দেশের জন্য মন-কেমন-করা একটি অতি চমৎকার অনুভূতি। যারা চিরকাল এক জায়গায় কাটায়, স্বগ্রাম বা তাহার নিকটবর্তী স্থান ছাড়িয়া নড়ে না - তাহারা জানে না ইহার বৈচিত্র্য। দূরপ্রবাসে আত্মীয়স্বজনশূন্য স্থানে দীর্ঘদিন যে বাস করিয়াছে, সে জানে বাংলা দেশের জন্য, বাঙালির জন্য, নিজের গ্রামের জন্য, দেশের প্রিয় আত্মীয়স্বজনের জন্য মন কি রকম হু-হু করে, অতি তুচ্ছ পুরাতন ঘটনাও তখন অপূর্ব বলিয়া মনে হয় - মনে হয় যাহা হইয়া গিয়াছে, জীবনে তাহা আর হইবার নহে - পৃথিবী উদাস হইয়া যায়, বাংলা দেশের প্রত্যেক জিনিসটা তখন অত্যন্ত প্রিয় হইয়া ওঠে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় / আরণ্যক
১
বাংলাদেশে, আমার দেশে, এখন আরেকটি ভোরের আলো ফুটছে। শীতকাল, আমাদের বাড়ির শিউলিতলাটি ভরে আছে শিশিরধোয়া কমলা রঙের আভারঞ্জিত সাদা সাদা ফুলে। গাছের পাতা, বাগানের ঘাসগুলিতে স্ফটিকস্বচ্ছ শিশিরের ফোঁটা। খানিক পরে সূর্যের আলো এসে পড়লে শিশিরবিন্দুগুলি বিচিত্র বর্ণচ্ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। ঘন কুয়াশায় ঢাকা চারপাশ স্বপ্নের মতো অপার্থিব মনে হয়। কুয়াশার ভেতরে অস্পষ্ট একজন মানুষ। মানুষটির মুখ দেখা যায় না, তাঁকে দেখছি পেছন থেকে - গায়ে জড়ানো শাল, মাথায় কানঢাকা পশমী টুপি, মোজাপরা পায়ে কাবলি চপ্পল। মানুষটি আমার পিতা, প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছেন। আমার ছোটো দেশের, পৃথিবীর মানচিত্রে যা প্রায় অদৃশ্য হয়ে থাকে, ক্ষুদ্র একটি শহরের বাসিন্দা তিনি। প্রকৃতপক্ষে তিনি আর সেখানে বাস করেন না - তিনি কোথাও আর নেই, এই জানুয়ারিতে তিন বছর হবে। বহু বছর আগে দেখা এই ছবিটি থেকে গেছে। এখনো কুয়াশাময় শীতের সকালে তিনি তেমনই হাঁটেন দেখি।
কালিকাপুর নামের গ্রামটিতে ক্ষীয়মাণ ও ক্ষীণপ্রাণ নলামারা নদীর ওপারে কুয়াশায় কুয়াশা। নদীর পানির ওপরে ঘন কুয়াশা ভাসে, শীতসকালের অল্প বাতাসে ধোঁয়ার মতো পাক খায়। ঘাটে বসে একজন বয়স্ক মানুষ নিমের দাঁতনে দাঁত মাজেন। মানুষটির পরনে লুঙ্গি, খালি পা, গায়ে ফতুয়ার ওপর জড়ানো আলোয়ান। দাঁতমাজা শেষ হলে ঝুঁকে পড়ে নদীর শীতল পানিতে হাত ডুবিয়ে দেন। আমার মাতামহ। তিনিও আর নেই, অনেকগুলো বছর চলে গেলো। নলামারা নদী হেজেমজে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে কবে! তাঁকে দেখি এখনো পৌষের ভোরে কুয়াশার ভেতরে বসে নলামারার ঘাটে দাঁত মাজেন, অজু করেন। এরপর তিনি নিজের ঘরে জায়নামাজ বিছিয়ে একা একা ফজরের নামাজ পড়বেন। লেখাপড়া জানেন না, নিজের নামটি স্বাক্ষর করার মতো অক্ষরজ্ঞানও নেই তাঁর, কিন্তু ধর্মাচরণকে তিনি খুব ব্যক্তিগত করে রাখেন। বয়োজ্যেষ্ঠতার অধিকারে পুত্র-কন্যা, আত্মীয়-পরিজন কাউকেই এ বিষয়ে কোনো আদেশ দেন না, উপদেশ বর্ষণ করেন না। তিনি যথার্থ বিজ্ঞ ও আধুনিক মানুষ ছিলেন।
পিতামহের গ্রাম দোগাছির খুব কাছাকাছি কোনো নদী নেই, আখের ক্ষেত চারদিকে। এ অঞ্চলের মানুষ আখ বলে না, বলে কুশার। কোন সুদূর এক শীতভোরের সুগন্ধ এখনো ভেসে আসে। কুয়াশাময় তীব্র শীতের ভোরে খোলা মাঠের মাঝখানে অনুচ্চ খুঁটি পুঁতে আড়াআড়ি বাঁশে ঘেরা একটি জায়গায় চুলায় আগুন জ্বলে। খড়ের আগুনে কুশারের গুড় জ্বাল হয়। আগুনের চারপাশে ঘিরে বসা কয়েকজন মানুষ, তাদের মধ্যে আমার পিতামহকে কি দেখা যায়? মনে পড়ে না। আখগুড়ের সুগন্ধে ম ম করে চরাচর।
তখন আমার বালক বয়স, জয়পুরহাটে চিনিকল হয়নি। চিনিকল স্থাপিত হওয়ার পর এ অঞ্চলের সমস্ত গ্রামে গুড় বানানো নিষিদ্ধ হয়ে যায়, আইন করে বলা হয় সব কুশার বিক্রি করতে হবে চিনিকলের কাছে। গুড় তৈরির সুগন্ধ লুকানো যায় না বলে গোপনেও তা করা সম্ভব হয় না, জীবনভর অভ্যস্ত গুড়প্রিয় মানুষ তখন হুতাশ করে। গুড়ের সেই স্বাদ চিনিতে নেই, তবু উপায় কি! মানুষ মুখ বদলাতে বাধ্য হয়। নিজের জমিতে ঘাম ঝরিয়ে কুশারের চাষ হবে, তা দিয়ে আমি কী করবো তা-ও রাষ্ট্র নির্দেশ করে দেয়। আজ মনে হয়, মানুষের জীবন হয়তো এইভাবে বদলে যেতে থাকে। বালকের মস্তিষ্কে তখনো এইসব বোধ জন্মায়নি। মাঘ মাসের সেই শীতভোরের সুগন্ধ এখন দূরস্মৃতির বেশি কিছু আর নয়। পিতামহ বিগত কতোকাল আগে, আগুনের চারপাশ ঘিরে বসে থাকা কয়েকজন মানুষ গুড় তৈরি হওয়ার অপেক্ষায়, এই ছবিটি অটুট।
এক শীতসন্ধ্যায় তেঁতুলতলার ছোটো মাঠে ব্যাডমিন্টন খেলা। একদিকে বালক একা, প্রতিপক্ষ দু’জন। ছোটো মফস্বল শহরের এই পাড়ায় প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে টুর্নামেন্ট হচ্ছে। ডাবলস ম্যাচ, কিন্তু প্রতিপক্ষের দু’জন কোর্টে চলে এলেও বালকের সঙ্গী খেলোয়াড়টি নির্ধারিত সময়ের অনেক পরেও উপস্থিত হয়নি। উদ্যোক্তারা অন্য আরেকদিন ম্যাচটি হতে পারে বলে জানায়। বালক অসম্মত, সে একাই খেলবে। কেউ একজন বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করে, একা দু’জনের বিরুদ্ধে খেলা বোকামি তো বটেই, উপরন্তু প্রতিপক্ষের একজন, আইনুল, সিঙ্গলসে এ শহরের চ্যাম্পিয়ন টানা কয়েক বছর ধরে। বালকের তাতে কিছু এসে যায় না, অনুপস্থিত সঙ্গীর ওপরে রাগ-অভিমানও বোধ করে না। সে শুধু জানে, তাকে খেলতে হবে।
আরো কম বয়সে বালক শুনেছিলো, তেঁতুলতলার বিশাল ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছের মাথায় অশরীরী কিছু দেখা যায় চন্দ্রালোকিত রাতে। দিনের বেলায় ঝরে পড়া ছোটো ছোটো শুকনো পাতা আর পাকা তেঁতুলে গাছতলাটি ভরে থাকে। গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখা যায়, ফলন্ত গাছটির পাতা বাতাসে ঝিরিঝিরি কাঁপে। তখন সেদিকে তাকিয়ে কে বলবে এই গাছে কোনো কোনো রাতে অশরীরীরা যাতায়াত করে!
তেঁতুলতলার গা ঘেঁষে প্রাইমারী ট্রেনিং স্কুলের আজিজ স্যারের একতলা বাসা। রাগী বলে খ্যাতি আছে আজিজ স্যারের। অথচ গ্রীষ্মকালের বিকেলে খালি গায়ে লুঙ্গি পরে বারান্দায় একটি চেয়ারে বসে তাঁকে হাতপাখার বাতাস খেতে দেখলে সে কথা বিশ্বাস করার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যেতো না। অবশ্য কথা তিনি কম বলেন, হাসতেও বড়ো একটা দেখা যায় না। একদিন সাহস করে বালক তাঁকে জিজ্ঞেস করে ওই অশরীরীদের কথা। আজিজ স্যার গলা খুলে হেসে বলেন, হামি তা’লে এই গাছতলার বাসাত অ্যাদ্দিন আছি ক্যাঙ্কা কর্যা? বালক সেই একবারই আজিজ স্যারকে অট্টহাস্য করতে দেখেছিলো।
আরেক শীতসকালে অনুচ্চ স্বরে পাড়াময় রটে যায়, ময়না খুন হয়েছে। ময়না কে? ময়না এই পাড়ার এক নবীন যুবক। ঠনঠনিয়া মসজিদের পেছনে মানুষজন গিজগিজ করে। তার ফাঁক দিয়ে নিজের অকিঞ্চিৎকর শরীরটি গলিয়ে বালক সামনে এসে দেখে, একটি প্রায় পত্রশূন্য বৃক্ষের তলায় বুকে ছুরি বেঁধা ময়না চিৎ হয়ে পড়ে আছে। কালচে রক্ত জমাট হয়ে আছে। তার শরীর ঠিক শায়িত নয়, দুই পা পেছনের দিকে মোড়ানো। যেন সেজদায় বসে সামনে উবু না হয়ে উল্টোদিকে শরীর চিতিয়ে বুকে ছুরি নিয়েছে। ঝাঁকড়া চুলে ভরা মাথাটি একপাশে ফেরানো, চোখ খোলা। যেন কিছু বলে উঠবে এখনি। কিন্তু ভালো করে দেখলে বোঝা যায় তা প্রকৃতপক্ষে মৃত মাছের চোখের মতো। পাথরের চোখ বলে ভ্রম হলেও হতে পারে। বালকের বিস্ময় লাগে, এইভাবে মানুষ খুন হয়? এর আগে কোনো মৃতদেহ সে দেখেনি। আজও দেখতো না যদি তার এই ভিড়ে মিশে আসা কারো জ্ঞাতসারে ঘটতো। এক পাড়ায় বাস করেও ময়নাকে সে আগে কখনো দেখেনি। গাছতলায় হাঁটু মুড়ে পড়ে থাকা নিস্পন্দ প্রাণহীন ময়নাকে কোনোকালে ভুলে যাওয়া হলো না।
চোখের সামনে নেই, আর কখনো দেখা হবে না, এইসকল ছবি আমার হৃদয়ের অতি গহীন অভ্যন্তরে চিরকালের হয়ে আছে।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন