২০০৭-এ পুনরায় মঞ্চস্থ, ৭৫-এর অগাস্টের তৃতীয় সপ্তাহে অভিনীত নাটকের একটি দৃশ্য

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি
লিখেছেন মুহম্মদ জুবায়ের (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৩/০৮/২০০৭ - ১১:১৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

... দুপুরে গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া এলাকায় অকস্মাৎ এক নির্দেশ শুনে যুবক কিয়ৎক্ষণের জন্যে বিচলিত হয়। ... মধ্যবয়সী রিকশাওয়ালা রিকশা থামিয়েছে। আরোহী যুবক তাকিয়ে দেখে, সামরিক পোশাকে এক সশস্ত্র সৈনিক সামনে দাঁড়ানো। ... বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর একজন এই সৈনিক! ...

... রিকশাওয়ালা সৈনিকের সামনে রিকশা থামিয়ে নিজের সীটে বসে ছিলো। আরোহী যুবকের মতো তারও চোখে জিজ্ঞাসা, রাস্তার মাঝখানে থামতে বলা হলো কেন হঠাৎ? সৈনিকপুরুষ আচমকা তার পিতার বয়সী প্রৌঢ় রিকশাওয়ালার গালে সজোরে চড় বসিয়ে দেয়। রিকশাওয়ালা ঘুরে পড়ে যায় রাস্তায়। যুবক নিজের অজান্তে রিকশা থেকে নেমে এসে মুখোমুখি হয় সৈনিকের। চোখে চোখ ফেলে জিজ্ঞেস করে, অরে মারলেন ক্যান? কী দোষ করছিলো সে?

আপনে চুপ থাকেন তো মিয়া! নবাবের বাচ্চা রিকশা থামাইয়া সীটের উপরে বইসা থাকে!

বোঝা গেলো। প্রভুদের প্রতিনিধি সেপাইয়ের সামনে রিকশাওয়ালার সীটে বসে থাকাটা শক্ত ধরনের বেয়াদবি হয়েছিলো। যুবক এবার জিজ্ঞেস করে, কিন্তু থামতে বললেন ক্যান তা তো বুঝলাম না!

থামাইছি আপনের জন্যে। আপনের লম্বা চুলগুলি কাইটা ফেলতে হবে।

মানে?

ওঃ, আবার মানে জিগায়। আপনেরে তো বাংলায়ই বললাম, লম্বা চুলগুলি কাটতে হবে। ...

... চুলের দৈর্ঘ্য কমিয়ে ফেললেও মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল রাখে সে এখনো। একেবারে ছোটো ছোটো করে কদমছাঁট দেওয়া তার কোনোকালে পছন্দ ছিলো না। ...

... নিজেকে সুন্দর লাগুক, কোন মানুষ তা না চায়? ... কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা চুলগুলি তার ব্যক্তিত্বের অংশ, যেমন তার চোখ, মুখমণ্ডল, পোশাক, তার হাঁটাচলা এবং বাকভঙ্গি। এইসব মিলিয়ে সে অন্য সবার চেয়ে আলাদা একজন কেউ। সৈনিকদের সে সুযোগ অবশ্য নেই - কদমছাঁট চুল তাদের সবার, প্রত্যেককে একই ইউনিফর্ম ও বুট পরতে হয়, একই ছাঁচে তাদের হাঁটা বা ছোটা, বিশেষ ভঙ্গি ও স্বরে তাদের কথা বলা - সম্মিলিতভাবে তারা একটি একক ব্যক্তিত্বের ছবি। অন্যদের থেকে একটু আলাদা হতে গেলেই শৃঙ্খলাভঙ্গ, শাস্তির ভয়।

সামরিক শাসকরা ও তাদের বাধ্য-অনুগত সৈনিকরা ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতীকগুলোকে অনুমোদন দিতে প্রস্তুত নয়। প্রত্যেকটি মানুষকে এক ছাঁচে, নিজেদের সম্মিলিত একক ব্যত্তিত্বের সম্প্রসারণ হিসেবে দেখতে ইচ্ছুক তারা। ব্লাডি সিভিলিয়ানদের তারা নিচু জাতের প্রাণী, যেন মনুষ্যপদবাচ্য নয়, বলে মনে করে এবং তাদের ওপর কর্তৃত্ব করার সুযোগ হাতছাড়া করতে তারা অনীহ। তোমার চুল কতোটা লম্বা হতে পারবে তা-ও আমরা নির্দিষ্ট করে দেবো। তোমার ওপর আমাদের সর্বময় কর্তৃত্ব, আমরা তোমার আহার-বিহারসহ সবকিছুর মালিক। মনে থাকে যেন, তুমি আমাদের আজ্ঞাবহ মাত্র।

যুবক প্রতিবাদ জানানোর চেষ্টা করে, আমার চুলে কী দোষ করলো? আমি আমার নিজের মতন থাকি, কারো সাতে-পাঁচে নাই।

তীক্ষ্ণ স্বরে সৈনিক বলে, ওইসব কিছু বুঝি না, ওইদিকে গিয়া বাবরিডা কাইটা নিয়া তারপর যেখানে যাইতেছিলেন যান। বেশি প্যাচাল পাড়লে খবর আছে।

সৈনিকের নির্দেশ করা আঙুল অনুসরণ করে যুবক দেখতে পায়, রাস্তার পাশে একটি দেয়াল ঘেঁষে সারি দিয়ে অনেকগুলো উঁচু কাঠের টুল বসানো। প্রত্যেকটির ওপরে মাথা নিচু করা একেকজন মানুষ বসা এবং পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষৌরকাররা মানুষগুলোর চুল ছাঁটে একাগ্রমনে। টুলে বসা মানুষগুলোর মুখভঙ্গি এখান থেকে বোঝা যায় না, বুকের কাছে মাথা নামিয়ে রাখাও একটি কারণ বটে, কিন্তু যুবক জানে, বাধ্য হয়ে এইভাবে অন্যের কাছে নিজের মাথাটি জমা দেওয়ার অপমান তাদের সবার চোখেমুখে লেগে আছে।

শেষ চেষ্টা হিসেবে যুবক জানায়, সে একটি জরুরি কাজে যাচ্ছে, দেরিও হয়ে গেছে। তা সম্পন্ন করে চুল ছাঁটানোর কাজটি সে নিজেই সেরে নেবে।

আচমকা আরেক সৈনিকপুরুষ, একজন অফিসার, আবির্ভূত হয়। রাস্তার একপাশে অপেক্ষমাণ সাঁজোয়া গাড়ির ভেতরে সম্ভবত এতোক্ষণ বসে ছিলো। কর্কশ স্বরে সে জিজ্ঞাসা করে, প্রবলেমটা কি?

অধঃস্তন সৈনিকটি জানায় যে, বড়োই বেয়াড়া এই যুবক।

অফিসার শ্রেণীর সৈনিকপুরুষের মুখ থেকে একটিমাত্র শব্দ - তা স্বর্গনিসৃত কোনো শব্দ বলে ভ্রম হয় না - নির্গত হয়, বাঞ্চোৎ!

এই মোক্ষম শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে সে যুবকের মাথাভরা ঝাঁকড়া চুল মুঠো করে ধরে টেনে নিয়ে যায় রাস্তার পাশে। ধাক্কা দিয়ে তাকে পাঠিয়ে দেয় দেয়াল ঘেঁষে চুল ছাঁটানোর জায়গাটির দিকে। অপ্রস্তুত ছিলো যুবক এই চকিত আক্রমণের জন্যে, কোনোমতে রাস্তার ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়া থেকে সে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। কিন্তু অপমানবোধে চোখমুখ জ্বালা করে ওঠা থেকে নিজেকে কীভাবে রক্ষা করবে সে জানে না। তার কান-মাথা-মুখমণ্ডল উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, তা শুধুমাত্র এই সূর্যতপ্ত দুপুরের তীব্র উত্তাপের কারণে নয়। দুই চোখ তীব্র ঘৃণার আগুনে জ্বলতে থাকে, হাত নিশপিশ করে, কিছু একটা তাকে করতে হবে, কিন্তু কী করা যেতে পারে তা সে ভেবে স্থির করতে পারে না। রাষ্ট্রশক্তির সশস্ত্র প্রতিনিধির সামনে তার কিছুই করার ক্ষমতা নেই, এই বোধ তাকে আরো ক্রুদ্ধ করে। শিকারীর জালে আটকা পড়া বাঘের তবু গর্জন ও আস্ফালন করার ক্ষমতা থাকে, যুবকের তা-ও নেই। এই অসহায়ত্বের অনিবার্য অনুভব ক্রমশ বিস্তারলাভ করলে ক্রোধের সঙ্গে সঙ্গে নিরুপায় হতাশাবোধ তাকে আচ্ছন্ন করে দেয়।


মন্তব্য

সুজন চৌধুরী এর ছবি

ভয়ংকর বর্ণনা। আমারও হাত পা বাঁধা মনে হচ্ছে।
____________________________
লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ......

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আমি ঘটনা থেকে বহুদূরে। অথচ যা পড়ছি আর শুনছি, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

সুজন চৌধুরী এর ছবি

খুবই সময় উপযোগী লেখা।
____________________________
লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ......

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

ক্ষমাপ্রার্থনা তাঁদের কাছে যাঁরা আগেই আমার খসড়া উপন্যাস 'চুপকথা'-র এই পর্বটি পড়েছেন। এই মুহূর্তে খুব উপযোগী মনে হলো বলে অংশবিশেষ পুনঃপ্রকাশ করা হলো। আপত্তি জানালে মুছে ফেলা হবে।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

এধরনের লেখা লিখে মানুষের মনে আগুন জ্বালানোর অপরাধে আপনাকে দোষী সাব্যস্ত করা হল। এবং শাস্তি স্বরূপ ৫ দেয়া হল।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

লিখে আগুন জ্বালানো যায় কিনা জানি না। অন্তত আমার সে ক্ষমতা বিষয়ে সংশয় ষোলো আনা। তবে অসহায়ত্বের একটা সান্ত্বনা হয়তো এইভাবে মেলে। আর নিজের ভেতরের আগুন যদি কিছু থেকে থাকে, তাকে জ্বালিয়ে রাখা - এই তো।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

অমিত আহমেদ এর ছবি

ভাল হয়েছে জুবায়ের ভাই। এই গতকালকেই আমি কেমিকেল আলিকে বলছিলাম চুপকথার এ অংশটুকে পড়ে নিতে।


আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

পড়ে এবং শুনে এতো অস্থির লাগছিলো যে নতুন কিছু লেখা সম্ভব ছিলো না। তখন হঠাৎ মাথায় আসে এটার কথা। হয়তো কিছুই নয়, কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখলাম লেখাটা পোস্ট করার পরে অনেক স্বস্তি লাগলো।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

এস্কিমো এর ছবি

উপযোগী লেখা..ভাল লাগলো।

লেখতে চাই ..কিন্তু কি লিখবো?

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

ধন্যবাদ। পড়লাম। জ্বলে উঠলো।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

ধন্যবাদ। পড়লাম। জ্বলে উঠলো।

কেমিকেল আলী এর ছবি

গতকাল সাব্বির বলল আর আজকেই পেলাম হাতের কাছে।

ভয়ংকর বর্ননা।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

এস্কিমো ও ইশতিয়াক রউফ, অসংখ্য ধন্যবাদ।

কেমিকেল আলী, কাকতালীয় বটে!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

অতিথি (রেনেসা) এর ছবি

আমার শহরের কাহিনী।

হাতে ব্রেসলেট, মাথায় ঝাকড়া চুল, গলায় চেইন। নাম ছান্নু। বাবা মায়ের বড় আদরের সন্তান। জিপিএ ৫ পেয়েছে। বড় ডাক্তার ইঞ্জিনিয়র হতে হবে এই স্বপ্ন দেখে এবং দেখিয়ে তার বাবা ছেলেকে ছেড়ে দেয় নিজের চেনা জগত থেকে। লঞ্চঘাট পর্যন্ত আসে বাবা-মা ও একমাত্র ছোট বোন। লঞ্চ এসে গেছে। মায়ের চোখ মোছা শুরু হয়ে গেছে। যেন সুদুর চীন দেশে যাচ্ছে তার ছেলে।

''মা তুমি শুধু শুধু কাদছো। ৩ মাসের কোচিং। তার পরতো ফিরে আসছি। কেদোনা মা। দেখ সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার অস্বস্তি লাগছে।

মা তার পরেও কাদে বলে তুই প্রতিদিন ফোন করবি। কখনো ফোন বন্ধ রাখবি না। কোন সমস্যা হলেই ফোন করবি। আর বাজে ছেলেদের সাথে মিশবি না।

মা তুমি যে কি। ওখানে বাজে ছেলে পাব কোথায়। ভাল ছাত্ররাই ওখানে যায়। পড়াশুনা করতে। মা তুমি কোন চিন্তা করো না বলে মায়ের চোখ মুছে দেয়। মা আলতো করে চুমু খায়, বলে ভাল থাকিস।

ছান্নু ঢাকায় এসেছে ২ মাসের মত হবে। ফার্মগেটে ভর্তি কোচিং করছে। ইন্দিরা রোডে আমার সাথে একই রুমে থাকছে। অসম্ভব ক্ষ্যাপাটে। যা বিশ্বাস করবে তা প্রতিষ্ঠিত করতে হাজরো যুক্তি দাড় করাতে তার সময় লাগে না। খুব দ্রুত। একটা বিষয় আমি বিস্মিত হই। ও ট্রাডিশনাল রাজনীতির পক্ষে। আমরা বলি পচে যাওয়া সমাজ। ও বলে সেখানে যারা টিকে আছে রাজনীতি করছে তারা নিশ্চিত ভাবে কৌশলী ও বুদ্ধিমান। না হয় এখানে, এই সময় টিকে থাকা যায় না। আর যারা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারে না তাদের দিয়ে মঞ্চে বক্তৃতা দেয়া যায় দেশ চালানো যায় না। তার দর্শন ম্যাকিয়াভেলী।

বিষয়ের সুক্ষ্মতা আর সুক্ষ্ম বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য কি ইদানিং এটাই ওর গবেষণার বিষয়। আমাকে জিগ্যেস করেছিল। আমি বলেছি মূর্খদের জ্ঞানের কথা জিগ্যেস করতে নেই। ওরা মাঝে মাঝে মাঝে কিছু ভাবের কথা বলতে পারে কিন্তু জ্ঞানের কথা না। ও হাসে। বলে আমাকে দিয়ে কিছু হবে না। জানার আগ্রহ নাকি কমে গেছে আমার। ও হাল ছাড়ে না খুজে খুজে এক বন্ধুকে বের করে। সে বলে তার আঙ্কেল কোন এক বিখ্যাত ফটোগ্রাফার বাসাবোতে থাকে সে নাকি খুব জ্ঞানের কথা জানে। তাকে জিগ্যেস করা যেতে পারে ---- চলবে (সময়ের অভাবে শেষ করতে পারলাম না)

অতিথি(রেনেসা) এর ছবি

সে বলে তার আঙ্কেল কোন এক বিখ্যাত ফটোগ্রাফার বাসাবোতে থাকে সে নাকি খুব জ্ঞানের কথা জানে। তাকে জিগ্যেস করা যেতে পারে ---- চলবে (সময়ের অভাবে শেষ করতে পারলাম না)
......................

সঠিক তারিখ মনে নেই। খালেদা সরকারের শেষ দিকে। বাসাবোর সেই বিখ্যাত ফটোগ্রাফার এর সাথে দেখা করতে চলে যায়। আমাকে ফোন করে জানায় আসতে একটু রাত হতে পারে। বিখ্যাত লোকদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে সে খুব উত্তেজিত। আমাকে জিগ্যেস করে, ভাই ছোট একটা বাচ্চার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত এরকম একটি বিখ্যাত ছবি তুলেছেন তার নাম কি। রশীদ হায়দার বা এরকম কেউ হবে। তবে আমি কর্নফার্ম না, তাকে উত্তর দেই। সে বলে তার সাথেও দেখা হতে পারে। সম্ভাবনা আছে।

তো আমি কি করতে পারি?

না, মানে .. ও আমতা আমতা করতে থাকে।

আমি জানি ও কি চায়। বলি আচ্ছা নিয়ে যা। তবে সাবধানে রাখিস। গরিবের শথের ক্যামেরা নষ্ট হলে কিন্তু ফুল জরিমানা দিতে হবে।

তার পর রাত ১১ বাজে ওর খবর নেই রাত ১২ বাজে খবর নেই। ওর ফোন বন্ধ। বাড়ি থেকে আন্টি ফোন করে ছান্নুর ফোন বন্ধ কেন। আমি বলি এক বন্ধুর বাড়িতে গেছে । হয়তো মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে গেছে। আন্টি বলে বন্ধুর নাম্বার দাও। আমি অপারগ। তাকে বলি চিন্তা করবেন না। আমি খোজ নিয়ে জানাচ্ছি।

পরদিন সকাল ৮টায় ছান্নুর ফোন। ভাই তুমি একটু রমনা থানায় আসবে। আমি হতবাক হয়ে যাই। কেন কি হয়েছে? তুমি আস না, ভাই, প্লিজ।

থানা পুলিশ আমি এমনিতে ভয় পাই। নিরীহ ধরেনের গোবেচারা টাইপ আমি। ঘরের বসে বই পড়ে, অফিস করে, ইটিস পিটিস করাই আমার কাজ। থানা পুলিশ করবে পাড়ার বড় ভাই, রাজনীতিবিদ ....

(লেখাটা বড় হয়ে যাচ্ছে, তাই আসল ঘটনাটা বলি)

ওই দিন রাত আনুমানিক ৮টার দিকে ও মৎস্ ভবন এলাকা থেকে রমনার দিকে হেটে আসছিল। এ সময় ২ জন আরমি ওকে থামতে বলে। ওর ভাষায় শুনুন

কি নাম?
জি, ছান্নু
বাড়ি কই?
বরিশাল
ও বরিশাইল্যা
জি বরিশাইল্লা
হাতে কি
ব্রেস লেট
ও তাইতো দেখছি, গলায় লোহার দড়ি (চেইন), চুল বড় মস্তান, তা কি করেন
জি লেখা পড়া করি
কোথায়
ঢাকায়
ঢাকায় কোথায়
ফার্মগেটে
কই পরিচয়পত্র দেখি
না মানে আমি কেবল কোচিং করছি পাশ করলেই ভর্তি হব।
কোচিং করছেন তার আইডি কার্ড
জি আনিনি, ব্যাগের ভিতর রয়েছে
আইডি কার্ড কি ব্যাগের ভিতর রাখার জিনিস, তা হলে ব্যগের ভিতরে রাখছেন কেন

ছান্নুর ভাষায় - এটা কোন প্রশ্ন হলো, ব্যাগ নিয়ে কোচিং করি, তো সেটা ব্যাগে থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

ও বলে, আমি আর্মি ভাইকে বলি, ভাই আমার একটু দ্রুত যেতে হবে।

আর্মির ভাষায়: ..... বাচ্চা, তোর জরুরী কাজ তাতে আমার কি, শালা "বাঞ্চোদ" সন্ত্রাসী কাজ করিস। বাবার টাকা এনে ঢাকায় বসে মাইয়া নিয়া ফুর্তি করিস। গাজা খাস ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

সান্নু অবাক হয়। এরকম আচরনের জন্য ও প্রস্তুত ছিল না। কখনো এরকম আচরণ দেখেনি। তাই কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পরে। একটু ক্ষ্যাপাটে টাইপের হওয়ায় হয়তো জেদ চেপে যায়। ও বলে গালি দিবেন না।
.... বাচ্চা গালি দিব না তো আদর করবো

ভদ্রলোকরা ও রকম বিশ্রি ভাষায় গালি দিয়ে কথা বলে না

তবেরে বাঞ্চোদ, ভদ্রতা শেখাও, ........ বাচ্চা আয় তুই দেখ ভদ্রতা কাকে বলে ....... কলার ধরে টেনে নিয়ে যায় রাস্তার ওপাশে দাড়ানো গাড়ির কাছে।

তার পর ওকে লাথি, থাপ্পড় দিয়ে নিয়ে যায় রমনা থানায়। নাপিত এনে রাত্রেই সব চুল কেটে ফেলা হয়। গলার চেইন, হাতের ব্রেসলেট ফেলে দেয়। সারা রাত্র হাজত ভরে রাখে। সকাল বেলা হাজত থেকে বের করে থানার ডিউটি অফিসার বলে তোর আত্মীয় স্বজন কে কে আছে তাদের ফোন করে থানায় নিয়ে আয়।...

*****

জুবায়ের ভাই,

"বড় চুল রাখা, হাতে ব্রেসলেট পড়া, জিন্স টি শাট পড়া কি বাংলাদেশের আইনে কোন অপরাধ? বা ও গুলো যারা পরে তারা সবাই সন্ত্রাসী, মাইয়া নিয়া ফুর্তি করে?

যদি অপরাধ না হয় তা হলে কি আমাদের কিছুই করার নেই?"

এ কথা গুলো ছান্নুর। আমাকে বলে ছিল। আমি উত্তর দিতে পারি নি। অক্ষম। আপনার উত্তর জানা থাকলে জানাবেন। ছান্নু বড় কৃতজ্ঞ থাকবে। আমিও।

আরিফ জেবতিক এর ছবি

এই সব অতিথিরা নাম লিখছেন না কেন?

-----------------------------------
ঢাকার ভূমে ফিরেছে একাত্তর/প্রস্তুতি নে,সময় হলো তোর..

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

ভাই রেনেসা, ছান্নুর হয়ে প্রশ্নটা আপনি এমন একজনকে করেছেন যে তার জীবনের প্রায় অর্ধেকটা সময় অতিবাহিত করেছে সরাসরি উর্দিধারীদের বন্দুক ও হুংকারের নিচে। এবং বলতে গেলে সারাটা জীবন ধরে এইসব অসংখ্য প্রশ্নের না পেয়ে ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ হয়েছে। তাতে ফল তেমন কিছু হয়নি, নিজের আয়ুক্ষয় ছাড়া।

আপনার লেখাটা পড়তে পড়তে দৃশ্যগুলি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। অনেকবার দেখা তো!

আমার লেখার মন্তব্য হিসেবে না দিয়ে আলাদা পোস্ট হিসেবে দিলে লেখাটা আরো অনেকের পড়ার সুযোগ হতো।

অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।