২
মস্তিষ্ক, যাকে আমরা সাধারণভাবে সর্বত্রগামী হৃদয় বলে ভাবতে বেশি ইচ্ছুক ও অভ্যস্ত, তার চেয়ে দ্রুতগামী কোনো যান মানুষ আবিষ্কার করেনি। হৃদয়যানের যাত্রী হয়ে অনায়াসে চারপাশের মানুষজনের অজ্ঞাতে মানস-ভ্রমণটি সম্পন্ন করা যায়। কর্মস্থল থেকে ছুটি নেওয়ার প্রয়োজন হয় না, অফিসে নিজের টেবিল-চেয়ারে বসে সম্পন্ন করা চলে। দূরদেশে, আমার দেশ থেকে পঁচিশ-তিরিশ ঘণ্টার বিমানযাত্রার দূরত্বে এখন আমি, অফিসের কর্মকোলাহলের ভেতরে।
পাশের কিউবিকলে সহকর্মীর স্পীকারফোন অন করা, কনফারেন্স কল। ভিন্ন ভিন্ন টাইমজোনের তিনটি শহরের সাত-আটজন মানুষ কথা বলে অনবরত। একটি কর্মপ্রকল্পে এ-যাবত চিহ্নিত ও সম্ভাব্য সমস্যাবলি নিয়ে যে যার মতামত ও বিশ্লেষণ উপস্থিত করে, নিজের অবস্থান ও ধারণার ব্যাখ্যা দেয়। এই পর্ব সম্পন্ন হলে অতঃপর সর্বজনগ্রাহ্য একটি কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ ও কর্মদক্ষতা অনুয়ায়ী দায়িত্ববণ্টন। এইরকমই হয়ে থাকে, সবই জানা কথা। আমি আজ এই আলোচনার অংশীদার নই বলে সম্পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া আমার জন্যে বাধ্যতামূলক নয়, কিন্তু অনিচ্ছায় হলেও শুনতে হয়। শ্রবণপর্বের ভারী ও দায়িত্বপূর্ণ কথাগুলির কিছু আমার কানে আসে, কিছু অধরা থাকে।
জীবিকার জন্যে মানুষকে কোনো না কোনো কর্মে সম্পৃক্ত হতে হয়। আমার মতো উচ্চাকাক্সক্ষাশূন্য মানুষও ব্যতিক্রম থাকে না। এই কর্মে অর্থাগম ঘটে, আহার-বসন-গৃহসংস্থান হয়, জীবনের আয়েশ সহজলভ্য হয়। প্রত্যেকটি সভ্য মানুষের দেওয়ার মতো একটি পরিচয় থাকা প্রথাসম্মত এবং তা প্রধানত কর্মনির্ভর। এখন থেকে হাজার হাজার বছর আগে মানুষ এইসব পরিচয় নিয়ে ভাবেইনি, ব্যক্তিপরিচয় বা পেশাগত কৌলিন্যের ভেদাভেদ নিয়ে তাদের মাথাব্যথা ছিলো না। শিথিল সামাজিক বন্ধনেও তারা যূথবদ্ধ হয়ে থাকতে জানতো। ভাবি, তারা কি অসুখী ছিলো?
আমি যে কাজটি করে জীবনধারণ করি, সেই পেশায় প্রসেস অটোমেশন বলে একটি কথা চালু আছে। অটোমেশন সেই জিনিস যা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মানুষের চেয়ে যন্ত্রের অধিকতর ব্যবহার নিশ্চিত করবে, তোমার জীবনকে সহজ করবে, সময়ের সাশ্রয় ঘটিয়ে উৎপাদন দ্রুততর ও বেশি ফলপ্রসূ করবে। সরল সোজা কথায় তা বলছে, আরো বেশি যন্ত্রনির্ভর হও, আলস্যকে জীবনের মোক্ষ করো। বিস্ময়ের কথা, সুখী হওয়ার জন্যে দরকারি সব উপকরণ আজ মানুষের নাগালে ও নিয়ন্ত্রণে, তবু মানুষ সুখী নয় কেন? সবসময়ই কিছু একটা নেই মনে হয়। আমার চারদিকে তাকিয়ে দেখি, বুঝতে চাই, ঠিক কী নেই যা হলে সত্যি সুখী হওয়া সম্ভবপর হতো।
আমার কর্মস্থলে কেউ জানে না, আমি এখন এখানে নেই। কমপিউটারের মনিটরে চোখ, হাতের অভ্যস্ত আঙুলগুলি কীবোর্ডে নির্ভুলভাবে চলাচল করে, প্রয়োজনে মাউস টেপে। আর সকলের অগোচরে মনে মনে আমার দেশে যাওয়া-আসার খেলা। খেলাটি আমার প্রতিদিনের। কতোবার যে চলে! খেলাই বটে। যা ঘটছে না, ঘটার সম্ভাবনাও নিকটবর্তী নয়, তাকে মনের মধ্যে বাস্তব করে দেখা খেলা ছাড়া আর কি? দয়াহীন বান্ধবশূন্য দূর পরবাসে এইটুকু আমার একেবারে নিজস্ব, কোথাও কোনো জমা-খরচের হিসেব না-দেওয়া লুকানো প্রশান্তির জায়গা। এর মধ্যে কারো কোনো ভাগ নেই, কোনো জবাবদিহি করা নেই, শুধু আমার একার।
এখানে এখন ফুরিয়ে আসা দিন। শীতের দিনে পাঁচটার পরপরই অন্ধকার নেমে আসতে থাকে। অফিসের ভেতরে বসে কিছু টের পাওয়া যায় না, মাথার ওপরে টিউবলাইট জ্বলে দিনমান, দিনরাতের তফাৎ বোঝার উপায় নেই। সময় দেখে বুঝি, বাইরে অন্ধকার নামছে। ঘড়ির হিসেবে বাংলাদেশ সময়ের বারো ঘণ্টা পেছনে আমি। দেশে আজকের খবর কি? নতুন কি ঘটছে?
ঢাকার কাগজগুলো দেখার জন্যে ইন্টারনেটে হানা দিই। আঃ, এই আন্তর্জাল না থাকার কালে দেশের খবর পাওয়া কী দুরূহ ছিলো! সেই সময় বড়ো ধরনের বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ের মতো কিছু হলে টিভিতে, স্থানীয় দৈনিকে দু’চার বাক্যের সংবাদ পাওয়া যেতো। না হলে তৎক্ষণাৎ কিছু জানার উপায় ছিলো না, ভরসা ছিলো নিউ ইয়র্কের বাংলা সাপ্তাহিকগুলো। তার জন্যেও আবার সপ্তাহভর অপেক্ষা। আজকাল এখানকার সময়ে দুপুর তিনটার মধ্যেই ঢাকার অনেকগুলো দৈনিক ইন্টারনেটে চলে আসে। ঢাকায় পত্রিকা তখনো প্রেসে, ছাপা শেষ হয়ে বেরোতে আরো কিছু দেরি। ততোক্ষণে দেশের সব খবর পড়া মোটামুটি শেষ হয়ে যায় আমার। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে ঢাকায় ফোন করলে সেখানে তখন সকাল হচ্ছে, অনেকে ঘুম থেকেও ওঠেনি, দৈনিক কাগজের প্রধান খবরগুলো সব আমার জানা। কাউকে দেশের খবর জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হয় না।
আজ সকাল থেকে কাজের চাপ কিছু বেশি, অল্প কিছুদিন আগে তৈরি করা একটি প্রোগ্রামের ত্রুটি মেরামতের কাজে কিঞ্চিৎ পিছিয়ে পড়েছিলাম। তাগিদ ছিলো আজ দুপুরের মধ্যে শেষ করে দেওয়ার। কমপিউটারে প্রোগ্রাম লেখার স্পেসিফিকেশন প্রস্তুত হয় ব্যবহারকারীদের প্রয়োজনের পুঙ্খানুপুঙ্খ জেনে, অথচ তারপরেও ব্যবহারকালে অজানা ও অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে কারো সন্বিৎ ফেরে - আরে, এই পরিস্থিতিটি আগে কেউ ভাবেনি কেন? বস্তুত মানুষের জীবনের গল্পেও এরকমই হয়ে থাকে, হোক তা ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত অথবা রাষ্ট্রীয়। তখন মনে হতে থাকে, আগে ভাবা উচিত ছিলো!
কাগজগুলো এখন দেখবো। দেরি হয়েছে কিছু, তা হোক, ঢাকায় কেউ এখনো কাগজ হাতে পায়নি। রেলস্টেশন, দূরপাল্লার বাস টার্মিনাল বা সদরঘাটে অতি প্রত্যুষের যাত্রীরাও না।
দেশের সংবাদের জন্যে এতো যে আগ্রহ, অধীরতা আমার, অনেকটা হয়তো নেশাগ্রস্তের মতো, কিন্তু কী দেখবো বলে আশা করি প্রতিদিন? স্পষ্ট কোনো উত্তর জানা নেই। ঘটনা-দুর্ঘটনা, হানাহানি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিপুল বিস্তার আর হতাশার খবরে ভরে থাকে কাগজ। দৈনিক দুঃসংবাদ নামে একটি কাগজ থাকলে খুব উপযুক্ত হতো বলে মনে হয়। কাগজে আর থাকে রাজনৈতিক ক্ষুদ্রতা ও অদূরদর্শিতার লজ্জাহীন বিস্তারের সংবাদ - দেশ নয়, দেশের মানুষ নয়, তাদের ভালোমন্দে কিছু এসে যায়না, আমি এবং আমার দলই একমাত্র বিবেচ্য। এইসব দেখে দেখে ভারি ক্লান্ত লাগে, বিষাদে মন ভরে যায়। কখনো এমনও মনে হয়, প্রতিদিন একই খবর পড়ছি। ভাবি, কী হবে আর দেখে, একদিনের কাগজ দেখলে সারা বছরের খবর পাওয়া হয়ে যায়। অথচ পরেরদিন নির্ধারিত সময়ে আবার ইন্টারনেটে না গিয়ে উপায় থাকে না আমার - মনে হতে থাকে আজই হয়তো অন্যরকম কোনো একটি সংবাদ দেখবো। আমার দেশে নতুন ও সুন্দর কিছু একটা ঘটে যাবে আর আমি যথাসময়ে সে সংবাদটি জানতে পারবো না, তাই হয়! বাস্তব এই যে বাস্তবে কিছুই ঘটে না, সুসংবাদের অপেক্ষায় দিনের পর দিন চলে যায়, তবু আমার আশা মরে না। অন্তিম বিচারে আশা নিয়েই হয়তো মানুষ বেঁচে থাকে।
আমার দেশে ডিসেম্বরের আজকের সকালটি অন্যসব দিনের থেকে অন্যরকম। তেত্রিশ বছর বয়সী আমার দেশটির জন্মের সময় আমি সদ্যযুবা। কতো বিসর্জন ও রক্তক্ষয়ের কাহিনী আর বীরত্বগাথায় পূর্ণ ছিলো সেই ডিসেম্বর।
In the grip of this cold December
You and I have reason to remember...
ডিসেম্বরের এই শীতল থাবার অন্তর্গত হয়ে তোমার এবং আমার স্মৃতিমন্থন করার কারণও কিছু আছে! সেদিন আমাদের প্রাণে অর্জনের অহংকার ছিলো, দুই চোখ ভরা স্বপ্নের দ্যুতি ও বিস্তৃতি ছিলো। আকাশতুল্য অনন্ত সম্ভাবনা নিয়ে আমরা টগবগ তখন করছি, আমাদের সামনে কী আলোকময় অলৌকিক একটি ভবিষ্যৎ!
এই দিনে আজ সুদূর মনে হওয়া অনতিদূরের সেই ডিসেম্বরের কথা কি আমাদের স্মরণে আসবে না? মাঝখানের বছরগুলোকে ভাবলে ভুল, ব্যর্থতা ও হতাশার কথা আসবে, তা-ও নিশ্চিত। বিস্মৃত হতে আমরা প্রায়শ সচ্ছন্দ, হয়তো এই বিস্মৃতি না ঘটলে আমাদের দুঃখ-হতাশার আর শেষ থাকতো না, সর্বনাশে সম্পূর্ণ নিমজ্জন অমোচনীয়ভাবে ঘটে যেতে পারতো। তবু ডিসেম্বরের এই দিনটিকে স্মরণ না করে আমাদের উপায় নেই।
আজ আমাদের সেইসব স্বপ্ন ও সম্ভাবনার সবই ভুল ও ব্যর্থ হয়ে গেছে বলে মনে হয়। বস্তুত আমাদের ব্যর্থ স্বপ্নের গল্প অগণন। এতোদিন হয়ে গেলো, তবু কিছু অর্জনের গরিমা নেই আমার দেশের, অর্থ-বিত্তের অহংকার নেই। আছে যতোটুকু, নেই তার থেকে ঢের বেশি। দারিদ্র্য নামে যা আছে অপরিমেয়, তাকে লোকে ভালো চোখে দেখে না, অভাবীদের গৌরব যদি কিছু থাকেও, নিত্যদিনের ক্লিন্নতার আড়ালে তা অনায়াসে ঢাকা পড়ে যায়। তা-ও সহনীয় হতে পারতো, কিন্তু আমার দেশ জগতের সেরা হয় দৈনন্দিন অসততা ও অসদুপায়ের জন্যে। রাজনৈতিক কোলাহলে সে সারা পৃথিবীর নিন্দা কুড়ায়। রাষ্ট্রপ্রধান হত্যায় আমাদের দক্ষতা একসময় রাষ্ট্র হয়ে যায় বিশ্বময়। নিত্যদিনের খুনখারাবিতে মানুষের জীবনই সর্বাপেক্ষা শস্তা ও সুলভ পণ্য হিসেবে প্রতীয়মান হয়। ক্ষমতাধররা লোভ ও নির্লজ্জতার নতুন নতুন শীর্ষ আবিষ্কার করে এবং সেই শীর্ষে তাদের আরোহণপর্বটি ঘটে সাড়ম্বরে, অকম্পিত ও অপরিবর্তিত মুখে। মানুষের কোনো কীর্তি বা সাফল্য নয়, বন্যায়-মহামারীতে-দুর্ভিক্ষে বছর-বছর পৃথিবীর তাবৎ সংবাদপত্রের শিরোনাম হয় আমার দেশ। এতো যে নেই নেই, পর্বতপ্রমাণ আমাদের অক্ষমতা ও ব্যর্থতা, স্বপ্নভঙ্গের বিষাদ - তারপরেও মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলা কি মানায়!
তবু এই রুগ্ণ করুণ অসহায়, ক্ষুদ্র ভুখণ্ডটির জন্যে অতি উচ্চ একটি গৌরবস্তম্ভ ও শর্তহীন ভালোবাসা নিজের ভেতরে যত্নে লুকিয়ে রাখি। দেশটি যে আমার!
আজকের একটি দৈনিকে নিজস্ব প্রতিবেদকের লেখা প্রধান প্রতিবেদন :
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর সূর্য উঠেছিল শুধু একটি নতুন দিনের জন্য নয়, বিশ্বের মানচিত্রে একটি নতুন দেশের আগমন সংবাদ নিয়ে। সকালের সূর্য লাল হয়, তবে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রাঙা সেদিনের সূর্য বোধহয় একটু বেশিই লাল ছিল। ... ৩৩ বছরে সেই সূর্য আরো একটু লাল হয়েছে, বিজয়ের স্বপ্ন পূরণ না হওয়া, অর্থনৈতিক মুক্তি না আসা আর সরাসরি স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমতায় অংশীদার হওয়ার লজ্জায়। ...
প্রথম পাতায় আরো একটু এগিয়ে পাওয়া যায় বিজয় দিবসের বিশেষ রচনা আনিসুজ্জামানের, তিনি লিখছেন :
...সেদিন চোখে যে স্বপ্ন ছিল, বুকে যে বল ছিল, মনে যে আশা ছিল আজ তার কিছুই অবশিষ্ট নেই।
...যে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা সাহস করনি হত্যা করতে, অবলীলায় তাঁকে আমরা মেরে ফেললাম। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যে-নেতারা - বিশ্বাসহন্তা একজন ছাড়া - তাঁরা সকলে নিহত হলেন আমাদেরই হাতে। চারজন সেক্টর কম্যান্ডার প্রাণ দিলেন আত্মঘাতী দ্বন্দ্বে।
...নিরীহ বাঙালি একদিন অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল হানাদারকে হটাতে। বীরত্ব সে দেখিয়েছিল বটে। তারপর সেই অস্ত্র হাতে নিয়ে সে হয়ে গেল সন্ত্রাসী। সেই সন্ত্রাসের সঙ্গে প্রবল যোগ অসুস্থ রাজনীতির। আজ আমাদের দৈনন্দিন জীবন সন্ত্রাস-পীড়িত, সামাজিক আয়োজন সন্ত্রাস-লাঞ্ছিত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সন্ত্রাস-কবলিত। রাষ্ট্র এখন স্বয়ং সন্ত্রাস চালাচ্ছে, নির্বিচারে মানুষ মেরে চলেছে।
১৯৭১ সালে কে ভাবতে পেরেছিল বাংলাদেশে কখনো আসবে সামরিক শাসন? কে ভেবেছিল যে, সাম্প্রদায়িকতা এখানে মাথা তুলবে এত প্রবলভাবে? প্রবল ভেদবুদ্ধি দিয়ে আমরা মানুষকে ভাগ করছি। মুসলমান-অমুসলমানের ভাগ। খাঁটি মুসলমান-নকল মুসলমানের ভাগ। আমার মতে মুসলমান না হলে কিংবা আমার মতো মুসলমান না হলে দখল করো তার মসজিদ, আগুন দাও তার ঘরে। ...এত যে ধর্মের কথা বলছি আমরা, তারপরও তো দুর্নীতি কেবল বেড়েই যাচ্ছে। তাহলে কী নিচ্ছি আমরা ধর্ম থেকে?
...এই ধর্মের কথা বলেই তো পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা আর সম্পদহরণের যজ্ঞ চালিয়েছিল একাত্তরে। ইসলামরক্ষার নাম করেই তো তাদের এ দেশী সহচরেরা জানমাল কবজ করেছিল, বুদ্ধিজীবী হত্যা করেছিল নির্মমভাবে। একদিনের জন্যেও তারা নিজেদের অন্যায় স্বীকার করেনি, ক্ষমাভিক্ষা করেনি।
...তার পুরস্কারও তারা পেয়েছে। আজ তারা রাষ্ট্রপরিচালনার অংশীদার। বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা সেনা-কর্মকর্তার পদাবনতি হয়, সেনানিবাসে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু জাতীয় পতাকা ওড়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের বাড়িতে-গাড়িতে, সকল স্থান তার জন্যে অবারিত।
...আমি চক্ষুষ্মান, কিন্তু অন্ধ টাইরেসিয়াসের মতো আমি ভবিষ্যৎ দেখতে পাই না। কী ঘটবে আগামীতে, তা আমার জানা নেই। চারপাশে এখন যা দেখি, তাতে বেদনায় ক্লিষ্ট হই। তাই বারবার ফিরে যাই মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে। সেসব দিনের অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে কিংবা যাঁরা কল্পনায় চলে যেতে পারেন সেসব দিনে, তাঁরা যদি নিজেকে জিজ্ঞাসা করেন, তখন কেন আমার ভাই প্রাণ দিয়েছিল, কেন আমার বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিল, কী চেয়েছিল সেদিন দেশের মানুষ, তাহলে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যকে আবার জেনে নিতে পারবেন। ...
দুঃসময়ে আনিসুজ্জামানরা সত্য উচ্চারণের সামর্থ্য রাখেন, তাঁরা দেশের মানুষের বিবেক হয়ে ওঠেন। ক্ষীণপ্রাণ, বাকশূন্য মানুষের কথা ও আকাঙ্ক্ষাগুলি তাঁদের লেখায় ভাষা পায়। আর কে আছে যে বলবে এইসব মানুষের কথা? মনে পড়ে, মুক্তিযুদ্ধের সেনাধ্যক্ষ জেনারেল ওসমানীর মৃত্যুর পরে আনিসুজ্জামানই বলেছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে এই প্রথম একজন মুক্তিযোদ্ধার স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটলো! বুকের ভেতরে মোচড় দেয়। অন্যমনস্ক হই। বড়ো বেশি স্মৃতি-জাগানিয়া। এইভাবে একে একে সর্বস্ব হারিয়ে ফেলার স্বাধীনতা আমরা চাইনি।
Freedom is just another word for nothing-left-to-lose
Nothing don’t mean nothing honey, if it ain’t free...
হায়, আমাদের আর কিছুই যে হারানোর নেই!
আজ ডিসেম্বরের এই সকালে বাংলাদেশ জেগে উঠে দেখবে কুয়াশাচ্ছন্ন একটি শীতসকাল।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন