১.১
আমার অনেক ঋণ রয়ে গেলো তোমার কাছে!
ভেজানো দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অস্পষ্ট স্বরে প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলেন এবারক হোসেন। তাঁর গলা ধরে আসে। জোহরা বেগম এমনিতে সহজে ভেঙে পড়ার মানুষ নন, কিন্তু কথাগুলো তো শুধু কথা নয়, তার পেছনে কিছু একটা যেন লুকানো। ভাবতে চান না এমন কথা মনে আসে, তাহলে এই সেই সময়! এসে গেলো!
চোখ ভিজে উঠতে মুখ নিচু করেন জোহরা বেগম। এবারক হোসেনের দুই হাতের মুঠোয় ধরা তাঁর ডান হাত। হাতগুলো কি একটু কেঁপে ওঠে? ঠিক বোঝা যায় না। বুকের ভেতরে শেকড় উপড়ে ফেলার মতো তোলপাড়, মাথা পাগল-পাগল। এই সময়ে হাতের সামান্য কেঁপে যাওয়া কি আর টের পাওয়া যায় তেমন করে! টের পেলেও মানতে ইচ্ছে করে না। এ সত্যি নয়, সত্যি নয়!
দরজার বাইরে বারান্দায় রবি অপেক্ষা করছে। গেটের সামনে রিকশা দাঁড়িয়ে, ওই রিকশাতেই রবি এসেছে। আর দেরি করিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না ভেবে জোহরা বেগম বললেন, তোমরা যাও। আমি আরেকটা রিকশা পেলেই চলে আসছি।
এবারক হোসেন শিশুর মতো ফুঁপিয়ে ওঠেন। ঘরের ম্লান আলোয় দেখা যায়, তাঁর ফর্সা মুখ লালচে হয়ে উঠেছে। গায়ে জড়ানো চাদরে চোখ মুছে এবারক হোসেন ডান হাত রাখেন জোহরা বেগমের মাথায়। সে মাথায় এখন কালোর চেয়ে সাদা চুল অনেক বেশি, পাতলাও হয়ে এসেছে। পঞ্চাশ বছর আগের একটি ছবি এক ঝলক দেখতে পেলেন এবারক হোসেন। মাথাভরা কোঁকড়া কালো চুলের মেয়েটি। টলটলে একখানা মুখের ওপরে বসানো উজ্জ্বল একজোড়া চোখ।
বিয়ের পরে এবারক হোসেন কর্মস্থলে ফিরে যাচ্ছেন, জোহরা বেগম কিছুদিন নিজের বাবা-মা’র কাছেই থাকবেন। বিদায় দেওয়া-নেওয়ার ছোট্টো এক টুকরো ছবি। সেই ছবিটিই এখন এবারক হোসেন স্পষ্ট দেখলেন। কী মায়া মাখানো সেই মুখ, সেই দেখা! ‘চেয়ে দেখি আর মনে হয় / এ যেন আর-কোনো একটা দিনের আবছায়া, ... দূরকালের কার একটি ছবি নিয়ে এল মনে। / স্পর্শ তার করুণ, স্নিগ্ধ তার কণ্ঠ, / মুগ্ধ সরল তার কালো চোখের দৃষ্টি।’
মুখ বাড়িয়ে জোহরা বেগমের কপালে ছোটো করে ঠোঁট ছুঁইয়েই পেছন ফিরেছেন এবারক হোসেন। টের পেলেন, তাঁর একটা হাত শক্ত করে ধরে আছেন জোহরা বেগম। ‘লতায়ে থাকুক বুকে চির-আলিঙ্গন, / ছিঁড়ো না, ছিঁড়ো না দুটি বাহুর বন্ধন।’
কী হলো, এবার যাই!
জোহরা বেগম জানেন না কখন তাঁর দুই হাত এবারক হোসেনের হাত আঁকড়ে ধরেছে। কী একটা মনে পড়ি-পড়ি করে। মনের ভেতরটা কী-যেন-কী কয়ে ওঠে। উপায় নেই, হাতটা আলগা করে দিতে হয়।
দরজা খুলে বাইরে আসতে এক ঝলক ঠাণ্ডা এসে মুখে লাগে। পৌষ শেষ হয়ে মাঘের শুরু। এবারে শীতও যেন একটু বেশিই পড়েছে। জোহরা বেগম জানেন, তবু জানেন না, বুকের ভেতর এমন খালি লাগে কেন!
ধীর পায়ে দুটো সিঁড়ি ভেঙে নামেন এবারক হোসেন। গেটের কাছে এসে এক মুহূর্ত থামেন। রাস্তায় আলো বেশি নেই। বাইরের বারান্দায় আলো জ্বালানোর কথা মনেও পড়েনি। বসার ঘরের জানালা ঘেঁষে দাঁড়ানো পুরনো শিউলি গাছে সাদা ফুলগুলো দেখা যায় আধো অন্ধকারে।
ভোরের আলো ফোটার আগে পাড়ার কয়েকটা ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে শিউলি কুড়িয়ে নিয়ে যায় রোজ। মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে মাঝে মাঝে ওদের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। প্রথম প্রথম সকালে দরজা খুলে বেরোলে ফুলচোররা দৌড়ে পালিয়ে যেতো, প্রশ্রয় পেয়ে আজকাল আর পালায় না। অনেক বছর ধরে ওই ভোরের ফুলচোরদের মুখ বদলে গেছে কিছুদিন পর পর, ফুল কুড়ানোর বয়স ছাড়িয়ে গেলে নতুন মুখ এসে তাদের জায়গা নিয়েছে। কাল ভোরে কি ওদের দেখা পাওয়া আর হবে?
রবি এবারক হোসেনের হাত ধরে রিকশায় তুলে বসিয়ে দেয়। নিজে উঠে বসার আগে বলে, আমি রিকশা পেলে পাঠিয়ে দিচ্ছি, দিদা। না হলে এই রিকশাই আপনাকে নিতে আসবে।
এবারক হোসেনের মুখটা ভালো করে দেখতে পাচ্ছিলেন না বলে নেমে রাস্তার কাছে চলে এলেন জোহরা বেগম। এবারক হোসেন শক্ত মুখে সোজা সামনে তাকিয়ে আছেন। ব্যথাটা কি আছে এখনো? বাড়লো কি আবার? এমন মানুষ, মুখে ফুটে বলবেন না, বুঝতেও দেবেন না! চোখের কোলে কি পানি দেখা যায়! কিছু একটা বলতে গিয়েও পারলেন না জোহরা বেগম, রিকশা চলতে শুরু করেছে। এবারক হোসেন মুখ তুলে দোতলা বাড়িটা একবার দেখলেন -Ñ ‘ভাঙল দুয়ার, কাটলো দড়াদড়ি...’।
এমনিতে শীতবোধ খুব বেশি তাঁর, অথচ আজ এই মাঘের প্রবল শীতের রাতে রিকশায় বসে কিছুই টের পাচ্ছিলেন না। ফুলহাতা ফ্লানেলের শার্টের ওপর সোয়েটার, তার ওপরে উলের চাদর জড়ানো। একটু মনে হয় গরমই লাগছে। লাগুক, কিছু এসে যায় না। রবি পাশে বসে এক হাতে তাঁর কোমর জড়িয়ে ধরে আছে। মনে মনে হাসলেন, ধরে কি আর রাখতে পারবি রে রবি? চলেই তো যাবো।
মন্তব্য
পড়ছি
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ
অজ্ঞাতবাস
আমিও...
বরফখচিত দেশ ক্যান এতোদূরে থাকো!
স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...
পড়ছি আমিও
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
নতুন মন্তব্য করুন