বেবি ট্যাক্সিতে ঘুমন্ত আমানতকে একনজর দেখে পাঞ্জাবির বুকপকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে ইয়াসির আলী। সিগারেট ধরিয়ে ছেলেকে জিজ্ঞাসা করে, আমার লগে গদিত যাবি?
ইয়াসির আলীর থান কাপড়ের হোলসেলের ব্যবসায় চার ছেলের কারোই কোনো উৎসাহ নাই। যে যার নিজের মতো আছে তারা। মাথাব্যথা শুধু তার একার! বাপে চক্ষু দুইখান বন্ধ করলে তখন বুইঝো, বাবারা! সে অবশ্য জানে, চোখ মুদে ফেলতে এখনো ঢের বাকি তার। ততোদিনে মেয়েদের বিয়াশাদী হয়ে যাবে, ছেলেরা লেখাপড়া শেষ করে লায়েক হবে। তার আশঙ্কা, সে চোখ বুজলে পৈত্রিক ব্যবসাটাও অবিলম্বে ইন্তেকাল করবে। আর নারিন্দার বসত কি তার আগেই চলে যাবে উত্তরায়?
আপনের শরীল খারাপ, কইলে লগে যাইতে পারি। ছেলে আস্তে করে বলে, তার কথায় অনিচ্ছা খুব অস্পষ্ট থাকে না।
ইয়াসির আলী ভাবে, তার সিরিয়াস কিছু হয় নাই কথাডা ডাকতারে না কইয়া ফালাইলে কি এমুন কইরা কইতে পারতো? এমন ভাব, যেন তাকে উদ্ধার করে দিচ্ছে পোলা! ক্যানসার হয়েছে জানলে ছেলের গলার আওয়াজ কেমন হতো? জানার উপায় নাই, ডাক্তার দিয়েছে সব গড়বড় করে। সে বলে, থাউক, তর যাইয়া কাম নাই। আমারে দোকানে নামাইয়া দিয়া বেবি লইয়া তুই বাসায় যা গিয়া।
আমি এখন বাসায় যামু না।
তয় কই যাবি?
সলিমুল্লাহ হলে এক দোস্তের লগে দ্যাখা করতে হইবো।
আইজই যাইতে হইবো?
হ, কাম আছে।
কী এমুন দরকার?
আছে, আপনে বোঝবেন না।
বাঃ, পোলা রে আমার! ইয়াসির আলী খেয়াল করে দেখেছে, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে আজকাল অল্প কয়েক কথার পরেই গাঙের চড়ায় স্টীমার আটকে যাওয়ার মতো ঠেকে যাচ্ছে, কথাবার্তা সেখানেই শেষ। আপনে বোঝবেন না মানেডা কি? আমি তগো বাপ লাগি তো, না কি? বয়সে তগো বড়ো না? দুনিয়াদারি তগো থিকা কম দেখি নাই রে, বাপ! দীর্ঘশ্বাস চেপে ইয়াসির আলী মনে মনে বলে, তা বড়ো বুঝদার হইছো, বাবারা! তোমাগো বুঝ লইয়া থাকো তোমরা।
সিগারেটে একটা জোর টান দেয় ইয়াসির আলী। এই যে এখনো সে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তুই-তোকারি করে কথা বলে, ভয় হয় না জানি কবে নিজের পোলাপানগুলিরেই না আপনে-আপনে করতে হয়! এইগুলা তো তারই পোলাপান। না কি? নিজের জায়গা ছেড়ে দিয়ে পিছু হটতে হটতে এতোদূর পিছিয়ে এসেছে সে! ওইসব জায়গার দখল কি আর এ জীবনে ফিরে পাওয়া হবে? কে কইতে পারে!
তাইলে বেবিডা লইয়া যা গা তুই।
না, আপনে যান। আমি রিকশা ধইরা লমু নে।
মালিকের গলা শুনে ঝিমানি ছুটে গিয়েছিলো আমানতের। বাইরে বেরিয়ে এসে মালিকের সঙ্গে খানিক দূরত্ব রেখে দাঁড়ায়। বেবিতে উঠে বসার আগে ইয়াসির আলী পকেট থেকে দুইটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে। পুত্রধন অনেকক্ষণ বাপের সঙ্গে আছে। তার টাইমের দাম নাই? টাকাটা ছেলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, এইটা রাখ।
না না, লাগবো না, আমার কাছে ট্যাকা আছে।
রাইখা দে, ট্যাকা বেশি হয় না।
হাত বাড়িয়ে টাকা নেয় ছেলে। বেবিতে উঠে ইয়াসির আলী বলে, তাড়াতাড়ি আ’বি তো? বেশি দেরি হইলে চিন্তা লাগে, দিনকাল তো ভালো দেখি না।
বেবি ট্যাক্সি নবাবপুর রোড ধরে ইসলামপুরের দিকে যায়। চুপচাপ সিগারেট টানে সে, সামান্য ক্লান্তি লাগে। সিগারেটের শেষটা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে। ভুঁইয়া ডাকতার এখন অসুখটা ফুসফুসের বলে সন্দেহ করে। তা সে কইতেই পারে, সে ফুসফুসেরই ডাকতার। কিন্তু বিশ্বাস কি? এতোগুলো ডাকতার এখনো ধরতেই পারলো না কীসের অসুবিধা। মানুষ আজকাল যে চিকিৎসা করতে ইন্ডিয়া যায়, থাইল্যান্ড যায় - সাধে যায়? সে-ও যেতে পারে, কিন্তু শুরু যখন এখানেই হয়েছে, দেখা যাক কি পাওয়া যায়। তেমন বুঝলে না হয় বাইরে যাওয়া যাবে।
বংশালের মোড়ে হঠাৎ কামালউদ্দিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক ইয়াসির আলী। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়, রিকশা বা বেবি টাক্সি খুঁজছে। লোকটা যে কামালউদ্দিন, সেটা বুঝতেও সময় লেগে যায়। আগে দেখলে বেবি থামিয়ে কথাবার্তা বলা যেতো, পৌঁছে দেওয়া যেতো যেখানে সে যেতে চায়। এইখানে কামালউদ্দিন? কী মনে করে? সে ধানমন্ডিতে উঠে গেছে সেই কবে, অনেকদিন দেখা-সাক্ষাত নাই। বংশালের মোড় পার হয়ে একটু কেমন সন্দেহও হয়, লোকটা কি আসলে কামালউদ্দিনই? না হওয়ারই কথা। কিন্তু ভুল দেখার কোনো কারণও নাই। তবু কারণ যে একটা আছে, ইয়াসির আলী নিজে জানে। তার কথা কখনো ভাবে কি না কামালউদ্দিন, জানা নাই। খুব জানতে ইচ্ছা করে, ইয়াসির আলীর কথা ভাবলে কি এখনো একটা অর্ডিনারি মুখ মনে পড়ে কামালউদ্দিনের?
স্কুলে পড়ার কালে দোস্তি কামালউদ্দিনের সঙ্গে, দুই গলি পরে তাদের বাসা ছিলো। স্কুলের পরেও যাওয়া-আসা হতো হরহামেশা। ইয়াসির আলীর লেখাপড়ার দম ফুরিয়ে যায় ক্লাস এইটে পৌঁছে, কামাল থামেনি। আর্ট কলেজে পড়ে নামকরা আর্টিস হয়েছে সে। তা নাম হলে কি হয়, এখনো দেখা হলে কাঁধে হাত রেখে কথা বলে, খুবই ইজ্জত করে, পুরান দোস্তের কথা একদম ভোলে নাই।
কামালউদ্দিন একদিন দুপুরে এসে হাজির, কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ। তখন সে আর্ট কলেজে পড়ে, ব্যাগটা তারই সাইনবোর্ড। ইয়াসির আলী খেয়েদেয়ে নিজের ঘরে এসে মাত্র সিগারেট ধরিয়েছে। দরজা খুলে কামালকে দেখে খুশি হয়ে বলে, কী দোস্ত্, এক্কেরে ভুইলা গ্যালা দেহি।
কামালকে নিজের ঘরে নিয়ে বসায়। সিগারেট সাধে। কামাল সিগারেট খায় না। ইয়াসির আলী বলে, চা-সিগ্রেট না খাইলে আর্টিস হওন যায় না, হুনছি। হেইডা তাইলে ঠিক না, কি কও?
কামাল কিছু না বলে সামান্য হাসে। ইয়াসির আলী ভাবে, কামাল কথাবার্তা কমাইয়া দিলো ক্যামনে? আর্টিস হইলে কথা কম কওন লাগে?
না, আসলে বোঝার ভুল। ঝোলার ভেতর থেকে বড়ো সাইজের একটা খাতা আর পেন্সিল বের করে কামাল। বলে, দোস্ত্, তোমার একখান পোর্ট্রটে করুম। কাউলকা জমা দিতে হইবো স্যারের কাছে।
কী করবা কইলা?
তোমার ছবি আঁকুম।
তোমার স্যারে কইছে আমার তসবির বানাইতে? ইয়াসির আলীর বিস্ময় লাগে, কামালের স্যার তাকে চেনে কেমন করে?
কামাল বলে, না, ঠিক নাম ধইরা তোমার কথা কয় নাই, যে কেউ একজনের হইলেই হয়। আমি ভাবলাম, তোমার মুখখানই আঁইকা ফালাই। তুমি চুপ কইরা কতোক্ষণ বইয়া থাকো তো, দোস্ত্।
কাগজ-পেন্সিল নিয়ে বসে যায় কামালউদ্দিন। ইয়াসির আলীকে ভালো করে দেখে। কাগজে কিছু দাগটাগও দেয়। তারপর বলে, না দোস্ত্ কিছু মনে কইরো না, তোমারে দিয়া হইবো না।
ক্যান হইবো না? আমার চেহারা খারাপ?
তা না। তোমার চেহারা ঠিকই আছে। মগর গণ্ডগোলও হইলো গিয়া ওইখানেই।
ইয়াসির আলীর বিভ্রান্ত মুখ দেখে কামালউদ্দিন বুঝিয়ে বলে, সব মানুষের চেহারায় এমন একটা কিছু থাকে যা দিয়ে তাকে আলাদা করে চেনা যায়। কারো টিয়া পাখির ঠোঁটের মতো বাঁকানো নাক, কারো চোখ শালিখের চোখের মতো, কারো কপাল ছোটো, কারো সামনের দাঁতদুটো দেখলে খরগোসের চেহারা মনে আসে, কোনো কোনো মানুষের মুখে সবকিছু বাদ দিয়ে গোঁফটাই হয়তো চোখে পড়ে - এইরকম আর কি। ইয়াসির আলীর মুখে তাকে আলাদা করে চেনানোর মতো সেরকম কোনোকিছু নাই। একেবারে সাদামাটা গোলাকার মুখমণ্ডল - নাকের জায়গায় নাক, কানের জায়গায় কান, ঠোঁট ইত্যাদি। গোঁফদাড়ি পরিষ্কার করে কামানো, একটু ছাগলদাড়ি থাকলেও চলতো। এই ধরনের মুখের ছবি আঁকা খুব কঠিন বলে মতামত দেয় কামাল।
মনে আছে কামালউদ্দিন সব শেষে বলেছিলো, তোমার মুখখান খুবই অর্ডিনারি, দোস্ত্।
কামালউদ্দিনের সঙ্গে আজও দোস্তি ঠিক থাকলেও ইয়াসির আলী ওই অর্ডিনারি কথাটা কোনোদিন ভোলে নাই। ভোলা কি যায়? সে জোর একটা ধাক্কা খেয়েছিলো। সেদিন পর্যন্ত নিজের চেহারা নিয়ে খানিকটা লুকানো গর্ব ছিলো, কামালউদ্দিন তার অহংকারের চাকা পেরেকের খোঁচায় পাংচার করে দিয়ে যায়। পেরেকটা আজও বুকের কোথাও আটকে আছে, টের পায় সে।
কাউকে কোনোদিন বলেনি, কিন্তু নিজের শরীর নিয়ে ছোটোকাল থেকেই সে ভারি বিব্রত, অসন্তুষ্ট ও বিরক্ত। মুখখানা নিয়ে যা-ও একটু তুষ্টি ছিলো, কামালউদ্দিন তারও বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গেলো। পাড়ার জলিল ভাই বডি বিল্ডিং-এ মিস্টার ইস্ট পাকিস্তান হলো। ইয়াসির আলী তখন ক্লাস সেভেনে। জলিল ভাই ছাড়া আর কেউ তখন স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে দিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় না। দেখানোর মতো ওইরকম একটা শরীর থাকলে গেঞ্জি কেন, খালি গায়েও খুব ঘোরা যায়। নড়াচড়ার সঙ্গে জলিল ভাইয়ের সবল পেশীগুলো নেচে নেচে ওঠে। যেন সিনেমায় দেখা টারজান বা হারকিউলিস।
ওইরকম একখান বডির মালিক হওয়ার ইচ্ছায় সে দিনকয়েক খুব ঘোরাঘুরি করেছিলো। সদরঘাটে তখন কায়েদে আজম ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, লোকে মুখে বলে কাপতি। সেই জিমন্যাসিয়ামে খালি-গা জলিল ভাইয়ের ব্যায়াম করা দেখেছিলো একদিন। সারা গা ঘামে ধুয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার কোনোদিকে মনোযোগ নাই। ক্লান্ত হয়ে জলিল ভাই মেঝের ওপরে বসে পড়লে সে দেখে, সারা শরীরের কোথাও এক ফোঁটা চর্বি নাই - পাশাপাশি সার দিয়ে রাখা কেঁচোর মতো পেটের সরু চামড়ায় পাঁচ-ছয়টা ভাঁজ। বড়ো বড়ো নিশ্বাসের সঙ্গে জলিল ভাইয়ের বুকের ছাতি ওঠানামা করে।
বাসায় ফিরে নিজের ঘরে খালি গা হয়ে ইয়াসির আলী বিছানায় বসে দেখে, তার পেটে মোটা মোটা দুইটা ভাঁজ। এতো চর্বি! হাতে-পায়ে, উরুতে, পেটে-পিঠে সর্বত্র চামড়ার নিচে স্তূপ হয়ে জমে আছে। অচেনা কেউ দূরে থাক, ইয়ার-দোস্তদের সামনেও খালি গা হওয়া চলে না এই শরীর নিয়ে। মোটাসোটা শরীরের তুলনায় হাত দুইটা তার খুব ঢ্যাঙা আর শীর্ণ দেখায়। বাইসেপ আছে কি নাই, বোঝাও যায় না। থামের মতো মোটা উরু, হাঁটুর নিচে প্রায় অদৃশ্য কাফ-মাসলগুলি একেবারে মানানসই না। বুকে কাঁধে পেশী স্পষ্ট না। ভারি ঘেন্না হয় নিজের ওপর। এই শরীর তার কী কাজে লাগবে? বডি হলে হবে জলিল ভাইয়ের মতো।
জিমন্যাসিয়ামে নাম লেখানোর আগে নিজে নিজে কিছু ব্যায়াম করার কথা ভেবেছিলো সে। খুব ভোরবেলা উঠে পাড়ার খেলার মাঠে এক চক্কর দৌড়ে ঘরে এসে খানিক হাত-পা ছুঁড়ে ব্যায়াম করে সে দিন দুয়েক। ওতেই জিভ বেরিয়ে যাওয়ার দশা। আগের রাতে ভিজিয়ে রাখা কাঁচা ছোলা খায় লবণ দিয়ে। শুনেছিলো, কাঁচা ডিম খেলে অনেক তাগত হয়। রসুইঘর থেকে চুরি করা ডিম ভেঙে মুখে দিয়ে বমি করার জোগাড়। তিন দিনের দিন ভোরে ঘুম ভাঙলে মনে হয়, আরো কিছু পরে উঠলেই হবে। ওঠা আর হয়নি, তার শরীরচর্চার ইতি। আবার শুরু করার ইচ্ছা খুবই ছিলো, এখনো এই বয়সেও আছে - কোনো একদিন সে আবার ঠিকই ব্যায়াম করতে শুরু করবে বলে মনে মনে আশা পোষণ করে। এই থলথলে গা-গতর তার খুবই না-পসন্দ্। একদিন সে এমন একটা বডি বানাবে...।
মুখখানা নিয়ে অহংকার ছিলো, কামালউদ্দিন অর্ডিনারি বলে তা-ও বাতিল করে দিয়ে গেলে আয়নায় নিজেকে দেখে ইয়াসির আলী। এই তো এখন অনেক খুঁত পাওয়া যাচ্ছে। আগে কখনো চোখে পড়েনি। গায়ের রং এতো ফর্সা যে দেখলে বেশি পেকে যাওয়া গন্ধওয়ালা পেয়ারার মতো লাগে। পুরুষমানুষের এতো ফর্সা হওয়া ঠিক না। চুলগুলো সামান্য কোঁকড়া, রাজ্জাকের স্টাইলে সামনে উঁচু করে আঁচড়ানো, কিন্তু তাকে দেখতে রাজ্জাকের মতো লাগে না। একেবারে সোজা টান টান চুল হলে নাদিম বা ওয়াহিদ মুরাদের স্টাইল মারতে পারতো। হাসি হাসি মুখ করে আয়নায় নিজেকে দেখে, খানিকটা রাগের অভিব্যক্তি আনে। সিনেমার নায়কের কায়দায় ভুরু দুটো সামান্য তুলে মুখে নায়িকা-ভোলানো দুষ্টুমির হাসি ফোটায়। মানায় না। নিজেকে বেকুব, ভাদাইম্মার মতো লাগে। আচ্ছা জ্বালাতন তো, কামালউদ্দিন তারে এইটা কী দিয়া গেলো?
ওপরের ফিনিশিং ভালো না হলেও ইয়াসির আলীর শরীরের কলকব্জাগুলো সবই মনে লয় ইমপোর্টের মাল। জীবনেও কোনো গণ্ডগোল করে নাই। এতোগুলি বছরে ডাক্তারের কাছে গেছে সে মাত্র হাতে গোনা কয়েকবার। পাশের দোকানের আইনুল মোল্লা তো ডাক্তারের চেম্বারেই সারাবচ্ছর পড়ে থাকে, মাঝেমধ্যে দোকানে এসে বসে, বাসায় যায় বউ-বাচ্চাগুলারে দেখা দিতে। বিরক্ত হয়ে একদিন বলেওছিলো ইয়াসির আলী, আরে মিয়া, শরীলডা তো মনে লয় ডাকতারের লগে জমা দিয়া রাখছো, ফিরৎ কি আর পাইবা?
আইনুল মোল্লা মিন মিন করে বলে, করি কি, মিয়াভাই। আর যে পারি না।
পারলেই পারবা। তুমি তো মিয়া ডাকতারখানা যাও বিছরাইয়া অসুখ বাইর করনের লাইগা। যেই অসুখ তোমার নাই, হেইডাও হ্যারা পয়দা করতে পারে, তা জানো?
জ্বরজারি, সামান্য পেটের গোলমাল ছাড়া ইয়াসির আলীর অসুখ-বিসুখ বলতে গেলে হয়ইনি সারা জীবনে। তার চেনা-পরিচয়ের মধ্যে সকলের শরীরেই দুই-একটা ভাঙাচোরা আছে, না হয় সেলাইয়ের দাগ পড়েছে। তার পড়ে নাই, ফ্যাক্টরির ফিট করা অরিজিন্যাল পার্টস নিয়ে সে চালু আছে এখনো। টিকা-ইঞ্জেকশনের সুঁই ছাড়া তার গায়ে ডাক্তার আর কিছু ফোটাতে পারে নাই। কিন্তু বয়সে ধরলে কী করার আছে! তার বয়সী প্রায় সবারই কিছু না কিছু গড়বড় হয়ে গেছে। বউয়ের বাতের ব্যথা আর হাঁপানি, ঠাণ্ডা পড়লো তো এক্কেরে চিৎ। পাড়ার সাইদুল্লাহর আলসার। বিষ্ণুর ব্লাড প্রেশার আর ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাকে মরতে মরতে ফিরে এলো গত বছর। এতোদিন পর্যন্ত তার নিজের কোনো গোলমাল ছিলো না, এখন বোঝে কিছু একটা হয়েছে। চালু গাড়ির তেল ফুরিয়ে গেলে যেমন ইঞ্জিনে ধক ধক আওয়াজ ওঠে, তারও অনেকটা সেরকম কিছু একটা গড়বড় হয়েছে। কিন্তু ডাকতার হালারা কিছু পায় না ক্যান?
বউকে জানায় সে, ডাকতারে কইলো কিছু বলে খুইজা পায় নাই।
বউ জবাব দেয়, আপনে আমারে আর মিছা কতা কইয়েন না তো!
আজিব! মিছা কতা হইবো ক্যান? বউয়ের ক্যামনে মনে হইলো আমি মিছা কইতাছি? নাকি, ইয়াসির আলীর সত্যি সত্যি সাংঘাতিক খারাপ কিছু হয়েছে শুনবে বলে আশা করছিলো বউ? হলে খুশি হতো? এইসব কথার জবাব জীবনে সে পায়নি, পাবে বলে আশা করে না। জিজ্ঞাসা করে কোনো ফায়দা নাই।
ভুঁইয়া ডাক্তারের কথামতো ইয়াসির আলী যায় আরেক ডাক্তারের কাছে। আরো কতোজনের কাছে যেতে হবে, কে জানে? পাড়ার ডাক্তার কিছু বুঝতে না পেরে পাঠিয়েছিলো লাং স্পেশালিস্টের কাছে। হ্যায় এখন পাঠায় আরেকজনের কাছে। এইডা নাকি আবার হালায় সার্জন, রুগীরে ফালাইয়া কাটাকাটি করে। তা সার্জনের কাছে ইয়াসির আলীর কি দরকার? না, তার কী হয়েছে বোঝার জন্যে একটা ছোটো অপারেশন করতে হবে। অসুখ জানার জন্যে অপারেশন! তাইলে চিকিৎসা মাশাল্লা না জানি কি হয়!
বেবি ট্যাক্সিতে বসে উৎসাহিত বোধ করে সে, বড়োসড়ো কিছু একটা হবে মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে, তার সিরিয়াস কিছু হয় নাই বলেছে ডাক্তার। গোলমাল ফুসফুসে - মনে হয় ইনফেকশনের কেস। তা সেইটা বুঝলে আর অপারেশন ক্যান? না, তারা ঠিক কইরা জানতে চায়, বুইঝা লইতে চায়। যা হয় হোক, তাড়াতাড়ি একটা এসপার-ওসপার হওয়া দরকার। অসুস্থ থাকতেই তার বেশি অসুস্থ লাগছে এখন। আর ভাল্লাগে না, কতো আর রুগী রুগী হয়ে থাকা যায়! সে যে সত্যি সত্যি রুগী, হলে কীসের রুগী তা-ই তো এখনো জানা গেলো না! এই মাসখানেকেও অভ্যাস হয়নি, মনেও থাকে না - ধীরপায়ে হাঁটতে সে কোনোদিন পারে না, কিন্তু একটু হাঁটলেই আজকাল নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার অবস্থা হয়। তখন ধপাস করে বসে না পড়ে উপায় থাকে না, শ্বাসকষ্টে বুক চেপে আসে, কাশিতে আরো অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। কাশির সঙ্গে কিছু একটা বেরিয়ে এলে মনে হয় খানিক আরাম হতো, শুকনা কাশিতে দম বন্ধ হয়ে আসে। খানিক পরেই আবার ঠিক। অসুখ বলতে এই আর ঘুমের কিছু গড়বড়, কিন্তু তা-ও বা আর কাঁহাতক সহ্য হয়?
সার্জন তাকে বুঝিয়ে বলে, আপনার ডাইনপাশের পাঁজরের নিচে ইঞ্চি দুয়েক কাটা হবে। ফুসফুসের ছোট্টো একটা টুকরা কাইটা নিয়া পরীক্ষা করলে আপনের সমস্যাটা জানা যাবে। ঘাবড়াইয়েন না কিন্তু, খুবই ছোটো অপারেশন। এইগুলা আজকাল ডালভাতের মতন।
ডাক্তার অভয় দিলে কী হয়, ফুসফুস কাটাকুটির কথায় ইয়াসির আলী স্বস্তি পায় না। ঘাবড়ানো ঠিক না, কেমন যেন খুঁতখুঁত করে। কিন্তু সেটা বুঝতে দেবে কেন সে? অকম্পিত মুখে জিজ্ঞাসা করে, এইডা কইরা কী পাওয়া যাইতে পারে বইলা মনে করেন?
বলা মুশকিল।
ক্যানসার-ম্যানসার হইতে পারে?
সার্জন বলে, তা পারে, তবে সম্ভাবনা কম। হইলেও সেইটা কোনো সমস্যা না। বায়োপসি কইরা যখন ধরা পড়ে নাই, তার মানে ক্যানসার থাকলেও খুবই প্রাথমিক অবস্থা। সেইটা পুরা সারাইয়া তোলা সম্ভব। সুতরাং ওই নিয়া দুশ্চিন্তা করার দরকার নাই।
দুশ্চিন্তা সে মোটেই করে নাই। বলে, আর কি হইতে পারে?
খুব সম্ভব ইনফেকশন। হয়তো পুরান কোনো একটা ইনফেকশন ঠিকমতো সারে নাই, তারই কিছু তলানি ফুসফুসে কোথাও রইয়া গেছে। ফুসফুস ঠিকমতো কাজ করতে না পারলে নিশ্বাসে কষ্ট হইতেই পারে। টেস্ট করলে বোঝা যাবে।
তাইলে কবে করতে চান অপারেশন?
সামনের সোমবার। ভালো কথা, অপারেশনটা মাইনর হইলেও আপনে দুইটা দিন হাসপাতালে অবজারভেশনে থাকবেন। রবিবার রাত বারোটার পর কোনোকিছু খাইবেন না। সকালে একদম খালি পেটে আইসা পড়বেন হসপিটালে।
পানি-উনি খাওন যাইবো তো?
চা-পানি কিচ্ছু না।
কী মুসিবত! বাসেত ভুঁইয়ার টেস্টের সময়ও এই করতে হয়েছিলো। সকালে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানির পরে একটা সিগারেট না ধরালে তো বাথরুম ভি যাওন যায় না। তাতে কিছু আসে যায় না, হাসপাতালে দুইদিন বাস করার সম্ভাবনা ভেবে বাথরুম সমস্যা অবিলম্বে ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়। বাল্যকালে ঈদের চাঁদ দেখার মতো খুশি বুকের মধ্যে খলবল করে। এইবার হসপিটালে নিয়া ডাকতারে একখান বড়ো অসুখ বানাইয়া ফালাইলেই হয়, হালায় মউত হইলেও ভি আচ্ছা। অনেকদিন পরে ইয়াসির আলী মনে ফূর্তি নিয়ে বাসায় ফেরে। সোমবার আসতে আরো তিনদিন বাকি। বউকে পরে বলা যাবে। আগে নিজে নিজে খুশিটা উপভোগ ও উদযাপন করা দরকার। সন্ধ্যায় বাড়ির সবার জন্যে হাজির বিরিয়ানি কিনতে লোক পাঠায়। বউ আপত্তি করে বলে, কইলে বাসায়ই তো করন যাইতো।
ইয়াসির আলী হাসতে হাসতে বলে, তুমি বানাইলে তো আর হাজির বিরানি হইবো না। হেইডা হইলো গিয়া বিবির বিরানি, বুঝলা না?
রাতে ইয়াসির আলী স্বপ্নে দেখে, সে হাসপাতালের বিছানায় চোখ বুজে শোয়া। নার্স ঘরে এসেছে, পায়ের শব্দ শুনে চোখ খুলে ফেলে সে। সাদা পোশাক পরা নার্সকে দেখে। আরে আজিব বাত, সুচিত্রা সেন আইলো কইত্থিকা? সেই চোখ, ফোলা ফোলা ঠোঁট, পরীর মতন মুখখান। এই রাত তোমার আমার গানের সুরে শিস দেয় ক্যাঠা? ইয়াসির আলীর বিশ্বাস হতে চায় না। ভাবে, বিছানায় শোয়া লোকটা তাইলে আসলে কে? সে, ইয়াসির আলী? না, উত্তম কুমার? নাকি বসন্ত্ চৌধুরী? এইডা কি হালায় বায়োস্কোপ নাকি? বায়োস্কোপ না হলে হঠাৎই সব বদলে যায় কী করে? কীসের হসপিটাল, কোথায় সুচিত্রা সেন, কিসের কি? সব কোথায় মিলিয়ে গেছে!
তার বদলে ইয়াসির আলী দেখে, বাপের হাত ধরে সে কোথাও যাচ্ছে। জায়গাটা চেনে না, তবে নবাবপুর রোডের মতো যেন দেখায়, খুব ভিড়। নবাবপুর রোড হইলে গাড়িঘোড়াগুলান গেলো গা কই? জায়গাটা গাঁয়ের মেলার মতো লাগে। খালি মানুষ আর মানুষ। এতো মানুষ এইখানে কী করে? বাপের মুখের দিকে তাকায় ইয়াসির আলী। জিজ্ঞেস করে, কও তো বাপজান, আমার মুখখান কি খুব অর্ডিনারি?
বাপের মুখে সেই কমবয়সের চেনা হাসি, সে ইয়াসির আলীর কথার জবাব দেয় না। বাপে কয়, আমার হাত ছাড়িস না কইলাম, ইয়াসির। ভিড়ে হারাইয়া যাবি, তাইলে তরে আর পামু কই?
বাপের বুড়া আঙুল শক্ত হাতে ধরতে যায় ইয়াসির আলী, সেই আঙুল এতো শক্ত কাঠ-কাঠ লাগে কেন? তাকিয়ে দেখে, কোথায় বাপের আঙুল, কোথায় কি! বাপে নাই লগে, আশপাশের ভিড় হাওয়ায় ভ্যানিশ। এখন তার হাতে ধরা একখান চাবি, নতুন একটা বাড়ির বন্ধ দরজার বাইরে সে দাঁড়ানো। বউ-পোলাপানের কথা মনে আসে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে, কেউ তার সঙ্গে নাই, সে একলা। কোনোদিন দেখে নাই, তবু মনে হয়, এইটাই তাগো উত্তরার নতুন বাড়ি। তার এইখানে আসার কথা না, আইলেও একলা না, এইখানে একলা কেমনে আইসা পড়লো সে? আর হগলতে গেলো গা কই? আমারে একলা ফালাইয়া? এইসব কি হইতাছে? ইয়ার্কি নাকি? অ্যাঁ!
মন্তব্য
এইরকম একটা লাইন থাকবে আর অর্ডিনারি আলবাব সেইটা মুগ্ধ হয়ে পড়বেনা তাতো হতে পারেনা?
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
নজমুল আলবাব অর্ডিনারি নয়
অর্ডিনারি সেই হয় লোকে যারে...
ধুরো, ছন্দ মিলানি আমার কাম না। পারলে তো কবিই হইতাম। আলবাব নিজেই বাকিটি মিলাইয়া দিতে পারবেন।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
গল্পের শেষে এসে সত্যি সত্যি মেরুদন্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল ,, এরকম একা হয়ে যায়!
বাবর হাত ধরে মেলায় যাওয়ার অংশটা ছোটবেলার মতিঝিল কলোনীর কথা মনে করিয়ে দিল।
যথারীতি উপাদেয় আরেকটা গল্পের জন্য ধন্যবাদ।
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
আশেপাশে সবাইকে নিয়েও মানুষ তো আসলেই একা।
ধৈর্য ধরে পুরোটা পড়লেন বলে আবারও ধন্যবাদ। মন্তব্যের জন্যে কৃতজ্ঞতা।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
আশেপাশে সবাইকে নিয়েও মানুষ তো আসলেই একা।
ধৈর্য ধরে পুরোটা পড়লেন বলে আবারও ধন্যবাদ। মন্তব্যের জন্যে কৃতজ্ঞতা।
============
দুঃখিত, এক মন্তব্য দু'বার পড়ে গেছে। মোছার কোনো কায়দা দেখছি না।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
নতুন মন্তব্য করুন