গোড়া তুমি। বলে হাসি চাপে রিনি।

অজান্তে রিনি একটা সত্যি কথা বলে ফেলেছিলো। আমি নিজে তখন জানতাম না, জানলে স্বীকার করাও সহজ ছিলো না। আমিই নষ্টের গোড়া। রিনি জানে না, তার কাছে সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত আর নই আমি।

শুরুটা কেন কীভাবে হয়েছিলো, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। টাকা দিয়ে মেয়েমানুষের শরীর কেনার রুচি আমার ছিলো না, কিন্তু কিছু কৌশলী হতে জানলে কোনো নারীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা কঠিন কাজ নয় বলে আমার ধারণা জন্মে। কৌশলগুলি আমার আয়ত্বে আসতে থাকে, শিকার-পদ্ধতিতে নৈপুণ্য বাড়ে। অন্য নারীতে আসক্তি মানেই যে রিনির জন্যে ভালোবাসা না-থাকা, তা আমার কখনো মনে হয়নি। দুটোই সমান সত্য। আমার কাছে তখন তা ছিলো শুধুই অ্যাডভেঞ্চার, আরো দখল করতে পারার উল্লাস-উৎসব। মনে হয়, আমিও নিতে জানি, জয় করে নিতে পারি। আমি উপেক্ষিত, আড়ালে পরগাছা হয়ে বেড়ে ওঠা নিঃসঙ্গ ও আত্মবিশ্বাসহীন এক কিশোর আর নই। একজন সম্পূর্ণ পুরুষ। যুদ্ধকালে অন্ধকার এক রাতের সেই রহস্যময়ীর কোনো ভূমিকা ছিলো নাকি? হয়তো ছিলো, আমি জানি না।

বিষয়টা প্রথম আঁচ করে আশরাফ। ততোদিনে সাজিদ জন্মেছে। নাতির জন্মের পর রিনির বাবা-মা পুরনো অভিমান তুলে নিয়েছেন। ছেলে এবং বাপমায়ের সঙ্গে মেরামত হওয়া সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়ে রিনির সময় কাটে। প্রেস চালু হয়ে গেছে, আমার ব্যস্ততা বেড়েছে। এক সন্ধ্যায় প্রেসের অফিসঘরে বসে আশরাফের সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছি। আড্ডায় মন ছিলো না। কিছু আগে আমার নতুনতম বান্ধবী ফোন করে যেতে বলেছে, আমি উসখুস করছিলাম।

আশরাফ বলে, তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করে ফেলছিস জামাল। জানাজানি হলে খবর আছে। এর মধ্যে বাহাদুরির কিছু নেই। বউয়ের কাছে, প্রেমিকার কাছে অবিশ্বস্ত হতে যে কেউ পারে, তার জন্যে প্রতিভার দরকার হয় না। শুধু লাগে সামান্য সাহস আর নির্লজ্জ হওয়ার ক্ষমতা।

আশরাফ কিছু গম্ভীর ও নীতিবাগীশ ধরনের, তা আমরা সবাই জানি। তবে তাকে সমীহ না করাও সম্ভব হয় না। প্রসঙ্গ হালকা করার জন্যে বলি, বাদ দে, সিরিয়াস কিছু না।

তা বুঝলাম, কিন্তু যা করে বেড়াচ্ছিস তার কোনো মানেও হয় না।

নিজের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করিয়ে বলি, আমি রিনিকে অবহেলা করছি না, তাকে আমার জীবন থেকে বাদ দেওয়ার কথাও ভাবি না।

চশমার কাচের পেছন থেকে চোখ দুটি তীক্ষ্ণ করে আমার চোখে তাকায় আশরাফ। বলে, বন্ধু হিসেবে বলি, অন্য কেউ হলে আমার কিছু এসে যায় না। ভেবে দেখেছিস, পৃথিবীর অন্যসব প্রাণীর সঙ্গে মানুষের পার্থক্য কোথায়?

তাদের কোনো ধর্মগ্রন্থ নেই, নীতিশাস্ত্র নেই। এই বলবি তো?

যদি বলি তাহলে কি সেটা খুব ভুল হবে? ধর্ম-অধর্মের কথা তুলছি না। নীতিশাস্ত্রও বাদ দে। কিন্তু কিছু আচার-আচরণের সাধারণ নিয়ম-কানুন মানুষ তৈরি করে নিয়েছে, অন্য কোনো প্রাণীর সেসব দায় নেই। ভালোবাসার মানুষের কাছে বিশ্বস্ত থাকা কিন্তু সেই নিয়মের মধ্যেই পড়ে। ভেবে দেখ, তোর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক, তারও কিছু শর্ত আছে, নিয়ম আছে। এক ব্যবসার অংশীদার হিসেবেও কথাটা সত্যি।

আশরাফের যুক্তি ও ব্যাখ্যা মানতে অসুবিধা হয় না, মান্য করা অবশ্য অন্য কথা। আমার ভেতরের অসহায় অপূর্ণ জামালকে সে চেনে না, চেনার কথা নয়। আমি নিজে পুরোপুরি জানি? ঘরের বাইরে এই নারীসংসর্গ জীবনভর ভালোবাসার কাঙাল আমার বুভুক্ষু না-পাওয়াগুলিকে পরিশোধ করছিলো কি না জানি না। কোনো অন্যায় করছি বলে মনে হয়নি। আশরাফের সতর্কসংকেত অনায়াসে উপেক্ষা করি। যুক্তির চেয়ে নগদ প্রাপ্তির লোভ অনেক বড়ো।

একদিন দুপুরে অফিসে বসে আছি, আচমকা বাবার ফোন।

যা শুনছি তা কি সত্যি?

কী শুনেছেন?

সাজিদকে নিয়ে রিনি বাপের বাড়ি চলে গেছে এবং আর ফিরবে না বলে জানিয়েছে।

বিস্ময় নিয়ে বলি, সে বাপের বাড়ি গেছে তা ঠিক। কিন্তু আসবে না তেমন কিছু তো আমি জানি না।

আমাকে আর তোমার ছোটো মাকে চিঠি লিখে জানিয়েছে সে। আশা করি তুমি কারণটা জানো।

বাবা জীবনের প্রথম আমাকে তুই ছেড়ে তুমি বলছেন। তাঁর অসন্তোষ খুব পরিষ্কার। কী বলা যায় বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকি।

বাবা বলেন, ওই চিঠির জবাব আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়, রিনি অবশ্য জবাব আশা করছে বলেও মনে হয় না। সে নালিশ করেনি, আমাদের সালিশও মানেনি। শুধু তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে লিখেছে, আমরা যেন তাকে ভুল না বুঝি। যা লিখেছে, তাকে দোষ দিতে পারি না।

সাজিদের তখনো চার বছর হয়নি। এক ছাদের নিচে বাস করে গোপন বেশিদিন গোপন রাখা যায় না, প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। রিনি কিছু একটা ঘটছে অনুমান করেছিলো বলে ধারণা করছিলাম, আমার দুয়েকজন বন্ধুর সহযোগিতায় তথ্য-প্রমাণ-সাক্ষ্য উদ্ধারও তার পক্ষে কঠিন হয়নি।

আশ্চর্য লাগে, রিনি আমাকে বিন্দুবিসর্গ কিছু জানায়নি। বাপের বাড়িতে গেছে দিনকয়েক আগে, অল্প কয়েকদিন থাকার মতো প্রস্তুতি নিয়ে, বরাবর যেমন যায়। গতকাল ফোনে যথারীতি ছেলের সঙ্গে কথা হলো, রিনির সঙ্গেও। কোনো আভাস ছিলো না। যাওয়ার আগে-পরে ঝগড়াঝাটি, কথা কাটাকাটি নয়। সুতরাং রিনি যে ভেবেচিন্তে আর ফিরবে না বলে স্থির করে গেছে তাতে কোনো সন্দেহ থাকে না। প্রশ্ন বা অভিযোগ করলে আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ থাকে, রিনি সে সুযোগও দিচ্ছে না। দেবে না। অবশ্য আত্মপক্ষ সমর্থন করার কিছু নেই, স্বীকারোক্তি দেওয়া যেতে পারে। তা করতে না হলেই ভালো। স্বস্তিকর নয়।

(ক্রমশ)


মন্তব্য

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

"যুক্তির চেয়ে নগদ প্রাপ্তির লোভ অনেক বড়ো।" -- এইটাই হয়তো মেরে দেয় ,,,, এটা থেকেই হয়ত কথা আর কাজের ফারাক তৈরী হয় মন খারাপ
গল্প চলুক শিনকানসেনের বেগে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

একটা প্রশ্ন: আপনার বই কবে দেখতে পাবো?

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

যখন বড়ো হবো ... ! চোখ টিপি

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- তখন আমাদের জন্য কি কয়েকলট ডাইরেক্ট HHL (হেইল কুরিয়ার সার্ভিস) সার্ভিসে পাঠিয়ে দিবেন?
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

কী আশ্চর্য, আমি পাঠাবো কেন? কিনবেন না? চিন্তিত

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

এ পর্ব অনেক গভীর মনে হলো। মানবিক সম্পর্কের জটিলতা উঠে এসেছে। পাঠক হিসেবে প্রত্যাশা করি - আরো আসুক, আরও।

বউয়ের কাছে, প্রেমিকার কাছে অবিশ্বস্ত হতে যে কেউ পারে, তার জন্যে প্রতিভার দরকার হয় না। শুধু লাগে সামান্য সাহস আর নির্লজ্জ হওয়ার ক্ষমতা।

ভালো লাগা একটি লাইন হয়ে থাকলো ।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

দারুণ গতিশীল !
রিনির চরিত্র ভালো লাগছে।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।