১৩
কয়েক মাস আগে একটি ভিডিও দেখেছিলাম। এ দেশে যাকে হোম ভিডিও বলে, সেই গোত্রের - একজন মানুষের অত্যন্ত ব্যক্তিগত আত্ম-অনুসন্ধানের সফল ও আনন্দদায়ক পরিণতির ছোট্টো দলিল। কিন্তু সব মিলিয়ে তাতে নিদারুণ এক কাহিনীর আভাস। ঘণ্টাখানেক দৈর্ঘ্যের ভিডিও শুধু পরিণতির ছবিটি দেখায়, সম্পূর্ণ গল্প বলে না। পরে প্রাসঙ্গিক তথ্য, পেছনের গল্পটি জানা হয়।
শুরুতে দেখা যায়, বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্ত বাড়ির একটি টেবিলে, সেটি ডাইনিং টেবিল বলে ধারণা হয়, দুটি চেয়ারে বসে আছে দুই নারী। একজন বয়স্ক - চেহারায়, পোশাকে গ্রামীণ মানুষের ছাপ, কথা বলে বগুড়া শহর বা তৎসংলগ্ন অঞ্চলের ভাষায়। এই মুহূর্তে তার বয়স অনুমান করা সম্ভব হয় না, ধারণা করা যায় আনুষঙ্গিক কাহিনীটি জানা হলে। অপরজন বয়সে তরুণী, মাথাভর্তি কোঁকড়া চুলগুলিই প্রথমে চোখে পড়ে। রং-চেহারায় পুরোপুরি বাঙালি ছাপ থাকলেও কথা বলে মার্কিনি ধাঁচের ইংরেজিতে। তার পরনের পোশাকটি অবশ্য কোনো তথ্য জানায় না, আজকাল বাংলাদেশে শহরের অনেক মেয়ে এ ধরনের পোশাক পরে। দুই নারী পরস্পরের ভাষা বোঝে না, তবু তাদের কথোপকথন চলে। একজন মহিলা দোভাষী, যাঁকে ক্যামেরায় দেখা যায় না, একজনের কথা অনুবাদ করে জানাচ্ছেন অন্যজনকে। অবিলম্বে জানা হয়ে যায়, এই ইংরেজি-বলা তরুণীটি ওই বয়স্কার কন্যা।
এদের নাম জানা হয়নি। আমি মনে মনে বয়স্কার নাম দিই আমিনা এবং তরুণীকে সামিনা। তিরিশ বছর পরে দু’জনের এই প্রথম সাক্ষাত। তারা একজন আরেকজনকে ক্রমাগত স্পর্শ করে, অনুভব করার চেষ্টা করে। পরস্পরের অজানা অসম ভাষা তাদের হৃদয়ের যে আর্দ্রতা-ভালোবাসার পূর্ণ প্রকাশ ঘটাতে পারে না, স্পর্শে তা সঞ্চারিত হতে থাকে। বস্তুত, প্রথমবারের সাক্ষাতে সারাজীবনের বিচ্ছেদ ও অদেখার তৃষ্ণা তবু অপূর্ণ থাকে বলে বোধ হয়। একসময় সামিনা ক্রমাগত চোখের পানি মোছে। মা তাকে বলে, ওঙ্কা কর্যা চোখ মুছপার থাকলে চোখ বিষ করবি রে মা...।
মা ঠিক জানে, তাই তো সে মা। অনূদিত হয়ে কথাটি মেয়ের কাছে পৌঁছুলে কান্নাচোখেই হেসে ফেলে সে, আমার চোখ সত্যিই ব্যথা করছে, মা।
মায়ের মাথায়, কপালে, চুলে, গালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মেয়ে একবার হাসে, পরক্ষণেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। বলে, এতোদিন পর সত্যি তোমার দেখা পেলাম, মা গো! এই দিনের জন্যে আমি অপেক্ষা করেছি আমার সারাটা জীবন ধরে!
মেয়ের তুলনায় মায়ের আবেগ খানিকটা নিয়ন্ত্রিত মনে হলেও মুহূর্তে তার চোখও ভিজে ওঠে।
আরো খানিকক্ষণ এই ধরনের কথোপকথন চলে। তাদের পরস্পরকে জানা হয় প্রধানত স্পর্শে ও দর্শনে - আনন্দ-বেদনার বিনিময় ঘটে। তারপর দেখা যায়, মা-মেয়েতে মিলে বগুড়ায় গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছে। আমেরিকানিবাসী এই গ্রামেরই কোনোদিন-না-দেখা মেয়েটিকে প্রথমবারের মতো দেখতে মানুষ ভেঙে পড়ে। মায়ের হতদরিদ্র বাড়িঘর - হয়তো বাংলাদেশের বিচারে অতোটা খারাপ নয়, কিন্তু মেয়েটির অনভ্যস্ত চোখে তাই মনে হবে বলে অনুমান হয় - দেখে মেয়ে। দেখে গ্রামের মানুষদের, কোনোদিন না-দেখা একটি ভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। ভিডিওটি মোটামুটি এইভাবে শেষ হয়।
অনেকগুলি অনিবার্য প্রশ্ন, এই দু’জন নারী, যারা পরস্পরের সঙ্গে রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত, আলাদা হয়ে গিয়েছিলো কীভাবে? কেন তাদের প্রথম সাক্ষাতের জন্যে তিরিশ বছর অপেক্ষা করতে হলো? ভিডিওতে দু’জনের সাক্ষাতের আবেগার্দ্র মুহূর্তগুলো দেখে কৌতূহল বেড়ে উঠতে থাকে। কাহিনীটি পরে জানা হয়। করুণ ও হৃদয়বিদারক সে গল্প, নিবিড় অনুসন্ধানী এক নারীর জয়ী হওয়ার ইতিবৃত্ত।
তিরিশ বছর আগে আমিনা ছিলো গ্রামে বেড়ে ওঠা সাধারণ কৃষক পরিবারের এক সদ্য-তরুণী। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ পনেরো-ষোলো বছর বয়সী মেয়েদের জন্যে নিরাপদ জায়গা ছিলো না। তাদের গ্রাম আক্রান্ত হয়, পাকিস্তানী উর্দিধারীদের হাতে পড়ে আমিনা। সদ্য-তারুণ্যের স্বপ্ন অবিলম্বে রূপান্তরিত হয় এক দীর্ঘ দুঃস্বপ্নে। যে বয়সে চারদিকের পৃথিবী রঙিন হয়ে থাকার কথা, আমিনার জগৎ সেই সময়ে ঘিরে ফেলে এক নিকষ অন্ধকার। পরবর্তী কয়েকটি মাস তার বদ্ধ পৃথিবীতে কালো ছাড়া আর কোনো রং ছিলো না, যন্ত্রণা ও গ্লানি ছাড়া কোনো অনুভূতি ছিলো না। স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধারা তাকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যায়। নিজেকে সে আবিষ্কার করে এক সম্পূর্ণ অপরিচিত জায়গায়, তার নাম-ধামও জানা নেই। শুধু বোঝে, জায়গাটি নিজের গ্রাম থেকে অনেকদূরে।
একদিক থেকে হয়তো ভালোই হয়েছিলো, তখন তার ঘরে ফেরা সম্ভবও ছিলো না। শরীরের ভেতরে আরেকজন ক্ষুদ্র মানুষের উপস্থিতির সমস্ত লক্ষণ প্রকাশ্য। অচেনা জায়গাই তার জন্যে স্বস্তিকর। অল্পদিন পরে একটি মেয়ে ভূমিষ্ঠ হলে শিশুটিকে রেডক্রসের লোকদের হাতে তুলে দিয়ে একসময় আমিনা ফিরে যায় নিজের গ্রামে। মেয়েটির জন্যে তার কোনো অনুভূতি বা ভালোবাসা তৈরি হয়নি, তাকে তো আমিনা ভালোবেসে জন্ম দেয়নি। যে বর্বরতার ফসল হয়ে শিশুটি এসেছিলো, তার জন্যে সুন্দর অনুভূতি তৈরি হওয়ার কোনো সুযোগ ছিলো না! দুঃস্বপ্ন কোনো ভালো অনুভূতি দেয় না।
এতোকিছুর পরেও মানুষের বেঁচে থাকার সহজ প্রবণতাই হয়তো আমিনাকে আবার স্বাভাবিক মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করে। কালক্রমে নিজের গ্রামেই তার বিয়ে হয়, স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসার হয়। তবু কখনো কোনো উদাস মুহূর্তে পরিত্যক্ত মেয়েটির কথা কি কখনো তার মনে পড়েনি? কিন্তু কোনোদিন কাউকে বলা যায়নি সে কথা। ভয়াবহ গোপন কাহিনীটি কারো সঙ্গে ভাগ করা যায় না, নিজের মনের গহীনে লুকিয়ে রাখতে হয়।
সামিনাকে সেই শিশুকালেই রেডক্রসের লোকেরা যুদ্ধশিশু হিসেবে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেয়। একটি মার্কিন পরিবার তাকে দত্তক নেয়। বোধ-বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে দত্তক নেওয়া পরিবারেরই একজন হিসেবে নিজেকে জেনে এসেছে সে। বড়ো হয়ে একসময় নিষ্ঠুর সত্যটি জেনেছে - সে আসলে যুদ্ধশিশু। তখন থেকে তার অনুসন্ধানের শুরু। সে বুঝে যায়, পৈত্রিক পরিচয় কোনোদিনই আর উদ্ধার করা যাবে না, কিন্তু মায়ের সন্ধানে সে অক্লান্ত, একাগ্র হয়ে থাকে। বহু বছরের অনুসন্ধানের পর তার মায়ের পরিচয় ও গ্রামের নামটি সে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। রেডক্রসের কাগজপত্র ঘেঁটে নিশ্চিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রনিবাসী বাংলাদেশের এক বন্ধুর মাধ্যমে সে আমিনার কাছে এই মর্মে খবর পাঠায় যে, হারিয়ে যাওয়া মেয়েটি তার সাক্ষাৎপ্রার্থী। আমিনা কোনো উৎসাহ দেখায় না, কোনো কথা বলতে আগ্রহী নয় সে, ব্যাপারটিকে সত্যি বলে স্বীকারও করে না।
আমিনার মৌখিক অস্বীকারের যুক্তি বোঝা দুরূহ নয়। যে সত্য এতো বছর ধরে সে আড়ালে রেখে এসেছে, স্বামী-সন্তান-সংসারের বাস্তব পৃথিবীতে যে সত্যের কোনো অস্তিত্ব এতোদিন ছিলো না - সেই সত্য যাবতীয় অন্ধকার ও দুঃখস্মৃতিসহ এখন সামনে এসে উপস্থিত হলে তাকে মেনে নেওয়া সহজ নয়। তার সমস্ত পৃথিবী যে ওলটপালট হয়ে যাবে! জানাজানি হলে মানুষের কাছে মুখ দেখাবে সে কী করে? আরো কঠিন কথা, যে মেয়েকে জন্মের পরেই সে পরিত্যাগ করেছে, নিজের সন্তান বলে স্বীকৃতি দেয়নি মনে মনেও, মায়ের পরিচয়ে তার সামনে দাঁড়াবে কোন দাবিতে?
এই দোটানারও একদিন সমাপ্তি ঘটে। সামিনা আরো কয়েকবার চেষ্টা করেও আমিনার মন গলাতে সক্ষম হয় না। শেষমেশ সামিনা খবর পাঠায়, সে বাংলাদেশে আসছে এবং নিজে মায়ের সামনে দাঁড়াবে। তখন দেখবে, কেমন করে মা তাকে অস্বীকার করে, ফিরিয়ে দেয়!
আমিনার তখন সত্যের মুখোমুখি না হয়ে আর উপায় থাকে না। বুকভরা আকুতি ও চোখভরা জল নিয়ে সে ঢাকায় আসে মেয়ের সঙ্গে মিলিত হতে। তিরিশ বছর পর।
তার আগে এই লুকিয়ে রাখা কাহিনীটি স্বয়ং আমিনাকেই উন্মোচন করতে হয় স্বামী ও পুত্রের কাছে। গ্রামের প্রতিবেশী ও আত্মীয়-পরিজনের কাছে। বিস্মিত হয়ে সে দেখে, তার আশঙ্কা কিছুমাত্র সত্যি হয়নি। তার চেনা পৃথিবী উল্টে যায়নি। কেউ তাকে কোনো প্রশ্ন করেনি, অভিযোগের আঙুল তার দিকে তোলেনি, কলঙ্কের ছবিও কেউ আঁকতে বসেনি। বরং ভালোবাসা, সহানুভূতি দিয়ে পরিপূর্ণ করে দিয়েছে। আমিনা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করে, মানুষ আজও মানুষ আছে। গ্রামের বয়স্কদের মনে সেই সময়ের স্মৃতি এখনো খুবই জাগ্রত। তারা জানে, মানুষের মতো দেখতে একদল অমানুষ আমিনাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিলো, কিন্তু তাতে সে কিছুমাত্র অপবিত্র হয়নি। সেই মানুষেরা আরো জানে, সামিনার জন্মের ইতিহাসটি তার নিজের রচিত নয়, সেই ইতিবৃত্ত রচনায় তার কোনো ভূমিকা ছিলো না। যে মানুষটি আমিনার স্বামী, সামিনাকে সে আপন কন্যার øেহ দিতে কার্পণ্য করে না, এবং তার পুত্র - সম্পর্কে সামিনার সৎভাই - সামিনাকে বোন বলে জড়িয়ে ধরে। দুই ভাইবোনে গলা জড়াজড়ি করে কাঁদে।
সামিনা ও আমিনার প্রথম সাক্ষাতের মুহূর্তটিতে ভিডিওর শুরু। বেদনাময় মধুর তার পরিসমাপ্তি।
যুদ্ধ, বিপ্লব বদলে দেয় রাষ্ট্র ও সমাজ, তা হয় ইতিহাসের উপকরণ। তার প্রতিক্রিয়ায় ব্যক্তিমানুষের জীবন পাল্টে যায়, যুদ্ধের হিংস্র ও দয়াহীন নখর গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত রেখে যায় কতোশত মানুষের জীবনে - তারই একটি অসামান্য গল্প-দলিল এই ভিডিও। এই দলিল ইতিহাস বটে, তবে তা ব্যক্তিগত। কেতাবী ইতিহাস ব্যক্তিমানুষের জীবন বা তার অনুভবের কারবারী তো নয়!
মন্তব্য
জুবায়ের ভাই, আরেকটু বেশী লিখেন।
কি মাঝি? ডরাইলা?
ক্যামনে?
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
এক কথায় বললে, এক্সেলেন্ট!!!
এটা খুবই উঁচুমানের একটা কাজ হতে যাচ্ছে ... যাস্ট জুবায়ের ভাই, আপনাকে অনুরোধ এই লেখাটাকে ২৫ পর্বে শেষ করে দেবেননা ...
একজন মুক্তিযোদ্ধার চোখে ৭১ এর স্মৃতি প্লাস তার পরের ৩৬ বছরের রিভিশন ... চমৎকার একটা উপন্যাস ... আপনি সময় নিয়ে ধীরে ধীরে হলেও এটাকে ডিটেইলড একটা বড় উপন্যাস করবেন ... দাবী করি।
আর অধমের একটা অনুরোধ, পুরো লেখাটাতে আপনি তো সত্য কিছু ঘটনাকে তুলে ধরে ধরে ব্ক্তব্য তুলে ধরেছেন ... রাজাকার ফোকাসের ক্ষেত্রে স্পেসিফিক গো.আ/মইত্যাদের ঘটনা দিয়ে ফোকাস করবেন প্লিজ ... সিনেমা/সাহিত্যে রাজাকার বললে আবছা একটা ইমেজ হয় ... গ্রামের টুপি-দাড়ীওয়ালা কিছু লোক ... কিন্তু নটের রাজারা সবসময় পার পেয়ে যায় ... আপনার এই উপন্যাসে এদের সরাসরি দেখতে চাই।
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
ধন্যবাদ। পরামর্শগুলি আপাতত জমিয়ে রাখি, যদি কাজে লাগাতে পারি।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
একদম আমার মনের কথা!
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে
আমি এখন আপডেটেড
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
ভালো লাগল।
পড়ছি
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ
অজ্ঞাতবাস
পড়ছি
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ
অজ্ঞাতবাস
ধন্যবাদ অমিত আহমেদ, হাসিব, সুমন রহমান ও সুমন চৌধুরীকে।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
নতুন মন্তব্য করুন