চুপকথা ১২

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি
লিখেছেন মুহম্মদ জুবায়ের (তারিখ: রবি, ১৬/১২/২০০৭ - ১:১৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১২

কতোবড়ো দুর্ভাগ্য আমাদের, তাই ভাবি। কী করে যে কী হয়ে গেলো, এইসব কথা এখন আর প্রকাশ্যে বলা সম্ভব হয় না। দেশে ক্ষমতাবানরা বলতে দেয় না, শুনতেও চায় না। আর এই পরবাসে আমরা একদিন দেশের জন্যে যুদ্ধ করেছি শুনলে মানুষ অবাক হয়ে তাকায়, ভাবে পাগল নাকি? কথায় কথায় তারা আজ বাংলাদেশের নিন্দামন্দ করে। তাদের কথার প্রতিবাদ করলে, একমত হতে না পারলে ঠাট্টা-ব্যঙ্গ শুনি। দেশের জন্যে এই ভালোবাসার কথা আজ বড়ো গোপনীয়। কথা বলতে হবে শুধু নিজের সঙ্গে, আমার লেখার খাতায়।

মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই বলি, তুমি যে একটি কাপুরুষকে দেখছো, তা জানো? অঘটনগুলো যখন ঘটতে শুরু করলো, তুমি তাদের বিরুদ্ধে বলতে পারতে, কিছুই বলোনি। এবং সেই না-বলার কারণে তুমি নিজে সেই একই রকম দুষ্কর্মে দোষী।

অথচ আমি জানি, একেকসময় যখন মুখ ফুটে কিছু বলতে গেছি, দেখি আমি একা। আর কেউ সেসব নিয়ে কিছু বলে না। চারদিকে তাকাই, সম্মতি ও সমর্থনের অপেক্ষা করি। দেখি সব পাথরের মতো ভাবলেশহীন একেকটি মুখ, তাতে কোনো অভিব্যক্তি ফোটে না।

অনেক দেরি হয়ে গেছে। আজ কে আর শুনবে সেসব কথা? আমার সামনে নিরেট দেওয়াল উঁচু হয়ে দাঁড়ানো। আমি কি দেওয়ালকে উদ্দেশে কিছু বলতে পারি? তারা উল্টে চিৎকার করে থামিয়ে দেয় আমাকে। কাউকে কোনো একটি কথাও বলা হয় না, যাকে বলতে যাই সে দেওয়ালের দিকে মুখ করে দেওয়ালের কথা শোনে।

আজও আমার দেশের কতো মানুষ অস্বীকার করে অথবা চোখ বন্ধ রেখে বিশ্বাস করতে চায় যে, একাত্তর বলে কোনো একটি বছর পৃথিবীতে এসেছিলো এবং যুদ্ধ করে বাংলাদেশ নামের একটি রাষ্ট্রের উত্থান ঘটাতে হয়েছিলো, আমাদের স্বাধীনতা আকাশ থেকে অবতীর্ণ হয়নি। অফুরান প্রমাণাদি থাকা সত্ত্বেও তারা বিশ্বাস করে আমাদের যুদ্ধটি আসলে কোনো যুদ্ধ ছিলোনা, সেই সময়ে লক্ষ লক্ষ নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করার ঘটনা আদৌ ঘটেনি, মেয়েদের লাঞ্ছিত করা হয়নি। অথচ লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই যুদ্ধের ক্ষত আজও শরীরে ও হৃদয়ে বহন করে, মানুষ এখনো তাদের হারিয়ে ফেলা স্বজনদের স্মরণে অশ্রুপাত করে।

ওদের মনোভাবটি আমি বুঝি, এইসব স্বীকার করে নেওয়ার অর্থ হলো তাদের এখনকার ক্ষমতা ও সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিটি দুর্বল হয়ে যাওয়া। তা তারা করবে কেন? ফলে, তাদের মতামত বা বিশ্বাস নিয়ে তারা হয়তো আমার মতোই একমুখী ও একরোখা।

তারপরেও আমি বিশ্বাস করি, সত্য একদিন প্রকাশিত হবে, ক্রমশ হচ্ছে। এই সত্য প্রকাশিত হলে তাকে স্বীকার করে নিয়েই বোঝাপড়ার একটা পথ তৈরি হতে পারে। এটি ঠিক যে দীর্ঘদিনের লালিত গভীর এই ক্ষতের নিরাময় সময়সাপেক্ষ। যারা স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা ও শত্রুতা করেছিলো বিশ্বাসঘাতকতাময় কার্যকলাপে, আজও তারা একবারের জন্যেও ভুল স্বীকার করেনি, কৃতকর্মের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করেনি, দুঃখিতও নয়। তাদের কৃত অপরাধের শাস্তি হয়তো কোনোদিনই হবে না, রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের যুদ্ধাপরাধ থেকে অব্যাহতির বিধান দেওয়া হয়েছে। মনে মনে বলি, 'ক্ষমিতে পারিলাম না যে, ক্ষমো হে মম দীনতা...।'

আজকের প্রজন্ম, যারা যুদ্ধ দেখেনি এবং বাঙালির শৌর্য, আত্মত্যাগ ও কীর্তি প্রত্যক্ষ না করে এবং না জেনে বেড়ে উঠেছে, তাদের কাছে এ হয়তো অপ্রয়োজনীয় অতীত খনন। তাদের কাছে বর্তমান সময়টি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, ভবিষ্যতের কথা ভাবতে তারা অধিক ইচ্ছুক। তাতে দোষের কিছু দেখি না। কিন্তু অতীত শুধুই অতীত নয়, তা কখনোই স্বয়ম্ভু হয় না, সেই অতীতেরও একটি অতীত থাকে। সুতরাং, অতীত বর্তমানেরই একটি অংশ। অতীত বাদ দিয়ে বর্তমানে উপস্থিত হবো আমরা কী উপায়ে? বর্তমানটিও আগামীকালের মধ্যে মিশে যাবে নিজেকে অতীত করে।

আমাদের যুদ্ধে নিহত-আহত-লাঞ্ছিতদের আপনজনরা কী উপায়ে, কোন জাদুবলে অতীত ভুলতে সক্ষম হবে কেউ কি জানে? সহযোদ্ধা হারানো মুক্তিযোদ্ধা তার শোকগাথা নিয়ে কোথায় যাবে? তার শৌর্যের কাহিনীতে কেউ অনাসক্ত হলেও হতে পারে, কিছু এসে যায় না এবং সেই অসামান্য গৌরব, যা তার জীবনের সর্বোত্তম সঞ্চয়, তা-ও কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয় না। সেই সময়ের সর্বশেষ প্রত্যক্ষ সাক্ষীটির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে হয়তো সম্পূর্ণ বিস্মৃতি সম্ভব হতে পারে। হয়তো তখনই আমাদের ইতিহাসের এই পর্বটির ইতি ঘটবে।

অতি দ্রুতগামী কোনো যানের যাত্রী বাইরে তাকালে সবুজ শস্যভরা একটি মাঠকে দেখে ভ্রমে আক্রান্ত হয় - বিশাল এক ঝলক সবুজ, উজ্জ্বল একখণ্ড হলুদ মানে শর্ষের ক্ষেত, রুপালির একটি রেখার ঝলক হলো নদী। কোনোকিছু স্পষ্ট ও আলাদা করে দেখা তখন সম্ভব হয় না, কেবল রঙের বিস্তার - কোনোকিছুরই স্পষ্ট কোনো আকার-অবয়ব নেই। সময় এইরকম এক দুর্দান্ত ও আশ্চর্য দ্রুতগামী যান। আমরা, এই সময়ের যাত্রীরা যা-সব অতিক্রম করে যাচ্ছি, তার বেশিরভাগই বড়ো দ্রুত সরে যায় আমাদের দৃষ্টি থেকে, যা দেখা হয় তা মোটা দাগে অনুমান করা একেকটি রঙের বা অবয়বের ধারণামাত্র।

আমি অবশ, অবসন্ন। কবে থেকে শুরু? মনে পড়ে না। এই অবসাদ একসময় চলেও যাবে, জানি। যেতে হবেই। কোথাও কিছু একটা ঘটবে, আমি নিজে ঘটাবো অথবা আর কেউ ঘটিয়ে ফেলবে। আমার স্নায়ু, অনুভব তখন ফিরে আসবে - ওই তো আমি, আমার অস্তিত্ব, আমার পরিচয় - আমি। গ্রীক পুরাণের মহাবিক্রমশালী কুস্তিগীর অ্যান্টেয়াস ততোক্ষণই অপরাজেয় যতোক্ষণ তার পা দুটি মাটি আঁকড়ে থাকবে। কিন্তু হারকিউলিস যখন তাকে মাটি থেকে উপড়ে শূন্যে তুলে ফেলে, সে হয়ে পড়ে নিতান্ত সাধারণ একজন যে-কেউ।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।