২.২
আমার দেশে ডিসেম্বরের আজকের সকালটি অন্যসব দিনের থেকে অন্যরকম। তেত্রিশ বছর বয়সী আমার দেশটির জন্মের সময় আমি সদ্যযুবা। কতো বিসর্জন ও রক্তক্ষয়ের কাহিনী আর বীরত্বগাথায় পূর্ণ ছিলো সেই ডিসেম্বর।
In the grip of this cold December
You and I have reason to remember...
ডিসেম্বরের এই শীতল থাবার অন্তর্গত হয়ে তোমার এবং আমার স্মৃতিমন্থন করার কারণও কিছু আছে! সেদিন আমাদের প্রাণে অর্জনের অহংকার ছিলো, দুই চোখ ভরা স্বপ্নের দ্যুতি ও বিস্তৃতি ছিলো। আকাশতুল্য অনন্ত সম্ভাবনা নিয়ে আমরা টগবগ তখন করছি, আমাদের সামনে কী আলোকময় অলৌকিক একটি ভবিষ্যৎ!
এই দিনে আজ সুদূর মনে হওয়া অনতিদূরের সেই ডিসেম্বরের কথা কি আমাদের স্মরণে আসবে না? মাঝখানের বছরগুলোকে ভাবলে ভুল, ব্যর্থতা ও হতাশার কথা আসবে, তা-ও নিশ্চিত। বিস্মৃত হতে আমরা প্রায়শ সচ্ছন্দ, হয়তো এই বিস্মৃতি না ঘটলে আমাদের দুঃখ-হতাশার আর শেষ থাকতো না, সর্বনাশে সম্পূর্ণ নিমজ্জন অমোচনীয়ভাবে ঘটে যেতে পারতো। তবু ডিসেম্বরের এই দিনটিকে স্মরণ না করে আমাদের উপায় নেই।
আজ আমাদের সেইসব স্বপ্ন ও সম্ভাবনার সবই ভুল ও ব্যর্থ হয়ে গেছে বলে মনে হয়। বস্তুত আমাদের ব্যর্থ স্বপ্নের গল্প অগণন। এতোদিন হয়ে গেলো, তবু কিছু অর্জনের গরিমা নেই আমার দেশের, অর্থ-বিত্তের অহংকার নেই। আছে যতোটুকু, নেই তার থেকে ঢের বেশি। দারিদ্র্য নামে যা আছে অপরিমেয়, তাকে লোকে ভালো চোখে দেখে না, অভাবীদের গৌরব যদি কিছু থাকেও, নিত্যদিনের ক্লিন্নতার আড়ালে তা অনায়াসে ঢাকা পড়ে যায়। তা-ও সহনীয় হতে পারতো, কিন্তু আমার দেশ জগতের সেরা হয় দৈনন্দিন অসততা ও অসদুপায়ের জন্যে। রাজনৈতিক কোলাহলে সে সারা পৃথিবীর নিন্দা কুড়ায়। রাষ্ট্রপ্রধান হত্যায় আমাদের দক্ষতা একসময় রাষ্ট্র হয়ে যায় বিশ্বময়। নিত্যদিনের খুনখারাবিতে মানুষের জীবনই সর্বাপেক্ষা শস্তা ও সুলভ পণ্য হিসেবে প্রতীয়মান হয়। ক্ষমতাধররা লোভ ও নির্লজ্জতার নতুন নতুন শীর্ষ আবিষ্কার করে এবং সেই শীর্ষে তাদের আরোহণপর্বটি ঘটে সাড়ম্বরে, অকম্পিত ও অপরিবর্তিত মুখে। মানুষের কোনো কীর্তি বা সাফল্য নয়, বন্যায়-মহামারীতে-দুর্ভিক্ষে বছর-বছর পৃথিবীর তাবৎ সংবাদপত্রের শিরোনাম হয় আমার দেশ। এতো যে নেই নেই, পর্বতপ্রমাণ আমাদের অক্ষমতা ও ব্যর্থতা, স্বপ্নভঙ্গের বিষাদ - তারপরেও মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলা কি মানায়!
তবু এই রুগ্ণ করুণ অসহায়, ক্ষুদ্র ভুখণ্ডটির জন্যে অতি উচ্চ একটি গৌরবস্তম্ভ ও শর্তহীন ভালোবাসা নিজের ভেতরে যত্নে লুকিয়ে রাখি। দেশটি যে আমার!
আজকের একটি দৈনিকে নিজস্ব প্রতিবেদকের লেখা প্রধান প্রতিবেদন :
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর সূর্য উঠেছিল শুধু একটি নতুন দিনের জন্য নয়, বিশ্বের মানচিত্রে একটি নতুন দেশের আগমন সংবাদ নিয়ে। সকালের সূর্য লাল হয়, তবে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রাঙা সেদিনের সূর্য বোধহয় একটু বেশিই লাল ছিল। ... ৩৩ বছরে সেই সূর্য আরো একটু লাল হয়েছে, বিজয়ের স্বপ্ন পূরণ না হওয়া, অর্থনৈতিক মুক্তি না আসা আর সরাসরি স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমতায় অংশীদার হওয়ার লজ্জায়। ...
প্রথম পাতায় আরো একটু এগিয়ে পাওয়া যায় বিজয় দিবসের বিশেষ রচনা আনিসুজ্জামানের, তিনি লিখছেন :
...সেদিন চোখে যে স্বপ্ন ছিল, বুকে যে বল ছিল, মনে যে আশা ছিল আজ তার কিছুই অবশিষ্ট নেই।
...যে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা সাহস করনি হত্যা করতে, অবলীলায় তাঁকে আমরা মেরে ফেললাম। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যে-নেতারা - বিশ্বাসহন্তা একজন ছাড়া - তাঁরা সকলে নিহত হলেন আমাদেরই হাতে। চারজন সেক্টর কম্যান্ডার প্রাণ দিলেন আত্মঘাতী দ্বন্দ্বে।
...নিরীহ বাঙালি একদিন অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল হানাদারকে হটাতে। বীরত্ব সে দেখিয়েছিল বটে। তারপর সেই অস্ত্র হাতে নিয়ে সে হয়ে গেল সন্ত্রাসী। সেই সন্ত্রাসের সঙ্গে প্রবল যোগ অসুস্থ রাজনীতির। আজ আমাদের দৈনন্দিন জীবন সন্ত্রাস-পীড়িত, সামাজিক আয়োজন সন্ত্রাস-লাঞ্ছিত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সন্ত্রাস-কবলিত। রাষ্ট্র এখন স্বয়ং সন্ত্রাস চালাচ্ছে, নির্বিচারে মানুষ মেরে চলেছে।
১৯৭১ সালে কে ভাবতে পেরেছিল বাংলাদেশে কখনো আসবে সামরিক শাসন? কে ভেবেছিল যে, সাম্প্রদায়িকতা এখানে মাথা তুলবে এত প্রবলভাবে? প্রবল ভেদবুদ্ধি দিয়ে আমরা মানুষকে ভাগ করছি। মুসলমান-অমুসলমানের ভাগ। খাঁটি মুসলমান-নকল মুসলমানের ভাগ। আমার মতে মুসলমান না হলে কিংবা আমার মতো মুসলমান না হলে দখল করো তার মসজিদ, আগুন দাও তার ঘরে। ...এত যে ধর্মের কথা বলছি আমরা, তারপরও তো দুর্নীতি কেবল বেড়েই যাচ্ছে। তাহলে কী নিচ্ছি আমরা ধর্ম থেকে?
...এই ধর্মের কথা বলেই তো পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা আর সম্পদহরণের যজ্ঞ চালিয়েছিল একাত্তরে। ইসলামরক্ষার নাম করেই তো তাদের এ দেশী সহচরেরা জানমাল কবজ করেছিল, বুদ্ধিজীবী হত্যা করেছিল নির্মমভাবে। একদিনের জন্যেও তারা নিজেদের অন্যায় স্বীকার করেনি, ক্ষমাভিক্ষা করেনি।
...তার পুরস্কারও তারা পেয়েছে। আজ তারা রাষ্ট্রপরিচালনার অংশীদার। বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা সেনা-কর্মকর্তার পদাবনতি হয়, সেনানিবাসে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু জাতীয় পতাকা ওড়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের বাড়িতে-গাড়িতে, সকল স্থান তার জন্যে অবারিত।
...আমি চক্ষুষ্মান, কিন্তু অন্ধ টাইরেসিয়াসের মতো আমি ভবিষ্যৎ দেখতে পাই না। কী ঘটবে আগামীতে, তা আমার জানা নেই। চারপাশে এখন যা দেখি, তাতে বেদনায় ক্লিষ্ট হই। তাই বারবার ফিরে যাই মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে। সেসব দিনের অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে কিংবা যাঁরা কল্পনায় চলে যেতে পারেন সেসব দিনে, তাঁরা যদি নিজেকে জিজ্ঞাসা করেন, তখন কেন আমার ভাই প্রাণ দিয়েছিল, কেন আমার বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিল, কী চেয়েছিল সেদিন দেশের মানুষ, তাহলে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যকে আবার জেনে নিতে পারবেন। ...
দুঃসময়ে আনিসুজ্জামানরা সত্য উচ্চারণের সামর্থ্য রাখেন, তাঁরা দেশের মানুষের বিবেক হয়ে ওঠেন। ক্ষীণপ্রাণ, বাকশূন্য মানুষের কথা ও আকাঙ্ক্ষাগুলি তাঁদের লেখায় ভাষা পায়। আর কে আছে যে বলবে এইসব মানুষের কথা? মনে পড়ে, মুক্তিযুদ্ধের সেনাধ্যক্ষ জেনারেল ওসমানীর মৃত্যুর পরে আনিসুজ্জামানই বলেছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে এই প্রথম একজন মুক্তিযোদ্ধার স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটলো! বুকের ভেতরে মোচড় দেয়। অন্যমনস্ক হই। বড়ো বেশি স্মৃতি-জাগানিয়া। এইভাবে একে একে সর্বস্ব হারিয়ে ফেলার স্বাধীনতা আমরা চাইনি।
Freedom is just another word for nothing-left-to-lose
Nothing don’t mean nothing honey, if it ain’t free...
হায়, আমাদের আর কিছুই যে হারানোর নেই!
আজ ডিসেম্বরের এই সকালে বাংলাদেশ জেগে উঠে দেখবে কুয়াশাচ্ছন্ন একটি শীতসকাল।
মন্তব্য
আগের পর্বগুলো পড়লাম। ভাল লাগছে। অনেক বড় উপন্যাস হবে মনে হচ্ছে। আমার ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়তে ভাল লাগে না একসাথে বসে অনেকটুকু ইচ্ছেমতন পরতে বেশি মজা। পিডিএফ এ পুরোটার অপেক্ষায় রইলাম।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
নাঃ, অনেক বড়ো নয়। তবে সুযোগ আছে বলেই আপাতত "খসড়া" বলছি। ধন্যবাদ আপনার মনোযোগের জন্যে।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
পড়ছি - - -।
এটাও পড়লাম।
'প্রতিটি উপন্যাসই শেষ পর্যন্ত এক একটা অটোবায়োগ্রাফি'--কার সমালোচনায় যেনো পড়েছিলাম ।
-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
হাসান মোরশেদ, বড়ো লেখকরা লেখা থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত করতে সক্ষম হন। আমি সেই জাতে যে পড়ি না, আমার চেয়ে বেশি কে জানে! ফলে, আমার সব লেখাতেই কমবেশি আমি উপস্থিত, সশরীরে না হলেও ভাবনা বা বক্তব্যে ছায়া হয়ে। এই লেখাটিতেও তাই, তবে এটি "আত্মজীবনী" নয়। কোথাও কোথাও আমি যে নেই, তা-ই বা বলি কী করে?
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
পড়লাম, পরের পর্বে যাই।
কি মাঝি? ডরাইলা?
হ, ডরাইছি।
আপনি মন্তব্য ফ্লাডিং-এ দায়ে পড়বেন মনে হচ্ছে। আমার কিন্তু দোষ নাই।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
হে হে, আমি মডুদের পেয়ারের লোক। কোন সমস্যা নাই।
কি মাঝি? ডরাইলা?
নতুন মন্তব্য করুন