১৪
মাঠে ক্রিকেট চলছে। বাংলাদেশ টেস্ট খেলছে তিন বছর ধরে, তাতে প্রথম জয়ের মুখ এখনো দেখা হয়নি। দশটি টেস্ট ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের মধ্যে কনিষ্ঠতম এবং শক্তিতে সবার চেয়ে দুর্বল। তা হোক, তবু তা আমার দল, হারতে হারতেই একদিন ঠিক উঠে দাঁড়াবে।
আমার দেশটি হয়তো খেলছে পার্থ অথবা মুলতান, কিংবা ব্রিজটাউনে। খেলা যেখানেই হোক, একটি দলের প্রত্যেকটি খেলোয়াড় বাংলা ভাষায় কথা বলে, ভাবতেও কী অহংকার! আগে তো কখনো ছিলো না! গায়ে কাঁটা দেয়। এবারে খেলাটি বাংলাদেশে, ভারতের সঙ্গে। এই টেস্টে প্রতিপক্ষেরও একজন, অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি, বাংলাভাষী। একটি ক্রিকেট ম্যাচে বাইশজন খেলোয়াড়ের বারোজনই বাংলাভাষী। ভাবা যায়! ক্রিকেটের ইতিহাসে এই ঘটনা অভিনব। ক্রিকেটের পরিসংখ্যান বইয়ে অবশ্য এই তথ্য জায়গা পায়নি। পাওয়া উচিত নয়?
খেলা চট্টগ্রামে। দেশে থাকলে চট্টগ্রাম গিয়ে মাঠে বসে চাক্ষুষ দেখা অসম্ভব হতো না। এখানে আর কী করে দেখবো? এ দেশে ক্রিকেট খেলা দূরে থাক, জিনিসটা কী তা-ই কেউ জানে না। এরা ক্রিকেট বলতে ওই নামের পোকাটিকেই বোঝে। এখানে টিভির স্পোর্টস চ্যানেলগুলো জগতের যাবতীয় খেলা দেখায়, এমনকী গলফের জন্যে আলাদা চ্যানেল। অথচ ক্রিকেট নেই। দর্শক নেই বলে বাজার নেই, সুতরাং বাণিজ্যের সম্ভাবনাও শূন্য। পুঁজির মালিকরা বাণিজ্য চায়। স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলিতে ক্রিকেট দেখা যায় খেলাপ্রতি টাকা দিয়ে। এ দেশে বসবাস করা উৎসাহী ভারতীয় ও পাকিস্তানীরা চাঁদা তুলে দলবদ্ধ হয়ে খেলা দেখে, কিন্তু বাঙালি নিজেদের ক্রিকেট নিয়ে তেমন উৎসাহী নয়। বাংলাদেশের ক্রিকেট রাত জেগে দেখার মতো প্রেম এখনো কারো জন্মায়নি। হবে কোনো একদিন। কবে?
ভাবতে লজ্জা করে, বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ ক্রিকেটে পাকিস্তানের সমর্থক। দেশে কী অবস্থা আমার সঠিক জানা নেই, কিন্তু এ দেশে এরকমই দেখি। এমনকি, ৯৯ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের এক ম্যাচে পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে পরাজিত হলে অনেককে বলতে শুনেছি, পাকিস্তান ইচ্ছে করে হেরেছে। কেউ বলেছে, বাংলাদেশকে টেস্ট ক্রিকেটে অন্তর্ভুক্ত করানোর জন্যে পাকিস্তান ম্যাচটি ইচ্ছে করে ছেড়ে দিয়েছে। কী আশ্চর্য! ক্রিকেটে হোক আমাদের সামর্থ্য অল্প, কিন্তু পাকিস্তানকে এক-আধবার হারানোর সামর্থ্য আমাদের যে আছে, তা-ও মানতে পারবো না? নির্লজ্জ আত্ম-অবমাননার এর চেয়ে বড়ো উদাহরণ আর কী হয়!
আমার স্যাটেলাইট টিভির সংযোগ নেই। একা মানুষ আমি, ঘরে থাকা কম হয়, টিভি দেখাও বড়ো একটা হয় না। আমার ভরসা ইন্টারনেট। গোটা তিনেক ক্রিকেট ওয়েবসাইট খুঁজে পেয়েছি, সেখানে ধারাভাষ্য পাওয়া যায় না, কিন্তু সচল স্কোরবোর্ড আছে। মিনিটে মিনিটে আপডেট, একটিতে প্রতি বলের আপডেটও পাওয়া যায়।
রাত জেগে স্কোর দেখছিলাম। আগের টেস্টে গো-হারা হেরেছিলো বাংলাদেশ - এক ইনিংস ও ১৪০ রানে। এই ম্যাচটিও হারবে মনে হচ্ছে। প্রথম ইনিংসে দ্রাবিড় আর গম্ভীরের সেঞ্চুরিসহ ভারত ৫৪০ রানের পাহাড় বানিয়ে রেখেছে। একেবারে অলৌকিক কিছু না হলে এই ম্যাচ বাঁচানো একরকম অসম্ভব। বাংলাদেশের ব্যাটিং সামর্থ্য নিয়ে খুব ভরসা করা চলে না। আজ তৃতীয় দিনের পুরোটা আগলে রাখতে পারলে ড্র করার একটা সম্ভাবনা অবশ্য তৈরি হয়। হবে কি? না হোক, হারলে হারবে, ভারতের মতো অভিজ্ঞ ও ভালো টীমের কাছে পরাজয়ে লজ্জা কিছু নেই। কিন্তু আমার দলটি অন্তত লড়াই করে হারুক, এইটুকুই আমার চাওয়া।
খেলা শুরু হতে হতে রাত এগারোটা। সকালে অফিসে যাওয়ার তাড়া আছে, দেরি হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের মধ্যে লড়াই করার চিহ্নগুলো দেখতে পাচ্ছি, জেগে বসে থাকি সেটি দেখার আশায়। ৫৪০-এর জবাবে বাংলাদেশের আগের দিন শেষ হয়েছিলো তিন উইকেটে ৫৪ করে। শুরুটি ভালো হয়নি, কিন্তু আজ সকাল থেকেই আশরাফুল ছেলেটি বুঝিয়ে দিচ্ছে লড়াই সে করবে।
বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত টেস্ট জেতেনি, কিন্তু এই ছেলেটি তিন বছর আগে ক্রিকেট রেকর্ডবুকে জায়গা করে নিয়েছে কনিষ্ঠতম সেঞ্চুরিয়ান হিসেবে, জীবনের প্রথম টেস্টে। তখন তার বয়স ১৭। আশরাফুল নামটি একটু অদল-বদল করে তার নাম দেওয়া হয়েছিলো আশার ফুল! আঃ, তাই যেন হয়। আজ সে আবার আশার ফুল হয়ে ফোটার লক্ষণ দেখাচ্ছে। সাত সকালেই সে জাহির খানের দ্রুতগামী বলে একটি ছক্কা মেরে বসে। চোখে দেখা হচ্ছে না, ধারাভাষ্যও শোনার উপায় নেই, কিন্তু মনে মনে ধারাভাষ্যকারকে বলতে শুনি, আ টাওয়ারিং সিক্স! বাশারের সঙ্গে জুটি বেঁধে সে তোলে ৭০ রান। বাশারের প্রস্থানের পরে তার সঙ্গী আফতাব, আরেক তরুণ-তুর্কী। সে আর আশরাফুল ১৫৬ বলে যোগ করে আরো ১১৫। সাবাশ! এই তো চাই!
লাঞ্চের বিরতি হলো, তখন আশরাফুলের নিজস্ব সংগ্রহ ৬২। আবার খেলা শুরু হলে তার ব্যাট আগুন ঝরায়। বলা যায়, আশার ফুলগুলি ফুটে উঠতে থাকে। ১৮টি বল পরে তার রান ৭৬। উত্তেজনায় আমার স্নায়ু টান টান হয়ে থাকে, সেঞ্চুরি পাবে কি সে? পেয়ে যায় সে স্বপ্নের সেঞ্চুরি - পরম দুঃসাহসে উদ্ধত বালক ৭টি মাত্র বল খেলে ২৪ রান যোগ করে নেয়। ইরফান পাঠানকে পরপর তিনটি বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ৮৮। ৯২-এ পৌঁছে হরভজন সিংকে চার। ঠিক তার পরের বলেই আরেকটি। স্বপ্নসম্ভবের শতরান। ধারাভাষ্যকার তখন নিশ্চয়ই বলছেন, ব্রিলিয়ান্ট! ম্যাগনিফিসেন্ট!
আঃ, এই সাহস আর বীরত্বও ধরে বাঙালি!
হয়তো কিছুই নয়, তবু গর্ব হয়, কোন চোরা আনন্দে চোখের কোল ভিজে ওঠে। আমার অপ্রাপ্তির দেশের জন্যে এই তো কতো বড়ো পাওয়া! কিছু না থাক, অহংকার করার মতো ছিটেফোঁটা একটি-দুটি লড়াইয়ের সামর্থ্য দেখতে চাই। আপাতত এর চেয়ে বেশি আর কিছু চাওয়ার নেই।
রাত সাড়ে তিনটা। ঘুমাতে যাওয়া দরকার। বিছানায় শুয়েও টের পাই, শরীরের সমস্ত তন্ত্রী তখনো গর্বে ও উত্তেজনায় সজাগ। জয়ের গৌরব এই টেস্টে হবে না, জানা কথা। না হোক, আমার অহংকারে কোনো ঘাটতি তাতে হবে না। আমার দেশ মাথা তুলতে শুরু করেছে, লড়াই করতে শিখছে। এইভাবে একদিন বুক ফুলিয়ে বলার মতো কিছু একটা তারা ঘটিয়ে ফেলবে। অপেক্ষায় থাকবো। ততোদিন এইসব ছোটো ছোটো গৌরবগাথা আমার ভেতরে সঞ্চিত হতে থাক, আমি লুকিয়ে রাখবো পরম যত্নে ও নিঃশর্ত মমতায়।
মন্তব্য
হুম...
কি মাঝি? ডরাইলা?
হোক সংক্ষিপ্ততম, তবু এই পর্বে একটা মন্তব্য তো পাওয়া গেলো!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
হা হা হা। শুধু 'হুম' দেখে মাইন্ড খাইলেন নাকি?
কি মাঝি? ডরাইলা?
মাইন্ড খাইলে হাসি ক্যামনে? আসলে মজা পাইছিলাম।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
গত কয়েকটা পর্ব পড়েছি।
একটা প্রশ্ন মাথায় ছিল। কিন্তু আগের সবগুলো পর্ব না পড়া থাকায় করছি না। এটা খসড়া বলছেন অবশ্য আপনি। পরে হয়তো সম্পাদনা করে সংযোগ ঘটাবেন সব পর্বের। কোনো বিশেষ চরিত্র দেখতে পাচ্ছি না সব কটা পর্বে। বর্ণনার উত্তম পুরুষ ছাড়া।
তাই ভাবছিলাম, আপনার লেখার কৌশলটা কি? সেলাইটা কখন কীভাবে করবেন?
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
শো.ম.চৌ., লেখাটি খসড়াই। এখন শুধুমাত্র কাঠামোটা হয়েছে। তবু সত্যি কথা বলতে কি, সংশোধন ও পরিবর্ধনের পরেও এটি ঠিক "ব্যাকরণসম্মত" উপন্যাস হবে বলে আমার মনে হয় না। আমার ইচ্ছেও তেমন নয়। এই অগোছালো আলগা ভাবটাই থাক না, সেলাই-ফোঁড়াই করে জুড়ে না দিলে ক্ষতি কি!
উপন্যাসের কথিত প্রথা মেনে অনেক চরিত্রের সমাবেশ ঘটানো হয়তো হবে না। উপস্থিত অন্য দু'একটি চরিত্র আরেকটু বিস্তৃত করা যাবে। লেখাটি মূলত একটি মানুষের মনোলোগ, তাই সে-ই নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়। আর সবাই প্রয়োজনে উপস্থিত ও নিষ্ক্রান্ত হবে।
ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা আপনার মনোযোগী পাঠের জন্যে।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
নতুন মন্তব্য করুন