৫
ডায়েরি লেখা আমার হয় না। অনেকে বলে থাকেন, ডায়েরিতে বেশিরভাগ মানুষ সত্যি কথা লেখে না। প্রতিভাবান ব্যতিক্রম অবশ্য আছেন, তাঁদের কথা আলাদা। কিন্তু গড়পড়তা মানুষ নিজে যা নয় তাই ডায়েরিতে লিখে রাখে। লেখার সময় তারা কল্পনায় একজন অচেনা পাঠককে দেখতে পায়, সুতরাং সেই পাঠকের কাছে নিজেকে মহৎ ও মহান হিসেবে উপস্থাপন করা তখন জরুরি হয়ে ওঠে।
আমি নিজে এই দুই প্রকারের কোনোটিই হতে পারিনি। তেমন করে লেখার প্রতিভা ও সামর্থ্য সকলের থাকে না, আমারও নেই। আর মিথ্যা লেখার আশংকা থেকেই সম্ভবত আমার ডায়েরি লেখার আগ্রহ হয় না। দেশ ছাড়ার সময় এক বন্ধু, কী মনে করে কে জানে, মজবুত বাঁধাই করা একটি খাতা উপহার দিয়েছিলো। এ ধরনের খাতা তখন বাংলাদেশে কিনতে পাওয়া যেতো না, এখন হয়তো যায়, ঠিক জানি না। কোথা থেকে যোগাড় করেছিলো, সে-ই জানে। প্রথম পাতায় বন্ধুটি গোটা গোটা অক্ষরে পাবলো নেরুদাকে কয়েক ছত্র উদ্ধৃত করে দিয়েছিলো :
For some reason or other, I am a sad exile.
In some way or other, our land travels with me
And with me too, though far, far away, live the longitudinal essences of my country.
উদ্ধৃতিটি আগে লক্ষ্য করে দেখিনি, দেশান্তরী হওয়ার উদ্বেগসংকুল ব্যস্ততার মধ্যে স্যুটকেসে ঢুকিয়ে ফেলেছিলাম। পঙক্তিগুলি নেরুদার রচনা, তা-ও জানা ছিলো না। বন্ধু উদ্ধৃতি লিখেছিলো, সূত্র উল্লেখ করেনি। পরে জানা হলো চিলির প্রবাসী লেখক ইজাবেল আলেন্দের মাই ইনভেন্টেড কান্ট্রি বইয়ে উদ্ধৃত দেখে। ইনভেন্টেড কান্ট্রি! নামকরণেই চমক লাগে, লেখকের নামের শেষাংশে আলেন্দে পদবীটিও অন্য এক অনুরণন তোলে। যৌবনকালে আমরা যারা একটি সাম্যবাদী রাষ্ট্র ও যূথবদ্ধ পৃথিবীর স্বপ্নে নিমজ্জিত ছিলাম, চিলির সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রনায়ক সালভাদর আলেন্দে তাদের আত্মীয়সম মানুষ ছিলেন। সালভাদরের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইজাবেল। সামরিক উর্দিধারী পিনোশের নেতৃত্বে সালভাদর আলেন্দে নিহত হন ১৯৭৩-এর ১১ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার। সামরিক একনায়ক পিনোশেকে সমর্থন ও সহায়তা দেয় মার্কিন গোয়েন্দাসংস্থা সিআইএ। আশ্চর্য, ঠিক বত্রিশ বছর পর সেই আমেরিকাই আক্রান্ত হয় ২০০১-এর ১১ সেপ্টেম্বর। সেদিনও মঙ্গলবার! কাকতালীয়, নাকি নিয়তি-নির্ধারিত?
সালভাদর নিহত হলে আলেন্দে পরিবারভুক্ত কারো পক্ষে চিলি তখন আর বাসযোগ্য ও নিরাপদ হওয়ার কথা নয়। ইজাবেলকে তাঁর জন্মভূমি ত্যাগ করতে হয়, এখন আমেরিকার বাসিন্দা তিনি। চিলিতে সশরীরে বাস না করলেও দেশটি এখনো তাঁর হৃদয়ে, নিজেকে তিনি চিলির মেয়ে হিসেবেই দেখেন এখনো। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকাকে একাকার করে কল্পনায় একটি নতুন দেশ নির্মাণ করে নিয়েছেন, যাকে তিনি বলছেন ইনভেন্টেড কান্ট্রি।
চিলির ভৌগোলিক অবস্থান এবং তুষারময় পর্বতমালা ও দীর্ঘ সমুদ্রতটের বৈশিষ্ট্য বাদ দিলে দেশটির সঙ্গে আমার দেশের কী আশ্চর্য সাদৃশ্য। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে চিলির বয়স প্রায় পৌনে দুশো বছরের। তার সমাজ, ইতিহাস, দেশের মানুষ ও তাদের সংগ্রাম, সামাজিক সংস্কার - সবই আমার দেশের সঙ্গে তুল্য। তারাও বন্যা-জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকে। আমার দেশের মতোই সে দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক গঠন, বিভাজন ও বিশৃঙ্খলা। রাজনীতি ও এককালের ক্ষমতা বদলের সামরিক পদ্ধতিটিও। চিলির আলেন্দের সমসাময়িক ও সমগোত্রীয় আমার দেশের প্রধানতম নেতা, শেখ মুজিব, সালভাদরের দু’বছর পর নিহত হয়েছিলেন, সপরিবারে। বাঙালি জাতির জন্যে একটি পৃথক রাষ্ট্রের নির্মাতা এইভাবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন, তা-ও আমেরিকার সৌজন্যে।
আরো একটি বিষয়ে চিলি কিছু আলাদা। সে দেশে ধর্মবিশ্বাসী মানুষ প্রচুর আছে, সম্ভবত বেশির ভাগ মানুষই তাই। ধর্ম নিয়ে উন্মাদনা নেই তা-ও নয়, কিন্তু এক ধর্মের মানুষরা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে বিতাড়ন বা নির্মূল করতে তৎপর হয় না, তাদের বিধর্মী বলে ঘোষণা দেয় না। ধর্ম বিষয়ে অবিশ্বাস স্থাপন করলে দেশত্যাগী হতে হয় না, প্রাণসংশয় ঘটে না। আজ শুনি আমার দেশে এই ধর্মোন্মাদদের অব্যাহত ও ক্রমবর্ধমান দাপট। তারপরেও জানি, বিশ্বাস করি, আমার দেশের গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষ এই উন্মাদনা ও দাপটের ভুক্তভোগীমাত্র - তার অংশীদার নয়।
বন্ধুর দেওয়া খাতার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম, একদিন অকস্মাৎ খাতাটি আমার হাতে উঠে আসে, যেন বিস্মৃতির ভেতর থেকে। উদ্ধৃত চরণগুলি পড়ে শিহরিত হই, এসব তো আমার কথা। সম্ভবত কবিরাই অন্যদের কথা এমন সুন্দর করে বলতে পারেন, যেন তা হৃদয় মুচড়ে দেওয়া একটি দীর্ঘশ্বাস!
খাতাটি কী কাজে ব্যবহার করা যায়, ভাবি। সাদা পাতাগুলো অপেক্ষায় আছে। মনে হয়, আমার বন্ধু খাতাটি অপাত্রে দান করেছে। লেখক বা কবি এমনকী চিত্রকর হলেও কাজে লাগানো সম্ভব হতো। আমি এখন কী করি? কিছু না ভেবে একদিন নিজের মনে লিখতে শুরু করি। আমার নিজের সব কথা। কোনো কোনো কথা আছে, অন্য কারো সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় না। আর আমি ভাগাভাগি করবো কার সঙ্গে? এই ডালাস শহরে বাস করি আজ পঁচিশ বছর। এ দেশীয় স্থানীয় অনেকের সঙ্গে কর্মসূত্রে বা অন্য কোনোভাবে পরিচয় ঘটেছে, তারা কেউ আমার বন্ধু নয়। আমি তাদের কতোটা বুঝবো, তারাই বা আমাকে কতোটা? ভাষা বোঝা গেলেও পরস্পরের সংস্কৃতি ও সামাজিকতার রীতিসমূহ অজানা থাকে, পারিবারিক ধ্যানধারণা ও আচার অবোধ্য থেকে যায়। গাত্রবর্ণের পার্থক্যও একটি বিষয় বটে, মার্কিন দেশীয় সাদা ও কালোদের চিরকালীন বিভাজন আজও খুব বেশি জীবন্ত।
স্বগোত্রের মানুষদের সঙ্গেও আমার জমেনি। এই শহরে যখন আসি তখন এক হাতের আঙুলে বাঙালি গোনা সম্ভব হতো। পরে মানুষজন অনেক বেড়েছে, তবু চেনাজানা বেশি হয়নি। এর আগে নিউ ইয়র্কে কেটেছে বছর চারেক, সেখানেও অন্যরকম কিছু ঘটেনি। দোষ অবশ্য অন্য কারো নয়, আমারই। আমি লক্ষ্য করি, মানুষ বড়ো বেশি অপ্রয়োজনীয় কথা বলতে পছন্দ করে, অহেতুক কৌতূহলী তারা। আমি সবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি - তারা কি বলে শুনবো, তাদের কথা বুঝবো বলে। জানতে চাই তারা কে, কী তাদের অভীষ্ট বা গন্তব্য। কিন্তু সখেদে টের পাই, অনেক কথা বলেও তারা আসলে কিছুই বলে না। তারা নতুন মডেলের গাড়ির কথা বলে। বাড়ির মর্টগেজে সুদের হার নিয়ে বিতর্ক করে। স্যুট-টাই ও স্বাস্থ্যবীমা বিষয়ে কথা বলে। বাংলাদেশ থেকে এখানে অবতীর্ণ হয়ে তারা কে কতোটা আমেরিকান হয়ে উঠতে পারলো তা ইংরেজি ভাষায় অনর্গল বলে অসংকোচ গর্বে। কয়েক বছর আগেও ছিলো না, সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে, কারণে-অকারণে ধর্মবিষয়ক কচকচানি - একে অন্যের চেয়ে কতোবেশি পরিমাণ ধার্মিক তার সবিস্তার বয়ান এবং অন্য অল্পপ্রাণ, স্বল্পবুদ্ধি ও গুনাহগার মানুষদের করণীয় কি, তার পাঠক্রম।
একই কথা ক্রমাগত বলে যায় তারা, কেউ অন্য কারো থেকে আলাদা কিছু শোনায় না। আর আছে বোধবুদ্ধিহীন ও স্থূল কৌতুকের অনিঃশেষ ভাণ্ডার - তরল, গরল, ইতর, অশ্লীল ও রুচিহীন। দেশের কথা বলতে তাদের প্রচুর উৎসাহ, অথচ তারা শুধু নিরাশার কথা বলে, আমার দেশটি কতো বিচিত্ররকমভাবে এবং কেন আর বাসযোগ্য নয়, আমেরিকার তুলনায় আমার দেশটি একটি জঙ্গলবিশেষ - সেইসব কথা। অবধারিতভাবে থাকে রাজনৈতিক ভেদবুদ্ধির কাহিনী ও যুক্তিবর্জিত উচ্চকিত তর্ক। হয়তো আমারই ভুল, আমি মানুষের কাছে খুব বেশি আশা করি। ভুলে যাই, শুধু আমার দেশের মানুষ নয়, পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই এইসব দিনানুদৈনিকের গল্পে নিবিষ্ট হয়ে থাকে। সর্বদা তারা আমোদিত হতে চায়, বিনোদনের সন্ধান করে। এইসব কথাও তাদের একরকমের বিনোদন বটে।
আমি আসলে যে কী শুনতে চাই খুব স্পষ্ট করে কি জানি? যা শোনার জন্যে আমি অপেক্ষা করি, তা এইসব নিচের তলার জিনিস নয়। এইসব দিয়ে মনুষ্যজাতির বা পৃথিবীর বিশালত্ব বোঝা যায় না। আমি শুনতে চাই মানুষের অর্জনের কথা। মনুষ্যজীবনের সংগ্রাম, অর্থপূর্ণতা, সুন্দরতর বিষয়সমূহ ও অনিত্যতার কথা। অকল্পনীয় বিশাল আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাসিন্দা হিসেবে আমার বা আর যে কোনো একক ব্যক্তির অকিঞ্চিৎকরতার স্বীকারোক্তি ও উপলব্ধি। বিদেশে বসবাসের সংগ্রাম ও যাতনার কথা শুনতে চাই। দেশের জন্যে স্ফুরিত অহংকার ও ভালোবাসার উৎসারে আমার আগ্রহ। ক্ষুদ্র রাজনীতি ও ধর্মীয় উন্মাদনার বাইরে যে দেশ, সেই বৃহৎ বাংলাদেশের সমষ্টিগত আকাক্সক্ষা আর ভবিষ্যতের কথা শুনতে চাই। এইসবই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক জ্ঞান করি।
আমি যেসব কথা অন্য মানুষদের মুখে শুনি না, যে কথাগুলো আমার বলা হয় না, শোনারও কেউ নেই - সেইসব আমি নিজের মতো করে নিজেরই জন্যে লিখে যাই। এইসব আমার নিজস্ব ভাবনার কথা, আমি ভাগাভাগি করি এই খাতার সঙ্গে।
জালাল ভাইয়ের বাসা থেকে বেরোতে বেশ রাত হয়ে যায়। নিজের ঘরে ফিরে ফোনের কলার আই ডি দেখি, অচেনা দুটো নাম্বার। অ্যানসারিং মেশিনে কোনো মেসেজ নেই। কাপড় পাল্টে হাতমুখ ধুয়ে নিই। মাঝেমধ্যে দেশ থেকে পুরনো বন্ধুবান্ধব ফোন করে, তার জন্যে আমি অপেক্ষা করে থাকি। আর অপেক্ষা মুনিয়ার ফোনের জন্যে। জানি কোনো কারণ নেই, তবু আশা করি। এমন নয় যে নিয়মিত ফোন করতে সে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তা সম্ভব নয়, উচিতও নয়। মাঝেমধ্যে আচমকা ফোন করে সে, এসএমএস পাই, ইমেলও কদাচিৎ। গত দু’সপ্তাহ কিছুই আসেনি। তার ঘরসংসারের ব্যস্ততা আছে, নিজস্ব জীবনবলয় ও প্রাত্যহিকতার দায় আছে। সেসব সম্পূর্ণ হলে তারপরে সুযোগমতো আমাকে ফোন করা তার সম্ভব হয়। ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী দেশ থেকে এখানকার সময়ের পার্থক্যও হিসেবে রাখতে হয়। এই যোগাযোগ পুরোটাই মুনিয়ার নিজের শর্তে, সেটিই সঙ্গত, আমার মতো দায়শূন্য জীবন তার নয়। আমার বিশেষ কোনো অনুযোগও অবশ্য নেই। এইটুকু যোগাযোগও তো থাকার কথা ছিলো না, আছে এই ঢের!
এক শয়নকক্ষবিশিষ্ট আমার এই ছোটো অ্যাপার্টমেন্টটি একা মানুষের জন্যে আদর্শ। ঢাকার জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ে একা একটি কক্ষের মালিকানা পাওয়া হয়ে ওঠেনি, তার আগেই দেশত্যাগী হয়েছি। নিউ ইয়র্কে একা বাসা ভাড়া করার সামর্থ্য ছিলো না, ভাড়া সেখানে অতিশয় বেশি, দুই বেডরুমের একটি বাসায় চারজন ভাগাভাগি করে থাকা। এই শহরে আসার পর নিজের মতো করে একা থাকার সুযোগটি আসে। মূল শহরের একটু বাইরে এই অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে আমার বাসা দোতলায়, পুব-উত্তর ফাঁকা। শয়নকক্ষের উত্তরের জানালা খুলে দিলে দেখা যায়, কিছু ফাঁকা জায়গা ছেড়ে ছোটো লেকসহ একটি পার্ক। জগিং ট্রেইলও আছে। আবহাওয়া অনুকূল থাকলে পার্কের বেঞ্চে বসে খানিকটা সময় কাটানো যায়। আমার প্রাতঃভ্রমণে উৎসাহী হয়ে ওঠার পেছনে বড়ো বড়ো গাছপালায় ঢাকা এই পার্কেরও একটি ভূমিকা আছে। মৌসুমী ফুল ফোটানো হয় যত্ন করে, বসন্তকালে বুনোফুলের প্রতাপ। পূর্ণ চাঁদের রাতে গিয়ে দেখেছি, লেকের শান্ত পানিতে নরম আলো ছড়িয়ে যায়, চাঁদের আলোয় বড়ো বড়ো গাছের ছায়া পড়ে থাকে সেখানে, চারপাশ ঘিরে থাকে বইয়ে পড়া রূপকথার মতো মায়াবী রাত। এই সময়ে আমার অবধারিতভাবে আরেকটি রাতের কথা স্মরণ হয়।
Can you hear the drums, Fernando?
I remember long ago another starry night like this
In the firelight, Fernando
You were humming to yourself and softly strumming your guitar
I could hear the distant drums
And sound of bugle calls were coming from afar
They were closer now, Fernando
Every hour every minute seemed to last eternally
I was so afraid, Fernando
We were so young and full of life and none of us prepared to die
And I am not ashamed to say
The constant roar of cannons almost made me cry
There was something in the air that night
The stars so bright, Fernando
They were shining there for you and me
For liberty, Fernando
Though I never thought that we could lose
There’s no regret
If I had to do the same again
I would my friend, Fernando…
যুদ্ধের সময় শেষ হেমন্তের একরাতে দেখা হয়েছিলো অপার্থিব পূর্ণ চাঁদের রাত। ঠিক মাথার ওপরে পরিষ্কার নীল আকাশের গা বেয়ে অঝোরে ঝরা চাঁদের আলোয় চরাচর ধুয়ে যাচ্ছিলো। বিগত-বর্ষার শীর্ণকায় নলামারা নদীর পাড়ে সাদা বালুকারাশি চাঁদের আলোয় মহার্ঘ্য ধাতুর মতো চকচক করে। আলোয়ানের তলায় সশস্ত্র আমরা পাঁচজন। দলনেতা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনশাস্ত্রের ছাত্র মাজেদ, তার কাছে স্টেনগান আর দুটি হ্যান্ড গ্রেনেড। নজরুল, আকবর, প্রণব আর আমার কাঁধে রাইফেল। আরো একজন আমাদের সঙ্গী, তবিবর, আমাদেরই বয়সী নৌকার মাঝি, তার হাতে লগি ও বৈঠা। নদীর ঘাটে বাঁধা ছোটো একটি ডিঙি নৌকা। দলনেতা ছাড়া গন্তব্য আমাদের কারো জানা নেই, তাতে কিছু আসে যায় না। আমরা নিঃশব্দে নৌকার দিকে হাঁটি। এমন মনোহর চাঁদের রাত আর কখনো কি দেখবো? মনে হয়, এই অপরূপ দৃশ্যের জন্যে পৃথিবীতে বারংবার ফিরে আসা যায়।
এই পৃথিবীতে আমার বসবাস খুব অল্প দিনের নয়, পূর্ণ চাঁদের রাত আরো কতো শত শতবার দেখা হয়েছে, অথচ সেই রাত্রির সঙ্গে আর কোনো রাতের তুলনা হয় না। তেমন অলৌকিক ও মায়াবী চাঁদের রাত আর কোনোদিন দেখা হয়নি। হবে না। অপরিমেয় জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া একটি হেমন্তরাত আমার সারাজীবনের সঙ্গী হয়ে থেকে গেলো।
আমার শয়নকক্ষে মাঝারি বিছানা, বইয়ের শেলফ আর কমপিউটারসহ পড়ার টেবিল। লাগোয়া বাথরুম, ক্লজেটে কিছু কাপড়চোপড়। বসার ঘরে কোনোমতে ভদ্রগোছের সোফা, টিভি-ভিসিআর ও গান শোনার একটি যন্ত্র। রান্নাঘরের মতোই একটি রান্নাঘর, ফ্রিজসহ। তার পাশে ছোটো গোলাকার গ্লাসটপ খাওয়ার টেবিল। এই আমার সংসার।
এক কাপ কফি তৈরি করে নিয়ে পড়ার টেবিলে বসি। এতো রাতে কফি খাওয়া ঠিক হচ্ছে না জানি, ঘুমাতে কষ্ট হবে। তবু নিই, আজ এক্ষুণি বিছানায় যাবো না। আমার খাতাটি নিয়ে লিখতে বসি:
আমার দিনরাত্রি একাত্তর আর আমার দেশটির অনুষঙ্গে জড়ানো। আমার নিশ্বাসে, প্রতিদিনের অস্তিত্বে জেগে থাকে তারা। আমি বিশ্বাস করি বাঙালি জনগোষ্ঠীর শত শত বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবের, অর্জনের সময় ছিলো ওই বছরটি। এই জাতির এমন সংঘবদ্ধতা ও সম্মিলিত শৌর্য কেউ কোনোদিন দেখেনি, মানুষের জন্যে মানুষের ভালোবাসা ও মমতার অন্ত ছিলো না তখন - কার কি ধর্মবিশ্বাস তা জানার দরকার কারো হয়নি, তোমাকে চিনি না, তাতে কী, তোমার একবেলার খাদ্য প্রয়োজন, একটি রাত্রির আশ্রয় দরকার, বেশ তো এই আমার ঘর, উঠে এসো, ডালভাত যা আছে সবাই মিলে ভাগাভাগি করে খাবো, পর্যাপ্ত জায়গা নেই তো কী হলো, পালা করে ঘুমিয়ে রাত কাটিয়ে দেবো। মানুষগুলি যেন একেকটি নির্লোভ, অনাসক্ত সন্তের প্রতিমূর্তি। সে এক আশ্চর্য সময় ছিলো আমাদের! যারা দেখেনি, মানুষে-মানুষে এই ভ্রাতৃত্বের বোধ তাদের কল্পনায়ও সংকুলান হবে না। ভাবি, তেমন দিন কি আর কোনোদিন হবে!
জীবনের এই আশ্চর্য সময়টি আমার কমপিউটারে, ইমেল অ্যাকাউন্টের ইউজার আইডিতে, পাসওয়ার্ডে কোনো-না-কোনোভাবে যুদ্ধদিনের অনুষঙ্গ - ২৬ মার্চ অথবা ১৬ ডিসেম্বর আর আমার দেশ। এর নাম কি দেশপ্রেম? নাকি এক অনিবার্য নেশা বা মোহগ্রস্ততা? যে নামই দেওয়া হোক, এই তো আমি। এই উপলব্ধিতে আমি উপনীত হয়েছি, জীবনে যতোটুকু যা হয়েছি এবং যা-কিছু আমার হয়ে ওঠা হয়নি এবং আর কখনো হবে না - সবকিছুর মূলে থেকে গেলো সেই একটি যুদ্ধ। যুদ্ধ করতে হয়েছিলো বলে সতেরো বছরের রোমাঞ্চকর স্বপ্নিল অনুভবে সিঞ্চিত হওয়ার আগে শত্রুমিত্র চিনতে হলো, বাল্যকালের সঙ্গী সাইফুল, বাদশা, আলতাফ আলীকে শহীদের পরিচয়ে পরিচিত হতে হলো, গুলির ছররায় দুই চোখ অন্ধ হয়ে গেলো দুলালের, স্বাধীন দেশের সূর্যালোক তার কোনোদিন দেখা হলো না। যুদ্ধ হয়েছিলো বলে স্বাধীনতা এলো। আর স্বাধীনতার সঙ্গে ন্যায্য-অন্যায্য অনেককিছু আমাদের হাতের মুঠোয় এসে পড়লো, অনভ্যস্ত হাতে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে সেগুলো আমরা হারিয়েও ফেললাম অচিরে।
এই শহরে বাংলাদেশ কমিউনিটির তিনটি সংগঠন, তারা কেন বিজয় দিবসে কোনো অনুষ্ঠান করে না? উত্তরটি অপ্রিয়, কিন্তু আমার অজানা নয়। আমাদের দেশপ্রেম বা দেশের জন্যে আনুগত্য বড়ো বেশি দলানুগত্যভিত্তিক - এখানেও আওয়ামী লীগ-বিএনপির বিভাজন। অনেকে শুনি এই দিনগুলিকে ভুলে থাকতে চায়, ভুলিয়ে দিতে পারলে বেঁচে যায়। এখনো এসব খোলাখুলি বলা হয় না, হয়তো অচিরে হবে।
আশ্চর্য সহনশীল দেশ আমার। স্বাধীনতার এতো বছর পরেও এমন সব মানুষ এ দেশে রাজনীতি করার অধিকার রাখে যারা বাংলাদেশ নামটিও মুখে আনে না। এতো সাধনার ধন এই স্বাধীন দেশটিকে এখনো তারা বলে পূর্ব বাংলা। সারা পৃথিবী আমার দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় স্বীকার করে নিয়েছে, এরা আজও মানেনি। একাত্তরে আমাদের যুদ্ধটি কি মুক্তিযুদ্ধ না জনযুদ্ধ না গৃহযুদ্ধ নাকি শুধুই দুই কুকুরের কামড়াকামড়ি তা এখনো স্থির করা হয়নি তাদের। তর্ক ও তত্ত্বের যুদ্ধ তাদের এখনো অমীমাংসিত, বিপ্লবের নামে নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি, খুনোখুনি চলে আজও। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে আমার দেশের অভ্যুদয়ের বিপক্ষে সবচেয়ে বড়ো শক্তি যে জামাতে ইসলামী, তারা বাংলাদেশকে কোনোদিন স্বীকার করেনি, এ দেশটি তাদের কাছে এখনো পাকিস্তানের ছায়া-রাষ্ট্র। কৌশলগত কারণে বা আর যে কোনো কারণেই হোক, তারাও তাদের দলের নামের আগে বাংলাদেশ বসিয়ে দিয়েছে, অথচ আমাদের বিপ্লবীরা পারেনি। আমার দেশ এদের সবাইকে ধারণ ও সহ্য করে। ধর্মের বিপণনকারীরা বৈধভাবে রাজনীতি করার অধিকার পায়, তারা মাদ্রাসার নামে ধর্মসন্ত্রাসী ও ধর্মব্যবসায়ীদের উৎপাদন অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়। এমন মানুষের হত্যাকাণ্ডের বিচারও দাবি করা হয় বাংলাদেশের আইনের আওতায়, যে মানুষটি বাংলাদেশকে কোনোদিন বাংলাদেশ বলে মানেনি!
১৯৭২ সালে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনী ফিরে গেছে, আমাদের তখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিলো নিজেদের সংগঠিত থাকার, শত শত বছরের দীর্ঘ পরাধীনতার শেষে এই ভূখণ্ডের মানুষের সম্মিলিত শক্তির আরেকটি উৎসার। অথচ মাত্র কয়েকমাসের মধ্যে আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম একটি বিশাল ও উন্মত্ত বিভাজন - মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া রাজনৈতিক দলটি বিভক্ত হয় রাতারাতি। পরবর্তী মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে বিরোধীপক্ষের কথিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আন্দোলন পর্বতপ্রমাণ এক বিভ্রান্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। কিন্তু উপলব্ধিটি ঘটার আগেই হাজার হাজার তীক্ষ্ণধী ও মেধাবী যুবক এই বিভ্রান্তির শিকার হয়ে প্রাণ দেয়, জীবিতদেরও অনেকের আর কোনোদিন স্বাভাবিক জীবনে ফেরা হয়নি। সেই বিপ্লবের স্বপ্নটি ব্যর্থতা ও ভুলের কালিমায় লিপ্ত হয়ে গেলে আমার বাল্যকালের বন্ধু টিপু বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যায়। মিঠু এখন শুনেছি চায়ের দোকানে দিনমান বসে যে কোনো ইচ্ছুক শ্রোতাকে আসন্ন বিপ্লবের গল্প শোনায় আজও, শ্রোতা কেউ না থাকলেও সে অবিরাম একই কথা একা একা বলে যায়। হয়তো তা-ও একপ্রকার ভালোই, সুস্থ মস্তিষ্কে থাকলে আজ তাদের হয়তো বিশ্বায়ন ও একক বিশ্বের জয়গান করতে হতো।
বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নেতৃস্থানীয়দের একজন বিপ্লবের পথ পরিত্যাজ্য বিবেচনা করে অবিলম্বে মাথায় টুপি ধারণ করে বাকি জীবন ধর্মীয় রাজনীতি করেন। আরেকজন, যিনি একাত্তরে মার্চ মাসের দুই তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাটি উত্তোলন করেছিলেন, কালক্রমে বিশ্ববেহায়া নামে খ্যাত এক সামরিক শাসকের আয়োজিত জাতীয় সংসদে গৃহপালিত বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে খ্যাতি পান। স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করা সেই হাতটি উত্তোলিত করেন সামরিক একনায়কের সমর্থনে। আরেকজন, যিনি একাত্তরের মার্চে পল্টন ময়দানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেছিলেন, একাত্তরের রাজাকারের সহকর্মী হিসেবে আজ ক্ষমতাসীন মন্ত্রী এবং মেয়ের বিয়েতে কোটি টাকা ব্যয় করে কাগজের সংবাদ হন।
বিপ্লবের কাহিনী বলা তাদের বন্ধ হয়েছে সেই কবে, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের অনেক বছর আগেই, স্বপ্নেও আর সমাজতন্ত্র বলে কিছু অবশিষ্ট নেই। একবার এই বিভ্রান্ত ও ভুল বিপ্লবের স্বপ্ন দেখানোর নেপথ্য নায়ক, যিনি বাংলাদেশের রাজনীতির কাপালিক দাদা নামে ব্যাপক পরিচিত এবং যিনি সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকাকে এখন বসবাসের যথাযোগ্য স্থান বিবেচনা করেন, তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিলো। বগুড়ার টিপু এবং মিঠুকে তিনি স্মরণ করতে পারেন এবং তাদের উন্মাদ হয়ে যাওয়ার সংবাদ তাঁর হা হা হাসির উদ্রেক ঘটায়! যেন ‘গঙ্গার রুচিকর হাওয়ায় নতুনদার ক্ষুধার উদ্রেক হইল।’
আজ কতো সুদূর মনে হয়, অথচ সেই মধ্য-ডিসেম্বরে আমাদের নিশ্চিহ্ন করতে আসা পাকিস্তানী শত্রুদের আমরা পরাজিত, নতমুখ করেছিলাম। নিরস্ত্র মানুষ মারার হাতিয়ারগুলো তারা নামিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিলো। আপনা থেকে তা হয়নি, আমরা লড়াই করেছি, আমাদের বীরত্বগাথা কিছু কম নয়। কারো কারো ভুল হয়ে যায় আজকাল, কেউ কেউ ইচ্ছে করে ভোলে। কবি শঙ্খ ঘোষ জানাচ্ছেন, ‘...লোকে ভুলে যেতে চায়, সহজেই ভোলে...।’ গৌরব ভুলে থাকা মানুষগুলোকে, যুদ্ধে আমাদের প্রতিপক্ষের সহযোগীদের বহু বছর ধরে আমাদের ক্ষমতাধররা তোষণ-পোষণ করে আসছে। আমাদের রাষ্ট্রের ক্ষমতাবানদের কারো কারো জীবনবৃত্তান্তে যুদ্ধের বছরটি অনুক্ত থাকে। তারা কেউ কেউ আজ যুদ্ধের বছরকে গণ্ডগোলের বছর বলে সুখলাভ করে। কীসের গণ্ডগোল? শরীরে রক্ত টগবগ করে ফোটে - এতো নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে শেয়াল-কুকুরের মতো মেরে ফেলা হলো, আমরা বীরের মতো লড়াই করে জয়ী হলাম - তার নাম গণ্ডগোল! এমন অপমান করার সাহসও ওদের হয়। আমরা আজ কী শক্তিহীন, চুপ করে থাকি!
মানবিক অনুভূতি অবশ্য মানুষেরই থাকে। অনেকদিন আগে একবার যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের অনুভূতি ভাবতে চেষ্টা করেছিলাম। পরাজয়ের মুহূর্তে তাদের ঠিক কী মনে হয়? কেমন অনুভূতি হয় তখন? প্রাণে বেঁচে যাওয়া কি কোনো সান্ত্বনা? আচ্ছা, একাত্তরে ষোলোই ডিসেম্বরে আত্মসমর্পণের পর পাকিস্তানীরা দেশে ফিরে স্ত্রী-পুত্রকন্যাকে মুখ দেখিয়েছিলো কী করে? তাদের পরাজয়ের কী কৈফিয়ত ছিলো? পৃথিবীর সেরা সেনাবাহিনী বলে নিজেদের গণ্য করতো তারা, কী এমন হয়েছিলো যে মাথা নিচু করে তাদের ফিরতে হলো? গাজী বা শহীদ হওয়া নয়, আত্মসমর্পণের গ্লানি অনেক বড়ো।
কিছুতেই অনুমান করতে পারি না, আমার কল্পনাশক্তি সেই অনুভূতির বেড় পায় না। পাওয়ার কথা নয়, যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার অভিজ্ঞতাই যে আমাদের নেই! আমরা সেদিন পরাজয় জানিনি। অথচ আজ এতো বছর পরে ভাবি, আমরা কি সত্যি জিতেছিলাম? না, হেরে বসে আছি? এই প্রশ্ন আমার ভেতরে তুমুল শোরগোল তোলে। যে উত্তরটি প্রকাশ্য, তাকে মানতে পারি না। পারলে আমার এবং আমার মতো আরো অনেক মানুষের জীবনই যে ভুল হয়ে যায়, ব্যর্থ প্রতীয়মান হয়। আর লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগ? তার কি হবে? ইতিহাস বলছে, বিজয়ীরাই ইতিহাস রচনা করে। আমাদের সংগ্রামের, বীরত্বের ইতিহাস এখন কারা লিখছে, অথবা মুছে দিচ্ছে? অলিখিত ও উহ্য রাখছে?
Though I never thought that we could lose
There’s no regret
If I had to do the same again
I would my friend, Fernando…
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন