গত বছর অগাস্টে পোস্ট করেছিলাম। আশা করি এখনো পুরনো হয়ে যায়নি। হাসান মোরশেদের পোস্ট দেখে অনুপ্রাণিত।
১৯৭৫-এ শেখ মুজিবকে সপরিবারে খুন করার পর সেনাতন্ত্র শুরু হয়েছিলো। স্বাধীন বাংলাদেশে সেই প্রথম। এখনকার বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ ছিলো ২৩ বছর, তার শেষ ১৩টি বছর কেটেছে সামরিক শাসনের জগদ্দল কাঁধে নিয়ে। আমরা তা থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম বলে যুদ্ধ হলো। অথচ নবীন রাষ্ট্রের জন্মের সাড়ে তিন বছরের মাথায় আবার সেনাশাসনের ভূত।
হতভম্ব, বিহ্বল মানুষ। কাঁদতেও যেন ভুলে গেলো। তার খানিকটা আতংকেও। পাকিস্তানী সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতা এবং যুদ্ধের সময়ে সেনাবাহিনীর অপরিমেয় নৃশংসতার স্মৃতি তখনো টাটকা। তারা জানে উর্দিধারীদের কাছে যুক্তির কোনো জায়গা নেই।
সরল যুক্তিতে অবশ্য মানুষ বোঝে, যেহেতু শেখ মুজিবের হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতরা এবং সেই হত্যকাণ্ডের বেনিফিশিয়ারিরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, শেখ মুজিবের নাম প্রকাশ্যে উচ্চারণ করাও অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে। হত্যাকারীরা শেখ মুজিবকে বেঈমান হিসেবে বেতার-টিভিতে ঘোষণা দিয়েছিলো, যদিও কথিত সেই বেঈমানী আজও প্রমাণিত হলো না। সুতরাং চুপ করে না থেকে মানুষের তখন আর উপায় কী?
একটা কথা খুব জোরেশোরে বহুদিন ধরে প্রচারিত - শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডে অসংখ্য মানুষ নাকি খুশিতে পাড়ায় পাড়ায় মিষ্টি বিতরণ করেছিলো। এরকম আদৌ ঘটেনি, তা নয়। কিন্তু তা ব্যতিক্রমের হিসেবে থাকা উচিত। এই ঘটনাগুলি ছিলো নিতান্তই কিছু কিছু শহরাঞ্চলে, গ্রামে এই ধরনের ঘটনার কথা কেউ শুনেছেন বলে জানা যায় না।
অঘাষিতভাবে 'নিষিদ্ধ' শেখ মুজিবের নাম প্রথম প্রকাশ্যে উচ্চারিত হলো একজন কবির মুখে। ১৯৭৭ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে। শহীদ মিনার হয়ে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছেন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে। বইমেলার শেষদিন (তখন একুশে ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা শেষ হতো) বলে অতিরিক্ত কিছু ভিড়।
মঞ্চে কবিতাপাঠ চলছে। কবিরা একে একে মঞ্চে উঠে কবিতা পড়ে চলে যাচ্ছেন। পরেরজন আসছেন। কবিতার শ্রোতা খুব বেশি কোনোকালেই হয় না, কেউ কেউ মনোযোগ দিয়ে শুনছেন, বেশিরভাগই ব্যস্ত অন্যকিছুতে। শীর্ণ ও দীর্ঘকায় শশ্রুমণ্ডিত নির্মলেন্দু গুণ মঞ্চে এলে কিছু মনোযোগ এমনিতেই আকর্ষণ করেন। তাঁর বেশ কিছু কবিতা পাঠকপ্রিয়তা পেয়ে গেছে তখন। কিন্তু আজ তিনি যা করবেন, তার জন্যে কেউ তৈরি ছিলেন না। মাইক্রোফোনে শেখ মুজিবের নাম উচ্চারিত হতেই সবাই সচকিত। কী হচ্ছে এটা? লোকটা পাগল নাকি? এক্ষুণি তো তাকে ধরে নিয়ে যাবে!
কাউকে কাউকে ত্রস্তপায়ে বাংলা একাডেমির সীমানা ছেড়ে চলে যেতেও দেখা যায়।
নাঃ, এই নিয়ে অবশ্য নির্মলেন্দু গুণকে বিশেষ কোনো হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়নি শেষ পর্যন্ত। তবে এই ঘটনা অন্য অনেক সম্ভাবনা উন্মুক্ত করে দিয়েছিলো।
নির্মলেন্দু গুণের কবিতাটি নিচে তুলে দেওয়া হলো:
আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি
নির্মলেন্দু গুণ
সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হ’য়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ
গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
শহীদ মিনার থেকে খ’সে পড়া একটি রক্তাক্ত ইট গতকাল আমাকে বলেছে
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
সমবেত সকলের মতো আমিও পলাশ ফুল খুব ভালোবাসি, ‘সমকাল’
পার হয়ে যেতে যেতে সদ্যফোটা একটি পলাশ গতকাল কানে কানে
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
শাহবাগ এ্যভিন্যুর ঘূর্ণায়িত জলের ঝর্ণাটি আর্তস্বরে আমাকে বলেছে
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
সমবেত সকলের মতো আমারো স্বপ্নের প্রতি পক্ষপাত আছে,
ভালোবাসা আছে শেষ রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন গতকাল
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
এই বসন্তের বটমূলে সমবেত ব্যথিত মানুষগুলো সাক্ষী থাকুক,
না-ফোটা কৃষ্ণচূড়ার শুষ্কভগ্ন অপ্রস্তুত প্রাণের ঐ গোপন মঞ্জরীগুলো
কান পেতে শুনুক,
আসন্ন সন্ধ্যায় এই কালো কোকিলটি জেনে যাক -
আমার পায়ের তলার পুণ্য মাটি ছুঁয়ে
আমি আজ সেই গোলাপের কথা রাখলাম, আজ সেই পলাশের কথা
রাখলাম, আজ সে স্বপ্নের কথা রাখলাম।
আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি,
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।
মন্তব্য
আজকের এই দিনে কবিতাটি পড়ে যে কীরকম শিহরিত হলাম তা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়।
৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে গুণদার একটি কবিতা আছে, সেটিও আমার খুব প্রিয়;
লেখার জন্য ধন্যবাদ।
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
এই আবেগগুলি অটুট থাক।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
পোস্টের জন্য অনেক ধন্যবাদ জুবায়ের ভাই।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ রেখে যাওয়া আর কি!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
১৫ আগস্ট মধ্যরাতে মুজিব হইল খুন
সবচে বেশি দুঃখ পাইল নির্মলেন্দু গুণ
আশির দশকের কবি সোহেল অমিতাভের লেখা একটি ছড়ার প্রথম দু লাইন
নির্মলেন্দু গুণকে ছড়ার কথাটা মনে করিয়ে দিলে বেশ বিব্রত হযে পড়েন
বলেন- এতে অন্যদেরকে খাটো করা হয়। দুঃখ পেয়েছে সবাই কিন্তু হয়তো দুঃখ প্রকাশ করার সুযোগ পায়নি
পুরো লেখাটা আমার কালেকশনে নাই। কারো কাছে থাকলে দিতে পারেন
০২
৬৮-৬৯ এর দিকে মুজিবকে সিলেট থেকে গ্রেফতার করে ট্রেনে করে ঢাকায় নিয়ে আসার পথে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ স্টেশনে এক পুলিশ মিলটারির ভীড় ঠেলে এক লোক মুজিবের মুক্তি চিৎকার আর শ্লোগান দিয়ে উঠে
মিলিটারি মুজিবের চোখের সামনেই তাকে মারতে মারতে গ্রেফতার করে
মুজিব পরে তার খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন সেই লোকটার নাম নিম্বর আলী। এলাকায় আধা পাগলা হিসেবে পরিচিত
৭৫ পর্যন্ত মুজিবের বাড়িতে তার ছিল অবাধ যাতায়ত। তার বাড়িতে মুজিবের ব্যবহৃত অনেকগুলো জিনিস এখনও নাকি আছে
পাইপ কলম আরো কী কী যেন
মুজিব মারা যাবার পরে (সম্ভবত ১৬ আগস্ট) সেই লোকটি আবার গ্রেফতার হয়
সে একা একা মুজিব হত্যার প্রতিবাদ করে শ্লোগান দিচ্ছিল
আমার জানামতে প্রকাশ্যে মুজিব হত্যার প্রথম প্রতিবাদ কারী এই নিম্বর আলী
অজানাকে জেনে শিহরিত হলাম। যাক, একটা মানুষ অন্তত সাথে সাথে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছিল।
নিম্বর আলীরা সচরাচর লিপিবদ্ধ হন না। ফলে তাঁদের প্রতিবাদ ও উচচারণ অগোচরে থাকে। এরকম আরো দুই-একজন নিম্বর আলীর কথা শুনেছি, চেনা হয়নি।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
আরো একবার কবিতাটা পড়লাম
আরো একবার অভিভূত হলাম
অসংখ্য ধন্যবাদ।
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
কবিতাটি মনে করিয়ে দিলেন, অনেক ধন্যবাদ
------------------------------
'এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি ?'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
পোস্টটার জন্য অনেক ধন্যবাদ জুবায়ের ভাই।
কবিতা পড়ার জন্য শেষবার স্টেজে উঠেছিলাম ২০০১ সালের ২৬ মার্চ এ। ৮ বছর পর আজ আবার তীব্র ইচ্ছা হলো।
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
ইচ্ছেটা পুরোপুরি ফিরে আসুক এবং চালু থাক।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
আবার পড়লাম...
অভিভূত হলাম কবিতাটা পড়ে।
লেখককে ধন্যবাদ এই পোস্টটির জন্য।
১৯৭৭-এর সেই ২১ ফেব্রুয়ারির কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের অনুভূতি কীরকম হয়েছিলো ভাবতে পারেন?
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
ধন্যবাদ জুবায়ের ভাই।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
নতুন মন্তব্য করুন