৯
পরের তিনটি দিন কাটে গুহাবাসী সন্ন্যাসীদের মতো নিজের কক্ষে আবদ্ধ থেকে। এই সময়টি আমার নিজের সঙ্গে থাকার দরকার ছিলো। মুণ্ডিত মাথা একটি কারণ বটে, এভাবে আমাকে দেখতে কেউ অভ্যস্ত নয়, এমনকি আমি নিজেও না। প্রকৃতপক্ষে এই অযাচিত অপমান আমার প্রাপ্য ছিলো না, নিষ্ফল ক্রোধ এবং তার প্রতিক্রিয়ায় হতাশার বোধও ইপ্সিত ছিলো না। এইসব অদৃশ্য ক্ষতের পরিচর্যা ও উপশমের জন্যে সময়ের প্রয়োজন হয়। আমার ইতিকর্তব্য স্থির করাও জরুরি তখন।
দুই সীটের কক্ষটিতে রুমমেটের অনুপস্থিতি আমাকে কিছু অস্বস্তি থেকে রক্ষা করে। আমার রুমমেট যশোরের গোলাম মোস্তফা ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের নেতা। শেখ মুজিব নিহত হওয়ার খবর পেয়ে সে নিরাপদ আশ্রয়ে আত্মগোপন করা জরুরি বিবেচনা করে গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। জানিয়ে গেছে, কোনোরকম প্রতিরোধ সংগঠিত হওয়ার সংবাদ পেলে সে ফিরে আসবে।
মোস্তফা এবং আমি দু’জনেই এখন আত্মগোপনকারী - দুটি সম্পূর্ণ পৃথক কারণে। সে রাজনীতিসংশ্লিষ্ট এবং তার সমর্থিত দলটি অতর্কিতে ও অপ্রত্যাশিত উপায়ে ক্ষমতা থেকে অপসারিত হয়েছে, তাদের প্রধান নেতা নিহত, অন্য নেতাদের কেউ সামরিক শাসকের মন্ত্রী অথবা পলাতক কিংবা কারাগারে এবং সংগঠনটি ছত্রখান। আপাতত নিরাপদ কোথাও আশ্রয় নেওয়া তার জন্যে যুক্তিসঙ্গত।
রাজনীতিতে আমার প্রকাশ্য ও সক্রিয় কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। সাম্যবাদী একটি রাষ্ট্র আমাদের যুদ্ধের একটি লক্ষ্য ছিলো। শেখ মুজিব বা তাঁর দল তা অর্জন করতে সক্ষম হবে, এমন ভরসা কেউ হয়তো করেনি। তবু স্বীকার করতেই হবে, তিনি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র নির্মাণ করে দিয়েছিলেন, সমাজতন্ত্র রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ঘোষিত হয়েছিলো, সংবিধানে তার স্বীকৃতি ছিলো। সমাজ পরিবর্তনের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা বামপন্থী শক্তিগুলোর। অথচ উপযুক্তভাবে সংগঠিত বামশক্তির সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাদের কেউ অতি আপসকামী, বাকিরা অপ্রয়োজনে শক্তিক্ষয় করে - জনমানুষকে সংগঠিত না করেই বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে এবং দুর্বোধ্য ও অনুবাদসাপেক্ষ বাংলা ভাষায় তত্ত্ব প্রচার করে। ফলে, রাজনীতিমনস্ক হয়েও আমার তাতে শরিক হওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
তবু আমাকে আক্রান্ত ও অপমানিত হতে হয় প্রকাশ্য দিবালোকে, উন্মুক্ত রাজপথে শত শত মানুষ তা চাক্ষুষ করেছে। জানি, প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ আমার নাম-পরিচয় জানে না, কোনোকালে তাদের কারো সঙ্গে আবার সাক্ষাৎ ঘটলে আমি তাদের চিনবো না, তারাও কেউ আমাকে হয়তো শনাক্ত করতে পারবে না। অথচ এই উপলব্ধিও আমার প্রকাশ্য অপমান ও অবনমনের উপশম বা সান্ত্বনার কারণ হয় না। আমি নিজে এই ক্ষত এবং তার যাবতীয় অনুষঙ্গ উপেক্ষা করি কী করে? আমার মস্তকমুণ্ডন পর্বটি বড়ো বেশি অপমানসূচক হয়েছিলো। মাথার ভেতরে সেই দৃশ্যটি পুনঃ পুনঃ অভিনীত হতে থাকে এবং একসময় আমার চরিত্রটিকে আর আমার নিজের বলে মানতে পারি না। মনে হয়, আমি নই, ওই যুবক অন্য কেউ! এই উপলব্ধিও আমার ঘটে যে রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ না থাকলেও রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিবর্তনের আঁচড় সবার গায়েই কমবেশি লাগে। তখন রাষ্ট্রের সীমানায় নিরাপদ কোনো দূরত্ব নেই।
সেদিন সেই দুপুরে প্রবল বিবমিষা, নিষ্ফল ক্রোধ ও হতাশায় বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম রাস্তার পাশে। প্রৌঢ় রিকশাওয়ালা পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে আমার কাছে। ফিস ফিস করে অস্পষ্ট গলায় বলে, অগো লগে বিবাদ কইরা কী করবেন? শ্যাখ সাবের মতন মানুষরে মারছে, অরা মানুষের পয়দা না।
সন্বিত ফেরে। সামান্য কথায় বৃদ্ধ ভয়াবহ একটি সত্যের মুখোমুখি করে দেয় আমাকে। এই বাংলাদেশে শেখ মুজিবকে গুলি করে খুন করা সম্ভব হলে আর কেউ কি নিরাপদ?
ভাড়া দিয়ে বিদায় করতে উদ্যত হলে রিকশাওয়ালা বলে, আপনে চুল কাইটা আসেন, আমি আপনেরে জায়গামতো নামাইয়া দিয়া যামু।
চুল কেমন কাটা হয়েছিলো, দেখিনি। যন্ত্রচালিতের মতো গিয়ে টুলে গিয়ে বসি, একটিও কথা না বলে নিজের মাথাটি জমা দিই, একবারের জন্যেও মুখ তুলি না। আমার অবনত মুখ অপমানের অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছিলো। বাধ্যতামূলক চুল কাটানো শেষ হলে নিজের আপাত-অক্ষত অথচ প্রবলভাবে ক্ষতবিক্ষত মস্তকটি ফেরত পেয়ে রিকশায় উঠি। রিকশাওয়ালাকে সূর্যসেনের বদলে জহুরুল হক হলে যেতে বলি। সারা পথ সে অনেক কথা বলে যায়, আমি তার কিছুই শুনি না। নিউ মার্কেটে পরিচিত সেলুনে যাই না, সূর্যসেন হলের চেনা ক্ষৌরকারকে এখনকার চেহারা দেখানোর বাসনা নেই, হলে ঢুকতেও চেনা মুখের সাক্ষাৎ মিলে যাওয়ার আশংকা।
জহুরুল হক হল থেকে মুণ্ডিত মস্তকে বেরিয়ে আসি। বোধবুদ্ধি হওয়ার পর এই প্রথম আমি ন্যাড়া হলাম। আসলে রাষ্ট্রশক্তি আমাকে বাধ্য করে। হায়, আমাদের শাসকদের বুঝি করার মতো আর কোনো কাজ অবশিষ্ট নেই, কার মাথায় কতো বড়ো চুল তা নিয়ে তাদের এখন বেশি মাথা ঘামাতে হয়! এই মাথাগুলিকে বশে আনতে না পারলে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে! মনে পড়ে যায়, ৭৪ সালে সর্বশক্তিধারী রক্ষীবাহিনী আবির্ভূত হলে আমাদের ছোটো শহরে তাদের লক্ষ্য করে বিদ্রুপের স্বরে বলা হতো, মাথা রে! কে এবং কেন এই শব্দ দুটি চয়ন করেছিলো জানা যায় না, কিন্তু উদ্দেশ্যটি সিদ্ধ হয়েছিলো - মাথা রে! শুনলেই জলপাই রঙের পোশাকধারীরা ক্ষিপ্ত হয়ে তাড়া করে আসতো, তাদের হাতে পড়ে দু’চারজন কিছু মারও খেয়েছিলো মনে আছে।
আমি কাউকে উত্যক্ত করে কিছু বলিনি, রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন বিষয়ে আমার মতামত কিছু নিশ্চয়ই আছে, তা আমি নিজের কাছে গচ্ছিত রেখেছি। কারণ নিকট ইতিহাস জানাচ্ছে, সামরিক শাসন কোনো বিরুদ্ধমত সহ্য করে না, তাই বিস্ময়ে ও ঘটনাবলির আকস্মিকতায় ভয়ানক অনিশ্চিত বোধ করলেও মুখ বন্ধ রাখতে শিখে গিয়েছি। ক্রমাগত সামরিক শাসনের জগদ্দল থেকে উদ্ধার পাওয়ার আকুতি আমাদের ছিলো, প্রাণ ভরে শ্বাস নেওয়ার মতো একটি মুক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রাণপণ বাসনা আমাদের যুদ্ধের একটি শর্ত ছিলো। কী ফল হলো? আমার নিরীহ-নির্বিরোধ চুল পর্যন্ত এখন রাষ্ট্রের এখতিয়ারে এবং তা-ও বলপূর্বক আমাকে গলাধঃকরণ করানো হচ্ছে, আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা সেখানে অবান্তর। মুক্তিযুদ্ধ করে ফেরা একুশ বছরের যুবকের কাছে তা শ্বাসরোধের শামিল।
অফিসার শ্রেণীর সৈনিকপুরুষের উচ্চারিত সেই বাঞ্চোৎ শব্দটি আমার মাথায় বিপুল অগ্নিকাণ্ডের উত্তাপ ছড়ায়। অন্ধ ক্রোধে চারপাশের সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে ফেলতে ইচ্ছে করে। ঘরবন্দী ওই সময়ে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাস হাতের কাছে পেয়ে পড়ে ফেলি - ঘুণপোকা। উপন্যাসের নায়ক শ্যাম একটি ভালো চাকরি অনায়াসে ছেড়ে দিয়ে অনিশ্চিত জীবনের দিকে যায়, উর্দ্ধতন একজন শ্যামকে বাস্টার্ড বলেছিলো বলে। বাস্টার্ড ও বাঞ্চোৎ - দুটি শব্দই প্রবল অসঙ্গত ও অনৈতিক যৌনতার ইঙ্গিতবাহী। শ্যামের ক্ষেত্রে শব্দটি খানিকটা পরোক্ষ এবং তাকে সেই ক্রিয়ার ফলাফল হিসেবে সম্বোধন করা হচ্ছে, সেখানে তার কোনো অংশগ্রহণ নেই। কিন্তু আমার বেলায় তা অতি প্রত্যক্ষ, অসহনীয়ভাবে অপমানসূচক ও কৃতকর্মের অভিযোগসম্বলিত।
বইটি আমাকে অপ্রত্যাশিত ও আশ্চর্য এক প্রশান্তি দেয়, সন্ন্যাসীর উদাসীনতায় চারপাশকে দেখতে সাহায্য করে। বস্তুত, আমার কর্তব্যকর্ম নির্ধারিত করে দিয়েছিলো এই ক্ষীণকায় বইটি - আমি দেশত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। বড়ো বেদনায় আমাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এই দেশটির জন্যে আমি যুদ্ধ করেছি, জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিলাম, যুদ্ধশেষে দেশের মঙ্গল ছাড়া আর কিছু চাইনি। তবু এ দেশে আমার জায়গা হবে না!
আমার গুহাবাসী হয়ে থাকার কালে মুনিয়া নিয়মিত জায়গাগুলোতে সন্ধান না পেয়ে হলে আসে। ওয়েটিং রুম থেকে চিরকুট পাঠায়। চিরকুটের বাহককে বলে দিই জানিয়ে দিতে যে, আমার রুমে তালা দেওয়া। এই সময়ে আমি সিগারেটে আসক্ত হই। আগে দু’একবার টান দিয়েছি, ভালো লাগেনি। বৃদ্ধ সুরুজ মিয়া তখন আমার অভিভাবকের মতো। সুরুজ মিয়া হলের চতুর্থ শ্রেণীভুক্ত কর্মচারী, নিয়মিত কাজের পাশাপাশি ছাত্রদের ফাই-ফরমাশ খেটে কিছু বাড়তি উপার্জন করে। আমার ময়লা কাপড়-চোপড়, বিছানার চাদর নিজের উদ্যোগে নিয়ে যায় লন্ড্রি করতে, সময়মতো নিয়েও আসে, দরকারমতো ডাইনিং রুম থেকে বা বাইরের কোথাও থেকে টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার নিয়ে আসে। আমার ন্যাড়া মাথা দেখে বলে, আপনেরে এই চুল ফালানোর ভূতে পাইলো ক্যান? ভালো দ্যাহায় না মোডে।
সুরুজ মিয়াকে দুপুরের ভাত আনার সময় পাঁচটি ক্যাপস্টান সিগারেট কিনে আনতে বললে সে চোখ কপালে তুলে বলে, ওইসব আপনে খান না, আর খাইতে হইবো না। ঘর থিকাও দেহি বাইর হন না। কী হইছে আপনের?
খুব ঠাণ্ডা গলায় বলি, কিছু হয় নাই, সুরুজ মিয়া। যা কই, তাই শোনেন। সিগারেট আইনেন।
সুরুজ মিয়া কী বোঝে সে-ই জানে, হয়তো অসন্তোষ জানানোর জন্যেই, পাঁচটা নয়, দেশলাইসহ পুরো এক প্যাকেট ক্যাপস্টান এনে রাখে আমার টেবিলে।
তিনদিন পরে ঘর থেকে বেরোলেও বাইরে কোথাও যাই না, হলের চত্বরে একা একা বসে থাকি। কতো কী যে সব উল্টোপাল্টা ভাবনা ভাবি। রাত বেশি হলে রেজিস্ট্রার বিল্ডিং-এর সামনের জনহীন কংক্রিটের রাস্তার ওপরে বসে থাকি, সিগারেট জ্বলে আঙুলের ফাঁকে।
মুনিয়াকে দেখা দিই প্রায় মাসখানেক পরে, ততোদিনে মাথায় চুল কিছু হয়েছে। এখনো চিরুনি না হলেও চলে অবস্থা। মুনিয়া হয়তো তা লক্ষ্য করে না, করলেও উল্লেখ করে না। তার উদ্বেগের জায়গা আলাদা, কী হয়েছিলো তোমার, কোথায় ছিলে?
প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলি, আমি বিদেশে চলে যাচ্ছি।
দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেও তখনো জানি না কোথায় কবে এবং কীভাবে যাচ্ছি। দেশের বাইরে বসবাস করতে যাবো, কোনোদিন ভাবিইনি। তার সুলুক-সন্ধান কিছু জানা নেই। জানতে হবে।
মুনিয়া জিজ্ঞেস করে, হঠাৎ কী হলো?
এমনি, কারণ ছাড়াই। ভালো লাগে না কিছু। থাকলাম তো এই দেশে অনেকদিন, এখন একটু বাইরের পৃথিবী দেখি।
মুনিয়া কী বোঝে কে জানে, চুপ করে যায় সে।
দিন যায়। উদাসীন সব দিন। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছে আলগাভাবে কিছু খোঁজখবর করি, দেশের বাইরে কোথায় যাবো, যেতে হলে কী করতে হবে। তারাই সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত দেয়, আমেরিকা চলে যা।
আমেরিকা নিয়ে আর অনেকের মতো আমার কোনো বিশেষ অনুরাগ বা আকর্ষণ নেই। যুদ্ধের সময় তারা আমাদের সরাসরি বিরোধিতা করেছে। ততোদিনে আবার কানাঘুষা শুরু হয়েছে যে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডে আমেরিকার হাত ছিলো। বহু বছর ধরে তারা অনেক দেশে এই কাণ্ড করেছে। তাতে কিছু বিরাগ জন্মাতেই পারে, কিন্তু নিজের ইচ্ছেমতো জীবন যাপন করার জন্যে আমেরিকা সবচেয়ে উপযুক্ত দেশ বলে বন্ধুরা প্রবলভাবে একমত। আমার তখন কিছুতেই কিছু এসে যায় না। আমেরিকা না হয়ে সাইবেরিয়া হলেও আমার আপত্তি ছিলো না।
রাতের পর রাত কারফিউ-এ দমবন্ধ অবস্থা, সেই মধ্য-অগাস্টে শুরু হয়েছে, তা আর কোনোদিন উঠে যাবে বলে মনেও হচ্ছে না। একুশ বছর বয়সী এই আমার মধ্যরাতের পরও বাইরে থাকার ইচ্ছে ও প্রয়োজন থাকতেই পারে। তা যদি না-ও থাকে, তবু ইচ্ছে হলেও কারফিউ-এর বেড়া আমাকে ঘর থেকে বাইরে যেতে দেবে না - ভাবলে দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে।
রাজনীতি বলে প্রকাশ্যে কিছু নেই, থাকলেও তার সন্ধান আমার জানা নেই, শাসকদের বিরোধী রাজনীতিকরা আত্মগোপনে অথবা জেলখানায়। কোথাও কোনো ভরসার আলো দৃশ্যমান নয়। মাঝে মধ্যেই পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানের গুজব শোনা যায়। নভেম্বরের শুরুতে সত্যি সত্যি তা ঘটেও - তিন-চার দিনের ব্যবধানে দুটি, যে সময় দেশটির চালক কারা তা-ও কারো জানার উপায় ছিলো না। গুজবের ডালপালা ছড়ায়। একসময় জয়ী এবং পরাজিত পক্ষের পরিচয় জানা যায় - প্রাথমিক জয় খালেদ মোশাররফের, তারপর কর্নেল তাহেরের সহযোগিতায় জিয়া জয়ী, ফলে খালেদ মোশাররফ পরাজিত ও নিহত। পুরাণকাহিনীতে বর্ণিত ভ্রাতৃসংহারের নতুন রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি।
এই গোলযোগের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় চার রাজনীতিককে জেলখানায় খুন করা হয়। শেখ মুজিবের হত্যাকারী বলে যারা নিজেদের বীর ঘোষণা করেছিলো, তাদের নিরাপদে দেশের বাইরে পাচার করে দেওয়া হয়। ষড়যন্ত্র, অভ্যুত্থান, গুজব, আতংক, উপর্যুপরি হত্যাকাণ্ড - এইসব উপাদান সহযোগে মানুষের জন্যে যা প্রস্তুত হয় তা এক ধরনের ক্লান্তি, নিরাসক্তি ও হতাশা।
এর শেষ কোথায়, কেউ জানে না। অনিশ্চয়তা ঘনীভূত হয়ে ওঠে। ক্রমশই প্রতীয়মান হতে থাকে, এ দেশটি চলবে গায়ের জোরে। বন্দুকধারীরা সহজে হটবে না। হত্যাকারীরা পুরস্কৃত হবে। কারাগারের নিরাপত্তার মধ্যেও কোনো নিরাপত্তা আসলে রাখা হবে না। ধিক্কার জন্মায় - এই দেশ আমার নয়, এই ব্যবস্থার জন্যে আমি যুদ্ধ করিনি।
আমার সিদ্ধান্ত তখন আরো সহজ হয়ে যায়। নভেম্বরে এইসব ঘটনার আগেই আমেরিকার ভিসা হয়ে গিয়েছিলো, ডিসেম্বরে আমার দেশ ছেড়ে আসা। পারিবারিক পিছুটান সবার মতো আমারও কিছু ছিলো, তবু কেউ কোনো আপত্তি জানায়নি।
এক মুনিয়াকে নিয়ে কিছু সংশয় ছিলো, সে কীভাবে নেবে। এই সময়ে আমার চলে যাওয়ার অর্থ তার সঙ্গে চিরস্থায়ী বিচ্ছেদ, তা আমার জানা ছিলো। মুনিয়াও জানতো, তবু সে খুব সহজভাবে বিদায় দিয়েছিলো। তাকে সব কথা খুলে বলা হয়নি, আমার আত্মসম্মানবোধ তা অনুমোদন করেনি। এ আমার এমনই ব্যক্তিগত অপমান, ব্যর্থতা ও পরাজয়, সে কথা প্রেমিকাকেও বলা সম্ভব হয় না।
মুনিয়া কী বোঝে, সে-ই জানে। বলেছিলো, তোমার ওপর আমার এইটুকু বিশ্বাস আছে যে, গভীর কোনো কারণ না থাকলে তুমি আমাদের সম্পর্ককে উপেক্ষা করে এরকম সিদ্ধান্ত নিতে পারতে না। আমাকে কিছু ব্যাখ্যা করে বলার দরকার নেই। তোমাকে ভালোবাসি বলে স্বার্থপরের মতো তোমার পথ আগলে ধরবো কেন? বরং ওই ভালোবাসার অধিকারেই আমি তোমাকে একটি প্রশ্নও করবো না।
বিদায়কালে এয়ারপোর্টে আমার হাতে একটি খাম গুঁজে দেয় মুনিয়া। বলে, এখন পড়ার দরকার নেই।
আসলে বিদায় জানাতে আসা সবার চোখের সামনে তা সম্ভবও ছিলো না। বিমান আকাশে উড্ডীন হলে খামটি খুলি। একটি ছোটো চিরকুট। মুনিয়া লিখেছে, কোনোদিন আমাদের দেখা আর হবে কিনা, জানি না। তবু যতোদূরেই যাও, আমি তোমার খুব কাছাকাছি আছি জেনো। বিচ্ছেদেই তুমি আমার চিরদিনের হয়ে গেলে।
বিমান ক্রমশ উঁচুতে ওঠে। মনে হয়, এই উচ্চতা ও ব্যবধান থেকে আমার দেশটিকে কোনোদিন দেখা হয়নি। আমার জন্মভূমির বৃক্ষলতা, মানুষের বসতি, জলাশয় আর ওপরে নীল আকাশ - সব ছেড়ে এখন আমার অনিশ্চিত যাত্রা। যুদ্ধের দিনে কখনো স্বপ্নেও কি ভেবেছি, এই দেশটি ত্যাগ করে আমাকে চলে যেতে হবে?
একসময় চারপাশে শুধু সাদা মেঘের ওড়াউড়ি ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না, মনে হয় মাটির পৃথিবীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগই আর নেই। টের পাই, প্রতি মিনিটে এখন আমার আর মুনিয়ার মধ্যে যোজন যোজন শূন্যতার দূরত্ব রচিত হয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ দূর, আরো দূর। এখনো বিমান আমার দেশের সীমানায়, কিছুক্ষণ পরে চলে যাবো অন্য কোনো সীমানায়। হঠাৎ মনে হয়, আমি হয়তো ভুল করে এই বিমানে উঠে বসেছি। আমার কোথাও যাওয়ার কথা ছিলো না।
এখন ভাবলে আশ্চর্য বোধ হয়, মুনিয়ার সঙ্গে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তটি কী সহজে নিয়েছিলাম। জীবনে প্রথমবারের মতো একটি প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছি, আভাসে-ইঙ্গিতে ভবিষ্যতের কথাও উল্লিখিত হতে শুরু করেছিলো, দু’জনেই হয়তো সম্পূর্ণ নিমজ্জনের জন্যে তৈরিও ছিলাম। সেই ভালোবাসার জনকে ছেড়ে দিতে কষ্ট হওয়ার কথা। হয়নি তা নয়, কিন্তু তা অনেক পরে, যখন আর ফিরে যাওয়া নেই। ততোদিনে মুনিয়াকে আমি সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছি। আবার ভাবি, সেই সময়ে হয়তো আমি স্বাভাবিক মানুষ ছিলাম না। কেউ কি ছিলো সেদিনের বাংলাদেশে? থাকা সম্ভব ছিলো না। কী অসহ্য উদ্ভ্রান্ত ও বিভ্রান্তিময় এক সময় - ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক।
সজ্ঞানে অথবা অজ্ঞাতসারে সেদিন একই সঙ্গে দুটি ভালোবাসা থেকে আমি দূরে চলে গিয়েছি। আমার দেশটির জন্যেও আমার ভালোবাসা কিছু কম নয়। এই আজও, প্রায় তিরিশ বছর পরে, দুটি ভালোবাসাই আমার জীবনে সমান জাগ্রত। এও জানি, দূরবর্তী থেকে ভালোবেসে যাওয়াই আমার নিয়তি।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন