দেহকাণ্ডের মূল (পর্ব ১)

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি
লিখেছেন মুহম্মদ জুবায়ের (তারিখ: রবি, ১৯/০৮/২০০৭ - ১:২৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাপে জিন্দা থাকলে কইতো, ডাকতার ব্যাটা কী বুঝে?

বাপের তেজ ইয়াসির আলীর চরিত্রে বর্তায় নাই। ফলে, মাসখানেক ধরে ছোটোবড়ো নানা রকমের পরীক্ষার পরেও যখন তার ঠিক কী হয়েছে ডাক্তার পরিষ্কার করে বলতে পারে না - তবে ক্যানসার, টি বি বা ব্রংকাইটিস যে না, এমনকি হার্টের গণ্ডগোলও না জানা গেছে - তখন তার ভারি মন খারাপ হয়।

পঞ্চাশ হয়-হয় বয়সে ক্যানসারের মতো বড়ো কিছু একটা লেগে গেলে জীবনে এই প্রথম তাবৎ লোকজনের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠার একটা বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হতে পারতো। খবর পেয়ে জ্ঞাতিগুষ্টি, ইয়ার-দোস্তরা ভিড় করে আসবে হসপিটালে, আহা রে, তোমার মতন মাইনষের এইডা ক্যামনে হইলো - এইরকম একটা ছবি মনে মনে সে দেখতেও শুরু করে দিয়েছিলো। জানের দুশমন বলতে তার কেউ নাই, সারা জীবনেও না, নিতান্ত অপছন্দের দুইচারজন যারা, তারাও ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় দুঃখ-দুঃখ মুখে বিছানার পাশে বসবে। দাঁতের পিঠে জিভের টোকা দিয়ে চুক চুক আওয়াজ তুলবে, আহা-ওহো করবে। ভেবে খুবই আমোদ হচ্ছিলো। ডাক্তার হয়তো তখন মেয়াদও জানিয়ে দিয়ে গেছে, আর ঠিক কতোদিন সে টিকবে - এক-দুই বা তিন মাস। হসপিটালের ফকফকা বিছানায় শুয়ে সে দরকারি কাজগুলো মনে করবে, বউ-ছেলেমেয়েদের এক এক করে জানিয়ে দেবে কোনটা কোথায় আছে, কীভাবে সামলাতে হবে, কোথায় কীসে কার তদ্বির লাগবে; যদিও সে জানে না, তার বিবেচনায় যেগুলি দরকারি, বউ-পোলাপানরা সেগুলিকে পাত্তা দেয় কি না, দিলে কতোখানি দেয়। বিছানার পাশে তখন লোকজনের আনাগোনার শেষ নাই। ভিড়-ভাট্টা দেখে ডাক্তার বিরক্ত হবে। নার্স গলা তুলে বলবে, রুগীর ভালো চাইলে আপনেরা এখন যান গিয়া, ভিজিটিং আওয়ারে আইসেন। তবু ভিড় পাতলা না হলে ইয়াসির আলী ঠিক বুঝে নেবে, তাকে ভালোবাসে বলেই না ওরা যেতে চায় না, আশেপাশে ঘুরঘুর করে। না হলে আর কি! ভালো থাকলে কেউ কি আর হসপিটালে থাকে!

বালক বয়সে ইয়াসির আলী নাগরমহলে একটা বাংলা বই দেখেছিলো। চিরাগ জ্বেলে..., নাঃ, চিরাগ না, দুরো হালায় মুখে ঠিকমতন দেখি আইবারও চায় না - দীপ জ্বেলে যাই। সেই বইয়ে সুচিত্রা সেন হাসপাতালের নার্স, তার সঙ্গে প্রেম-ভালোবাসা হয় রুগীর। রুগী ব্যাটাই হিরো, নামটা খেয়াল আসে না। না না, মনে পড়ছে, অর নাম আছিলো বসন্ত্ চৌধুরী। বইতে কী সুন্দর একখান গান আছিলো, এই রাত তোমার আমার...। হেমন্ত্ কুমার গান করতে করতে শিস ভি দেয়! উত্তম কুমারের বইয়েও সুচিত্রাকে নার্স হতে দেখেছে মনে আছে। দেখতে বহুতই সুন্দর আছিলো সুচিত্রা। পাকিস্তান-ইন্ডিয়ায় যুদ্ধ করলো, তারপর ইন্ডিয়ান সিনেমাও বন্ধ্। সুচিত্রাবিহনে বড়োই আফসোসের সঙ্গে ইয়াসির আলী তখন ভাবে, আমাগো পাবনার মাইয়া তুই ইন্ডিয়া গেলি কী’র লাইগা? অহন তরে পাই কই? ঊর্দু বইয়ের নাচনেওয়ালি নীলো তখন আইয়া পড়ছে, কমবয়সী পোলাগো সপ্নো কি রানী। নীলোর বই দেখে ভোররাতে ঘুমচোখে লুঙ্গি বদলাতে হয়নি এমন পোলা তখন কেউ আছিলো? যদি থাইকা থাকে, ব্যাটাগো শইলের কই কি গলতি আছিলো খবর লওন দরকার। নীলো বিবি স্বপ্নের রানী হয়ে উঠলে সুচিত্রা সেনের অভাব ভুলে যাওয়া তখন সম্ভব হয়েছিলো। এই এতোদিন পরে এখন আবার তার কথা খুব মনে পড়ছে।

সুচিত্রা সেনের বই দেখার বয়স থেকে ইয়াসির আলীর হসপিটালে কয়টা দিন থাকার শখ। নিজের জন্যে কোনোদিন যেতে হয়নি, তবু হাসপাতালে জীবনে যায়নি এমন মানুষ তো আর হয় না। কাউকে হয়তো সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়েছে ভর্তি করাতে, রোগী দেখার জন্যেও অনেকবার গেছে। সিনেমার হসপিটালের সঙ্গে বেশি মিল নাই মিটফোর্ড বা ঢাকা মেডিক্যালের। ডাক্তার-নার্স আছে ঠিকই, সুচিত্রা সেন যে সেইখানে পাওয়া যায় না তা-ও সে বুঝে গিয়েছিলো যথাসময়ে। হাসপাতাল বাসের বাসনা অবশ্য তার যায় নাই। সফেদ বিছানায় সে শোয়া, মায়াময়ী মুখের নার্স থার্মোমিটার হাতে তাকে হাঁ করতে বলছে, আধোঘুম থেকে তুলে ওষুধ খাইয়ে দিচ্ছে, একটু অবাধ্য হলে সুচিত্রা সেনের মতো আদুরে গলায় বলছে, এমন অবুঝের মতো করলে কী করে চলবে?

ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয় ইয়াসির আলীর।

মগর এখন ডাকতারে যা কয়, তার মানে হসপিটালে যাওয়া এইবারও কপালে নাই। কী মুসিবত! খুব আশা করেছিলো সে। নিরাশার হাত ধরে মন-খারাপ হতে আর কতোক্ষণ?

বড়ো ছেলে সঙ্গে গিয়েছিলো ডাক্তারের চেম্বারে। বাপের মারাত্মক কিছু হয় নাই শুনে একটা নিশ্চিন্তির হাসি ফোটায়, দেখে পিত্তি জ্বলে যায় ইয়াসির আলীর। বলতে ইচ্ছা হয়, হাসস ক্যান? বাপের দিলে কি চায়, তার খবর তো লইবা না!

বলা হয় না, ইনভারসিটি পড়া বাইশ বচ্ছরের বিদ্বান পোলার ওপর মেজাজ করার যোগ্যতা সে হারিয়েছে অনেক আগেই। এই পোলা তার খানদানে পয়লা ম্যাট্রিক পাশ। তারপর ছয় ছেলেমেয়ের মধ্যে দুই নম্বর ছেলে আর বড়ো মেয়েটাও টুক টুক করে কলেজে পৌঁছে গেলে ইয়াসির আলীর প্রত্যয় হয়, বয়সকালে একটু লাইগা থাকলে তারও হইতে পারতো। এইসব ছেলেমেয়ের বাপ হওয়ার যোগ্যতা যখন তার আছে, তাদের মতো বিদ্যাশিক্ষা করা কী আর এমন অসম্ভব ছিলো? কাজটা করতে পারলে মানুষজন কিছু ইজ্জত করতো। বয়স হলে চুলে পাক ধরলে লোকে এমনিতেই বাজারে রাস্তাঘাটে সালাম-টালাম দেয়, কমবয়সী পোলাপানরা হাতের পাঞ্জার আড়ালে সিগারেট লুকায়। কিন্তু তারপরেও লেখাপড়া জানা মানুষের মধ্যে কী জানি কী একটা থাকে, দেখেছে লোকে তাদের কথা খুব শোনে। বয়সে ছোটো হলেও। নিজের ঘরেই তো দেখে আসছে - বউয়ের কাছে লেখাপড়া করা পোলাপানের কথার দাম বেশি, অল্পবিদ্যা ইয়াসির আলীরে পোছে ক্যাঠা?

ডাক্তারখানা থেকে বেরিয়ে দেখে, আকাশে মেঘ। সন্ধ্যা হতে এখনো দেরি, মেঘের দাপটে এখনই সন্ধ্যা-সন্ধ্যা লাগে। বেবি ট্যাক্সিতে পেছনের সীটে দুই পা মুড়ে বসে ঝিমাচ্ছিলো আমানত। সাদাসিধা পোলাডা, ড্রাইভারও ভালো। কোনো আজাইর‌্যা কামের মধ্যে নাই, পাঁচ লিটার তেলের ট্যাকা লইয়া তিন লিটার কেনে না, পার্টস খুইলা লইয়া ধোলাইখালে বেচে না। দোষের মধ্যে একটা, খালি ঘুমাইবার চায়। মাসকাবারি ট্যাকা না দিয়া খালি ঘুমাইতে দিলেও মনে হয় আপত্তি হইবো না ব্যাটার। আমানত তার নিজস্ব ড্রাইভার, কিন্তু এই বেবি ট্যাক্সিটা ইয়াসির আলীর নিজের না। বউয়ের আটটা বেবি চলে ঢাকা শহরে, তারই একটা আজকের দিনের জন্যে ধার নিতে হয়েছে।

ইয়াসির আলীর নিজেরও একখান বেবি আছে Ñ বাসা-দোকান-বাজার ছাড়াও এখানে-ওখানে যাওয়া চলে। কয়দিন ধরে ইঞ্জিনে একটা বদখত আওয়াজ হচ্ছিলো, কাল পাঠানো হয়েছে মেরামতের জন্যে। হালার বেবিও অসুখ সারাইতে হসপিটাল যাইতে পারে। আর ইয়াসির আলীর বেলায়?

আল্লায় দিলে গাড়ি কেনার ক্ষমতা তার আছে, চিন্তা যে দুই-একবার করে নাই তা-ও না। নারিন্দার বাসার গলিতে দুই রিকশারই পাশ কাটানের জাগা নাই, গাড়ি কিনলে তখন আরেক মুসিবত হইবো না? ইসলামপুরের দোকানে যাওয়া-আসার গ্যাঞ্জামও কি কম! রিকশা ঠ্যালা ট্রাক বাস টেম্পো আর মানুষজন Ñ ভিড়ে সয়লাব। যার খায়েশ আছে গাড়ি নিয়ে যাক এই জঙ্গলে, সে এর মধ্যে নাই। বেবিতেই সুবিধা - তিন চাকার সামনেরটা ভিড়ের মধ্যে ভিড়াইয়া দিতে পারলে পিছনের দুইটাও আটকাইয়া থাকে না, ব্যবস্থা একটা হইয়া যায় কোনোমতে।

ছাব্বিশ বছর আগে শাদীর রাতে দেনমোহরের পুরো টাকা ইয়াসির আলী বউয়ের হাতে নগদ তুলে দিয়েছিলো। চিরকাল এইরকমই হয়ে আসছে তাদের খানদানে। বউয়ের কাছে ঋণী হয়ে থাকার দরকার নাই, এক দিনও না। ইয়াসির আলীর শ্বশুর চকবাজারে মনোহারী জিনিসের পাইকারি ব্যবসাদার, শ্বশুরের মেয়েরও ব্যবসাবুদ্ধি খারাপ না, দেনমোহরের কিছু টাকা দিয়ে প্রথমে তিনটা রিকশা কিনেছিলো। দুই-চারটা করে বাড়তে বাড়তে ক্রমে গোটা তিরিশেক রিকশার মালকিন হয় সে। পরে এতোগুলি মানুষজন সামলানোর ঝামেলা আর খটাখটি বেড়ে গেলে বউ বিরক্ত হয়ে ওঠে। কয়েকটা রেখে বাকি রিকশাগুলো বেচে দিয়ে বেবি ট্যাক্সি কিনে ভাড়া লাগায় সে বছর কয়েক আগে। এখন বোধহয় আটটা বেবি আর গোটাদশেক রিকশা আছে। সেই হিসাব অবশ্য ইয়াসির আলীর সঠিক জানা নাই।

বউয়ের রোজগারের টাকাকড়ি, তার ব্যবসার ঝুটঝামেলা নিয়ে সে কোনোদিন মাথা ঘামায় নাই। ঘামাইতে চায়ও নাই। সংসারে বউয়ের আর খরচা কি, শাড়ি-গয়নাপাতির দিকেও বিশেষ ঝোঁক দেখা যায় না, রিকশা-বেবির রোজগারের সব টাকাই তার জমা পড়ে। জমানো টাকাপয়সায় বউ গুলশান আর উত্তরায় দুইটা প্লট কিনেছিলো বেশ আগে। গুলশানে বাড়ি তুলে ভাড়া দিয়েছে এক ফরেন কোম্পানিকে। উত্তরায় উঠছে আরেক বাড়ি, নিজেদের জন্যে। ইয়াসির আলী নিজে দেখতে যায়নি, শুনেছে আলিশান দুইতলা বাড়ির প্রায় সবই কমপ্লিট, ওপর-নিচ মিলিয়ে গোটাদশেক ঘর, ছাদ ঢালাই শেষ, মার্বেল পাথরের মেঝে - বাকি কাজ মাস দুইয়ের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। তারপর নাকি সবাই মিলে নতুন বাড়িতে উঠে যাওয়া হবে। তাকে কেউ একবার জিজ্ঞাসাও করেনি, সে নারিন্দার বাসা ছেড়ে উত্তরায় যেতে চায় কি না, তার মতামত কি, সুবিধা-অসুবিধা কি। সিদ্ধান্ত তার অজান্তে হয়ে গেছে। বউ স্পষ্ট বলে দিয়েছে, পুরান ঢাকার এই গলিতে আর সে বাস করতে চায় না। পোলাপানগুলিও মায়ের দলে, ওরা বড়ো হয়ে দলে ভারী হচ্ছে, তাদের গলার আওয়াজও এখন জোরদার। অথচ একখান মোটে বউ, তার আপনা মানুষ, অরেও এখন কেমন পর-পর লাগে। চেনা যায় না। ছেলেমেয়েরা কি বুঝিয়েছে কে জানে, বউ একদিন বলে, অ্যারিস্টোক্যাট পাবলিকে কি আর ওল্ড ঢাকার মইদ্যে থাকে? হগলতেই উইঠা বনানী যায়, গুলশান যায়, দ্যাহেন না?

বাপদাদার বসতভিটা ত্যাগ করে বউয়ের পয়সায় বানানো চকচকে নতুন বাড়িতে উঠে যাওয়ার মতো অ্যারিস্টোক্যাট ইয়াসির আলী হয়েছে বা হতে চায়, কে বললো?

সে আস্তে করে বলেছিলো, তা তোমরা আমারে একলা ফালাইয়া যাইবা নাকি?

আপনেরে রাইখা যাইতাছে কে? যাওনের টাইম হইলে একলগেই যামু।

সবাই যে একসঙ্গে নতুন বাড়িতে উঠে যাওয়া হচ্ছে, তা-ও জানা ছিলো না। ভাবে, সে কবে থেকে সংসারের হিসাবের বাইরে চলে গেলো? তার হয়ে অন্যেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছে। মানেটা কি?

মানে যা-ই হোক, ইয়াসির আলী তার নাগাল পাওয়ার আশা রাখে না। এই সংসারের এক লম্বর মানুষ সে, সংসারের মাথা। তার কথায় সবাই চলবে, ওঠাবসা করবে - এই রকমই না হওয়ার কথা। বাপে জিন্দা থাকতে তাই দেখেছে সে। বাপের কাছে শুনেছে, দাদার আমলেও সেই রকমই আছিলো সব। কী যে দিনকাল পড়লো, তার বেলায় খালি সব উল্টাইয়া যায় গিয়া। কাজকারবার দেখলে তো মনে লয়, ইয়াসির আলী এই বাড়ির কেউ না, দয়া কইরা তারে থাকতে দিছে এইখানে। সে যদি এই বাড়ির কেউ হয়, তাইলে তারে বাদ দিয়া সব ঠিক হয় কেমনে?

এই যে মাসখানেক ধরে শরীরের গড়বড় নিয়ে সে ডাক্তারদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছে, তারও মাথামুণ্ডু কিছু বোঝা যাচ্ছে না। একটু হাঁটাচলাতেই হাঁফ ধরে যায়, শ্বাস নিতে কষ্ট, তখন বসে পড়ে হাঁ করে মুখ দিয়ে বুকের ভেতর বাতাস টানতে হয়। সেই সময় হাজির হয় শুকনা কাশি, নিশ্বাসের সঙ্গে বুকের মধ্যে বাঁশির মতো পিঁ পুঁ আওয়াজে বোঝা যায় কাশি জমে আছে, কিন্তু এক নাগাড়ে খকখক করাই সার, গলায় কিছু উঠে আসে না। ঘুমের গোলমালও আছে। দিনে ঘুমানোর অভ্যাস ইয়াসির আলীর কোনোদিন নাই, কিন্তু আজকাল দিনে-দুপুরে যখন-তখন খালি ঘুম পায়। দোকানে ব্যাপারিদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সমানে হাই উঠতে থাকে। দোকানে পেছনের দিকে কাপড়ের গাটঠি সাজিয়ে একটুখানি জায়গা ঘিরে নিতে হয়েছে, সেখানে গিয়ে তখন শুয়ে থাকতে হয়। দশ-পনেরো মিনিটের একটা ঘুমের চটকা, কিন্তু এইটুকু না হলে চলে না। দিনের মধ্যে তিনচারবার এখন এই করতে হচ্ছে।

রাতের ঘুমের অসুবিধা তার সারাজীবনে ছিলো না। বিছানায় গিয়ে পড়লে বড়োজোর পাঁচ মিনিট, তার মধ্যেই অটোমেটিক মেশিন চালু হয়ে যায়। মেশিনের খবর অবশ্য বউয়ের মুখে শোনা, ঘুমের মধ্যে নিজের নাকের গর্জন সে শোনে কি করে! এখনো ঘুমিয়ে পড়তে সমস্যা নাই, শুধু রাতের মধ্যে অনেকবার ঘুম ভেঙে ভেঙে যায়। উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখে, সবগুলি মনেও থাকে না। গাঢ় ঘুমের মানুষেরা স্বপ্ন দেখে না। আজকাল সে দেখে। মরা বাপ-মা খোয়াবের মধ্যে আজকাল ঘন ঘন আসে। একদিন দেখে, নৌকা করে কোথাও যাচ্ছে সে, সঙ্গে বাপ-মা দুইজনই। সে নৌকার পাটাতনে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশে ভয়ংকর ঘন কালো মেঘের ছোটাছুটি দেখে। হাসি হাসি মুখে বাপ বলে, ডর লাগে রে, বাপ? তারপর খোয়াবের মধ্যে যা হয়, উত্তরে কিছু বলার আগেই দেখে তার পাশে বাপ-মা কেউ আর নাই। সে একলা, একেবারে একলা। নৌকায় মাঝি কেউ ছিলো কি না, আগে খেয়াল করে দেখেনি, এখন দেখে গলুইয়ের কাছে কেউ নাই। নিজে সে নৌকা চালাতে জানে না, এখন কি হবে? এইবার তার একটু ভয় ভয় করে। হঠাৎ দেখে, আকাশে কালো মেঘের মধ্যে বাপের হাসিভরা মুখ। জেগে বিছানায় উঠে বসে ইয়াসির আলী। খোয়াবে দেখা হাসিমুখটা বাপের অনেক কম বয়সের, মরার আগে তার মুখটা আরো অনেক বুড়া-বুড়া দেখাতো, সামনে একটাও দাঁত ছিলো না। কিন্তু খোয়াবের মধ্যে হোক আর জেগে হোক, বাপের ওই হাসি হাসি মুখখানই যে সবসময় মনে আসে! মাথার মধ্যে কোথাও অন্য সকলের একেকটা ছবি মনে হয় খোদাই হয়ে থাকে, কাউকে ভাবলে তার সেই বাঁধানো ছবিটাই সামনে এসে হাজির হয়। আচ্ছা, তার কথা ভাবলে বউ বা পোলাপানের চোখে কেমন ছবি আসে? জানার কোনো কায়দা আছে!

ইয়াসির আলীর নিশ্বাসের অসুবিধা শুনে ডাক্তার প্রথমে সন্দেহ করেছিলো, হার্টের কেস। বহুত রকম টেস্ট-মেস্ট করে বলে, হার্ট তো ঠিকই আছে।

তাহলে? গোলমালটা কোথায়?

ডাকতারে তখন কয়, টি বি হইলেও হইতে পারে। হাতের মইধ্যে ইঞ্জেকশন ফুটাইয়া দুইদিন পরে পরীক্ষা করে, হালায় টি বি-ও খুঁইজা পায় না। তাইলে এখন যাও, এক্স-রে করাও। ইয়াসির আলী জীবনে প্রথম তার বুকের হাড়-পাঁজরের তসবির দেখে ডাক্তারের সঙ্গে। বড়ো সাদাকালো নিগিটিভ কিসিমের ছবি দেখিয়ে ডাক্তার কী যেন বোঝানোর চেষ্টা করে। সে শুধু এইটুকু বোঝে, ডাকতারে নিজেই অহনতরি কিছু বোঝে নাই। এইবার তাইলে ক্যাট-স্ক্যান করাও। ডাক্তারদের সবকিছুই বেশ লাইন দিয়ে সাজানো থাকে মনে হয় - এইটার পরে ওইটা, ওইটার পরে সেইটা। কিন্তু হালায় যে কী খোঁজ করে, কেউ কইতে পারে না, হ্যায় নিজে ভি না। ক্যাট-স্ক্যান নিয়া একটু ধন্দে পড়েছিলো ইয়াসির আলী, এই জিনিসটা আবার কি? বিড়াল-টিড়াল দেখাইবো নাকি? হালায় কীসের কি, সরু একখান বিছনার মইদ্যে পা উঁচা কইরা শোয়াইলো, সারেন্ডার করনের মতন হাত দুইখান মাথার উপ্রে তোলা। গোঁ গোঁ আওয়াজ করা বিরাট একখান মেশিনের মইদ্যে শইলডা লইয়া ফালাইলো। মেশিনে একবার কয়, দম বন্দ্ করো, আবার কয় দম ছাড়ো। মেশিনই চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা ইয়াসির আলীরে নিয়া একবার আগে যায়, আবার পিছায়। অপারেটর তার হাতে সুঁই ফুটিয়ে বলে, এইবার আপনের খুব গরম লাগবো। সত্যিই কান-মাথা গরম হয়ে ওঠে অল্পক্ষণের জন্যে। ব্যস, হয়ে গেলো ক্যাট-স্ক্যান।

দুইদিন পরে ডাক্তার ফোন করে বলে, যা যা পরীক্ষা করার আছিলো, সবই তো করলাম, এখনো কিছু ধরতে পারি নাই।

খবর নতুন না, ইয়াসির আলী আগেই জানে। জিজ্ঞাসা করে, তাইলে এখন কি হইবো?

আপনে আরেক ডাক্তারের কাছে যাইবেন, উনি লাং স্পেশালিস্ট। (কীসের ইসপিশালিস্ট কইলা, ডাকতার? খারাপ কথা কও ক্যান?) কালকা বিকাল চারটার সময় যাইবেন ডাক্তার বাসেত ভুঁইয়ার চেম্বারে, আমি বইলা রাখছি। যাওয়ার সময় এক্স-রে আর ক্যাট-স্ক্যান ফিল্মগুলা নিয়া যাইয়েন, ডাক্তার ভুঁইয়ারে দেখাতে হবে।

ইয়াসির আলীর ধারণা, এইসবের দুইখান মানে হইতে পারে। এক হইবার পারে খবর খুবই খারাপ, চেনা ডাকতার নিজের মুখে কিছু কইতে চায় না, আরেকজনের মুখ দিয়া হুনাইবো। আর হইতে পারে, এই হালার পুতে কিচ্ছু জানেই না, এখন তারে আরেকজনের হাওলা কইরা দিয়া কাট মারবার চায়। টাকা-পয়সার মায়া ইয়াসির আলীর নাই, কিন্তু এতো সময় নষ্ট না কইরা ব্যাটা আগেই বড়ো ডাকতারের কাছে তারে ভিড়াইয়া দিবার পারতো।

কাগজপত্র দেখে ডাক্তার বাসেত ভুঁইয়া জানায়, বায়োপসি আর ব্রংকোস্কপি করতে হইবো।

এইগুলি আবার কি? কতো যে নতুন কথা শুনছে ইয়াসির আলী! আরো কতো বাকি, কে জানে?

বাসেত ভুঁইয়া বুঝিয়ে দেয়, হাসপাতালে যেতে হবে তাকে। ওষুধে ঘুম পাড়িয়ে তার নাক দিয়ে নল ঢোকানো হবে বুকের ভেতরে। নলের সঙ্গে যাবে ফটো তোলার যন্ত্র। সেই যন্ত্র ঘুরে ঘুরে ফটো তুলবে আর সেগুলো ডাক্তার দেখবে কমপিউটারে, বোঝার চেষ্টা করবে গোলমালটা কই।

ইয়াসির আলী খুব আশা নিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কয়দিন থাকতে হইবো হসপিটালে?

না না, থাকার দরকার নাই, তিন-চার ঘণ্টার ব্যাপার। বাসায় গিয়া দুপুরে ভাত খাইতে পারবেন।

কোনো মানে হয়? আর সবকিছুর মতো তার হাসপাতালে যাওয়াটাও আধা-খ্যাঁচড়া কারবার। যাবে ঠিকই, নিয়মমতো নিজেকে ডাক্তার-নার্সের হাওলা করে দিতে হবে। বিছানায় শুয়েও থাকতে হবে। তবু হাসপাতালে থাকা হচ্ছে না। ওয়ার্ড নম্বর বেড নম্বর থাকবে না, কোনো দর্শনার্থী আসার সুযোগও থাকছে না। তাহলে আর কি?

হাসপাতালে যা ঘটবে তার বিবরণ শুনে জীবনভর সেভাবে ডাক্তারের হাতে না-পড়া ইয়াসির আলীর কিছু অস্বস্তিও হয়। অন্ধকার রাতে অজানা অচেনা জায়গায় যাওয়ার মতো উৎকণ্ঠা। তবু সময়মতো হাজির হয় সে খুব সাহসী মুখ করে। কাউকে না জানিয়ে একাই আসার ইচ্ছা ছিলো, কী ভেবে আগের রাতে বউকে বলেছিলো। বউ কি আর তাকে একা ছাড়ে? লগে না গেলে মাইনষে কথা কইবো না?

হাসপাতালের গাউন পরিয়ে রুগী হিসেবে বিছানায় শোয়ানো হলে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। না ভয়, না শংকা, না উৎকণ্ঠা। তবু কী যেন একটা বুকের মধ্যে খরচরমচর করে আঁচড় কাটে। ব্যাপারটা পছন্দ হয় না, অন্যকিছু একটা ভাবতে চেষ্টা করে সে। বউকে আচমকা জিজ্ঞাসা করে, তোমারে নিয়া অনেকদিন আগে ট্রেনে কইরা একবার সিলেট গেছিলাম, মনে আছে?

বউ স্পষ্টই অবাক হয়। এতো বছর পরে হঠাৎ? কী মনে করে? সে পাল্টা জিজ্ঞাসা করে, এই কথা মনে হইলো ক্যান আপনের?

না, এমনেই। ঢাকা শহরের বাইরে তার আগে তুমি কুনোদিন যাও নাই, ঠিক না?

বউ উত্তরে কিছু বলার আগেই নার্স আসে। না, সুচিত্রা সেন না। শ্যামলামতো গায়ের রং নার্সের, বয়স বোঝা যায় না, বড়ো বড়ো দুইখান চোখ, কিন্তু শইলে কিচ্ছু নাই বেডির, খালি হাড্ডি। সে ইয়াসির আলীর পালস্ দেখে, টেমপারেচার নেয়, টুকিটাকি কথাবার্তা বলে, হাতের কব্জিতে সুঁই ফুটিয়ে আই ভি লাগায়। পাশ ফিরিয়ে কোমরের কাছে ইঞ্জেকশন ফুঁড়ে বলে, খানিক বাদে আপনের ঘুম আইসা পড়বো।

চাকা লাগানো বিছানায় এতোক্ষণ শুয়ে ছিলো, ইয়াসির আলী বুঝতে পারেনি। বোঝে যখন বিছানাসহ ঠেলে তাকে অন্য একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। বউকে এই ঘরে আসতে দেওয়া হবে না, এইখানে সে একলা। ডাক্তার ভুঁইয়া আর তার দুই অ্যাসিসট্যান যন্ত্রপাতি ফিট করে বসে আছে। এইবার যাইবা কই, ইয়াসির আলী?

একটা মোটামতো প্লাস্টিকের নল হাঁ করা মুখের ভেতরে ঢুকিয়ে নার্স তাকে মুখ দিয়ে শ্বাস টানতে বলে। বাধ্য ছেলের মতো মান্য করে সে। নল দিয়ে এক ধরনের সাদা ধোঁয়া নিশ্বাসের সঙ্গে গলায় ঢুকে যাচ্ছিলো, গলা শুকিয়ে অনুভূতিশূন্য হয়ে যায়। নার্স এবার নাকে অক্সিজেনের নল লাগিয়ে দিলে নিজেকে সত্যিকারের রুগী বলে মনে হয় তার।

ডাক্তার-নার্সদের কথা শুনতে শুনতে কখন ঘুমে তলিয়ে গেছে জানে না। ঘুম ভাঙলে দেখে আগের ঘরে তাকে ফেরত দিয়ে গেছে। বউ বিছানার পাশে চেয়ারে বসা। কোথায় কীভাবে কী করা হয়েছে, কিছুই টের পায়নি সে, মনেও নাই। শুধু ডানদিকে নাকের ভেতরে সামান্য চিনচিন করে। এই নাক দিয়েই বোধহয় নল ঢুকিয়েছিলো।

বউ জিজ্ঞাসা করে, কেমুন লাগতাছে?

খুব খিদা লাগছে। আর কিছু তো টের পাই না।

দুইদিন পরে ডাক্তারের রিপোর্ট আসে, এবারও কিছু পাওয়া যায়নি। বঢ়ি আজিব বাত! ক্যানসার নাই, ব্রংকাইটিসও না। এতো এতো টেস্ট করেও কিছু পাওয়া যাচ্ছে না, কিন্তু গড়বড় তো একটা ঠিকই আছে। এখন তাহলে কি?

ক্যানসারের সম্ভাবনা বাতিল হয়ে গেলে ইয়াসির আলীর একটু কি মন খারাপ লাগে? ক্যানসার। রোগের নামেই রুগী আধামরা। তা না হয় না হলো, ব্রংকাইটিসটা অন্তত হতে পারতো। নাকি পারতো না? অসুখের নামটাই কী ব্যাটা ব্যাটা! বিমারির নাম কি? না, ব্রংকাইটিস! পুরুষ মাইনষের অসুখ হইলে নাম এই রহমই হওনের কথা। ব্রংকাইটিস। কইতেও কতো ভাল্লাগে!

(আগামী পর্বে সমাপ্য)


মন্তব্য

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

জমজমাট!
কাহিনীতে যেমন বৈচিত্র্য আছে, তেমনি রম্যটাও উপভোগ্য হয়েছে।
পরের পর্বে যাচ্ছি
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

ধন্যবাদ, জ্বিনের বাদশা জাঁহাপনা।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।