তখনো স্কুলের সীমানা পার হইনি। ছোটো জেলা শহরের ছেলে আমি। রেলস্টেশনের স্টলটি বাদ দিলে শহরে একমাত্র সংবাদপত্র ও পত্রিকার এজেন্ট থানা রোডের ফজলুর রহমান। মূলত রেডিও-ট্রানজিসটর বিক্রি ও মেরামতের দোকান, একপাশে সরু ক্ষুদ্র পরিসরের একটি ঘরে পত্র-পত্রিকা। তখনো বগুড়া শহরে একটি বা দুটিমাত্র টিভি, দোকানে টিভি ওঠেনি। ষাট দশকের শেষদিকের কথা।
সেই দোকানে একদিন হঠাৎ একটি নতুন পত্রিকা ঝুলে আছে দেখা গেলো। নাম ললনা। নামই বলে দিচ্ছে মেয়েদের কাগজ। ঢাকার সেগুনবাগিচা থেকে প্রকাশিত। পত্রিকা চালাচ্ছেন সব পুরুষরা। শাহাদত চৌধুরী, শাহরিয়ার কবিররা জড়িত ছিলেন সেই কাগজের সঙ্গে। এর আগে মেয়েদের জন্যে একমাত্র কাগজ ছিলো বেগম। বেগম-এর সঙ্গে ললনা-র পার্থক্য সহজেই চোখে পড়ে। আকারে-প্রকারে ললনা অনেক আধুনিক, বেগম গৃহিনী মহিলাদের, ললনা তরুণীদের পত্রিকা। নামে ললনা হলেও শুধু মেয়েদের কাগজ ছিলো না। বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলো কাগজটি। সম্ভবত যুদ্ধের সময় বন্ধ হয়ে যায়, পরে আর কখনো প্রকাশিত হয়নি।
ললনা-র এক সংখ্যায় প্রচ্ছদে সুন্দর হস্তাক্ষরে একটি পুরো কবিতা ছাপা হলো। হস্তাক্ষরটি শিল্পী হাশেম খানের। কবিতার নাম কখনো আমার মাকে। রচয়িতার নাম শামসুর রাহমান। তাঁকে নামে চিনতাম। বিধ্বস্ত নীলিমা নামে তাঁর একটি কবিতার বইও বাড়িতে দেখছি, পড়িনি।
প্রচ্ছদে পুরো কবিতা, তা-ও আবার হাতে লেখা, বিষয়টি সবচেয়ে অভিনব মনে হলো, এর আগে কখনো দেখিনি। প্রথম পংক্তি কখনো আমার মাকে গান গাইতে শুনিনি কবিকে মুহূর্তে আপন মানুষ বানিয়ে দিলো। এমন ঘরোয়া জিনিস নিয়ে সহজ করে লেখা যায় কবিতা! আধুনিক কবিতা বলতে যা বোঝায়, মফস্বলের মধ্যবিত্ত পরিবারে তা খুব একটা ঢোকেনি তখনো। শামসুর রাহমান নামের এক কবি সেই বেড়াটি ভেঙে দিলেন।
কখনো আমার মাকে গান গাইতে শুনিনি মনে পড়লে এখনো রোমাঞ্চ হয়। সেই প্রথমবারের মতো।
পুনশ্চ: এই লেখাটি যাঁরা পড়ছেন, তাঁদের সবার কাছে প্রথম পড়া শামসুর রাহমানের কবিতা বিষয়ে জানার আগ্রহ। কবির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা কবিতে এইভাবেও স্মরণ করতে পারি। পারি না?
মন্তব্য
'এই নিয়েছে,এই নিলো যা-কান নিয়েছে চিলে
চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে'
এটা যদি রাহমানের কবিতা হয়,সম্ভবতঃএটাই প্রথম পড়া । পাঠ্যবইয়ে পড়েছি । এ ছাড়া 'স্বাধীনতা তুমি ' তো ছিলোই ।
সপ্তম শ্রেনীতে আবৃত্তি প্রতিযোগীতায় পড়তে হয়েছিলো 'আসাদের শার্ট' । ২০ বছর পর অবাক বিস্ময়ে আবিস্কার করছি একটা লাইন মনে রয়ে গেছেঃ
'গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো
কিংবা সুর্যাস্তের জ্বলন্ত সুর্যের মতো আসাদের শার্ট
দুলছে হাওয়ায়,নীলিমায় '
-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
আমাদের কালে শামসুর রাহমান পাঠ্য বইয়ে ওঠেননি।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
প্রথম কোনটা পড়েছি?
ঝক ঝকাঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে ওই,
ট্রেন চলেছে ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই?
নাকি-
'এই নিয়েছে,এই নিলো যা-কান নিয়েছে চিলে
চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে'
নাকি-
স্বাধীনতা তুমি রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
(ক্লাশ ফোরেই পড়েছি আপার পাঠ্য বই থেকে।)
নাকি-
কতকাল পরে কন্ঠে তোমার মেয়ে বইয়ে দিয়েছো
চকিতে ঝর্ণাধারা,
যেন শীতার্ত প্রহরে পেলো ফিরে প্রাণ
মৃত পুষ্পের চারা।
তবে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে নীচের কবিতাটি,
কবি-
ধরো তুমি প্রস্তুত হচ্ছো মৌলবাদী বিরোধী সমাবেশে যাওয়ার,
তখন যদি আমি তোমার যাত্রায় বাঁধা দেই,
না প্রিয়তমা, সেদিন আমি কোন বাঁধাই মানবো না,
তোমাকে সঙ্গী করে, দ্রোহের দীপক রাগিনী হয়ে
নিশ্চিত মিশে যাবো ভাস্বর জনস্রোতে।
(এই কবিতাটিতে কিছু ভুল হতে পারে, কেউ জানলে সংশোধন করে দিবেন। অগ্রিম ধন্যবাদ।)
রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।
বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।
আমি তো রীতিমত সম্পাদনা করেছি শামসুর রাহমানের কবিতা।
সে গল্পই আলাদা করে পোস্ট দিলাম।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
আমার কি আছে এরকম ঘটনা! কি জানি মনে হয় না।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
চিলের কান নেয়ার কবিতটাই মনে হয় প্রথম পড়া। তার পর স্বাধীনতা তুমি।
প্রথম পড়া কবিতা : 'স্বাধীনতা তুমি'।
প্রথম বই: বন্দী শিবির থেকে।
শামসুর রাহমানের আর কোনো পাঠক নেই? না, প্রথম কবিতা পাঠের স্মৃতি লুপ্ত?
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
নতুন মন্তব্য করুন