উপন্যাস : যদি সে ভালো না বাসে – পর্ব ১৬

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি
লিখেছেন মুহম্মদ জুবায়ের (তারিখ: শনি, ১৯/০৪/২০০৮ - ১০:২৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৪.৭ জামাল

আমার দুর্বলতার জায়গাগুলি নীলা ঠিক জানে এবং সেই ক্ষতগুলিকে সে শুকাতে দেয় না। কর্মস্থলে আমার দুর্ভাগ্য ও টাকাপয়সার বিপর্যয়। এককালের সচ্ছল জীবনের জায়গায় আজকের অকিঞ্চিৎকর জীবনের গ্লানি এবং তার সম্পূর্ণ দায় যে আমার, তা আমার চেয়ে বেশি আর কে জানে? নীলার মুখে আমার অক্ষমতার কথা শোনার কষ্ট আলাদা। রিনির সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ ও তার পেছনের কাহিনীও চলে আসে। হয়তো প্রতিশোধ। রিনি সম্পর্কে নীলার কোনো ঈর্ষা আছে বলে মনে হয় না। থাকার কারণও নেই। সাজিদের সঙ্গে তার বার দুয়েক দেখা হয়েছে সে ঢাকায় এলে। নীলা তার সঙ্গে যথেষ্ট সহজ ছিলো। সাজিদ জিজ্ঞেস করেছিলো, আচ্ছা তোমাকে আমি কী বলে ডাকবো?

নীলা হেসে ফেলেছিলো। কী বলে ডাকতে ইচ্ছে করে তোমার?

তা তো জানি না।

নীলা তখনো হাসছে, তোমার মাকে জিজ্ঞেস করলে পারতে।

আগে ভাবিনি।

তাহলে আমিই না হয় ঠিক করে দিই। আমাকে তুমি ছোটো-মা বলবে।

সাজিদ মৃদু হেসে ঘাড় নাড়ে, বাবার মতো?

আমার সঙ্গে বাবার এবং সাজিদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক একই সমান্তরাল, ছোটো মা-র সঙ্গে আমার এবং সাজিদের সঙ্গে নীলার। আশ্চর্য হয়ে ভাবছিলাম, আগে কখনো খেয়াল করিনি, সাজিদ করেছে। এর নাম জীবনপ্রবাহ? পরম্পরা?

পরশু সাজিদ ফোন করে আসার খবর জানানোর পর একটা কথা আচমকা জিজ্ঞেস করেছিলো, বাবা আমি যে আসছি তোমার আপত্তি নেই তো?

আমার আপত্তি থাকবে কেন?

সেরকম আপত্তির কথা বলতে চাইনি। এবার তো ঠিক বেড়াতে আসা নয়। বলতে গেলে তোমার সঙ্গে আমার নতুন করে পরিচয় হবে, সম্পর্ক গড়তে হবে, একটা বোঝাপড়া দরকার হবে। তুমি যে সাজিদকে দেখেছো, সে আর সেই ছোটোবেলার সাজিদ নয়। আর যে বাবাকে আমি চিনতাম, তুমিও সেই বাবা নও। আমাদের জীবন পাল্টে গেছে। আসলে ভাবছিলাম, তোমার সঙ্গে সেই বোঝাপড়াটা হবে তো? আমরা পরস্পরকে সহ্য করতে পারবো কি না, ভালোবাসতে পারবো কিনা তাই ভাবি।

পূর্ণবয়স্ক পুরুষের মতো কথা বলে সাজিদ। সত্যিই তো, এই সাজিদকে আমি কতোটুকু জানি? সে-ই বা আমাকে কতোটুকু বুঝবে? যখন আমরা বিচ্ছিন্ন হয়েছিলাম, তখন সে শিশু। আজ এতো বছর পরে পুনর্মিলনের সময় সে যদি কৈফিয়ত দাবি করে বসে, কোন দোষে ওই বয়সে প্রিয় পিতার সঙ্গ থেকে তাকে বঞ্চিত হতে হয়েছিলো? কী জবাব আছে আমার? যদি থাকে এবং খুব যুক্তিসঙ্গতও হয়, সাজিদ তা মানবে কেন? তার বা আমার এই অনিশ্চয়তার বোধের মধ্যে খুব পার্থক্য নেই।

একটা সময়ে সংকটে পড়লে মনে হতো, উপায় একটা হয়ে যাবে। কোনোকিছু আটকে থাকে না। আমার সেই বিশ্বাস আর নেই, বয়স ও অভিজ্ঞতায় তা জীর্ণ-মলিন, টুটা-ফাটা। যে কোনো সংকটকেই অনেক বড়ো ও অলঙ্ঘনীয় লাগে। তবু যা অনিবার্য তার মুখোমুখি হতে হয়, না হয়ে উপায় থাকে না।

এইসময় বাবা দেশে থাকলেও একটা ব্যবস্থা সহজেই হতে পারতো। দাদার বাসায় উঠতে সাজিদের অসুবিধা হতো না। কিন্তু অবসরের পরে বাবা এখন চুক্তিতে একটা কনসালটিং-এর কাজ করছেন থাইল্যান্ডে। ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা শেষ করে চাকরি-বাকরিতে ঢুকে গেছে, সুখী আমেরিকায়, সুমন অস্ট্রেলিয়ায়। বাবার কনসালটিং-এর মেয়াদ শেষ হতে আরো বছরখানেক, তারপর স্থায়ীভাবে দেশে ফেরার ইচ্ছে। তাতে সাজিদকে নিয়ে আমার এখনকার সংকটের কোনো সুরাহা হচ্ছে না।

বাসায় ফিরে দেখি, নীলা রান্নাঘরে বাজারের ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বের করছে। ঋষিকে স্কুলে নামিয়ে বাজার সেরে ফিরেছে। বাসায় আছি, বাজারটা আজ আমিই করতে পারতাম। সওদাপাতি গুছিয়ে নীলা মাছ কাটতে বসে যায়। ইলিশ আমার পছন্দের মাছ, আমি বাসায় আছি বলে এনেছে? ঘরে যাই। কাপড় বদলে বসার ঘরে সোফায় বসি। উঠে আবার রান্নাঘরে। অস্থির লাগে। কীভাবে কথা শুরু করা যায়?

নীলা চোখ না তুলেই জিজ্ঞেস করে, কিছু বলবে?

টের পায় কী করে? বলি, হ্যাঁ। একটু কথা ছিলো।

তুমি ওদিকে গিয়ে বসো, মাছ কোটা শেষ করে আসছি।

শোয়ার ঘরে বিছানায় গা এলিয়ে দিই। বাসায় দুইজনে সম্পূর্ণ একা। কতোদিন পরে। কোনো একটা বাসনা জেগে উঠতে চায়। কিন্তু সাজিদ আমার মাথার পুরো দখল নিয়ে বসে আছে।

নীলা এক কাপ চা নিয়ে ঘরে আসে। চা দিতে বলেছিলাম নাকি? মনে পড়ছে না। উঠে বসি। বেডসাইড টেবিলে কাপ নামিয়ে রেখে নীলা বলে, কী বলবে বলো।

আচমকা তার হাত ধরি। টেনে পাশে বসিয়ে চুমু খাই। নীলার হাত আমার কাঁধের ওপর উঠে আসে। আমার দুই হাত ব্যস্ত হয়ে ওঠার সময় পায় না। উঠে দাঁড়িয়েছে নীলা।

আমার সারা গায়ে মাছের গন্ধ। তুমি চা শেষ করো, আমি চট করে গোসল সেরে নিই।

একটু দূরত্বে, হয়তো নিরাপদ দূরত্বে, দাঁড়িয়ে শরীর থেকে শাড়ি নামিয়ে ফেলে নীলা। তার মুখে মৃদু হাসি, কিছু রহস্যমাখা। হয়তো ততো রহস্যময়ও নয়, এই ঠোঁটচাপা হাসি আমার চেনা। পরণের অবশিষ্ট সব বস্ত্র ও বস্ত্রখণ্ড একে একে তার পায়ের কাছে মেঝেতে জায়গা পায়। চোখভরা তৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে আমিও হাসি, হাত তুলে ইশারায় কাছে আসতে বলি। হাস্যে-লাস্যে মাথা ঝাঁকায় সে, চকিত পায়ে বাথরুমে অন্তর্হিত হয়। প্রায় বিশ বছরের পুরনো স্ত্রীকে এখন আবার বউ-বউ লাগে।

ধুলিমলিন জীবনের ক্লিন্নতা তবু ভোলা হয় না। এই আমার সংকটের সমাধান? হয়তো। হয়তো নয়। কে জানে!

(ক্রমশ)


মন্তব্য

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

চারদেয়ালে জীবন খোঁজে সংসারী মানুষ।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

পড়ছি ।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।