৭
সাল ১৯৭৪। আমার দেশটিতে পর পর অনেকগুলো ঘটনা ঘটে যায়। আজ এতোদিন পরে এসে মনে হয়, একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে কিছু বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা খুব অস্বাভাবিক বিষয় হয়তো নয়। সেইসব দিনে সশস্ত্র খুনখারাবি, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, ছিনতাই, ব্যাংক ডাকাতি, রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলে ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ড এবং রাজনৈতিক নেতাদের লোলুপতা ও ভোগের কাহিনীর সঙ্গে আমরা সবেমাত্র পরিচিত হতে শুরু করেছি। তারপরেও আজকের বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করলে সেই সময়ের বিশৃঙ্খলাগুলোকে ছেলেখেলার মতো নিরীহ ও নিতান্ত অপেশাদার মনে হতে পারে। কিন্তু সে ছিলো সূত্রপাতের দিন।
বন্যায় তখন সারাদেশ ডুবে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটি, বাড়ি যাবো, রাস্তাঘাটে পানি উঠে যাওয়ায় সড়কপথ বন্ধ। রেলপথটি কোনোমতে চালু আছে। এক সন্ধ্যায় কমলাপুর থেকে ট্রেনে উঠি। বাহাদুরাবাদ ঘাটে স্টীমার ধরে ওপারে ফুলছড়িঘাট। তারপর আবার ট্রেন। রেলপথেও কোথাও কোথাও বন্যার পানি উঠেছে। অনেক জায়গায় ট্রেন অতি ধীরে ও সাবধানে চলে। ভিড়ের ভেতরে কামরায় অনেকক্ষণ ধরেই এক ধরনের বোঁটকা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিলো। মনে হতে থাকে, চলে যাবে দুর্গন্ধটি, অথচ অনেকক্ষণ পরেও তা ট্রেনের কামরার ভেতরে আটকে ঘুরপাক খায়। ট্রেন স্বাভাবিক গতিতে চললে কম টের পাওয়া যায়, কিন্তু গতি কমলে দুর্গন্ধটি তীব্র হয়ে ওঠে। ক্রমশ বোঝা যায় আমি একা নই, ট্রেনের আর সব যাত্রীও সেই বিবমিষাময় দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ।
একটি ছোটো স্টেশনে ট্রেন থামলে সমস্ত যাত্রী প্ল্যাটফরমে নেমে আসে, হামলে পড়ে ট্রেনের গার্ডের কাছে। ড্রাইভার সামনে বসা বলে কোনো গন্ধ পায়নি, কিন্তু গার্ড নিজেও ভুক্তভোগী। সবাই একমত, এই দুর্গন্ধে টেকা সম্ভব নয়, মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়বে। কেউ কেউ দু’একবার বমিও করেছে বলে শোনা যায়। সবগুলো কামরা তোলপাড় করেও কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। দুর্গন্ধের উৎস শেষমেশ আবিষ্কৃত হয় ট্রেনের ছাদে - যুবাবয়সী একজন মানুষের গলিত লাশ, বাঁশের চাটাইয়ে মুড়ে কেউ তুলে দিয়েছে। লাশের দাবিদার কেউ নেই। জানা কথা, থাকলেও স্বীকার করবে কে!
লাশটি ওই প্রায় অন্ধকার ছোটো স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে ট্রেন আবার চলতে শুরু করে। এতোক্ষণ তবু এক ট্রেন বোঝাই মানুষ লাশটির অনিচ্ছুক সহযাত্রী হয়ে ছিলো, এখন তা সত্যিকারের বেওয়ারিশ হয়ে পড়ে থাকে প্রায় অন্ধকার স্টেশনে। দাবিদার কেউ থাকলে সে-ও হয়তো ওই স্টেশনে নিঃশব্দে নেমে গিয়েছিলো। আমরা কেউ জানি না, কোনোদিন জানবো না।
বন্যার সঙ্গে হাত ধরাধরি করে এসেছিলো দুর্ভিক্ষ। হয়তো মনুষ্যসৃষ্ট, আমাদের রাষ্ট্রীয় পরনির্ভরশীলতার সুযোগে তা হয়তো ক্ষমতাধর প্রথম বিশ্বের দর্প প্রকাশের প্রমাণিত অমানবিক নিষ্ঠুরতা। তবু শেষ বিচারে তা একটি দুর্ভিক্ষই - অনাহারে-অপুষ্টিতে মানুষের মৃত্যু ও মহামারী, আর কিছু নয়। অসহায় ও নিরুপায় ক্রীড়নকের ভূমিকায় থাকে আমাদের রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব।
একই বছরে এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলে এক গভীর রাতে গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়। আমার রুমমেটরা ঘুমিয়ে, আমি একটি চিঠি লিখছি। হলের বাসিন্দা হিসেবে আমরা জানি হুড়মুড় ধাওয়া, ভাঙচুর, হৈ-হুল্লোড়, যখন-তখন গোলাগুলির শব্দ প্রায় প্রতিদিনের ব্যাপার, আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনের আশীর্বাদে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা শাসন করা বাবা গ্রুপের ঘাঁটি এখানে, কোহিনূর নামের একজন তাদের দলনেতা। এই স্বঘোষিত বাবারা অনেক সময় নিজেদের মধ্যে মজা করার জন্যেও শূন্যে গুলি ছোঁড়ে। ক্যান্টিনে, ডাইনিং রুমে তারা আলাদা টেবিলে জামাই আদরে আহার করে, সামান্য এদিক-ওদিক কিছু ঘটলে থালাবাসন ভাঙাভাঙি, ম্যানেজারকে তখন কান ধরে উঠবস করতে হবে। তারা বরাবরই বড়ো সশব্দ, সুতরাং গভীর রাতের এই হৈ হুল্লোড়ে মনোযোগ না দিলেও চলে। আপনা থেকেই থেমে যাবে, আমরা এরকমই দেখে আসছি। কিন্তু আজ অন্যরকম হয়, সিঁড়িতে দীর্ঘ সময় ধরে অনেকগুলো পায়ের একসঙ্গে দ্রুত ওঠানামার শব্দ আসে, অস্পষ্ট চিৎকার ও ত্রস্ত গলায় কথা শোনা যায়।
কিছূক্ষণ পর নিস্তব্ধতা নেমে এলে ছয়তলা ছাত্রাবাসের সবগুলো কক্ষের বাসিন্দারা একে একে বেরিয়ে আসে। চাপা স্বরে এই সংবাদ প্রচারিত হয়ে যায় যে, কোহিনূর ও তার দলবলকে বন্দুকের মুখে তুলে নিয়ে গেছে আরেকটি সশস্ত্র দল। শুনে প্রত্যয় না হয়। কোহিনূরের দলবলকে তাদের নিজস্ব ঘাঁটি থেকে রাতদুপুরে তুলে নিয়ে যাওয়ার হিম্মৎ কার হবে! কয়েক মিনিট পরে ব্রাশফায়ারের আওয়াজ শুনি আমরা যে যার কক্ষ থেকে, বাইরে গিয়ে খোঁজ নেওয়ার কথা কারো কারো হয়তো মনে হয়, সাহসে কুলিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না।
পরদিন ভোরবেলা সংবাদ রাষ্ট্র হয়ে যায়, মহসীন হলের টিভি রুমের সামনে কোহিনূরসহ সাতটি তাজা যুবকের রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। অবিলম্বে এ কথাও কারো অজানা থাকে না যে, এটি তাদের নিজেদের দলের অতি তুচ্ছ অভ্যন্তরীণ কোন্দলের রক্তাক্ত ফলাফল। আমরা পুনর্বার বুঝে যাই, রাষ্ট্রের ঘোষিত নীতি সমাজতন্ত্রের কর্মী এরা নয়, হবে না।
সেই বছরে একটি কবিতা রচনার দায়ে তরুণ কবি দাউদ হায়দারকে বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত হতে হয়। কবিতাটি ধর্মপ্রাণ মানুষকে আহত করে বলে জানানো হয়েছিলো। তখনো বাংলাদেশ শাসন করে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রচারক একটি দল। যুদ্ধে পরাজিত ধর্মমুখী রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং ধর্মের ধ্বজাধারীরা অসংগঠিত ও ছত্রখান। একটি দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীতে দাউদের কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিলো। বাংলাদেশে তখন সংবাদপত্রের পাঠকই বা কতো! সাহিত্য সাময়িকী বা কবিতার পাঠকও হাতেগোনা। তবু এই সীমিত প্রচারেও কবিতাটি কী প্রকারে ধর্মপ্রাণ মানুষকে আহত করেছিলো বা ধর্মোন্মাদদের সংগঠিত হতে সাহায্য করেছিলো, তার ব্যাখ্যা জানা যায় না।
নির্বাচনে অর্পিত যাবতীয় ক্ষমতা ও অনুকুল জনমত সত্ত্বেও সেই বাদ-প্রতিবাদ সামাল দেওয়ার মতো শক্তি বা সাহস তখনকার শাসকদের ছিলো না কেন, তা-ও এক পরম বিস্ময়। একজন কবির লেখার স্বাধীনতা শাসকরা সেদিন রক্ষা করতে সাহসী হয়নি। তারা ধর্মোন্মাদনাকে প্রশ্রয় দেয় এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দুই বছরের মধ্যে এক তরুণ কবির নির্বাসনের ঘটনায় পরোক্ষে পরাজিত, আত্মগোপনকারী ও অসংগঠিত মোল্লাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ঘটে যায়। রাষ্ট্র ও সংবিধান নির্ধারিত ধর্মনিরপেক্ষতার নৈতিক পরাজয়ের সেই শুরু।
একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রচার, তার পাশাপাশি এই মোল্লা ও তাদের মধ্যপ্রাচ্যদেশীয় মহাজনদের তুষ্ট করার জন্যে লাহোরে ইসলামি সম্মেলনে শরিক হওয়া - এই বৈপরীত্য চলতে থাকে। সেই প্রশ্রয়ের বিষবৃক্ষ আজ মহীরূহে পরিণত। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উত্থানের বীজমন্ত্রের শত্রুতা শুধু নয়, সর্বশক্তি দিয়ে সংগঠিত ইসলামপন্থীরা সেই উত্থানকে রুদ্ধ করতে চেয়েছে। কালক্রমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভাগীদার হওয়ার সামর্থ্যও তারা দেখিয়েছে।
আরো অদ্ভুত, যে লোকটির যুক্তিহীন একগুঁয়েমির কারণে এবং কূটচালের পরিণামে একাত্তরে পাকিস্তানী সেনারা নির্বিচারে বাঙালি হত্যা করেছিলো, সেই জুলফিকার আলী ভুট্টোকে জামাই আদরে বাংলাদেশে বরণ করা হলো। স্বাধীনতার দুই বছরের মধ্যে। পাকিস্তানে তখন লোকটি তার পরম সাধের প্রধানমন্ত্রিত্ব পেয়ে গেছে। ঢাকার রাস্তায় পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি শোনা যায়, তা-ও খুব গোপনে নয়। পরাজিতরা সংগঠিত হচ্ছে বলে কেউ কেউ সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলেন, শাসকদের সেদিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় ও ইচ্ছে ছিলো বলে ধারণা হয় না। একসময় যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানী সেনাদের বিচার করার কথা জোরেশোরে শোনা যাচ্ছিলো বাংলাদেশে, এখন তা চাপা দেওয়ার সমস্ত লক্ষণ প্রকাশ্য হয়ে উঠতে থাকে। আর কী অবশিষ্ট আছে, প্রাণ দিয়েছি, মান দিয়েছি, আত্মসম্মানবোধ তা-ও দিয়েছি, আরো কী বিসর্জন দিতে হবে আমাদের?
তাজউদ্দিনকে পদত্যাগ করতে হলো অক্টোবরে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তিনি, শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে প্রায় একা হাতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও পরিচালনার দুরূহ কাজটি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের যোগ্যতায় সম্পন্ন করেছিলেন। যুদ্ধের পরে শেখ মুজিব ফিরে এলে তাজউদ্দিন তাঁর কাছে গচ্ছিত আসনটি নেতাকে অর্পণ করে পেছনের সারিতে গিয়ে আসন নিয়েছিলেন। আমাদের জানতে বাকি থাকে না, তাঁকে কেন ও কাদের ইচ্ছায় রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব থেকে বিদায় নিতে হয়েছিলো - তিনি যে সাম্যবাদে বিশ্বাসী ছিলেন!
আশ্চর্য হয়ে ভাবি, এইরকম একটি দুরন্ত অস্থির অসময়ে মুনিয়ার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী করে তৈরি হতে পেরেছিলো। মহসীন হলে সাত খুনের পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিঃশব্দ আতঙ্ক ও চাপা চাঞ্চল্য। তারই মধ্যে খুব নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে একা একটি মেয়েকে হাঁটতে দেখি। তার কোনো উদ্বেগ নেই, শঙ্কা নেই, যেন কোনো কিছুতেই কিছু এসে যায় না। একা সে হেঁটে আসে কলাভবন থেকে লাইব্রেরির দিকে। আমরা কয়েকজন লাইব্রেরির বারান্দায় বসা। আড্ডার মেজাজ নেই কারো, কিছু করার নেই বলে শুধু শুধু বসে থাকা। মেয়েটিকে আমরা চিনি না, কিন্তু আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় সে। খুব সহজ গলায় জিজ্ঞেস করে, আমি আপনাদের সঙ্গে বসতে পারি?
ভালো করে লক্ষ্য করে দেখি, হালকা নীল রঙের শাড়ি পরা মেয়েটিকে অপরূপ সুন্দরী বলা চলে না, কিন্তু চোখমুখে এক ধরনের অনায়াস সরলতা ও লাবণ্য আছে। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা তাকে আলাদা ব্যক্তিত্ব দিয়েছে। আমরা সাব্যস্ত করে নিই, মেয়েটির মাথায় গোলমাল না থেকে যায় না। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি মেয়ে যেচে ছেলেদের আড্ডায় বসতে চায়, এমন অভিজ্ঞতা তখনো আমাদের হয়নি।
আমাদের মধ্যে কেউ একজন কিছু অনিশ্চিত স্বরে বলে, নিশ্চয়ই।
এইভাবেই মুনিয়া এসেছিলো। নিয়তির মতো অমোঘ ও অনিবার্যভাবে। মেয়েটি কিছু পাগল-পাগল, সে বিষয়ে আমরা সবাই কমবেশি একমত। সে আমাদের আড্ডায় নিয়মিত আসতে শুরু করে। অবিলম্বে আড্ডার বাইরেও তার সঙ্গে একা আমার সাক্ষাৎ হতে থাকে। আশ্চর্য সেই সরল মেয়েটি যে পাগলের মতো ভালোবাসতেও জানে, কে জানতো!
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন