ঢাকায় আমার কিছু প্রতিভাবান বন্ধু আছেন। এঁরা কোনো বিখ্যাত সেলিব্রিটি নন, কিন্তু এঁদের বিস্ময়কর উদ্ভাবনী প্রতিভায় আমি বরাবর মুগ্ধ কখনো কখনো ভুক্তভাগী। ২০০৬ সালে রমজান মাস শুরু হবো-হবো, ঢাকায় পত্রিকাগুলির ঈদসংখ্যার প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে, দুয়েকটা এমনকি বাজারে এসেও গেছে। এইসময় ঢাকা থেকে এক বন্ধু (ইনি প্রতিভাবান নন) ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি নাকি অমুক পত্রিকায় উপন্যাস লিখছো?
বিস্মিত না হয়ে উপায় কী! প্রথমত, ঐ অমুক পত্রিকাটির নাম শুনেছি, চোখে দেখিনি। তবে আমাদের এক বন্ধু (যাঁর প্রতিভার আগুনে আমি দগ্ধ হবো অচিরে) সে পত্রিকায় খণ্ডকালীন কাজ করেন জানি। কিন্তু ঐ কাগজে ঈদসংখ্যা দূরে থাক, এমনিতেও লেখালেখি বিষয়ে আমার বন্ধুর সঙ্গে কখনো কথা হয়নি। সুতরাং আমি উপন্যাস লিখছি? কই, জানি না তো! ছাড়া অন্য কোনো কথা মুখে আসে না।
ফোনের অন্য প্রান্তে বন্ধুটি ধন্দে পড়ে, আমি হলেও পড়তাম। বস্তুত, ধন্দে আমি ততোক্ষণে পড়ে গেছি। কথাটা এলো কোত্থেকে? সেই অমুক কাগজের খণ্ডকালীন কর্মী আমার বন্ধুকে ফোনে ধরি অনেক কষ্টে। তিনি একটি মোবাইল ফোন বহন করেন বটে, তবে প্রায়ই তার উপস্থিতি ভুলে যান অথবা রিং এলে না-ধরলে-কী-হয় জাতীয় দার্শনিকতায় উপেক্ষা করতে পারেন। দয়াপরবশ হয়ে যখন তিনি ফোনে হ্যালো বললেন এবং ঘটনার বিবরণ দিলেন, আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হওয়ার অবস্থা। আমার সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ না করে তিনি তাঁর সম্পাদককে জানিয়ে দিয়েছেন, আমার কাছ থেকে তিনি একটি উপন্যাসের প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন এবং লেখাটি এই এলো বলে!
তার চেয়েও ভয়ংকর কথা, সম্পাদকের কাছে অলিখিত ও অকথিত উপন্যাসটি আসছে বলার পরও তিনি আমাকে বিষয়টি জানানোর দরকারই মনে করেননি। আমি কিছু উষ্মা প্রকাশ করলে তিনি নির্বিকার বললেন, আমি জানি আপনার কাছে লেখা তৈরি আছে। আর না থাকলেও এক সপ্তাহের মধ্যে একটা নামিয়ে দিতে পারবেন।
‘যদি সে ভালো না বাসে’ লিখতে হলো দুই সপ্তাহের মধ্যে। বিরক্তি, প্রস্তুতিহীনতা, সময়ের স্বল্পতা, ঈদসংখ্যায় ফরমায়েশি আকৃতির ‘উপন্যাস’ লেখার অনিচ্ছা নিয়েও। বন্ধুর প্রতিশ্রুতির (হোক তা বাগাড়ম্বর, আর কারো তা জানারও দরকার নেই) সম্মানটুকু আমাকে রাখতে হয়।
কোথা থেকে কে জানে, ডিমের ভাঙা কুসুমের মতো সূর্যের আলো কথাটা মাথায় এলো। ঠিক আছে, তাই দিয়েই শুরু হোক। দেখা যাবে কোথায় গিয়ে ঠেকে। চরিত্রগুলির মধ্যে এক জামাল খানিকটা পরিচিত। নীলা-নিশি-ইরফান বা আর কাউকে চিনি না। তাদের তৈরি করতে হলো একাধিক চেনা মানুষের এটা-ওটা মিলিয়ে। প্লুটোর গ্রহত্বমোচন নিয়ে তখন কিছু হৈ চৈ, আচ্ছা তাকেও ঢুকিয়ে ফেলো।
সময় কম তো বটেই, এদিকে আকৃতি যাতে খুব বড়ো না হয় তা-ও দেখতে হবে। শেষ না হলেও শেষ করে ফেলো। তাই হলো।
এই রচনা অসম্পূর্ণ। উপন্যাস তো নয়ই। হয়তো টেনে লম্বা করা একটি বড়োগল্প, অথবা দু’তিনটি গল্প জোড়া দিয়ে একটা পাঠক-ঠকানোর গোঁজামিল। আনোয়ার সাদাত শিমুলকে উদ্ধৃত করে বলা যায় ‘বনসাই উপন্যাস’। কী সর্বনাশ, আমার তৈরি অস্ত্রে আমি নিজে আক্রান্ত – ‘দিয়াশলাই’ সংকলনের কিছু গল্পকে আমি ‘বনসাই গল্প’ বলে চিহ্নিত করেছিলাম।
প্রশ্ন হলো, লেখাটি সচলায়তনে ধারাবাহিকভাবে কেন পোস্ট করলাম? একটিমাত্র কারণে। লেখাটির মধ্যে সম্পূর্ণ উপন্যাস হয়ে ওঠার একটা সম্ভাবনা আমি দেখতে পাই। পোস্ট করে কিছু পাঠক মতামত পেলে কাজটা সম্পূর্ণ করার বাসনা ছিলো। বিশেষ করে লেখার দুর্বলতার দিকে কেউ কেউ নির্দেশ করবেন ভাবছিলাম। সে উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ সফল যেমন হয়নি, একেবারে ব্যর্থ তা-ও বলা চলে না। টুকরো কিছু মন্তব্য ছাড়াও শেষ পোস্টে আনোয়ার সাদাত শিমুলের নাতিদীর্ঘ আলোচনায় অনেকগুলি জিনিসই সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তার নির্দেশ করা দুর্বলতা ও অসম্পূর্ণতাগুলি নিয়ে আমার কিছুমাত্র দ্বিমত নেই। বরং সমালোচনাটি আরো তীব্র হতে পারতো, শিমুল ভদ্রতাবশে হয়তো কিছু চেপে গেছে। বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে কিছু ছাড়ও হয়তো পেয়ে গেছি।
‘যদি সে ভালো না বাসে’ যাঁরা পড়েছেন এবং মন্তব্য করেছেন, তাঁদের কাছে আমার অসীম কৃতজ্ঞতা। যাঁরা পড়েননি, তাঁরাও এক অর্থে আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন! সুতরাং ধন্যবাদ তাঁদেরও।
মন্তব্য
অনেকদিন থেকেই পড়ব পড়ব করেও আলসেমির কারণে পড়া হচ্ছিল না (উপন্যাস বলেই হয়ত)। শুরু করলে তাড়াতাড়ি শেষ করতে পারব জানি, শুরু করাটাই সমস্যা। তবে এই লেখার পর আগ্রহ অনেকগুণ বেড়ে গেল। শুরুটা করেই ফেলব ভাবছি।
লাজলজ্জার মাথা খেয়ে (না-পড়েও যে ধন্যবাদ পাওয়া গেল, অনেকটা এজন্যেও) বলি, উপন্যাসটির একটি কিস্তিও আমার পুরো পড়া হয় নি। উপন্যাস আমি এমনিতেই পড়ি কম, তাও আবার কিস্তিতে-- ঠিক সয় নি। তবে ধারণা করি, আপনার উপন্যাস ভালো না-হয়ে যায় না। ছাপা হোক, পড়ে ফেলব।
এই লেখাটা পড়ে আপনার করিৎকর্মা বন্ধুর নাম জানতে ইচ্ছে করছে ; আপনি উপন্যাস লেখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সম্পাদককে এরকম সংবাদ দিয়েও যিনি আপনাকে খবরটা পৌঁছাতে বেমালুম ভুলে গেছেন বা প্রয়োজনীয় মনে করেন নি।
এরকম মানুষের নাম মুখস্থ রাখা ফরজ মনে হচ্ছে।
................................................................
আমার সমস্ত কৃতকর্মের জন্য দায়ী আমি বটে
তবে সহযোগিতায় ছিল মেঘ : আলতাফ হোসেন
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী
এই লেখাটি না পড়ে কোনো ক্ষতি হয়নি। বরং হয়তো আপনি বেঁচে গেলেন।
নাঃ, বন্ধুর নাম-পরিচয় ফাঁস করবো না। তিনি হয়তো আমাকে পরম বন্ধু ভেবেই অতোটা সাহস করেছিলেন। সবার সঙ্গে হয়তো করেন না, বা পারেন না। কে জানে!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
আমি আজ দুপুরেই আট পর্ব নামিয়েছি
কিন্তু জুবায়ের ভাই, পিডিএফ হলে খুব ভালো হত।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
পিডিএফ হলে খুব ভালো হতো আসলেই...আমিও পরীক্ষা শেষ হলেই পড়ে ফেলার আশায় আছি...
---------------------------------
জ্ঞানীরা ভাবলেন খুব নাস্তানাবুদ করে ছাড়া গেছে...আআআহ...কি আরাম। বিশাল মাঠের একটি তৃণের সাথে লড়াই করে জিতে গেলেন।
ছোট্ট তৃণের জন্য অপরিসীম ঘৃণা।
হা : হা : হা : !!!
ভাগ্যিস আপনাকে চানরাতে ফোন করে বলেনি যে আপনার উপন্যাসটি কালকের মাঝেই দিতে হবে ।
মনে পড়ল সামহোয়্যারে আপনার আর অমিতের দুইটি ধারাবাহিক উপন্যাসকে নিয়ে একটা " নিজের খাইয়া বিজ্ঞাপন দিলাম " জাতীয় পোস্ট দিয়েছিলাম , যাতে পাঠকরা সুস্বাদু লেখা মিস না করে ।
ধারাবাহিক উপন্যাস আমি শুরুতে পড়ি না । কারন বিভিন্ন পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাস পড়ে আমার সর্বনাশ হয়েছে । নানা কারনে শেষ পর্যন্ত পড়তে পারিনি , এবং তারপর অনেক কষ্ট করে জোগাড় করে করে পড়তে হয়েছে ।
ধারাবাহিক উপন্যাস শেষ হওয়ার পরে পড়তে বসি ।
সামহোয়্যারে আব্দুর রাজ্জাক শিপনের উপন্যাস " চন্দ্রাবতী" শেষ হওয়ার পরে গতকাল এক বৈঠকে পড়ে গেছি । এখন সেটার সমালোচনা লিখছি শিপনকে দেয়ার জন্য ।
আপনারটা শেষ হয়েছে অবগত হলাম । তবে ধারনা করেছিলাম যে এবারও আপনি পিডিএফ আপলোড করবেন , তাহলে এক ডাউনলোডে পড়ে ফেলব ।
পিডিএফ না পেলেও পড়া শুরু করব এবং শেষও করব ।
কিন্তু এটাকে উপন্যাস করার জন্য মতামত দেয়ার সাহস করব কি না , বলতে পারছি না ।
-----------------------------
কালের ইতিহাসের পাতা
সবাইকে কি দেন বিধাতা?
আমি লিখি সত্য যা তা,
রাজার ভয়ে গীত ভনি না।
কেন, জানতে পারি? আমার কিন্তু গণ্ডারের চামড়া।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
আমি ও তো অপেক্ষায় ছিলাম একসাথে পুরোটা পড়ব বলে ।
----x----
...অথবা সময় ছিলো;আমারই অস্তিত্ব ছিলোনা
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
অখণ্ড পিডিএফ দেওয়া হলো। নিচে লিংক।
যদি সে ভালো না বাসে
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
নামালাম। পরীক্ষা শেষ হলে একবারে পড়বো।
বাহ! জুবায়ের ভাই দেখি আলাদা পোস্ট দিলেন!!
ভালো হলো - উপন্যাসের পেছনের গল্প শোনা হলো। ইদানিং পাঠক হিসেবে এই ইচ্ছেটা বেশি মাথাচাড়া দেয়।
আবারও বলি - প্রতিক্রিয়াটুকু ছিল প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির ব্যবধান নিয়ে। 'সমালোচক' হওয়ার যোগ্যতা কিংবা সাহস পেলাম কই? মনে হয়েছে, আরো অনেক কিছু আসতে পারতো উপন্যাসে, আরো বিস্তৃত হতে পারতো। এখন ঈদসংখ্যা কাহিনী শুনে ভাবছি, হায়! লেখক!! হায়!!!
দৈনিক পত্রিকা/সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের ঈদসংখ্যায় ছাপানো কিছু উপন্যাস দেখেছি বইমেলায় এক মলাটে প্রকাশিত হয়। শুরুতে ছোট্ট নোটঃ 'উপন্যাসটি সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ হয়েছিল ঈদ সংখ্যা---। এবার পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস।'
'যদি সে ভালো না বাসে' সেরকম কিছু হবে নাকি!
__
পোস্টের বক্তব্যে একটু সংশোধনী প্রস্তাবঃ 'বনসাই উপন্যাস' উদ্ধৃত করেছেন অমিত আহমেদ।
ঈদসংখ্যায় লেখা নিয়ে কাহিনী আরো আছে। কখনো লিখে ফেলা যাবে।
এটা নিয়েও অবশ্যই লিখবো। বিশেষ করে সংক্ষিপ্ত আকার বিষয়ে।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
নতুন মন্তব্য করুন